পাণিপথের প্রথম যুদ্ধের সালটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ইতিহাস পরীক্ষায় কোশ্চেন পেপারের শুরুতেই কুড়িয়ে পাওয়া এক নম্বরের লোপ্পা অবজেক্টিভ। তখন। এখন আর মনে এল না। পলাশীর যুদ্ধ? সেকি! এটাও মাথায় আসছে না চটজলদি। হাতে কলমের বদলে কি বোর্ড। কিছু কামড়ানোও যাচ্ছে না আপাতত। 

মহাকালের যদি কোনও প্রায়োরিটি লিস্ট থাকে, তা হলে এই সব যুদ্ধের সালতামামির তুলনায় ১৯৯২ সালের ২২শে নভেম্বর আর কিই বা। একেবারে তুচ্ছ, অচ্ছুৎ। কারণটা জানতে পারলে ইতিহাসবিদেরা হাসবেন। শুধু হাসবেন বলি কেন, হেসে গড়াগড়ি যাবেন। পুকুরধার লাগোয়া বিরাটীর ছোট্ট বাড়িটায় সেদিন আমার অফিস ফেরত বাবার হাতে ছিল একটা বড় বাক্স। বাক্সের উপরে বড় বড় করে লেখা, ফিলিপস। আলমারির একটা বইয়ের তাক খালি করে রাখা হয়েছিল সাতসকালেই। মা খালি করছিল যখন, সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া এই আমি ভেবেছিলাম, খেলনা আসছে বুঝি। ব্যাটারিওয়ালা রোবটের চারটের সেট, যেটা বাবা দেব দেব করেও দিচ্ছেনা তিন মাস হল, সেটা? রোবটের বদলে বাক্স থেকে যেটা বেরোল, তা হল কালো রঙের একটা বড় যন্ত্র। বাবা বলল, এটার নাম টু-ইন-ওয়ান। আমি বললাম, এমন নামের তো কেক হয়। অথবা আইসক্রিম। এক দিকে ভ্যানিলা, অন্য দিকে বাটারস্কচ। বাবা বলল, ধুর বোকা। টু-ইন-ওয়ান মানে এর মধ্যে টেপও আছে, রেডিও-ও আছে। আর কয়েকটা মাস যেতে দে। এফ এম বলে একটা জানিস আসছে। খুব পরিষ্কার আওয়াজের রেডিও।

পাশের ঘরে, আমার দাদামণি থাকত যেখানে, চোদ্দ ইঞ্চির সাদাকালো টেলিরামা কোম্পানির টিভিতে তখন সদ্য শুরু হয়েছে দূরদর্শনের খবর। স্বভাববশত, একটা একটা করে হেডলাইন শুনছেন আর দাদামণি ‘আচ্ছা আচ্ছা’ কিংবা ‘বেশ’ বলছেন। যেন টিভির মধ্যে বসে খবর পড়ছে যে, সে দাদামণির কথা শুনতে পাচ্ছে। বাবাকে বললাম, টিভির চেয়েও পরিষ্কার? বলল, একদম। তার পরেই ব্যাগ থেকে বের করল একটা ক্যাসেট। প্যাক করা, নতুন। কালচে নীল রঙের একটা কভার। মাঝবয়সী, গম্ভীর একটা লোক, গিটার হাতে। কভারে লেখা, সুমনের গান। তোমাকে চাই। 

টু-ইন-ওয়ানের ইজেক্ট বোতামটা টেপার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসেট ভরার ট্রে-টা ইতিহাস গিলে খাবার জন্য নেমে এসেছিল, সেই প্রথম বার। 

স্বচ্ছ প্লাস্টিকের রাংতা ছাড়িয়ে নিজের হাতে জীবনে প্রথম ক্যাসেট ‘উদ্বোধন’ ওটাই। টু-ইন-ওয়ানটারও বৌনি হয়েছিল ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই’ বাজাতে বাজাতে। নাগরিক ক্লান্তির মানে তখনও বোঝার বয়স হয়নি, ভাগ্যিস।

ক্যাসেট। ক্যাসেট। ক্যাসেট। ক্রমশ বড় হয়েছি যত, গান ভরা এই ছোট্ট প্লাস্টিকের বাক্সগুলো আমাকে চুম্বকের মতো, আলেয়ার মতো টেনেছে। ওদের গায়ে যত্নে হাত বুলিয়েছি যখন দিনের পর দিন, বুঝিনি বছর পঁচিশ পরেও ওরা থেকে যাবে আমার আলমারির তাকে, মৃত সৈনিকের সারির মতো। যে ভাবে মন প্রাণ ঢেলে ক্যাসেটের পরিচর্যা করতাম, অত দরদ মাখিয়ে জীবনে আর কিছু করিনি। চার্লস কিংবা বয়েলস ল’-র অঙ্কগুলো রিভিশন করার কথা ছিল যখন, কেশবচন্দ্র নাগের সঙ্গে বক্সিং রিং-এ নেমে ডব্লু ডব্লু এফ খেলার ভয়ঙ্কর সুন্দর সুযোগ ছিল যখন, তখন তা না করে ক্যাসেটের পরিচর্যা করেছি। সময় নষ্ট করা যে কেরিয়ারের শত্রু, তখন তা বুঝতাম না। যা বুঝতাম, তা হল, জল, অর্থাৎ ময়েশ্চার, ক্যাসেটের জাতশত্রু। সপ্তাহে দু’দিন করে ক্যাসেটগুলো বাক্স থেকে বের করে রোদে দিতে হত। টু-ইন-ওয়ান বাড়িতে আসার পাঁচ ছ’বছরের মধ্যে ক্যাসেটের সংখ্যা দুশ ছাড়ায়। টিফিনটাইমে ফাঁকি দেওয়া লুচি-আলুর দম বুঝলই না, ওদের বদলে কত সুর কেনা যায় দুনিয়ায়। কোচিংয়ে যাওয়ার বাসভাড়া হে, শুধু একটা ক্যাসেটের জন্য, আরও একটা ক্যাসেটের জন্য আমার মধ্যে কত দিন জোর করে ভর করেছে পি টি ঊষা- কার্ল ল্যুইস। নিখিল স্যার, বাড়ির অসুবিধার কথা বলে দু মাসের মাইনেটা বাকি থেকে গেল আজও। তাই দিয়ে কি এসেছিল জানেন? কিশোরকুমারের লেজেন্ডস। পাঁচটা ক্যাসেটের সেট। নাকি ছটা? রিমাস্টার্ড ভার্সান। শুনলে মনে হত, গানগুলো হয়তো রেকর্ড করা হয়েছে কালকেই। এর সঙ্গে আরও এসেছিল ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের ব্ল্যাক অ্যান্ড ব্লু। 

সাইবার ক্যাফেতে তিরিশ টাকা ঘণ্টা। গুগল সার্চ। হাউ টু টেক কেয়ার অফ ইওর ক্যাসেটস। বিশেষজ্ঞদের টিপস। একজন বলছেন, কালো কাগজ নিয়ে রোদের ওপরে ফেলে রাখ আধ ঘণ্টা। কাগজ গরম হয়ে গেলে প্রতিটা ক্যাসেট খাপ থেকে বের করে শুইয়ে দাওয়া কালো কাগজে। আর এক জন বলছেন, রোদে শোওয়ালেই রেজাল্ট পাওয়া যায় না। প্রতিটা ক্যাসেট বাক্স থেকে বের করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। ষাট ওয়াট বাল্বের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ক্যাসেটের তাকের দিকে তাক করে থাক আধা ঘণ্টা। সব ময়েশ্চার গায়েব হয়ে যাবে। অন্য মত, সিলিকা জেলের ছোট ছোট স্যাশে ভরে দিতে হবে প্রতিটা ক্যাসেটের খাপের মধ্যে। ক্যাসেট বাঁচাতে গেলে প্রতিটা ক্যাসেটের ফিতে এ মাথা ও মাথা করতে হবে মাসে অন্তত এক বার। মানে টেপরেকর্ডারে ক্যাসেটটা ভরে দিয়ে ফাস্ট ফরোয়ার্ড আর রি ওয়াইন্ড। তাতে নাকি ক্যাসেটের ফিতে উৎকৃষ্ট ফ্রায়েড রাইসের মতো ঝরঝরে থাকে। গায়ে গায়ে লেগে যায় না। মনে আছে, বাজারে এসেছিল ক্যাসেট ক্লিনিং কিট। ছোট ক্লিপের দুদিকে দুটো নরম কাপড়। তার মধ্যে কিটে দেওয়া সলিউশান দু-তিন ফোঁটা দিয়ে ক্লিপটা বসিয়ে দিতে হত ক্যাসেটের উপরে, ফিতের গায়ে। খুড়োর কলের মতো একটা যন্ত্র তার পর ঢুকিয়ে দিতে হত ক্যাসেটের পেটে, দাঁতগুলোর মধ্যে। ঘোরাতে হত, আস্তে আস্তে, ম্যানুয়ালি। আমার ক্যাসেট যেন থাকে দুধেভাতে। এই একাগ্রতা খাতায় থাকলে আজ আমি হয়তো নাসায় থাকতাম।

পুত্রের সঙ্গে যত্ন নিতে হত পিতারও। হেড ক্লিনার বলে বস্তুটির কথা পরের প্রজন্ম জানবেই না কোনওদিন। ইয়ারবাড কিংবা সুতির রুমালে চার ফোঁটা ফেলে টেপের প্লে সুইচটা দিয়ে হেডের নিচে কাপড়টা ঘষতে হত, আঙুলে চেপে। কত কোলাহল মধুরধ্বনি হয়ে উঠত এই ভাবে। 

গান শোনা এক পর্ব ছিল বটে। আমি গ্রামোফোন দেখেছি, ছবিতে। বড়দের মুখে শুনেছি, গান শোনার আসল আনন্দ গ্রামোফোনে। ইয়াব্বড় এল পি রেকর্ডটা যন্ত্রে বসানোর পরে যখন ধীরে ধীরে নেমে আসত পিন, এরোপ্লেন মাটিতে নামার মতো, তখন তাঁদের এক দৈব আনন্দ হত। গান শুরু হওয়ার আগে স্পিকার দিয়ে ভেসে আসা ধুলোর মৃদু কিচকিচ শব্দ, তা ছিল সঙ্গীতেরই গায়ে বসানো গয়নার মতো। সুন্দরী গ্রাম্য বধূ আসার আগে নুপূরধ্বনি। বড়রা বলেন, ক্যাসেটে সে আনন্দ কই? আমি মানি না। মানতে কষ্ট হয়। স্বচ্ছ ক্যাসেটগুলোর মধ্যে টেপের চক্র দেখে সব পেয়েছির দেশে উড়ে গিয়েছি কত বার। আকাশবাণীর স্টুডিওতে গিয়ে এক বার দেখেছিলাম, সুদর্শন চক্রের মতো ঘুরে চলেছে দুটো বিশাল বড় বড় টেপের রিল। মাঝখানে রাজার মতো বসে আছে একটা হেড। একটা রিল থেকে ফিতে চলে যাচ্ছে অন্য রিলে, হেড ছুঁয়ে, দীক্ষিত হয়ে। মনে পড়ে স্কুল জীবনে কেনা সোনি আর মেল্টট্র্যাকের ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট, থরে থরে। পাড়ার মোড়ের দোকানে মাস্টার ক্যাসেট থেকে ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে তুলে দেওয়া হত গান। এক একটা গান পাঁচ টাকা। সাড়ে আট টাকায় এগরোল হত তখন। কষ্ট করে কেনা টেপের ফিতে এক ইঞ্চিও ফেলব না ভেবে কত গান আধখাওয়া রেকর্ড হয়ে পড়ে রয়েছে, তার হিসেব আমার সাধের টু-ইন-ওয়ান ছাড়া বুঝি আর কেউ জানলই না। 

জেন এক্স তো আজ বুড়ো। জেন ওয়াই জেন জেড জানবেই না পঁয়ত্রিশ টাকার প্লাস্টিকের বাক্সের মধ্যে কি গুপ্তধনের সন্ধান করে গিয়েছি আমি, আমরা। সিডির ট্রে কালো গহ্বরে ঢুকে যাওয়ার পরে তো শুধু ক্রিস্টাল ক্লিয়ার আওয়াজটুকু থাকে। আওয়াজ কি ভাবে আসছে বোঝা যায় কই? এক দিকের ফিতে অন্য দিকে যায়? যায় না তো। সিডি, এমপিথ্রিও অস্তাচলের পথে। এখন তো সব চিপ। এক ইঞ্চি বাই হাফ ইঞ্চি চিপের মধ্যে কয়েক হাজার গান। আট জিবি আর একশ আটাশ জিবি চিপের মধ্যে আকারে প্রকারে তফাৎ নেই কোনও। এক বার গেলে গেল সর্বস্ব।

গান তো হল, গানের আধারটা কই? 

পুরনো শিশি-বোতল-কাগজ বিক্রির রতনদা মাসে এক বার করে ঢুঁ মারে বাড়িতে। পনেরো টাকার বেশি টু-ইন-ওয়ানে দেবে না বলেছে। এই সব ‘স্ক্যাপ’-এর নাকি আজ কোনও দাম নেই বাজারে। বলে, শুধু হেডটা বেচলে পাঁচ টাকা পাওয়া যাবে। বাকিটা প্লাস্টিক, সেরদরে। এই স্ক্র্যাপের দাম রতনদাকে বোঝাব কী করে? খাটের তলায়, এক কোণায়, ধুলো আর ঝুল গায়ে মেখেই পড়ে থাক তুই। বছরভর। তাও তো আছিস। আমি যদ্দিন আছি, থাকিস।

ক্যাসেটের তাকের সামনে রোজ দাঁডাই এক বার। বসে আঁকো, ইচ্ছে হল, শুনতে কি চাও, এই বেশ ভাল আছি, যাত্রা শুরু, আবার বছর কুড়ি পরে, আর জানি না, অসময়-রা ধ্বস্তাধ্বস্তি করে বেরোতে চায়, তাকের কাচটা ভেঙে। জামা ধরে টেনে বলে বাজাও না একবার, প্লিজ। কভারগুলো জানে না, ওরা কবে হেরে ভূত মাইক্রো এসডি কার্ডের কাছে। ক্যাসেট, ও ক্যাসেটের ফিতে, ফ্রায়েড রাইসটা আর ঝরঝরে নেই। আঠালো হয়ে গিয়েছে বড্ড। 

সবার মতো, সব গান, আমার কাছেও চিপ-এ আছে। হয়তো আর কোনও উপায় নেই বলেই। 

ক্যাসেটের ভিতরে পচা গলা টেপের ফিতে আর দেখতে ইচ্ছে করে না। দেহ আগলে বসে আছি। 

যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক..।

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *