সম্প্রতি যোধপুর পার্কের দ্য ওল্ড মেট’স ক্যাফেতে অনুষ্ঠিত হল কার্টুনদলের একটি কর্মশালা।

কার্টুনদলের জন্ম ২০১৪ সালে। সে বছর পশ্চিমবঙ্গ চারুকলা মেলায় শুরুতেই নজর কেড়ে নিয়েছিল কার্টুনদলের স্বতন্ত্র স্টলটি। আহ্বায়ক শ্রী শুভেন্দু দাশগুপ্ত একাধারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক এবং কার্টুন বিশেষজ্ঞ। তিনি চেয়েছিলেন কলকাতা তথা বাংলার নবীন-প্রবীণ কার্টুনিস্টদের এক ছাতার তলায় আনতে। সে বছরই মেলায় প্রথমবার চারুকলার একটি অংশ হিসেবে স্থান পেল কার্টুন। শুরু হলো কার্টুনদলের পথ চলা।

প্রবাদপ্রতীম বর্ষীয়ান কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী, অমল চক্রবর্তীর সঙ্গে কার্টুনদলে যোগ দিলেন বিশিষ্ট শিল্পী তথা কার্টুনিস্ট অনুপ রায় ও দেবাশিস দেবের মত ব্যাক্তিত্বরা। কার্টুনদল পেল এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কার্টুনিস্ট শ্রী উদয় দেব, ঋতুপর্ণ বসু ও উপল সেনগুপ্তর উপস্থিতি ও ভালোবাসা। এরপর একে একে কার্টুনদলের সদস্য হয়ে এলেন এই সময়ের অনেক তরুণ কার্টুনিস্ট, যাঁদের অনেকেই ভিন্ন পেশায় যুক্ত। কেউ  চিকিৎসক, কেউ বা প্রযুক্তিবিদ। কিন্তু সকলের মূল যোগসূত্র একটাই – তাঁরা প্রত্যেকেই কার্টুন ভালোবাসেন, কার্টুন আঁকেন এবং কার্টুন নিয়ে ভাবেন। ছোটবড় সকলকে নিয়েই কার্টুনদল একসঙ্গে ভাবতে চেয়েছে কার্টুনের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

এর আগেও বহুবার কার্টুন দল একাধিক কর্মশালার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। শুধু কলকাতায় নয়, ঝাড়গ্রাম অথবা শান্তিপুরের মত জেলা শহরের কার্টুনপ্রেমী শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে কার্টুনকে। দিয়েছে কার্টুন নিয়ে নতুন কিছু করার, নতুন ভাবে ভাবার বার্তা। শুভেন্দুবাবু বরাবরই চেয়েছেন কার্টুনকে মুষ্টিমেয় শহরকেন্দ্রিক মানুষজনের বাইরে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে দিতে।

এছাড়াও কার্টুনদলের কর্মকাণ্ড এই কয়েক বছরে ছড়িয়েছে ফ্রেমে বাঁধানো কার্টুন নিয়ে একাধিক যৌথ প্রদশনীতে অথবা সাদা অ্যাম্বাসাডরকে সৌন্দর্য ও সচেতনতার বার্তাবহ কার্টুন এঁকে ভরিয়ে তোলাতে। পাশাপাশি কার্টুনদলের নিজস্ব প্রকাশনাতে প্রকাশিত হয়েছে কার্টুন সংক্রান্ত বই ও পত্রিকা। সদস্যদের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে বাংলা কার্টুনের একটি সুবৃহৎ আর্কাইভ ও লাইব্রেরি।

দক্ষিণ কলকাতায় সম্প্রতি রূপ পেয়েছে কার্টুনদলের একটি নিজস্ব অফিস ও স্টুডিও যেখানে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে কার্টুন কেন্দ্রিক নানান বিপনন সামগ্রী। কাঠের পুতুল থেকে শুরু করে কফিমাগ, ক্যালেন্ডার, পোস্টার ও আরও হরেক জিনিস। এসবের মূল উদ্দেশ্য আসলে একটাই। কার্টুনকে নানা ভাবে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

(বাঁ দিক থেকে) দেবাশিস দেব ও উদয় দেব। ছবি: চিরঞ্জিত সামন্ত।

তবে সাম্প্রতিকতম কর্মশালাটি বেশ অভিনব। ক্যাফেতে বসে কার্টুন আঁকা ও কার্টুন শেখা। ওল্ড মেট’স ক্যাফের কর্ণধার নিজে প্রবল ভাবে কার্টুন ভালোবাসেন। ফলে আড্ডা থেকে উঠে আসা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে সময় লাগেনি বেশি। “ক্যাফেতে কার্টুন” শিরোনামে কর্মশালাতে যোগ দেওয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন অনেকেই। প্রাথমিক ভাবে প্রথম কুড়ি জনকে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল কার্টুনদল। তাঁদের মধ্যে বর্ষীয়ান কার্টুনপ্রেমিক থেকে শুরু করে কলেজ না-পেরনো আগ্রহী তরুণ, ছিলেন সব বয়েসের উৎসাহীরাই। সকলেই সমান উদ্যমে অনেক দূর থেকে ছুটে এসেছিলেন ৯ ফেব্রুয়ারি, রোববারের ঝলমলে সকালে বেশ কিছুটা সময় কার্টুন নিয়ে মেতে উঠতে।

সেখানে অসুস্থতাকে হেলায় পাশে সরিয়ে অনুপ রায় তাঁদের শেখালেন ক্যারিকেচারের সহজপাঠ, দেবাশিস দেব চিনিয়ে দিলেন কার্টুন আঁকার প্রথমিক নিয়মাবলি। উপল সেনগুপ্ত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মজার ছলে দেখালেন একটা মজার কুকুরছানাকে নিয়ে কার্টুনিং করার অনবদ্য প্রেজেন্টেশন। শুভেন্দুবাবুর সূত্র ধরে উদয় দেব সকলকে বুঝিয়ে দিলেন যে, কার্টুনের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। একটা ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকে আরেকটা গভীরতর ছবির ভাবনা। আর একটা অসংবেদনশীল অসহিষ্ণু সময়ে দাঁড়িয়ে একজন কার্টুনিস্ট-এর একটা রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাও থেকে যায়। বেঙ্গালুরু থেকে এসেছিলেন দলের আরও এক সদস্য বিবেক সেনগুপ্ত। তিনি তাঁর কাজ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বললেন। কার্টুনদলের শুরুর ইতিহাস সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ঋতুপর্ণ বসু।

পরবর্তী পর্বে কার্টুনদলের তরুণ সদস্যরা (অভিষেক, উজ্জয়িনী, অরিত্র, সৌতুমি-সহ অন্যান্যরা) অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে শুরু করলেন এক মিনি ওয়ার্কশপ। ওয়র্কশপে কতকগুলো পূর্বনির্ধারিত বিষয় নিয়ে নানা রকম কার্টুন-স্টোরি তৈরি করা হল একে একে। সেই গল্পের ছবিতে কখনও একদল পাখিকে গাছ ছাড়া হওয়ার ফরমান দিলো চশমা-টুপি পরা ময়ালসাপ। কখনও সাদামাটা শান্ত বাড়ির মাথায় বজ্রপাত ঘটাল শাসকরূপী কালো মেঘ। অবশ্য এসবের পরিণতিতে নাস্তানাবুদ হতে হল দুষ্টুদেরই। ঘটে চলা অন্যায়ের প্রতিবাদে সব্বাই দল বেঁধে একজোট হয়ে এগিয়ে এলে শেষমেশ জিতে যাওয়া থাকেই। সে কথাই যেন বার বার মনে করিয়ে দিলো ছবি গুলো।

হই হই করে শেষ হলো “ক্যাফেতে কার্টুন”-এর কর্মশালা আর রইল কার্টুনদলের অসংখ্য বন্ধুদের কাছে আবার কর্মশালার আবদার আর ভালোবাসার দাবি। সে সব নিয়ে কার্টুনদল আবার ফিরে আসছে শিগগিরই। আর পরিশেষে বলে রাখি, ফেসবুকে কার্টুনদলের একটি নিজস্ব পেজ আছে। দিন দিন যেই পেজের বন্ধুসংখ্যা বাড়ছে। সেখানে নিয়মিত দেওয়া হয় কার্টুনদলের নানান কর্মকাণ্ডের খবরাখবর। সকলের ভালোবাসায় একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে কার্টুনদল, অন্ধকার কাটিয়ে মানুষের সুচেতনার মেধার আলোটি মাথায় নিয়ে।

পেশায় চিকিৎসক। স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে কলকাতা মেডিকেল কলেজে কর্মরত। পাশাপাশি আশৈশব ভালবাসার টানে শিল্প ও সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন। বেশ কিছু বছর ধরে যুক্ত রয়েছেন প্রচ্ছদ, গ্রন্থচিত্রণ ও ক্যালিগ্রাফির কাজে। এছাড়া কার্টুন আঁকিয়ে হিসেবে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন কার্টুনদলের সঙ্গে। লেখালিখির শুরু মূলত কবিতার হাত ধরে। প্রকাশিত কবিতার বই 'প্রচ্ছদ শ্রমিকের জার্নাল'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *