আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/ তাহাতে কদলি দলি/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে….
এ হেন মিষ্টি লাইন-লেখা কবি প্রতিদিন খেতেন কিনা নিমপাতার রস! তাও খেতেন এমন করে যেন খাচ্ছেন পেস্তার শরবত! ঠাকুরবাড়ির হেঁসেলে রকমারি রান্নার কথা সবার জানা, সেসব নানান রান্নার পর কবিকে কেউ বলেছিলেন নিমপাতা সেদ্ধর জল বা নিমপাতার রস শরীরের শুদ্ধিকরণের জন্যে বড়ো উপকারী.. ব্যাস ওমনি শুরু! সাধুচরণ রোজ এক গ্লাস করে ধরিয়ে যেত। তারপর তো প্রমথনাথ বিশীর ওই শরবতের জন্যে লোভ আর রবি ঠাকুরের সেইটে দেখে কিঞ্চিৎ মজা করার গল্প সবার জানা…
আসলে আমাদের রসনা পরিতৃপ্তির জন্যে চারদিকে নানা লোভনীয় খাবার… আর তায় বাঙালির খাদ্যপ্রীতি! এই যে সেদিন ষষ্ঠী গেল, পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে কী কী না খাওয়া! নানারকম খাবার খেয়ে আমরা রোজ রোজ জেনেশুনে বিষ করি পান। আজকাল সবজিতে যে হারে রাসায়নিক সার এবং পোকা মারার ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে, তার ওপরে জেনেটিকালি মডিফাইড সবজি ব্যবহার, সব বর্জ্য বের করতে কিডনি লিভারের তো বেহাল অবস্থা হয়, তাই না? তারপর প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রিজারভেটিভ মেশানো সস ডিপ আর রেডি টু ইট খাবার খাওয়া– সব মিলে শরীরে এত এত বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রতিদিন। আর সবসময় ওয়ার্ক আউটও সম্ভব নয় যে ঘাম ঝরিয়ে সেসব বাদ দেওয়া হবে!
তাই শরীরকে বিষমুক্ত করতে বহু বছর ধরে চলে আসছে ডিটক্স পানীয়ের ব্যবহার। রবি ঠাকুরের যুগেরও বহু আগে। এই তো কদিন আগে ভুরিভোজ জামাই ষষ্ঠী গেল। অনেককিছু বর্জ্য জমা হল শরীরে। তাই ভাবলাম লিভার, কিডনির চাপ কমাতে, মেটাবলিজম বাড়াতে আর ত্বক চুলের যত্ন নিতে, কয়েকটা স্বাস্থ্যকর পানীয় নিয়ে আসি, যেটা নিমপাতার রসের মতো তেতোও নয় আবার সুস্বাদু, সুদৃশ্য এবং গ্রীষ্মকালের জন্য আদর্শও…
শসা-পুদিনার ডিটক্স ড্রিংক
একটা বড়ো শসা
৮-১০ টা পুদিনা পাতার ডগা ( কিচেন গার্ডেন থেকে তুলতে পারলে আরো আনন্দ)
দু’ টেবিল চামচ লেবুর রস
এক ছোটচামচ জিরেভাজার গুঁড়ো
স্বাদমতো বিট নুন
শসার উপকারিতা সবার জানা। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হজম করতে, ওজন কমাতেও, এদিকে ফ্যাটও নেই। তার ওপর অনেক খাদ্যগুণে ভরপুর শসা। তার সঙ্গে টাটকা পুদিনা, তারও খাদ্যগুণ কম না! শরীর-মন ঠান্ডাও করে পুদিনা পাতা। সঙ্গে জিরের গুণ মিশে গেলে তো সোনায় সোহাগা! শসা পুদিনা ব্লেন্ড করে ছেঁকে নিতে হবে, তারপর স্বাদমতো বিটনুন, লেবুর রস, জিরেভাজার গুঁড়ো মিশিয়ে সকালে খাওয়া।

গাজর, কমলা আর আদার সরবত
একটা গাজর
দুটো কমলা
আধইঞ্চি আদা টুকরো
অর্ধেক লেবুর রস
গাজর আর কমলা আলাদা রস করে নিয়ে তাতে আদাকুচি আর থেঁতো করা হলুদ মিশিয়ে একবার ব্লেন্ডারে চালিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। তারপর লেবুর রস দিয়ে টাটকা টাটকা খাওয়া। গাজরের গুণ তো সবার জানা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার– হজম করে, পেট পরিষ্কার রাখে। কমলালেবুর ভিটামিন সি আর হলুদ ইনফেকশন থেকে দূরে রাখে। ওয়ার্ক আউটের পরে এটি খুব উপকারী। ব্যথা দূরে রাখে…

হানি জিঞ্জার টি
তিন কাপ জল
প্রতিকাপের জন্যে এক ছোট চামচ চা
একচামচ আদাকুচি
লেবুর রস দু’চামচ
মধু দু’চামচ
গন্ধরাজ লেবুর পাতা দুটো
আর লেমন গ্রাসের পাতা কুচি কয়েক টুকরো (এটিও কিচেন গার্ডেনেই করে ফেলা যায় অনায়াসে)
আদার গুণ তো গুনে শেষ করা যায় না। হজমে সাহায্য করে, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, প্রোবায়োটিক হিসেবে বেশ নাম। তার সঙ্গে নানান রোগ জ্বালা থেকে বাঁচিয়ে রাখে শরীর কে। লেমন গ্রাস কোলেস্টেরল লেভেল কম রাখে, ইমিউনিটি বাড়ায়, ব্যথা দূর করে, ইনফেকশন থেকে বাঁচায়, আরো কত কী!
এটা বানানোর জন্যে, জল ফুটতে দেবার সময় লেবুপাতা আর লেমনগ্রাস দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। প্রায় ফুটবে এরকম সময় চা পাতা দিয়ে বন্ধ করে ঢেকে দিতে হবে। ছেঁকে নিয়ে খাবার সময় লেবুর রস আর মধু মিশিয়ে নিলেই হল। আমি আবার কয়েক টুকরো আমলকী ফেলে দিই। চা শেষ হলে, মুখে থাকে আমলকী!
তরমুজ আদার ড্রিংক
চার কাপ তরমুজের টুকরো
দু’চামচ আদা কুচি
অর্ধেক লেবুর রস
স্বাদমতো নুন
তরমুজের সবচেয়ে বড় গুণ হল, ওজন কমাতে সাহায্য করা! খানিক তরমুজ পেটে পড়লেই, বহুক্ষণ পেট ভর্তি থাকে, খিদেও পায় না। তার সঙ্গে তরমুজে ভিটামিন মিনারেল তো আছেই। তরমুজ বীজ ছাড়িয়ে টুকরো করে নিতে হবে, তারপর আদার সঙ্গে ব্লেন্ড করে ছেঁকে নিয়ে স্বাদমতো নুন আর লেবুর রস মিশিয়ে নিলেই রেডি।

লিচু লেমনেড
১০-১২ টা লিচু
একটা লেবু
এক কাপ জল
অল্প নুন
আদা (না দিলেও হয়, দিলেও চলে)
বরফ কয়েক টুকরো
লিচু তো এমনই দারুণ লাগে। কিন্তু সকালে খালি পেটে একটু ঠান্ডা লিচুর লেমনেড হলে দিনের শুরুটা মন্দ হয় না। লিচু ভরপুর ভিটামিন সি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, পটাসিয়াম, আরো কত খাদ্যগুণে। ওদিকে লেবুর গুণ তো এই করোনার সময় সবার জানা। এই রেসিপিতে চিনি দিইনি, মিষ্টি লিচু ধরে নিয়েই এবং ডিটক্স ড্রিংক হিসেবে। নয়তো চিনি আর সোডা ব্যবহার করলে আরো স্বাদ বাড়বে।
গরমকালের ভোরে এই তরতাজা, সুদৃশ্য পানীয়ে চুমুক দিয়ে দিন শুরু করলে, সারাদিন একটুও এনার্জির অভাব পড়ে না, শরীর মনও থাকে চাঙ্গা। ওয়ার্কআউটের আগে বা পরে, কিম্বা নিছক পাখি ডাকা ভোরে গান শুনতে শুনতে চুমুক দিন কোনও একটিতে। এসব খেয়ে শরীর শুদ্ধ হলে আসছি একদম নতুন ধরনের শরবত নিয়ে…
*সব ছবি ও পানীয় সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।