ফিজির দেনরৌ আইল্যান্ডে একটা কিউরিওর দোকানে অদ্ভুত শেপের একখানা আর্টিফ্যাক্ট দেখে নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করছিলুম যে এই বস্তুটি আসলে কী হতে পারে? দেখে মনে হচ্ছে ছোটোখাট একখানা রাজদণ্ড; চারকোণা মুকুটের মতো অংশ, এবং তার নীচে সূক্ষ্ম এবং জটিল কারুকাজ করা বেশ মজবুত একটা লাঠির মতো। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলুম কয়েকবার। মুকুটের ওপর দিকে চারটে কোণায় চারটে বড় বড় কাঁটা। বেশ কিছুক্ষণ দেখার পরেও বুঝতে না পেরে দোকানি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলুম:
– আচ্ছা এটা কী জিনিস? আই মীন হোয়াট ডু ইউ ডু উইদ্ দিস্?
– ওটা ফর্ক। আরও বিশদে বলতে গেলে ক্যানিবল ফর্ক। মেয়েটি হেসে জানাল। আমার তো আক্কেল গুড়ুম। বড় বড় চোখে তাকালুম।
– হো-হো- হোয়াট! ক্যানিবল ফর্ক!!! মা-মানে মানুষের মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার কাঁটাচামচ!!!
মেয়েটি হাসি হাসি মুখে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভাবখানা এই যে, এ আর এমন কী! এমনটা তো আকছার হচ্ছে। এতে অবাক হওয়ারই বা কী আছে! সাজানো গোছানো কিউরিওর দোকানে এমন এক আধখানা কাঁটাচামচ তো রাখা থাকতেই পারে যার অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য হল মৃত মানবশরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে খাওয়া।
চমৎকৃত হয়ে তাকিয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। কী বলব বুঝতে পারছি না। আমার অমন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা দেখে ফিজিসুন্দরী আবার মিষ্টি হেসে জানালেন:
– ম্যাডাম, শুধু এটাই নয়, আমাদের কাছে আইকুলানিবোকোলা-র মস্ত বড় কালেকশন রয়েছে। আপনি পছন্দ মতো ডিজাইন দেখে নিন।
– কী নাম বললেন?
– আই কুলা নি বোকোলা (I Cula Ni Bocola)।
মেয়েটি যেদিকে ইঙ্গিত করল সেদিকে তাকাতেই দেখি থরে থরে সাজানো ক্যানিবল ফর্ক। বেঁটে, লম্বা, সাদা, কালো, রকমারি আকার এবং আকৃতির।
– নিন না, আপনার যেটা পছন্দ, সেটাই নিয়ে নিন।
কর্তাবাবুটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তার দিকে তাকিয়ে কঁকিয়ে উঠলুম প্রায়:
– ওগো এ কোন দেশে এলুম গো আমরা! রাস্তাঘাটে এমন খতরনাক জিনিসপত্র খোলাখুলি বিক্রি হচ্ছে! ট্র্যাভেল ব্রোশিয়োরে এমন ভয়ানক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে কেউ তো কিচ্ছু বলেনি!

কত্তা অবশ্য ততক্ষণে গুগল্ করে ব্যাপারটা দেখে নিয়েছেন। তিনি আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন:
– আরে না, না। চিন্তা কোরো না। ইটস্ জাস্ট আ পার্ট অফ্ দেয়ার হিস্ট্রি। এখন এরা আর ক্যানিবলিজম প্র্যাকটিস করে না। সেকথা শুনে বললুম:
– হিস্ট্রি মানে? কতদিন আগের ব্যাপার?
কত্তা আবার গুগল্ দেখলেন।
– তা অবশ্য খুব বেশি দিন নয়। এই মনে কর, দেড়শো বছর।
দোকানের মেয়েটি বলল:
– একদম সঠিকভাবে বলতে গেলে ১৫২ বছর। ক্যানিবলিজমের শেষ ঘটনা ঘটেছিল ১৮৬৭ সালে। ক্রিশ্চান মিশনারি রেভারেন্ড থমাস বেকার এবং তার ছ’জন শিষ্য সেবারে তাঁদের অজ্ঞতার কারণে ক্যানিবলিজমের শিকার হয়েছিলেন।
অজ্ঞতা! আমার মুখে কথা সরছিল না।
মেয়েটি এমনভাবে বলল কথাগুলো যেন রেভারেন্ড থমাস বেকার ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা ক্যানিবলদের শিকার হয়ে ছিলেন তাঁদের নিজেদের দোষে। যেন নরমাংস ভক্ষণের ইতিহাসখানা বড় গর্বের ব্যাপার। আমার নির্বিবাদী বাঙালি হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার যোগাড় হল প্রায়। ভাগ্য ভাল যে তক্ষুনি তার মা এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেন।
***
এখানে জানিয়ে রাখা ভাল যে ক্যানিবলিজম বা স্বজাতিভক্ষণ মূলত দুই ধরনের: ১) এন্ডোক্যানিবালিজম এবং ২) এক্সোক্যানিবালিজম। প্রথমটির ক্ষেত্রে মানুষ নিজের পরিবারের বা গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদেরা মারা গেলে তাদের মাংস খায়। এ ব্যাপারটা আমাদের কাছে বীভৎস শোনালেও যে সমস্ত গোষ্ঠী এ নিয়ম মেনে চলে তারা কিন্তু এমনটা ভালবেসেই করে। তাদের মতে, এর উদ্দেশ্য হল আত্মজনের আত্তীকরণ। অর্থাৎ প্রিয়জনের স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে সম্মান জানাতে তাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করা। পাপুয়া-নিউগিনির ফোরে (Fore) সম্প্রদায় এবং ব্রাজিলের ইয়ানোমামি (Yanomami) গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে এমন নিয়ম প্রচলিত ছিল।
তবে দ্বিতীয় অর্থাৎ এক্সোক্যানিবলিজমের উদ্দেশ্য হল নিজের শত্রু দমন করা এবং তাদের মাংস দিয়ে নিজেদের খাদ্যের অভাব পূরণ করা। এখানে ভালবাসা নয়, বরং নিজের এবং নিজের গোষ্ঠীর শক্তি প্রদর্শনই হল মূল উদ্দেশ্য। ফিজিয়ানরা এই নিয়ম মেনে চলতেন।

তবে ফিজির ইতিহাস যেমনই হোক না কেন, আধুনিক ফিজিয়ানদের মতো দিলখোলা, হাসিখুশি জাতি আমি খুব কমই দেখেছি। অচেনা মানুষকে ভালবেসে আপন করে নিতে তাদের জুড়ি নেই। তার ওপর তাদের নিখুঁত পলিনেশিয়ান স্বাস্থ্য দেখলে রীতিমতো হিংসে হয়। বড় বড় বাদামি চোখ, কোঁকড়া চুল, রক্ত চন্দনের মতো গায়ের রং আর ঝকঝকে হাসি দেখলে এমনিতেই মন ভাল হয়ে যায়। ফিজিয়ানরা এমনিতেই সুন্দর, কিন্তু দোকানি মেয়েটির মায়ের যেন রূপের তুলনা নেই। জানালেন, তার নাম মিসেস মীরেবেই তুকানা। দুই কন্যা, আলিতি এবং আকিরার সাহায্যে দোকান চালাচ্ছেন।
সেদিন বিকেলবেলা ওঁর বাড়িতে কাভা পানের নেমন্তন্ন পেলাম আমরা দু’জন। তার সঙ্গে মিসেস তুকানা প্রতিশ্রুতি দিলেন যে ক্যানিবলিজমের ব্যাপারটা আরও ভাল করে গুছিয়ে বলবেন আমাদের। বিকেলবেলা সাজগোজ করে দোকানে যেতেই উনি দুই মেয়ের হাতে দোকানের দায়িত্ব সঁপে আমাদের নিয়ে গেলেন ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে। দোকানের ওপরেই তিন কামরার মাঝারি মাপের ফ্ল্যাট। ছোট ছোট ঘর, কিন্তু খুব যত্নে সাজানো গোছানো সবকিছু।
আমাদের বসিয়ে তিনি রান্নাঘর থেকে নিয়ে এলেন কাভা তৈরির সরঞ্জাম এবং একটা বড় প্লেটে সাজানো মস্ত বড় একখানা কাসাবা কেক। কাভাকে এদেশের জাতীয় পানীয় বলা যেতে পারে। ভারতীয়দের বাড়িতে যেমন চা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়, এদেশে তেমনি অতিথিসেবার প্রধান উপকরণ হল কাভা। কাঠের পাত্রে, কাভা গুল্মের শিকড়ের গুঁড়ো ঠান্ডা জলে মিশিয়ে তৈরি হয় কাভা। পরিবেশন করা হয় নারকেলের মালার কাপে। প্রথম দর্শনে দেখলে মনে হবে কাদা গোলা বৃষ্টির জল। খেতেও তেমন আহামরি কিছু নয়। স্বাদহীন, গন্ধহীন পানীয়। তবে বেশ কয়েক চুমুক খাওয়ার পর অদ্ভুত একটা ঝিম ধরানো অনুভূতি হয়।

কাসাবা কেকটি অবশ্য স্বাদে অতুলনীয়। এর স্বাদ অনেকটা গোয়ান বেবিংকার মতো। নরম সরভাজার মতো টেক্সচার। মিষ্টি আলুর মতো দেখতে কাসাবা রুটের গুঁড়ো দিয়ে এদেশে বহু রকমের খাদ্যবস্তু তৈরি করা হয়। কাসাবা কেক তারই মধ্যে অন্যতম। কাভা পানের পর্ব চলাকালীন আমি বললুম:
– আপনাদের দেখে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে ক্যানিবলিজমের মতো নৃশংস ঘটনা এদেশের এত সাম্প্রতিক ইতিহাসে সম্ভব! উনি বললেন:
– এ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা যেমন গর্ববোধ করি না, তেমনি আমরা লজ্জিতও নই। ফিজিয়ানরা সাহসি যুদ্ধবাজ জাতি। তারা প্রাণ দিতে বা নিতে ভয় পায় না।
– কিন্তু এখানে তো প্রাণ দেওয়া বা নেওয়ার কথা হচ্ছে না! যুদ্ধ করা এক জিনিস আর শত্রুপক্ষের শরীর কেটে ছিঁড়ে তাদের মাংস খাওয়া অন্য জিনিস। সবচাইতে বড় ব্যাপার হল, যে এই নরমাংস ভক্ষণের প্রথা শুরু হল কীভাবে এবং এর পেছনে দর্শনটাই বা কী? জানতে চাইলুম। উনি বললেন:
– দেখ, এমন অদ্ভুত প্রথা শুরুর কারণ কী কেউ জানে না। আড়াই হাজার বছর ধরে ফিজিতে নরমাংস ভক্ষণের এই প্রথা প্রচলিত ছিল। ফিজিয়ান যোদ্ধারা তাঁদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন নতুন দ্বীপের খোঁজে, সমুদ্র যাত্রায়; এবং নাবিকদের জন্য মৃতদেহ ভক্ষণ ছিল বেঁচে থাকার একটি আবশ্যিক শর্ত। প্রাণরক্ষার তাগিদে তাঁরাই এ প্রথা শুরু করেছিলেন। তাছাড়া দ্বীপে বসবাসের ফলে খাদ্য ও বাসযোগ্য স্থানের যোগান ছিল অতি সীমিত। সেই কারণেও নরমাংস ভোজনে কারও আপত্তি হয়নি।

একটু থেমে উনি আবার বললেন:
– ওঁদের কাছে নরমাংস ভক্ষণের ব্যাপারটা ছিল রীতিমতো উৎসবের মতো। সাধারণত যুদ্ধজয়ের পরে জয়ীপক্ষ বিজিতদের বন্দি করে নিয়ে আসত। তারপর রীতিমতো নিয়মনীতি মেনে, মন্ত্র পড়ে, পুজোআচ্চা করে তবে শত্রুদের হাত-পা কেটে তাদের পোড়ানো হত। এছাড়াও কেউ কাউকে প্রকাশ্যে অপমান করলে, সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার চূড়ান্ত উপায় হিসেবেও ক্যানিবলিজম্ প্র্যাকটিস করা হত।
– কী ভয়ঙ্কর! মা গো!
– ডোন্ট জাজ্ দেম। আমাদের পূর্বপুরুষদের চোখে সবাই ছিল প্রকৃতির সন্তান। তাই গরু বা শূকরের মাংস খাওয়ার মতো নরমাংস খাওয়াও ওঁদের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। এমনকী মানুষের মাংসকে ওঁরা বলতেন “লং পিগ স্টেক” (Long pig steak)। সেকালে ফিজিয়ানরা বিশ্বাস করতেন যে যুদ্ধজয়ের পর বিজিতপক্ষের ধনসম্পদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চারিত্রিক সম্পদ অর্থাৎ জ্ঞান, বুদ্ধি, সাহস ও শৌর্যের ওপরেও বিজেতার অধিকার বর্তায়; এবং এই চারিত্রিক সম্পদ দখল করার সবচাইতে সহজ উপায় হল তাদের মাংস খেয়ে ফেলা।
– তাহলে ১৮৬৭ সালে যে মিশনারি থমাস বেকার এবং তাঁর শিষ্যদের মৃত্যু হয়েছিল, তার পেছনে কারণ কী ছিল? মিশনারিদের সঙ্গে তো যুদ্ধ হওয়ার কথা নয়। তাঁরা তো নিরস্ত্র! আমি জিজ্ঞাসা করলুম। মিরেবাই বললেন:
– মিশনারীরা নিরস্ত্র ছিলেন, একথা বলা ঠিক নয়। বন্দুক, লাঠি, তরবারি ছাড়া অস্ত্র হয় না বুঝি! সবচাইতে বড় অস্ত্রের নাম কী জানেন?
– কী?
– লোভ! লোভ হল সবচাইতে বড় অস্ত্র। বন্দুকের গুলিতে যারা মরতে ভয় পায় না, সেই বীরপুরুষরাও লোভের সামনে দু’মিনিট টিকে থাকতে পারে না।
– কিন্তু ইংরেজ মিশনারিদের হাত ধরেই তো এদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু এসেছিল। তাই তাঁরা যে অকারণ লোভ দেখিয়েছিলেন সেকথা নিশ্চয় বলা উচিত নয়!
আরও পড়ুন: কৌশিক মজুমদারের কলমে: ড্রাকুলার সন্ধানে
– শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসেছিল সেকথা সত্যি। কিন্তু তার অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছিল স্থানীয় অধিবাসীদের খুন এবং লুটপাট। মিশনারিদের সঙ্গে যা হয়েছিল তা দুঃখজনক হলেও অন্যায় বলতে পারি না। প্রত্যক্ষ কারণটা ছিল তুচ্ছ। ঘটনাটা ঘটেছিল ভিটি লেভু দ্বীপের একটি গ্রামে। মিশনারি থমাস বেকার, গ্রামের মোড়ল অর্থাৎ রাতুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে উপহারস্বরূপ একখানা চিরুনি দিয়েছিলেন এবং তারপর তিনি রাতুকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। রাতু সে অনুরোধ অস্বীকার করেন এবং বেকারকে বলেন তাঁদের গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে। অপমানিত বেকার যাওয়ার আগে রাতুর চুল থেকে উপহারের চিরুনিটা খুলে নেন। এবং এইখানেই শুরু হয় সমস্যা। ফিজিয়ান সংস্কৃতিতে সমাজের শীর্ষস্থানীয় কারও মাথা ছোঁয়ার অর্থ হল তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা। তার ওপর অপমানকারী বিধর্মী হলে তো কথাই নেই।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম। শুধুমাত্র মাথা ছোঁয়ার “অপরাধে” এতবড় শাস্তি! মিরাবেই বললেন:
– ওটা শুধু মাথা ছোঁয়ার শাস্তিই ছিল না, ওটা আসলে ছিল শত্রুপক্ষের জন্য পাঠানো একটি বার্তা। ফিজি দ্বীপের সংস্কৃতি, তাদের ধর্মবিশ্বাস ধ্বংস করতে এলে তার পরিণাম কী হবে তা জানানো হয়েছিল সেদিন।
***
আমি চুপ করে বসে রইলুম। ট্রাভেল ব্রোশিয়োরে লেখা ছিল যে ফিজি ইংরেজদের অধীনস্থ হয় ১৮৭৪ সালে এবং ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা পায়। অর্থাৎ ছিয়ানব্বই বছর ধরে দেশটা পরাধীন ছিল। মিরেবাই একটাও কথা মিথ্যে বলেননি। মিশনারিদের অস্ত্র ছিল লোভ। ধর্মপ্রচারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একথা হয়তো সত্য নয়। কেননা কয়েক বছর পরেই ইংরেজ মিশনারিদের ধর্মের ধ্বজার পেছনে লুকিয়ে ফিজিতে প্রবেশ করেছিল ব্রিটিশ সৈনিকেরা। ভারতীয় হিসেবে তারপরের কাহিনিটা আমার বেশ জানা। দুশো বছর ধরে শেকল পরার যন্ত্রণা তো আমরাও ভোগ করেছি।
তাই সেদিক থেকে ভেবে দেখলে থমাস বেকারের হত্যাকারী রাতু শুধু একজন দূরদ্রষ্টা দলীয় প্রধানই নন, তিনি দেশপ্রেমিকও বটে। ধর্মপ্রচারের আড়ালে স্বাধীনতা হরণের ষড়যন্ত্রটুকু তিনি হয়তো তখনই বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেইজন্যই প্রথম থেকেই শক্ত হাতে সমস্যাটির মোকাবেলা করেছিলেন। মানছি নরমাংস খাওয়ার ব্যাপারটা আমাদের চোখে বর্বরতা, কিন্তু এটাও তো ভেবে দেখা উচিত যে তৎকালীন ফিজিয়ানদের প্রথা অনুসারে নরমাংস নিষিদ্ধ ছিল না। নাম না জানা সেই রাতু নিজেদের নিয়ম অনুযায়ী একজন সম্ভাব্য শত্রুকে শাস্তি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আধুনিক শহুরে মাপকাঠির নিরিখে হিসেবে বর্বর হলেও সেই রাতু যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং দেশপ্রেমিক ছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আমার মনের দোলাচল বুঝতে পেরেই বোধহয় মিরেবাই আবার বললেন:
– তবে এমন ভেবে বসবেন না যে সব রাতুরা একইরকম ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিকারের নরখাদক, রাক্ষসও ছিল। যেমন রাতু উদ্রে উদ্রে। ভিটি লেভু দ্বীপের রাতু উদ্রে উদ্রের নাম “গিনেস বুক ওফ ওয়ার্ল্ড”-এ বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে; পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি সংখ্যক (৮৭২) মানুষ খেয়ে নরভক্ষণের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর বংশধরদের মতে আসল সংখ্যাটি ছিল ৯৯৯। উদ্রে উদ্রে প্রতিবার নরহত্যার পর নিজের বাড়ির কাছে একটি করে পাথর জমা করতেন। ১৮৪০ সালে ইংরেজদের বন্দুকের গুলিতে উদ্রে উদ্রের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের লোকজন সেই পাথরগুলি তার সমাধির চারপাশে সাজিয়ে রাখেন।
আমার গলা প্রায় শুকিয়ে এসেছিল। নিজের নারকেল মালার কাপে আরেকটু কাভা ঢেলে বললাম,
– নশো নিরানব্বই!!! লোকটার এতগুলো শত্রু ছিল? মিরেবাই নিজের কাপে চুমুক দিলেন।
– ওই যে বললাম, উদ্রে উদ্রে প্রকৃত অর্থেই নরখাদক রাক্ষস ছিলেন। মানুষের মাংস খাওয়াটা ওঁর কাছে ছিল নেশার মতো। শিকারকে মারার পর রান্নাও তিনি নিজের হাতেই করতেন। মৃত শরীরের সবটুকু যেহেতু তাঁর পক্ষে খাওয়া সম্ভব হত না, সেজন্য উদ্বৃত্ত অংশ তেলে ডুবিয়ে তার আচার বানাতেন।
– অন্যান্য উপজাতির নেতারাও কী এমন…
– না। এ ব্যাপারে উদ্রে উদ্রে ব্যতিক্রমী এবং মানসিক রোগী ছিলেন বলতে পারেন। ফিজিয়ানদের বিশ্বাস অনুযায়ী পশুর মাংস শুদ্ধ কিন্তু নরমাংস অশুদ্ধ।
আমি অবাক হয়ে বললুম:
– অশুদ্ধ কেন?
– এর কারণ হল, মানুষের মস্তিষ্ক পশুদের থেকে পৃথক। পশুরা বাঁচে শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদার কারণে। তাই তারা ঠিকভুলের তফাত জানে না। কিন্তু মানুষ সবকিছু জেনেও মিথ্যে কথা বলে, অন্যায় করে, তাই তাদের শরীরও অশুদ্ধ। ফিজিয়ানরা নরমাংস খেলেও সেখানে তাদের মূল উদ্দেশ্য শত্রুকে শাস্তি দেওয়া। এজন্য অনেক নিয়মনীতিও মানতে হত। যেমন অশুদ্ধ মাংস রাতু কখনও নিজের হাতে স্পর্শ করবেন না। সেইজন্যই ক্যানিবাল ফর্ক বা আই কুলা নি বোকোলা ব্যবহার করা হত। গ্রামের পুরোহিত অথবা অন্যান্য কর্তাব্যক্তিরা সেই কাঁটার সাহায্যে নরমাংস ছিঁড়ে রাতুকে খাইয়ে দিতেন। অথচ দেখ, উদ্রে উদ্রে এসব নিয়মের কোনওটাই মানতেন না। তাঁর পরিবারের উত্তরসূরিদের থেকে জানা গেছে যে তিনি নরমাংস ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না এবং সেই মাংস ছোঁয়ার ব্যাপারেও কোনও নিয়মনীতি গ্রাহ্য করতেন না। কাজেই এ ব্যাপারে উদ্রে শত্রুতা বা বন্ধুত্বের পরোয়া করতেন বলে মনে হয় না।

কথায় কথায় সন্ধ্যে নেমে এল। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। কত্তামশাই এতক্ষণ দিব্যি চুপচাপ ছিলেন। মিরেবাই এবং তার দুই কন্যেকে “গুড বাই” বলে রাস্তায় বেরোতেই তিনি ফুট কাটলেন:
– ওগো শুনছ, ফিজিতে নাকি ছোট বড় মিলিয়ে তিনশো তিরিশখানা দ্বীপ আছে।
– তো?
– এর মধ্যে মাত্র একশোটাতে সভ্য মানুষজন থাকে।
আড়চোখে তাকিয়ে বললুম: তো?
– না, মানে বলছিলাম যে ছুটির তো আরও পাঁচদিন বাকি আছে। যাবে নাকি অন্য দ্বীপগুলোর মধ্যে কোনও একটায়? বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস ব্যাপার হবে। তুমি না হয় দেশে ফিরে বই লিখ, ‘নরখাদকের দেশে।’ আমিও বেশ বন্ধুদের গিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারব…
বলাই বাহুল্য, এমন অসাধারণ প্রস্তাবের উত্তরে কোনও কিছুই বলা উচিত নয়। আমি বলিওনি। শুধু তাঁর দিকে একটিবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলুম। সেই কটাক্ষের দাপটেই কত্তা নিমেষে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। দু’ মিনিট পর শুনলুম তিনি নিজেই বিড়বিড়িয়ে বলছেন:
– বাঙালির ছেলে, নিজের বৌয়ের ভয়ে নিত্যদিন অক্কা পাই, আমি নাকি লড়ব নরখাদকদের সঙ্গে! তাহলেই হয়েছে!
পরিশিষ্ট: ফিজির দেনেরৌ দ্বীপে ঘুরতে গিয়েছিলুম প্রায় চার বছর আগে। তখন লেখক হব এমন কোনও উচ্চাশা বা অভিসন্ধি কোনওটাই ছিল না। মিসেস মিরেবাই তুকানার সঙ্গে গল্প করেছিলাম শুধুমাত্র ইতিহাস জানার তাগিদেই। কাজেই সেই কথোপকথনের প্রমাণস্বরূপ কোনও ফোটো তুলে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি তখন। সেজন্য অবশ্য এখন আফসোসে হাত কামড়াচ্ছি। ঝুলিতে যে কয়েকখানা ফোটোগ্রাফ আছে তার মধ্যে কয়েকটা এখানে দিলাম।

আরও একটা ব্যাপার জানিয়ে রাখি, আধুনিক মোরাল কম্প্যাসের নির্দেশ অনুযায়ী ফিজিয়ান ক্যানিবলরা অতি নৃশংস ছিলেন। উৎসাহীরা Alfred St Johnston-এর লেখা “Camping Among Cannibals” এবং Dr. Felix Maynard ও Alexandre Dumas সাহেবের লেখা “The Whalers” বই দু’খানি পড়ে দেখতে পারেন। অতি বড় সাহসিরও বুক কেঁপে উঠবে সেই বর্ণনা পড়লে। তবে ফিজিয়ানদের তরফ থেকে দেখলে ব্যাপারটা আবার অন্যরকম। প্রথমত: দ্বীপে বসবাস করার কারণে ওঁদের জন্য জীবনধারণের সব উপাদানই ছিল অতি সীমিত। তাই বাঁচার তাগিদেই ওঁরা ক্যানিবলিজম বেছে নিয়েছিলেন, একথা বললে অত্যুক্তি হয় না।
তাছাড়া ওঁরা মানুষকে প্রকৃতির প্রভু হিসেবে নয়, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে দেখতেন। বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতিই ওঁদের মা, এবং মায়ের চোখে গরু, শূকর, মাছ, মানুষ সবাই এক। ওঁদের যুক্তি অনুযায়ী গরুর সামনে বাছুর হত্যা যতখানি নৃশংস, ততখানিই অন্যায় মানুষ মায়ের সামনে তাঁর শিশু সন্তানকে মেরে ফেলা। ওঁদের জীবন দর্শন অনুযায়ী দুটোই সমান। তাই আমি-আপনি যেমন মাছের ঝোল, পাঁঠার মাংসের ঝোল খাই, ওঁরাও তেমন নিছক খাদ্য ভেবেই মানুষের মাংস খেতেন। ওঁরা নৃশংস হলে ওঁদের যুক্তি অনুযায়ী আমি এবং আপনিও সমান হিংস্র!
*চিত্রঋণ: লেখকের তোলা ছবি ও wikimedia commons
*তথ্যঋণ:
https://www.irishtimes.com/n ews/missionary-s-grisly-death-leaves-bad-taste-for-fijians-1.383731
https://www.theguardian.com/world/2003/nov/14/1
https://jonahvatunigere.wordpress.com/2011/04/18/the-history-of-cannibalism-in-the-fiji-islands-4152011/
Book: The Whalers, by Dr. Felix Maynard & Alexandre Dumas
Book: Camping Among Cannibals, by Alfred St Johnston
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।
ফিজিয়ান পড়তে গিয়ে বারকয়েক ফিজিশিয়ান পড়ে ফেলছিলাম। উফ্ কী সাংঘাতিক 🤥
হা হা হা! মহা মুশকিল!