অরণ্যে বৃষ্টির কথা বলতে গেলে শুরুই করতে হয় কালিদাসের সেই “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং…” রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন না
“কখন বাদল ছোঁয়া লেগে,
মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেঘে মেঘে…
ওরা যে এই প্রাণের রণে মরুজয়ের সেনা
ওদের সাথে আমার প্রাণের প্রথম যুগের চেনা–
তাই এমন গভীর স্বরে
আমার আঁখি নিল ডাকি ওদের খেলাঘরে —
ওদের দোল দেখে আজ প্রাণে আমার দোলা ওঠে জেগে।।”

লেখক একদিন ম্যাকলাস্কিগঞ্জে
শ্রাবণধোওয়া ম্যাকলুস্কিগঞ্জের মেঠো লাল পথে চলেছেন লেখক।

আমাকেও বলতে হলে এমন ভাবেই বলতে হয়। অরণ্যে, পাহাড়ে যে মেঘ, যে বাদল আমাকে ছুঁয়েছে, বা আমি তাদের ছুঁয়েছি সেই সব মেঘ বৃষ্টি সত্যিই আমার খুব চেনা। শ্রাবণ বোধহয় চৈত্রের চেয়েও যৌনগন্ধী মাস। আমি তো কবিতা লিখতে পারি না। তবু একবার ছেলেবেলায় একটি কবিতা লিখেছিলাম
“তোমার কানে ঝুমকো ফুল,
কটক শাড়ি কেমন ভুল
পিঠের পরে ভরা শ্রাবণ খোলা”
যখনই জর্জদার গলায় “এই সকাল বেলার বাদল আঁধারে” বা ঋতুর গলায় “আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে” শুনি, মন আমার শ্রাবণাহত হয়। কত কথা মনে পড়ে।

এমনই এক শ্রাবণে গোপালপুর অন সি সৈকতে আমি আর ঋতু হনিমুনে গিয়েছি। সমুদ্রগন্ধী বালুতটে ও আমায় একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখায় “আকাশে আজ কোন চরণের যাওয়া আসা।” বর্ষা তো ভিজে যাওয়ারই ঋতু, তাই তো রবীন্দ্রনাথ বর্ষা নিয়েই রচনা করেছেন সবচেয়ে বেশি গান!

কখনও কি ভুলতে পারব সেই দিনটার কথা… তুরা পাহাড় থেকে নামছি। যাব গুয়াহাটি। সারা রাস্তা জুড়ে অবিরাম বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি! তিন ঘণ্টা ধরে সমানে বিদ্যুৎ, বিরামহীন। সেদিন বর্ষা বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা ওড়না পরে আমার সামনে এসেছিল। মনে পড়ে ঝাড়খন্ডের বৃষ্টি। সেখানে ফিসফিস করে বৃষ্টি পড়ে। ইউক্যালিপটাস গাছেরা গন্ধ ছাড়ে। কত জায়গার শ্রাবণ স্মৃতি যে বহু যুগের ওপার হতে ভেসে আসে!

কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা
বর্ষায় ভেসে যাচ্ছে ধানখেত।

সেই সময়ে কলকাতার শ্রাবণও ছিল অন্যরকম। রেইনি ডে-তে হাফপ্যান্ট পরে কলকাতার পথে পথে বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াতাম। দুপুরে ইলিশ মাছের মাথা আর ছোলা নারকেল দিয়ে রাঁধা কচুর শাক আর সরষে ইলিশ দিয়ে ভাত, রাতে মুগের ডালের খিচুড়ি, ডিমভাজা আর শুকনোলঙ্কা। শ্রাবণ মেঘের স্মৃতি ধেয়ে আসে। মনে পড়ে রংপুর শহরে আমাদের টিনের চালের বাড়িতে সারারাত বৃষ্টি পড়ার ঝমঝম শব্দ। ঠাকুমার পাশে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। পিছনের মাঠে সোনাব্যাঙ ডাকত। আর বড় গাছের অন্ধকার কোটর থেকে ডাকত কুটুরে ব্যাঙ। কানে আসত সাপের ব্যাঙ গেলার শব্দও! সন্ধে নামলেই শোনা যেত শেয়ালের ডাক, রাজবংশি ছেলেরা দুধ বিক্রি করে মাটির হাঁড়ি বাজাতে বাজাতে চলে যেত শংকামারি শ্মশানের দিকে যে পাটকিলে রঙের পথ চলে গেছে সেটা ধরে। সেই শ্রাবণগন্ধী পথ আমাকে ভাবাত, ভাবায় আজও, পথ কোথায় যায়? কী আছে পথের শেষে।

কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাই। আসলে বয়স হয়েছে তো… স্মৃতির বাতাসে সব এলোমেলো হয়ে যায়।

ভরা বর্ষায় নর্মদা নামছে
ভরা বর্ষায় নর্মদা নামছে প্রবল গতিতে, কূল ভাসিয়ে।

শুধু এদেশের বর্ষা নয়, আমি বহু দেশের বর্ষা দেখেছি। একবার স্যেশ্যেলস গিয়েছি। সেখানে প্লেনে করে বিভিন্ন দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হত। আমি গেছি প্রালে। কী অসাধারন সে দ্বীপ! সমুদ্রের দিকে মুখ করা এক হোটেলে সারা দুপুর বসে কাটিয়ে দিলাম। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সন্ধ্যায় ফিরে এসেছিলাম। শিলংয়ের বৃষ্টি বললে তো অবধারিত ভাবে মনে আসে শেষের কবিতা। আমি বোধ হয় বার তিরিশেক গেছি শিলং। মেঘালয় তো বৃষ্টিরই আবাসস্থল। তখনও চেরাপুঞ্জিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হত। ঝরনারা যৌবন ফিরে পেত।

mandu
বৃষ্টিস্নাত মান্ডুতে রূপমতীর মহল। এখান থেকেই সোজা তাকালে দেখা যায় ভিজে মাঠ পেরিয়ে বাজ বাহাদুরের প্রাসাদ।

ভারতবর্ষের বর্ষা অপরুপ। তার স্বাদ পেতে একবার যাওয়া উচিত মান্ডু। মান্ডু মানে বাজবাহাদুর আর রূপমতীর প্রেম আখ্যান। রূপমতীর জন্য বাজ বাহাদুর নির্মাণ করেছিলেন এক সরোবর। রূপমতী ভোরবেলায নর্মদাকে প্রণাম করে জল খেতেন। বর্ষায় মান্ডু সবুজে সবুজ হয়ে যায়। বর্ষা মানেই আসলে রোম্যান্স। বর্ষা বন্যপশুদের প্রজননকাল। এইজন্যই বর্ষায় জঙ্গল বন্ধ থাকে।

অসমের বর্ষাও নয়নাভিরাম। বরবাধা বনবাংলোর সামনে ছিল কেয়াবন। শ্রাবণের সন্ধেতে সেই বন থেকে কী যে গন্ধ উঠত, তা কী বলব। বরবাধা বন বাংলোর চারধারে ছিল কনকচাঁপা গাছ। সাপেরাও সেই মিশ্র গন্ধ অস্বীকার করতে পারত না। সেই সব সন্ধে… তামাহাটের মনা মিত্রের কিশোরী মেয়ে শেলির কোমর ছাপানো চুলের গন্ধের মতো রহস্যে ভরা। শেলি জানতেও চাইল না আমার মনের কথা। আজ আমার বেলা পড়ে এসেছে।  তবু শ্রাবণ আমাদের এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রেখেছে।

mandu
বর্ষায় পাহাড়-জঙ্গলে মিলে একাকার মান্ডুর প্রকৃতি।

মনে আছে একবার ঘোর বর্ষায় বেতলা ট্যুরিস্ট লজ থেকে বিকেলে চা খেয়ে আমরা জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কলকাতার এক দম্পতি। হঠাৎই নামল অঝোর বৃষ্টি। আমরা মাথা বাঁচাতে একটা পইসাঁর গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়েই দিচ্ছিল। তাই আমরা ঠিক করলাম পুরোপুরি ভেজার মজা নেব। যেমন কথা তেমন কাজ। ভিজতে ভিজতে ট্যুরিস্ট লজের দিকে চললাম। ঠিক তখনই একদল চিতল হরিণ কোথা থেকে দৌড়ে এসে উন্মুক্ত ঘাসবনে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। নীরেনদা অবাক হয়ে দেখছিলেন! আমার কাছে যদিও এই রকম ঘটনা নতুন ছিল না। এমনও হতে পারে ওদের বুনো কুকুর তাড়া করেছিল। বৃষ্টি থামতে গায়ে হলুদ মেখে ওরা যেন সবাই বের হল আর বনান্তরে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই ঘটনা আমি বর্ষার রাতে ওডিশা, আসাম, বিহার, মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলেও দেখেছি।

Tea Garden
সরস্বতী চা বাগানের বাংলোয় বৃষ্টি আজও মনে পড়ে। 

আমি দেখেছি বরিশাল শহরে গৌরনদীর উপর বর্ষা। নদীর চারপাশে ভেসে যেত ইলিশ ভরা নৌকা। আমি কত বর্ষায় জিঞ্জিরাম নদীর উপরে কুমির শিকারে গিয়েছি! আবার উত্তরবঙ্গের বৃষ্টির মজা হল, কাজের সময় বৃষ্টি নেই। অথচ সারারাত বৃষ্টি। সরস্বতী চা বাগানের বাংলোর উপর এক ক্ষান্তবর্ষণ কাকডাকা বিকেলে দেখেছি উন্মত্ত তিস্তাকে। শালগাছের গুঁড়ি দেশলাই কাঠির মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

বনে-পাহাড়ে বর্ষার যে সমারোহ তা অন্য কোনও ঋতুতেই নয়। কখনও কখনও বাংলোয় শুয়ে মনে হয় জঙ্গল-পাহাড় কাঁপিয়ে যেন বৃষ্টি নয়, আদ্যিকালের সব ঐরাবতেরা আসছে। তারপর একসময় বৃষ্টি আসে। তৃষিতা প্রকৃতিকে সিক্ত করে সোঁদা গন্ধ বের হয়। এই গন্ধ নারীর গর্ভাধানের গন্ধের মতো যা প্রমাণ করে প্রকৃতি আসলে নারীই। ঠিক তখনই ডেকে ওঠে ময়ূর কেঁয়া কেঁয়া করে, শম্বরের দল ঘাক ঘাক করে। সকাল বেলায় চোখ মেলে দেখি  বাংলোর গাছেদের রুক্ষ ডালে এসেছে গুঁড়ি গুঁড়ি কিশলয়। কতদিন আগে এই মেঘমালা অগণ্য জলকণা সঞ্চয় করে, আদিগন্ত বাষ্প ও  নিদারুণ অপেক্ষা বুকে নিয়ে এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্র পারে যেতে নিজেকে প্রস্তুত করে। তারপর যাবার পথে কোথাও রেখে যায় স্মৃতির জলকণা। উর্বর করে মাটি। দূর করে রুক্ষতা। এইসব দেখেই তো অস্বীকার করতে পারিনা তাঁকে, যিনি চরণ ছাড়া সর্বত্র গমন করেন, চোখ ছাড়াই সবকিছু দেখেন।

অচানকমারের জঙ্গল
অচানকমারে বর্ষা শেষের জঙ্গলে শুঁড়িপথে হরিণের পাল। 

আর একটা ঘটনার কথা বলি। মারুমার বাংলো থেকে বের হয়ে মিরচাইয়া জলপ্রপাতের কাছে একটি কদম গাছের নিচে পাথরে বসে আছি। হঠাৎ খসখস আওয়াজে ঘুরে দেখি, দশ হাত দূরে দেড় মিটার মতো উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মূর্তিমান যম, একটা শঙ্খচূড়। না। ছোবল দিল না। কী জানি কেন আমার প্রতি সদয় হয়ে বর্ষণক্ষান্ত বনে কদম্বগন্ধে আমোদিত ঘাসে সর্পিল গতিতে সে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আমি তো বারবারই বলি কেউ কেউ মারা যান বর্শাবিদ্ধ হয়ে, আমি মারা গেছি বর্ষাবিদ্ধ হয়ে!

চিত্রঋণ:

কৌশিক লাহিড়ী
ডাঃ সুমন্ত ভট্টাচার্য
পল্লবী মজুমদার

বুদ্ধদেব গুহ এই সময়ের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্ম হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশে। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেও সাহিত্যই তাঁর আদত বিচরণক্ষেত্র। রবীন্দ্রসংগীত, পুরাতনী ও টপ্পার আঙিনাতেও তাঁর সাবলীল যাতায়াত। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'জঙ্গলমহল।' তাঁর রচিত 'হলুদ বসন্ত', 'মাধুকরী', 'কোয়েলের কাছে', 'কোজাগর', 'একটু উষ্ণতার জন্য' দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার। পেয়েছেন আনন্দ ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার। তাঁর চোখে সব বনই সুন্দর, সুন্দর বন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *