*আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] []

অন্যদিনের মতো আজও সে সকাল ন’টা‌য় রাজা রাজবল্লভ স্ট্রিট থেকে বেরিয়েছিল। মানিকতলায় এক বড় ডিলার আছে। তার সঙ্গে দেখা করে অফিস যাবে। কিন্তু ওই যা হয়– মাঝপথ থেকে ঘুরতে শুরু করল। বাঁদিক, ডানদিক, সোজা দুশো মিটার গিয়ে বাঁ-দিকে। মাথার মধ্যে গুগল ম্যাপ খুলে কেউ যেন তাকে ফিসফিস করে পথনির্দেশ দিয়ে চলেছে। এইসব সময় রঞ্জন চোখ বন্ধ করলেও অ্যাপ ক্যাবের মতো রাস্তার ম্যাপ দেখতে পায়। ইউ হ্যাভ রিচড ইয়োর ডেস্টিনেশন–

যে বাড়ির ভেতরে গেল, বাইরেটা ভাঙাচোরা, কিন্তু ভেতর ঝকঝকে। মেঝেতে মার্বেল, দেওয়ালে দামি সাদা রঙ, ঘরের আলো অবধি ভেবেচিন্তে লাগানো। উজ্জ্বলতা অকারণে বেশি নয়, কমও নয়। যে ছেলেটা রঞ্জনকে সদর খুলে দিয়েছিল, তাকে বৈঠকখানায় বসিয়ে ভেতরে কাউকে খবর দিতে গেছে। এই যে এতটা নিজে-নিজে লক্ষ করে সবটা বুঝতে পারছে ঘোরের মধ্যেও, তা ভেবে রঞ্জনের মনটা আরাম পেলে। নিজস্ব জোরের জায়গাটা ফিরে পাওয়া, হল শীতের রাতে বহুকাল ধরে সঙ্গে থাকা তুলোর লেপ মুড়ি দিয়ে শোওয়া! যে সোফায় রঞ্জনকে বসান হয়েছে, বেশ দামি– ইটালির তৈরি বললেও বিশ্বাস হবে।

 

আরও পড়ুন: পিনাকী ভট্টাচার্যের কলমে: চপ দিয়ে যায় চেনা

 

বিশাল ঘর। হলঘরই বলা যায়। উলটো দিকের সোফার অবস্থান প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট দূরে। বাইরে পায়ের আওয়াজ– যে লোকটা ঢুকল, টাই স্যুট। নীল চোখ। সত্যি নীল না কনট্যাক্ট লেন্স লাগিয়েছে, এমন মার্জিত আলোয় বোঝার উপায় নেই। তবে মাথায় যে উইগ পরেছে তা স্পষ্ট। হঠা মনে এল, এই লোকটা সেই ঝাউতলা রোডের বাড়ির দাড়িওলা নয়তো, যে বলেছিল আল্লাহপাকের দোয়া মিলবে? ওই লোকটারও, এর মতো, চোখের পাতা আর ভুরুর মাঝখানে ছোট আঁচিল ছিল। খুবই ছোট, কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায়। খোলস ছাড়ালে লোকটা হয়তো টেকো গোপাল ভাঁড়, কিন্তু আপাতত, সব মিলিয়ে লোকটাকে বেশ নায়ক-নায়ক লাগছে। এতটাই, ওর একটা ছবি তুলতে ইচ্ছে করল রঞ্জনের। কিন্তু অচেনা লোককে হুট করে কী ছবি তোলার কথা বলা যায়? তবু সে উঠে দাঁড়াল। লোকটা রঞ্জনকে একবার দেখে নিঃশব্দে হাসল। ওকে বসবার ইঙ্গিত করে নিজে ধপ করে বসে পড়ল। ব্যস্ত হয়ে পড়ল মোবাইল চেক করতে।

সুযোগ এসে গেল একটু পরে। অন্য আর একজন ঢুকতেই, টাই-স্যুট বলে উঠল ‘হাই নীল–’ 
নীল যার নাম, বেঁটে গোল আলুর মতো চেহারা। মুখের ডানদিকে কাটা দাগ। রং টাই-স্যুটের মতো পরিষ্কার নয়, আবার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলাও যাবে না। এ এমন বর্ণ যার কোনও লিখিত বিবরণ দেওয়া শক্ত, অসম্ভবই বলা যায়। টাই-স্যুট বলল,
– সাবধানে হ্যান্ডল করতে হবে। মাথাটা চেক করে নিও কোনও ইমেজ বসে গেছে কিনা…
নীল চোখ পিটপিট করল–
– বসে গেলেই বা কী? রিমুভ করে দেব…

ওদের কথার ল্যাজামুড়ো কিছুই বুঝতে পারছিল না রঞ্জন। এইটুকু বুঝেছিল আজ কোনও বড় জাতের খেলা খেলতে চাইছে ওরা তাকে নিয়ে। আজ কোনও বড় কিছু শিকার করবে ওরা, ওদের পোষা সোনালি ঈগলকে লেলিয়ে! ওরা দু’জনে যখন কথা বলছে, নিজের মোবাইল দেখতে শুরু করল রঞ্জন। অনেকগুলো মেসেজ এসেছে। পাঁচটা মেসেজ সেলস বাড়বার। দুটো চিন্তার– বজবজ আর শ্যামবাজারে সেলস কমছে, হুহু করে। এদের হাত থেকে নিস্তার পেলে একবার শ্যামবাজারে যেতেই হবে। 

বাইরে পায়ের আওয়াজ– যে লোকটা ঢুকল, টাই স্যুট। নীল চোখ। সত্যি নীল না কনট্যাক্ট লেন্স লাগিয়েছে, এমন মার্জিত আলোয় বোঝার উপায় নেই। তবে মাথায় যে উইগ পরেছে তা স্পষ্ট। হঠা মনে এল, এই লোকটা সেই ঝাউতলা রোডের বাড়ির দাড়িওলা নয়তো, যে বলেছিল আল্লাহপাকের দোয়া মিলবে? ওই লোকটারও, এর মতো, চোখের পাতা আর ভুরুর মাঝখানে ছোট আঁচিল ছিল।

মাথা তুলেই রঞ্জন বুঝল, হাতের নাগালে সুযোগ। ওরা দু’জন হাত নেড়ে কথা বলছে। এত গভীর আলোচনা, ওদের কোনও নজর নেই তার দিকে। রঞ্জন ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এল ক্যামেরাটা। ফ্ল্যাশ অফ। আলোর ঝলকানিতে ওরা ঘাবড়ে যেতে পারে। এইবার সাবধানে বোতামে চাপ। একবার, দু’বার, তিনবার। নায়কের ছবি উঠেছে, বেঁটেরও।
আলোচনা শেষ। ওদের কাজ শুরু। রঞ্জনকে বসানো হল কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে। মাথায় বুকে লাগানো নানান তার। কীসব পরীক্ষা হল। ব্লাডপ্রেশার মাপা হল। রঞ্জনের বরাবর একশো কুড়ি-আশি থাকে। তাই-ই পাওয়া গেল।

এরপরে ওর জামা খুলে পরিয়ে দেওয়া হল জ্যাকেট। জ্যাকেটের তলায় ধাতব হাতল।
– এটা কী? জিজ্ঞাসা করেছিল রঞ্জন। টাই-স্যুট বলল,
– ওটা না জানলেও চলবে…
বেঁটেটা হাসল।
– তোমার মন লাগাম ছেঁড়া উন্মত্ত অশ্বের ন্যায় ধাবমান। চিত্ত সুস্থির কর। সুস্থির… নাহলে মোক্ষলাভ হবে কী করে?
লোকটা খিক-খিক করে হাসল। অন্য সময় এমন হাসি দেখলে রঞ্জন হাত চালিয়ে দিত, কিন্তু আজ হাত উঠছে না। পাহাড়ের মতো ভারী। মাথাও ওদের বশে। রঞ্জন মনের জোর ফিরে পেতে চেষ্টা করল প্রাণপণ। নিজের মস্তিষ্কের ওয়েভলেন্থ পালটে ফেলতে হবে। নন্দিনীর ওপর আগে খুব রাগ হত, ঘৃণা হত মারাত্মক। এখনও রাগ হয় কখনও, কিন্তু ঘৃণা হয় না আর। তার মানে নিজেকে পালটানো যায়। চিন্তাকে বাগে আনা যায়। স্ববশে আনা যায় প্রবৃত্তিকে।

প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেনের বাড়ি থেকে বেরবার পর থেকেই ফিসফিস– সোজা পশ্চিমে চল… হ্যাঁ, দাঁড়াও… এইবার রাস্তা পার হও, সাবধানে। দৌড়তে যেও না, বিপদ হবে। রাস্তা পার হয়ে পশ্চিমদিকের ফুটপাতে ওঠো। ওই বটগাছের তলায় দাঁড়াও। একটু পরেই ধুতি পরা এক ভদ্রলোক আসতে পারেন, তাকে দেখলেই গাড়ি চালিয়ে অন্য জায়গায় সটকে পড়বে, কিন্তু যদি খাকি শার্ট পরা কেউ এসে বলে…

তারপরেই ফট করে আওয়াজ। ফিউজ উড়ে গেলে এমন হয়। ফিসফিস বন্ধ। তাহলে কি প্রথম শিফট শেষ? ঘড়ি দেখল রঞ্জন। নাহ্, এখনও তো হাতে অনেক সময়। হয়তো ওদের লাইনে কোনও গন্ডগোল…

সেই থেকেই তো এই তিনটে ঝুরি নামা বটগাছের তলায়। রঞ্জন বেশ বুঝতে পারছে, বিপজ্জনক অপরাধীদের এই চক্রটা তাকে দিয়ে মারাত্মক সব কাজ করাতে চাইছে। এরকম হলে তলাপাত্র সাহেব বলেছিলেন খবর দিতে। এখনই কি খবর দেবে? না, আর একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক ওরা ঠিক কী করতে চায়। এই যে জ্যাকেটটা পরে আছে, এতে কী আছে? হেরোইন, না আরডিএক্স? যাই থাক, দুটোই বিপজ্জনক। একটা নেশায় খতম করে, অন্যটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। ওরা যে ঠিক কী করতে চায়, জানতে কৌতূহল হচ্ছে খুব। আজ নন্দিনী থাকলে ওকে বলা যেত। অবশ্য বলেই বা কী? নিশ্চয় কোনও মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত আবার। রঞ্জনের কান গরম হয়ে গেল। মেয়েটা সব ব্যাপারে পণ্ডিতি দেখায়। একটু নাম হবার পর থেকেই ওস্তাদি বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ আর এইসব চিন্তা করে নিজের মন খারাপ করবে না রঞ্জন। দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করতেই হাতটা কারো গায়ে লাগল। 
– স্যার কেয়া সোচ রহে হ্যায়? জুতা…
লছমন পালিশের বাক্সটা গাড়ির কাছেই নিয়ে এসেছে।

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *