শীত শেষের এই সময়টায় বাজারে বেশ সরেস মৌরলা দেখতে পাওয়া যায়। ভালো করে পরিস্কার করে, হাল্কা করে ভেজে, একটু সর্ষেবাটা, কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল আর বিউলির ডালের বড়ি দিয়ে গা মাখা মাখা মৌরলার ঝাল। লক্ষ রাখতে হবে বড়ি যেন গলেও না যায় আবার শক্তও না থাকে। অবশ্য মৌরলা তো আর প্রথম পাতের খাবার না, তার জন্য লাগবে গয়নাবড়ি ভাজা আর পালং শাক। সবার আগে গয়নাবড়িগুলো ভেজে আলাদা করে রেখে দিতে হবে। কড়ায় তেল গরম হলে গয়নাবড়ি এপিঠ ওপিঠ করে ভাজার সময় যখন দেখা যাবে ব্লটিং কাগজের মতো তেল টেনে নিচ্ছে বড়িগুলো, তখন একটু মন শক্ত করে থাকতে হবে আর রাতের শেষ পাতের মিষ্টিটা সেদিনের মত বাদ দেবার সংকল্প করে ফেলতে হবে। তারপর সাদা তেলে জোয়ান ফোড়ন দিয়ে, প্রথমে পালংটা একটু নাড়াচাড়া করে নিতে হবে। শাকটা নরম হয়ে এলে একটু হিং, তারপর একহাতা দুধ দিয়েই পাত্রটা ঢাকা দিয়ে কিছুক্ষণ রান্না করতে হবে। যতক্ষণ শাকটা রান্না হচ্ছে, ততক্ষণে একমুঠো মুসুর ডালের বড়ি ভেজে হাতে গুঁড়ো করে রাখতে হবে, গুঁড়ো যেন আবার বেশি মিহি না হয় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। শাকের জল মরে গেলে নুন চিনি দিয়ে নামিয়ে, ওপরে বড়ির গুঁড়ো ছড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে। বড়িটা মুচমুচে থাকতে থাকতে পরিবেশন না করতে পারলে কিন্তু প্রচুর পয়েন্ট এমনিই কাটা যাবে। শীতের পালং হোক কিংবা বসন্তের সজনে ফুল, মৌরলার ঝালই হোক আর রুই-এর আদাজিরে ঝোল, বাঙালির পাতে বড়ি না হলে চলে না। বড়ি যেমন প্রথম পাতের শুরুর সঙ্গী, তেমনই নিরামিষ রান্নার রক্ষাকর্তা আর মাছ রান্নার মোক্ষম অ্যাক্সেসরি।

পৌষের মিঠে রোদ, উত্তুরে হাওয়া, খোলা ছাদ, বিউলি মুসুর অথবা খেসারি ডাল বাটা আর হাঁটু কব্জি আর কাঁধের জোর – এই হল ভালো বড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ। ভালো বড়ি মানে হালকা ফুরফুরে নাক উঁচু বড়ি। ভাজার হোক কিংবা ঝোলের, মুখে দিলে সুড়ুত করে গলে যাবে, এইরকম। রোদ বেশি কড়া হলে বড়ি শক্ত হয়ে যাবে, আবার উত্তরের বদলে দক্ষিণ বা পূবের হাওয়া লাগলে বড়ি নুয়ে পড়বে। গয়না বড়ির জন্য আরও চাই নুন আর পোস্ত। থালায় এমনভাবে পোস্ত ছড়াতে হবে যাতে থালা দেখা না যায়। এই পোস্তর আস্তরণের ওপর তামার চোঙ দিয়ে ডাল বাটা ছড়িয়ে তুলতে হবে গয়না বড়ির নক্সা।
ঝোলের বড়ির জন্য বাটা বিউলির ডালের সঙ্গে হিং, জিরে, আদা মিশিয়ে বাটা ডালটাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফ্যাটাতে হবে, যাতে ডালবাটার মধ্যে হাওয়া ঢুকে ফুলে যায়। কিন্তু লক্ষ রাখতে হবে ফ্যাটানোর সময় যেন হাত একই দিকে ঘোরে। একবার ডান থেকে বাঁয়ে আর একবার বাঁ থেকে ডাঁয়ে ঘোরানোর মত অস্থিরমতি হলে বড়ি তার শোধ ঠিকই তুলে নেবে। আর এই ফ্যাটানোর ব্যাপারটা কিন্তু সব বড়ির ক্ষেত্রেই কমন (কাঁধ কব্জি আর হাঁটুর জোরের কথা এমনিই বলিনি)।

যে বিপুল পরিমাণ পরিশ্রম ধৈর্য আর অধ্যবসায় যেকোনো ভালো বড়ি দাবি করে, বলা বাহুল্য তা জোটানো কোনও একজনের কম্ম নয়। পিঠের মতই, বড়িও তাই আসলে একটা সমষ্টিগত কাজ। কঠিন করে সাহেবি কেতায় যাকে কমিউনিটি বিল্ডিং এক্সারসাইজ বলা যায়। শহুরে ব্যস্ততা এবং একলষেঁড়ে নিশ্চিন্তততার কোটরের চেয়ে দূরে গ্রামে (যেখান থেকে আপনার প্যাকেট করা বড়ি আসে), কিন্তু আজও কাঁধে কাঁধ হাতে হাত মিলিয়েই বড়ি দেওয়া চলে। মই-এর ওপর কঞ্চির সরু কাঠি আর শণের দড়ি দিয়ে বোনা ‘বাড়’ বিছিয়ে, ভোরবেলা থেকে দল বেঁধে বড়ি দেওয়া চলে। পরিবারের প্রায় সমস্ত সদস্যই পালা করে উবু হয়ে বসে পড়ে বাড়ের সামনে। গয়না আর ঝোলের বড়ি দেওয়া শেষ হলে শুরু হয় মুসুর ডাল আর খেসারি ডালের ফুলবড়ি দেওয়া। এর মধ্যে যে বড়ি শুধু ভাজা খাওয়ার জন্য – গুঁড়িয়ে রান্নায় ছড়ানোর কিংবা খিচুড়ির দোসর হিসেবে, তাতে সামান্য নুন আর পোস্ত দেওয়া চলবে। আর যে বড়ি শুধুমাত্র ঝাল ঝোল চচ্চড়িতে পড়বে, তাতে কোনও বাড়তি বাহুল্য থাকবে না। মূল রান্নার স্বাদটুকু শুষে রান্নায় একটা ব্যালান্স এনে দেওয়াই সেই বড়ির উদ্দেশ্য।
বাংলার সব জেলার মধ্যে বড়ি দেওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মেদিনীপুরের খাবারে বড়ি রীতিমত ঝালে ঝোলে অম্বলে সর্বত্র পাওয়া যায়। শীতের শেষ পাতে মুলো বেগুন বড়ি দিয়ে পুরনো কালো তেঁতুলের টক আর তারপর একটা গুড়ের রসগোল্লা পেলেই আগন্তুক ছবির মনমোহন মিত্রর কথা ধার করে, একটা ঢেকুর তুলা বলাই যায় – আহারের এত বাহার এ শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় আকারে স্থূল, প্রকারে কুল এবং জোকার-এ মশগুল। ভালোবাসেন মার্ভেল, ডিসি, আর যা কিছু ফিশি। পূর্বজন্মে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে বাংলার নেশায় বুঁদ। পরজন্মে গল-দের গ্রামে খোলা আকাশের নীচে গোল টেবিলে নৈশভোজের আসরে বসে বুনো শূকরের রোস্ট খেতে চান।