গুরুচণ্ডা৯-র সঙ্গে যাঁরা ইতিপূর্বে পরিচিত, তাঁরা হয়তো জানবেন, এই প্রকাশনা তাদের আদিলগ্ন থেকেই ‘সুলভ ও পুষ্টিকর’ বই ছাপার নীতি গ্রহণ করেছে। ২০২০-র কলকাতা বইমেলা থেকে এমনই একগুচ্ছ ‘চটি বই’ কিনে ফেলা গিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল এই ‘অতিনাটকীয়’ নামের বইটিও।
বইয়ের লেখক, একক। শুনে তো ছদ্মনাম বলেই মনে হয়। অথবা শুধুমাত্র নাম, পদবিহীন। ইতিপূর্বে এঁর আর কোনও গল্পের বই চোখে পড়েনি৷ আসলে, লেখকের নামঠিকানাঠিকুজিকুষ্ঠি, অধুনা যা যা একটি পেপারব্যাক বইয়ের পিছনের প্রচ্ছদে থাকা প্রায় বাধ্যতামূলক, সেসব কিছুর দিকনির্দেশের বালাই নেই এই বইটিতে। কেবলই চার ফর্মার একটি ক্রাউন সাইজ বই, ধূসর বেগুনি দুর্জ্ঞেয় প্রচ্ছদ, কালো রঙে অবিন্যস্ত সজ্জায় বই ও গল্পকারের নাম, ভেতরে চোদ্দোটি গল্প, এবং সূচি দেখলে বোঝা যায় তারা প্রায় প্রত্যেকেই স্বল্পায়তন।
ছেষট্টি পৃষ্ঠার বই শেষ করতে তিন দিন সময় লাগে। এমনটা সাধারণভাবে লাগার কথা নয়। কিন্তু, লাগে। বিশেষত ‘এমাজনের পেঁপে’ কিংবা ‘বিষক্ষয়’–এর মতো গল্প পাঠের পর, বেশ কিছুক্ষণ নিজের মধ্যে থাকতে হয়, বই খুলে, চোখ বন্ধ করে। না, কোনও চেনাদুঃখ-চেনাসুখের ক্যাথারসিস নয়, যা পাঠককে ধাক্কা দিয়ে ঝটিতি ফেলতে চাইবে ক্ষণস্থায়ী প্রতিক্রিয়াজনিত আবেগের মধ্যে। কেননা, এরা কোনও সুপরিচিত আবেগই নয়। কিছু ইনস্টিংকট চেনাশোনা মাত্র, যা বেশির ভাগ গল্পে ‘রিলেট’ তো নয়ই, বরং ‘অ্যালিয়েনেট’ করতে করতে যায়।
আসলে, লেখকের নামঠিকানাঠিকুজিকুষ্ঠি, অধুনা যা যা একটি পেপারব্যাক বইয়ের পিছনের প্রচ্ছদে থাকা প্রায় বাধ্যতামূলক, সেসব কিছুর দিকনির্দেশের বালাই নেই এই বইটিতে।
প্রায় প্রতিটি গল্পের প্রটাগনিস্ট, সে পুরুষ হোক বা নারী, এই অ্যালিয়েনেশন-জার্নির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বহির্জগতের প্রেম-বিরহ-সংঘাত-শান্তিপ্রস্তাব থেকে সু-দূরে, প্রটাগনিস্টের মধ্যেকার অন্তর্লীন উদ্দেশ্য়বিহীনতা, বিরাগ, বিচ্ছিন্নতাবোধের চড়াই উতরাইগুলোকে শুদ্ধ বাংলায়, শহুরে কথ্য বাংলায়, দেহাতি উচ্চারণের বাংলায়, গেঁয়ো মানুষের বাংলায় পরতে পরতে (না) সাজিয়ে এইসব গল্প লেখা হয়েছে৷ খুব দীর্ঘ কোনও সময়কাল ধরে এসব লেখা, তেমনটা মনে হয় না। ফলত, ভাষার গঠনে বিবিধতা থাকলেও, ক্রমান্বয়ে পাঠের ক্ষেত্রে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
‘এমাজনের পেঁপে’–র মতো ছোটগল্প যে বাংলাভাষায় স্বল্পলিখিত, সে বিষয়ে সংখ্যাগুরু পাঠক একমত হবেন, আশা করা যায়। মাতা-পুত্রের এ হেন গল্পের শুরুর দিকে, এ দুই ব্যক্তির প্রতিবেশী হিসেবে নাম পাওয়া যায় তিনটি চরিত্রের। একজন পাড়ার বেড়াল কুতকুতি, দ্বিতীয়জন ভোদাই নামে লেজকাটা কুকুর, এবং তৃতীয়, এক বৃদ্ধ কাক রামাধীন। কুতকুতি ও রামাধীনের অনুষঙ্গ গল্পের সমস্ত পরিসর জুড়ে বিদ্যমান৷ সাড়ে তিন পৃষ্ঠা পড়ে ফেলার পর মনে হতে থাকে, তাহলে ভোদাই কোথায়, ভোদাই কেন। গল্পের একেবারে শেষ অংশে ভোদাই আসে, আপাতদৃষ্টিতে গল্পে যার প্রায় কোনও ভূমিকা নেই৷ আনুগত্যহীনতার এই কাহিনিতে একটি নেড়ি কুকুর সুনিপুণভাবে সারমেয়সুলভ কর্তব্যপালনের চিহ্ন রেখে যায়, শুধুমাত্র তিনটি বাক্যের বর্ণনায়।
কোনও চেনাদুঃখ-চেনাসুখের ক্যাথারসিস নয়, যা পাঠককে ধাক্কা দিয়ে ঝটিতি ফেলতে চাইবে ক্ষণস্থায়ী প্রতিক্রিয়াজনিত আবেগের মধ্যে। কেননা, এরা কোনও সুপরিচিত আবেগই নয়।
সংকলনের সাধারণভাবে বিষয়কেন্দ্রিক হওয়ার দায় নেই। তাই বোধ করি, ‘দীহারী কথা’, ‘ভজো’ এবং ‘হাজবপুরের কেচ্ছা’ বাকি এগারোটি গল্পের থেকে বহিরঙ্গে পৃথক। এ তিনটি লেখার প্রাথমিক পাঠে কোনও আপাত-ক্লাইম্যাক্সের সন্ধান মেলে না। এমনকী বাকি গল্পগুলিকে যদি ‘জঁর’–এর চিরাচরিত বিভাজনের আওতায় ফেলতে গিয়ে ‘হরর’ শব্দটি মাথায় এসেও পড়ে, এ তিনটি লেখা তবে স্পষ্টত তা থেকে আলাদা। সত্যি বলতে কী, এই তিন গল্পে ততখানি অতিনাটকীয়তাও চোখে পড়ে না, যা বইয়ের নামের সার্থকতা নিরূপণ করতে সক্ষম। তবে, এখানে পাঠক-লেখক কেউই আদতে নামকরণের সার্থকতা প্রসঙ্গে দশ নম্বরের উত্তর লিখতে বসেননি৷ উপরন্তু এ হেন বিশ্লেষণ যেমন পাঠক-সমালোচকের স্বাধীনতা, তেমনই গল্প সাজানোর স্বাধীনতাও পূর্ণত লেখক-প্রকাশকের। তিনটিই, বিশেষত ‘ভজো’ লেখাটি ভাষা ও গঠনের প্রেক্ষিতে ভীষণরকম পরীক্ষামূলক ফলত সবিশেষ ভাবনার দাবি রাখে।
একক গোটা বইটিতে প্রাথমিকভাবে ‘হরর’ নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়েছে। মৃত্যু ও হত্যার পাশাপাশি, ঘৃণা কিংবা বীতশ্রদ্ধাজনিত প্রত্যাখ্যানও যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে অর্থাৎ ভীতির আবহ তৈরি করতে সক্ষম, সে কথা ‘অন্নময়‘ বা ‘সাংসারিক’ পড়লে বোধগম্য হয়। বেশির ভাগ গল্পকেই ‘গথিক হরর’ উপবিভাগের আওতায় ফেলা যায়, কেননা সেসব মৃত্যু, মূলত হত্যায় এসে পরিণতি পায়। ‘উডভুতুয়া’ গল্পটি অনেকাংশে পরিচিত ভয়ের, যাকে অলৌকিক বললে অতিরঞ্জন হয় না। সভ্যতার আদিমতম প্রবৃত্তির এতরকম শেড নিয়ে বাংলায় দু‘মলাটে একটি পূর্ণাঙ্গ বই আগে তৈরি হয়েছে কিনা জানা নেই৷ যা হয়েছে, তা সবই বাজারচলতি প্রকাশনার এক ডজন ভয় কিংবা রাতে পড়বেন না গোত্রের। সেসব শুধু রাতে কেন, আদৌ না পড়লেও বাঙালি পাঠকের সবিশেষ ক্ষতি সাধিত হয় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকে৷
এই বইয়ের দুর্বল দিক যদে কিছু থাকে তা হল, প্রথম ছ-সাতটি গল্প পড়ে ফেললে শেষদিকের লেখায় ঘটমানতার পরিণতিকে সহজ-অনুমানযোগ্য মনে হতে পারে। কিছুটা দেগে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে ওই কালো ফ্লাই-পেজটিতেও, যা ‘ভজো’ আর ‘অতিনাটকীয়’–র মধ্যে আন্ডারলাইন্ড ডার্কনেস এনে বসায়। এই আরোপিত অন্ধকারকে অতিরিক্ত বলে মনে হয়, সাজেসটিভনেস-এর অভাব বলে মনে হয়, বিশেষত, সমগ্র বইটিই যখন ডার্কনেস-এর নানাবিধ রূপ, শব্দ, গন্ধ চেনাতে চেনাতে চলেছে।
প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য থেকে বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইংরিজি সাহিত্য, সর্বত্রই ‘হরর’ নিয়ে বিস্তর কাজ হয়ে চলেছে। উপমহাদেশীয় ভাষায় লেখা ‘অতিনাটকীয়‘ বইটি সেই সুবৃহৎ পরিসরে, অণুপ্রমাণ হলেও, অপরিহার্য সংযোজন। এককের নতুন গল্প বইয়ের আকাঙ্ক্ষায় রইল বাঙালি পাঠক।
আলোচিত বই:
অতিনাটকীয়
একক
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৯
প্রকাশক: গুরুচণ্ডা৯
মূল্য: ৬০ টাকা
বিহু পেশায় বহুজাতিক সংস্থার কর্মী। আদি নিবাস নদিয়া জেলার শান্তিপুর। কর্মসূত্রে আট বছর যাবৎ দেশের একাধিক শহরে ভ্রাম্যমাণ। সঙ্গী বলতে রঙিন মাফলার আর বেরঙিন ইনহেলার। গরিমা বলতে ঘরজোড়া বইপত্র ও একটি যুক্তাক্ষরবিহীন নাম৷ স্বপ্ন দেখেন একদা চাকরি ছেড়ে গ্লোবট্রটার হওয়ার।
বহুবারই মনে হয়েছে, এককের লেখার এই যে ‘ভলকে ভলকে রূপ’- এই আশ্চর্য অন্ধকার রূপ রিভিউতে কতখানি ধরা বা বলা যায়? এককের গল্পের যেটা বৈশিষ্ট্য , যাকে কেউ নিমসৌন্দর্য বলেন, এই পাঠপ্রতিক্রিয়া তাকে অনেকটাই ধরতে পেরেছে।
অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার লিখন, বিশ্লেষণ প্রশংসার দাবি রাখে।