এখন প্রায়ই বিজ্ঞাপনে দেখি, বাংলার নববর্ষ মানে এলাহি খাওয়াদাওয়ার গপ্পো, হোটেলগুলোতেও বিশেষ ‘বৈশাখী মেনু’; আমাদের ছোটবেলায় এসব কিছুর চল ছিল বলে মনে পড়ে না। উল্টে মনে পড়ে, আমাদের কাছে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন মানেই সকলে মিলে বাড়িতে থাকা, স্নান করে সুতির একটা নরম নতুন জামা পরা, বড়দের প্রণাম আর দিনভর গড়িয়ে গড়িয়ে বিশ্রাম। তাছাড়া সব অনুষ্ঠানেই যেমন সময়ের সবজি ও ফল খাওয়ার আগে একটা শুরুয়াত থাকত, বা ঠাকুরকে নিবেদন করে খাওয়া হত, এদিনও তার ব্যতিক্রম হত না। চৈত্র শেষে, বৈশাখের গরম সহ্য করার প্রস্তুতিও নেওয়া হত, প্রথম দিন থেকেই। বৈশাখী খাওয়াদাওয়ায় সকালের জলখাবারে একটু লুচি আর ছোলার ডাল হলেও, দুপুরের শুক্তো থেকে অন্যান্য খাবার হত একদম অন্যরকম অনুপানে; সেক্ষত্রে গরমকালের উপযোগী রেসিপিরই প্রাধান্য থাকত মা-ঠাকুমাদের হেঁশেলে।

Bengali home recipe

শিউলিপাতার শুক্তুনি 

সামান্য ঘিয়ে মেথি ও রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে, কচি শিউলি পাতা নেড়েচেড়ে নিতে হবে, তাতে পড়বে আলুর মতো লম্বা করে কাটা, আন্দাজ মতো চালকুমড়ো, রাঙা আলু, কাঁচকলা, সজনে ডাঁটা এবং বেগুন। আর পড়বে আগে থেকে ভেজে রাখা বাটা মটর ডালের বড়া। সমস্ত সবজি নুন দিয়ে ভালো করে মজিয়ে নিয়ে তাতে উষ্ণ জল দিয়ে মরা আঁচে ফোটাতে হবে। আর নামাবার আগে এক কাপ মতো দুধে সরষে-আদা বাটা ও একছিটে চিনি মিশিয়ে, সেটা দিয়ে ফুটিয়ে নামানো। যজ্ঞিবাড়ির শুক্তোর মতো ঘি গরগরে নয়। পেট ঠান্ডা রাখতে খুবই উপকারী এই হালকা শুক্তো।

এইরকম রিফাইন্ড স্বাদের শুক্তো আমি আর কোনও বাড়িতেই খাইনি; যদিও শিউলি পাতার বড়া ও শিউলি পাতা দেওয়া ডাল খেয়েছি। মনে হয়, এটা আমার ঠাকুমার নিজস্ব উদ্ভাবন। দীর্ঘ সময় বাংলার নানা অঞ্চল এবং বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন জায়গায় থাকবার ফল। তাঁর মত অনুযায়ী উচ্ছে হল গরম, তাই শীতে খেতে হয়; তাছাড়া গরমকালে নাকি উচ্ছেতে পোকা ধরে। গরমের তেতো মানেই নানারকম পাতা সেদ্ধ, ভাজা বা ঝোল করে খাওয়া– যেমন নিম, হেলেঞ্চা, শিউলি, গিমে, সজনে বা উচ্ছে পাতা। 

বাঙালি রান্নায় তেতোর পরের পদই হল ডাল আর ভাজা। অন্য সব ঘটি বাড়ির মতো আমাদের বাড়িতেও রাঁধা হত, নারকেল কুচি দেওয়া মিষ্টি মিষ্টি মুগের ডাল এবং বেগুন ভাজা, সঙ্গে একমুঠো করে মুগের ডালের কুচো বড়ি ভাজা। মুগের ডালও পেট ঠান্ডা রাখে।

Shukto

বৈশাখেই শুরু হত এঁচোড় উদ্বোধন; তাই প্রথমবার বিশেষ আদরে রান্নাও হত, তবে সেটা কিন্তু সরষে-লংকাবাটা দেওয়া ঝাল এঁচোড়। ঠাকুমা যেহেতু বৈধব্য মেনে নিরামিষ খেতেন, তাই মাংসের মতো দেখতে, জিরে, আদাবাটা দেওয়া; গরম মশলার গন্ধ ভুরভুর এঁচোড় খেতে চাইতেন না। ফলে এই এঁচোড় হত নিরামিষ ঝাল এঁচোড়। গারনিশিংয়ের জন্য ওপরে সাজানো চেরা কাঁচা লংকাগুলো ঠাকুমা আবার ভাতের পাতে ডলে খেতেন। জানি না, এই ঝাল এঁচোড়ও অন্যান্য বাড়িতে হত কিনা!

নিরামিষ ঝাল এঁচোড়

কড়াতে গরম সরষের তেলে নুন, হলুদ ও আদাবাটা দিয়ে ভাপানো এঁচোড় কষিয়ে, অল্প গরম জল দিয়ে মজানো হত। ভাপানো কচি এঁচোড় যাতে গলে না যায়, তাঁর জন্য এক চিমটে চিনিও দেওয়া হত। নামানোর আগে, একটা বাটিতে দু পলা সরষের তেল নিয়ে, মিহি করে একসঙ্গে বাটা  দুরকম সরষে এবং বাটা হলুদ তাতে গুলে কড়াইতে দিয়ে ভালো করে নেড়ে তবে নামানো।

এই ঝাল এঁচোড়ের সরষেবাটাটাও হত একটু স্পেশাল। একভাগ সাদা সরষে আর তিনভাগ কালো সরষে জলে ভিজিয়ে, ধুয়ে, জল ছেঁকে একটু নুন, দুটো কাঁচা লংকা ও জবজবে সরষের তেল দিয়ে বাটা হত। কড়া চেঁচে সেই মাখো মাখো এঁচোড় বাটিতে ঢেলে, তার ওপরে সাজিয়ে দেওয়া হত দু তিনটে চেরা কাঁচা লংকা– লাল সবুজ মিশিয়ে। কড়া কাঁচিয়ে সবটা উঠে এলে, কড়াটাকে যদি মাজা মনে হয়, তবেই রান্নাটা ঠিকঠাক হয়েছে।

green jackfruit sliced
প্রথমবার বিশেষ আদরে রান্নাও হত এঁচোড়

চর্বিওয়ালা খাসির বদলে, গরমকালের ঘরোয়া রান্নায় বাবা মায়ের পছন্দ ছিল, কচি পাঁঠার মাংস। আমাদের বাড়িতে মাংস খাওয়ায় কোনও ছুঁৎমার্গ ছিল না। মুরগি, হাঁস বা অন্যান্য পাখির মাংসও খাওয়া হত। অবশ্য বিফ বা পোর্ক বাড়িতে রেঁধে খাওয়া হত না। কচি পাঁঠার ঝোলে লোভনীয় ছিল বড় করে কাটা নৈনিতাল আলুর তুলতুলে টুকরো। গরম বলে, ঠাকুমার নির্দেশে রসুন আর টমেটো পড়ত না। সামান্য পেঁয়াজ আদা পড়লেও, এই মাংস রান্নার আসল মশলা হল জিরে-ধনে বাটা। জিরে কম, ধনে বেশি। মাংসের এই পাতলা ঝোলে, গন্ধরাজ লেবুর রস সামান্য ছড়িয়ে ভাতে মেখে খেতে বা বাটি করে নিয়ে সুক সুক করে জিভে টানতে কী যে ভাল লাগত বলবার নয়!

কচি পাঁঠার ঝোল

মাংসের টুকরোগুলো কাচের বাটিতে রেখে, বাটা হলুদ, সর্ষের তেল, নুন ও সামান্য কাঁচা লংকাবাটা এবং আন্দাজমতো একটু পাকা তেঁতুলের ক্বাথ দিয়ে ম্যারিনেট করে নিতে হবে। গরম তেলে আলুর টুকরো ভেজে সরিয়ে রেখে, তাতেই একটা  গোটা লংকা ভেজে আবার তুলে নিতে হবে। এবার ওই তেলেই এক চিমটি চিনি ভেজে লাল হয়ে উঠলে, তাতেই পেঁয়াজ ভেজে নিতে হবে লাল করে। এরপর তেলে পড়বে আলাদা করে বাটা আদা, জিরে ও ধনে। মশলা কষে মাংস দিয়ে আবার তা কষতে হবে মরা আঁচে। জল বেরতে শুরু করলে, কানা-উঁচু থালায় জল দিয়ে তাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কড়াইয়ে মাংসের জল কমে, মাংস আধসেদ্ধ হলে, থালার উষ্ণ জল কড়াইতে দিয়ে আলুগুলো দিতে হবে। নিবু আঁচে ফুটে ঝোলের মধ্যে ভেসে থাকবে তুলতুলে মাংস আর আলু। সেই যে ভেজে সরিয়ে রাখা শুকনো লংকাখানি, এবার তা ঝোলে পড়বে। খাবার সময় ঢাকা খুললেই ধনে-জিরে-শুকনো লংকার গন্ধে নাক যাবে জুড়িয়ে।

Bengali mutton curry
কচি পাঁঠার ঝোল

শেষ পাতে ‘অম্বল’ তো চাইই। আমঝোল বা আমের চাটনি এ তো সারা বছরের। কিন্তু বছরের শুরুর দিন হবে পাঁচ তরকারির অম্বল। কী যে ভালো খেতে! আগের পদগুলির স্মৃতি নিমেষে ম্লান হয়ে যেত পাতে এই অম্বলটি পড়লেই। মা নিপুণ হাতে একমাপে কেটে দিতেন সবজি। আর ঠাকুমা ঝপঝপ করে রান্না করতেন। তবে অম্বল রান্না হত সবার আগে। অন্যান্য পদ রান্না হত তার পরে।

পাঁচ তরকারির অম্বল

পাকা কুমড়ো, কচি বেগুন, রাঙা আলু, কচি ঢেঁড়স– ছোট ডুমো করে কেটে, জলে একটু নুন ফেলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। কড়াই ডালের কুচো বড়ি ভেজে সরিয়ে রাখতে হবে। সেদ্ধ করা কাঁচা তেঁতুলের ক্বাথে পাকা তেঁতুলের ক্বাথ মিশিয়ে তাতেই বেশ খানিক চিনি ভিজিয়ে, একটা সস মতো তৈরি হবে। সর্ষের তেলে পাঁচ ফোড়ন দিয়ে ফুটে উঠলে, জলে ভেজানো তরকারি চালনিতে ছেঁকে, কড়াইতে দিয়ে, নুন হলুদ ফেলে একটু নাড়াচাড়া করে জল দিতে হবে। ফুটে ওঠা তরকারি সব সেদ্ধ হয়ে গেলে, তেঁতুলের ওই ঘন ক্বাথ কড়াইতে দিয়ে কম আঁচে ফোটালেই অম্বল রান্নায় বাদামি রং ধরবে। এবার শুকনো খোলায় ভেজে রাখা সামান্য মৌরি, রাঁধুনি, আর একটু বেশি জিরে একসঙ্গে গুঁড়ো করে ছড়িয়ে ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে। পাক ভাল হলে এই অম্বল দু -একদিন ধরে রেখে-ঢেকেও খাওয়া যাবে। 

আরও পড়ুন: নববর্ষে কবজি ডুবিয়ে বাঙালিয়ানার খানা তল্লাশি

খাওয়া শেষ হত কিনে আনা মিষ্টি দই দিয়ে। অন্যদিন বাড়িতে পাতা সাদা দইয়ের বদলে বছরের প্রথম দিনে দোকানের ওই মিষ্টি দই পেয়েই মনে হত আজ তো নববর্ষ।

Sweet yogurt
শেষ পাতে মিষ্টি দই

বিকেলে খেলে এসে দেখতাম, জলখাবারেও বদল এসেছে। গরম দুধের বদলে এক গ্লাস করে মিছরি আর লেবু দেওয়া ছাতুর শরবৎ। আর একটু খিদে পেলে কলা বাতাসা দিয়ে মাখা ভিজে সাবু। সারা গরমকাল এই চলত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তবে নববর্ষের বিকেলের ‘এসোজন–বসোজন’-এর কথা ভেবে একটা নোনতা-মিষ্টি পদ ঠাকুমা আগেই বানিয়ে রাখতেন। এর নানা রকম নাম আছে; তবে আমাদের বাড়িতে বলা হত পেরাকি। বিকেলে বেশি লোকজন এলেই মন খারাপ; কারণ ঝুড়ির পেরাকি দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে।

নোনতা এবং মিষ্টি পেরাকি

তখন ডালডার চল ছিল। জল বাদ দিয়ে শুধু ডালডা দিয়েই ময়দা মাখা হত। ঠাকুমা তাতে  একটু খাওয়ার সোডা, রোস্টেড সাদা তিল ও বাড়তি চিনি গুঁড়ো মিশিয়ে নিতেন। ছোট লেচি লুচির মতো বেলে, ছুরি দিয়ে আধাআধি কেটে নিয়ে, একটা ভাগে নারকেলের পুর বিছিয়ে, অন্যটা দিয়ে চাপা দেওয়া হত। তারপর অমৃত প্যাঁচের বালার মতো ছোট মোচড়ে নিপুণভাবে মুড়ে দেওয়া হত; গড়া শেষ হলে ডালডায় বেশ কিছুটা গাওয়া ঘি মিশিয়ে, তাতে ভেজে ছেঁকে তোলা হত নতুন ঝুড়িতে। নরম আর মুচমুচে দুইই হতে হবে যে। একভাগ পুর হল, নারকেল কোরার নোনতা ছেঁই; আর অন্য পুরটা খোয়া আর চিনি মিশিয়ে পাক করা মিষ্টি।

পেরাকি ভাজার মুন্সিয়ানা ছিল এর গায়ে ফোস্কা না পড়িয়ে হালকা বাদামি করে ভাজা। 

peraki
পেরাকি

এসব রান্না এতই সহজ যে, এখন তখন রেঁধে ফেলা যায়। না থাক নিবু আঁচের কয়লার উনুন, না থাক সেই সময়ের তাড়াহীন জীবন; এই বৈশাখ জমে উঠুক, বাড়ির সকলের সানন্দ বাড়ি বাড়ি খেলায়। ঠাকুমা বলতেন রান্নার আসল ‘স্বাদ’ এবং ‘তার’ হল গিন্নির হাতধোয়া জল। এখনকার দিনে তো গিন্নিরা আর একা নয়, কর্তারাও যথেষ্ট রান্নামুখো। দুজনের দুই হাত এক করে, রান্নাঘর জমে উঠুক নিজেদের পছন্দের রান্নায়। মেয়ের বন্ধু দিল্লিবাসী পারমিতা আর তাঁর বর অন্তর যেমন করে পারে। 

সবাইকে বৈশাখী শুভেচ্ছা।

 

 

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Shutterstock, Flickr

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

4 Responses

  1. অপূর্ব, ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমার দিদিমার রান্না ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার আর ঠাকুরমার রান্না ছিল বীরভূম জেলার ওনাদের বাপের বাড়ির মতো মা তাই দুরকম ই রান্না করতেন। কিন্তু এচোড়ের ঝাল এটা একেবারে নতুন রান্না। খুব ভালো লাগলো পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *