কিছু দিন আগে অভিনেত্রী জরিন খান সোশ্য়াল মিডিয়ায় নিজের একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। তা নিয়ে সাঙ্ঘাতিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ জরিনের ছবিতে তার পেটের স্ট্রেচ মার্কস বোঝা যাচ্ছিল। জরিন আগে খুবই মোটা ছিলেন। রোগা হওয়ার কারণে এই স্ট্রেচ মার্কসগুলো তার শরীরের নানা অংশ তৈরি হয়েছে। তা নিয়ে তিনি এতটুকু লজ্জিত নন, তা-ও জানিয়েছেন। কিন্তু এমন অনেক মানুষই আছেন পৃথিবীতে যাঁরা অন্যের ব্যাপারে শুধুই নিন্দে করতে জানেন। অনেকেই জরিনের প্রোফাইলে কুরুচিকর মন্তব্য করেছেন। তার চেহারা নিয়ে বাজে কথা বলেছেন। আসলে মানুষের চেহারা নিয়ে কথা বলাটা একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। বিশেষ করে মহিলাদের সকলেই যেন পারফেক্ট ফিগারের অধিকারী হতেই হবে। আর তা না হলেই শুনতে হবে, মোটা বা বাঁশকাঠি বা হাতি জাতীয় উপমা। কিন্তু কারও শরীর নিয়ে কথা বলার অধিকার কি অন্য কারও আছে? কেউ হরমোনের কারণে মোটা হতে পারেন, কেউ ডায়াবিটিসের জন্য অত্যধিক রোগা হতে পারেন, সুতরাং না জেনেবুঝে অন্যকে অপদস্থ করার মধ্যে যে কোনও মাহাত্ম্য নেই তা অনেকেই বোঝেন না বা বুঝতে চান না। বডি শেমিং আসলে সামাজিক ব্যাধি যা ক্রমশ তার ডালপালা বিস্তার করেই চলেছে।

নায়িকাদের কথাই ভাবুন না! তাঁরা তো গ্ল্যামার জগতের বাসিন্দা। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁরা পর্যন্ত এর থেকে নিস্তার পাননি। আসলে নায়িকাদের ফিগার নিয়ে সকলেই আগ্রহী। তাঁদের শরীরী বাঁধনে অনেক পুরুষই আটকা পড়েছেন। অনেক মহিলাই আবার তাঁদের অনুপ্রেরণা মনে করে নিজেদের শরীর সেইভাবে গড়ে তুলতে চান। নারী শরীর ভারতীয় পুরুষ আসলে তার মতো করেই দেখতে চায়, আর তা না হলেই কোথা থেকে যেন ছুটে আসেন তথাকথিত নীতিপুলিশ। পেটে ভাঁজ বা কোমরে লাভ হ্যান্ডল দেখা দিলেই ওমনি বাঁকা মন্তব্য করে বসেন তাঁরা। আর এখন তো সাধারণ মানুষরাও এই বডি শেমিং থেকে নিস্তার পান না। ফেসবুকে, ইনস্টাগ্যামের ছবি পছন্দ না হলেই ট্রোলিং-এর আর শেষ থাকে না, যার বেশির ভাগটাই হয় চেহারা নিয়ে।

কিন্তু মহিলারা তো আর ম্যানিকিন নন। যে সারা বছর একই রকম চেহারা থাকবে। নানা মানুষের নানা সমস্য়া থাকতে পারে। হরমোনের ভারসাম্যের অভাব হলেই চেহারায় পরিবর্তন আসতে পারে। কোনও অসুখ, কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হলেও এমন হতে পারে। আবার মা হওয়ার পরও অনেকের চেহারা পাল্টে যায়। ঐশ্বর্য রাইয়ের কথাই ভাবুন না। মেয়ে আরাধ্যার জন্মের পর ওজন বেড়ে যাওয়ায় কম কথা শুনতে হয়নি তাঁকে। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁর উপস্থিতি নয়, তাঁর ভারী চেহারা হয়ে উঠেছিল আলোচ্য বিষয়। বিদ্য়া বালান ডাকসাইটে অভিনেত্রী হতে পারেন, কিন্তু চেহারা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য বারবার শুনতে হয়েছে তাঁকে। বাদ জাননি পরিণীতি চোপড়াও। নির্দিষ্ট বডিটাইপ না হলেও যে কোনও মানুষ অসুন্দর তা তো নয়। কিন্তু সমাজের একদল মানুষের তা বোঝার মতো বোধ বা বুদ্ধি কোনওটাই নেই।

কথা হচ্ছিল ক্লাস নাইনের ছাত্রী তিন্নির সঙ্গে। ওঁর থাইরয়েড আছে। চেহারা একটু ভারীর দিকে। তাই নিয়ে স্কুলে সবাই হাসাহাসি করে। বেবি টুনটুন বলে নিত্য খোঁটা দেয়। স্কুল যেতে তাই আর ওর মোটে ইচ্ছে করে না। তা হলেই ভাবুন ছোটরা আর রেহাই পান না এই শেমিং থেকে। কিন্তু একবারও কি আমরা ভাবি আমাদের এই অসংবেদী কথায় কতটা প্রভাব পড়ে শিশুমনের উপর।

বডি শেমিং আসলে এক ধরনের বুলিয়িং। বলপূর্বক অন্যকে মানসিকভাবে নির্যতন করা। তাঁর আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেওয়া। আর জনসমক্ষে কারও দেহ নিয়ে খুঁত ধরার এই প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করে বাণিজ্যিক জগৎ। ওজন কমানোর জন্য জিম আছে, ফর্সা হওয়ার জন্য ক্রিম আছে, লম্বা হওয়ার জন্য ওষুধ আছে, অর্থাৎ চেহারা পাল্টে দেওযার সমস্ত পরিষেবাই কিন্তু হাজির হাতের গোড়ায়। বিপণন জগত যে আসলে ‘বডি শেমিং’কে নিয়ন্ত্রণ করছে। বৃহত্তর সমাজ থেকে শুরু করে পরিবারের একান্ত কাছের মানুষরাও নানা ভাবে নানা সময় জেনে না জেনে বডি শেমিং করেন। বাচ্চারাও একদম ছোট থেকেই এর শিকার।

ভিক্টোরিয়া কলেজের সাইকোলজির শিক্ষক ফুলজানি ঘোষ বললেন, ‘বাচ্চাদের মনে ছোট কথাই অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সেখানে চেহারা নিয়ে মন্তব্য করলে তাঁদের মনে নিজেকে নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। আমরা সব সময় বলি নিজেকে ভালবাসতে। কিন্তু এই ধরনের কথাবার্তা শুনলে স্বাভাবিকভাবে আত্মমর্যাদায় লাগে। তাঁরা অপমানিত বোধ করেন। নিজের চেহারা নিয়ে তখন মনের মধ্যে অবসাদ তৈরি হয়। কাঙ্ক্ষিত চেহারা পেতে তখন তরুণ-তরুণীরা অনেক ভুলভাল অভ্যেসের দাসত্ব শিকার করে নেন। আসলে যাঁরা অন্যের সমালোচনা করেন, বুঝতে হবে তাঁরা মানসিকভাবে অসুস্থ। তাঁদের জীবনে অপ্রাপ্তির ভাগটাই বেশি। মানুষের নিজের ভিতরে হীনম্মন্যতা থাকলে সে তখন অন্যদের কোনও খামতিকে বড় করে দেখতেই আনন্দ পায়! হাসিঠাট্টার কৌশলী মুখোশের আড়ালে তাঁদের আত্মবিশ্বাস ধসিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝতেই পারেন না যে যা তাঁরা ত্রুটি ভাবছেন, তা আসলে একেবারেই ত্রুটি নয়। সুতরাং এই ধরনের কথাবার্তা যতটা সম্ভব পাত্তা না দেওয়াই ভাল। আমি সব সময় আমার ছাত্রীদের বডি পজিটিভিটির কথা বলি। নিজেদেরকে অ্যাক্সেপ্ট করে নেওয়ার মধ্য়ে যে আনন্দ আছে, তা একবার আবিষ্কার করে নিতে পারলে, কোনও নেতিবাচক মন্তব্য আর মনের উপর প্রভাব ফেলতে পারবে না।”

বডি শেমিং যে শুধু বেশি ওজনের জন্য হয় তা নয়। রোগা হলে, মেয়েদের পুরুষালি চেহারা হলে, বেঁটে হলে, কালো হলে, সব ক্ষেত্রেই কুরুচিকর কথা শুনতে হয়। কিছুদিন আগেই নবাগতা অনন্য পাণ্ডে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে অতিরিক্ত রোগা হওয়ায় তাকে কঙ্কালের সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। অভিনেত্রী কলকি কেকঁলা বলেছেন তার চেহারা তথাকথিত নায়িকা সুলভ নয় বলে অনেক সিনেমা থেকে তিনি বাদ পড়েছেন।

তবে এতকিছুর মধ্যেও আলোর আশা আছে। নায়িকারা তো বটেই সাধারণ মেয়েরাও এখন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। বিদ্য বালন সম্প্রতি এই প্রসঙ্গে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। এমটিভির ভিজে বাণী জে, টেলি তারকা অনেরি ভাজানি প্রত্যেকেই ট্রোলারদের মুখের মতো জবাব দিয়েছেন। আর তাই কিন্তু সাহস যোগাচ্ছে আম মানুষদেরও। এখন তাঁরাও বডি শেমিংয়ের চেয়ে বডি পজিটিঙিটির দিকেই বেশি জোর দিচ্ছেন। এই যেমন আশনা ভাগওয়ানি। ওঁর ইনস্টাগ্র্যাম অ্য়াকাউন্ট বেজায় জনপ্রিয়। ভারী চেহারাতেও যে স্টাইলিশ পোশাক পরা যায় তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। ডিজাইনার মাসাবা গুপ্তা থেকে শুরু করে মডেল অঞ্জলি লামা, নিধি সুনীল, নিজেদের চেহারা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বারংবার।

পিকচার পারফেক্ট শরীর তে সকলের থাকে না। সকলেই তার নিজের মতো করে সুন্দর। তথাকথিক আদর্শ চেহারার মায়া কাটিয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতাকেও গ্রহণ করে নেওয়াই কিন্তু ম্যাচিওরিটির লক্ষণ। রূপ, রঙের বাইরে বেরিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই কিন্তু আসল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *