রাজদীপ রায়
বাংলা কবিতার বিপণনের প্রসঙ্গে শুরুতেই একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, ‘কবিতার বিপণন’ বলতে কী বুঝতে চাইছি? কবিতা লেখালিখি, তার বিপণন? শুধুমাত্র একটি কবিতার বিপণন? না, একটি কবিতাবই–এর বিপণন? এখন, কবিতাবই–এর বিপণন তো হবেই! সে বিপণনধর্মের শাস্ত্র মেনে দোকানদারি, মেলার স্টল ইত্যাদির মাধ্যমেই হোক, কিংবা সরাসরি কবিতা লেখকের মাধ্যমে। তা শাস্ত্র না মানলেও বিপণন তো বটেই, বিপণিটিই শুধু নেই। তবু ‘পণ্য’ বলতে একে দ্বিধা লাগে। অথচ আত্মপ্রচার এবং বিক্রির আওতায় সে পণ্যই। প্রতিটি কবিতার বই–ই যেন এক মায়া নিয়ে নিজের গভীরে পাঠকবিশ্ব খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হয়। তাই সেই পৃথিবীর বাইরে এসে কবি এবং পাঠকের যোগসূত্রের অদৃশ্য উপায়টি সে কীভাবে জয় করছে প্রকাশকের বিপণনবুদ্ধির দ্বারা, লক্ষণীয় সেটাই। প্রথমে দেখা যাক, কবিতার বই–এর প্রকাশক কারা, অনন্ত এই মুহূর্তে? আবার একেবারে ধূসর না হলেও সাম্প্রতিক অতীতে কারা ছিলেন কবিতার বইপ্রকাশ ও তার বিপণন জুড়ে?
সিগনেট প্রেস, সপ্তর্ষি প্রকাশন, ধানসিড়ি, প্রতিভাস, ছোঁয়া— এরা এই মুহূর্তে এমন কিছু প্রকাশনসংস্থা যারা কবিতার বই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। অর্থাৎ অন্যান্য উল্লেখ্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। বরং বলা যেতে পারে, প্রতিভাস, ধানসিড়ি কিংবা সপ্তর্ষি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমেই পাঠকমহলে পরিচিতি পেয়েছে। কাছাকাছিই থাকবে পরম্পরা, কিংবা লিটল ম্যাগাজিন থেকে বড় প্রকাশনা হয়ে–ওঠা আদম, নাটমন্দির, রাবণ। সিগনেট প্রেস ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনসংস্থা, যার সঙ্গে দিলীপকুমার গুপ্তর নাম জড়িয়ে আছে। কৃত্তিবাস–এর প্রথমদিকের দিনগুলিতে যে তার কাছে মুদ্রণ সৌকর্য বা পত্রিকা নির্মাণের বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি শিখেছেন, এ–কথা লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। জীবনানন্দের মহাপৃথিবী, বনলতা সেন, কবিতার কথা, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়, আম আঁটির ভেঁপু… এসব লক্ষ করেছে পাঠক। আনন্দ পাবলিশার্স সিগনেটকে অধিগ্রহণ করবার পর সিগনেট থেকে ক্রমাগত প্রতিষ্ঠিত ও তরুণ কবিদের গ্রন্থপ্রকাশ হয় বইমেলাকে কেন্দ্র করে (২০১১–১২)। সপ্তর্ষি–র কর্ণধার নিজেও কবিতা লেখেন, তাই তাঁর কবিতার প্রতি পক্ষপাত ধর্মতও সঠিক হয়ে থাকে। ধানসিড়ি–র অধিকাংশ গ্রন্থই হল তরুণ থেকে তরুণতর কবিদের। কাজেই একটি বিষয় পরিষ্কার, এইসব প্রকাশনা কবিতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
এখন প্রশ্ন হল, এদের বিপণন ব্যবস্থা কেমন? মনে রাখতে হবে, বিপণনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন অত্যন্ত জরুরি আত্মপ্রচার। কী আছে বিজ্ঞাপনের আদর্শে? How to Advertise বই-এ কেনেথ রোমান ও জেন মাশ লিখছেন: ‘The results of your advertising depend less on how your advertising is written than how your product or service is positioned how you want the consumer to think about it…. Just as in war, the strategy is half the battle. The other half is the advertising itself,’— বাস্তবিক এটিই বিপণনে বিজ্ঞাপনের ভূমিকা। তাবে এসব নিশ্চয়ই কবিতার বিপণনের কথা মাথায় রেখে বলেননি, বলেছেন ভোগ্যপণ্যের কথা ভেবে। কিন্তু আমরা যখন আমাদের কবিতাবই ছাপাই কিংবা নিজে ছাপি এবং স্বয়ং টেবিলে বসে বিক্রি করি, তখন এ-কথা মেনে নিতে দ্বিধা হওয়া উচিত নয় যে, এই বিশ্বায়ন-উত্তর পৃথিবীতে কবিতাও এক ভোগ্যপণ্য এবং যাকে বিপণনের অদম্য ইচ্ছায় আমরা দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি একটি স্থায়ী আউটলেটের খোঁজে। খুঁজে বেড়াচ্ছি একটি মেলা প্রাঙ্গণ। এবং ঘুরতে ঘুরতে এও বুঝতে পারছি, কখনো কখনো বিপণনকৌশলটিই এই যুদ্ধের আঙ্গিকের মতো সর্বস্ব হয়ে উঠতে চাইছে, বইটি নিতান্ত গৌণ। দেখা যাক, বাংলা কবিতার পেশাদার প্রকাশকরা কীভাবে তাদের কবিতাকেন্দ্রিক বিপণনটি সামলান। আনন্দ পাবলিশার্স, তাদের অনেক আউটলেট। শুধু কলেজস্ট্রিটের দু-টি বিপণিতে নিজেদের আটকে না রেখে, তারা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে। যাদবপুরে, রাসবিহারীতে। হাওড়ার কদমতলা, হুগলির উত্তরপাড়ায়। এককথায়, রাজ্যজুড়ে। রাজ্যের বাইরেও। বিশ্বায়নিক এই পরিবেশে পাঠককে আর যেতে হচ্ছে না কবিতার কাছে। কবিতা স্বয়ং এসে কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। তবে এমন ব্যবস্থা আনন্দ ছাড়া দু-একটি প্রকাশনা কিছুটা ভাবলেও, হয়তো পরিকাঠামো বা পেশাদারিত্বের অভাবে রূপায়িত করে উঠতে পারেনি। ফলে বাংলা কবিতা-বাজারের একটা বড়ো অংশই পড়ে রয়েছে কলেজস্ট্রিটকে কেন্দ্র করে। সুদূর বীরভূম, মেদিনীপুর কিংবা বাঁকুড়ার কোনো কবিতা পাঠককেও তাই কবিতার অধিকাংশ বই সংগ্রহের জন্য কলকাতাতেই আসতে হয়। তাঁরা চূড়ান্ত নিরুপায়। আর শুধু তো আনন্দ, সপ্তর্ষি, ধানসিড়ি কিংবা আদম-এর বিষয় নয়। বাংলা কবিতা প্রকাশনার ক্ষেত্র, কেন্দ্র ও তার বিকাশ বহুব্যাপ্ত। শুধু তার কোনো সুচিন্তিত দিশা নেই, এই যা! কত বই আছে, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পায়নি পাঠক, বিপণনের অভাবে, তার ইয়ত্তা নেই। কখনো-বা মুখে মুখে ছড়িয়েছে খবর। হাতে হাতে ফিরেছে বই। বই শেষ হলে ফটোকপি। বিশ্বায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রস্তাবনাও এই কবিতা-বাজারকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। যে অনলাইন ব্যাবসার মাধ্যমে বই এখন বাঙালির ঘরের কাছে, সেই ফ্লিপকার্ট কি অ্যামাজনের হাতেও কিন্তু নেই অচেনা কোনো গ্রাম থেকে বা শহরের কোনো স্যাঁৎসেঁতে গলির প্রান্তে নির্জনে প্রকাশিত হওয়া কোনো তরুণ কবির বই। কাজেই বিশ্বায়নের ফলে যে মুক্ত-অর্থনীতির বাজার, যাকে ‘খোলাবাজার’ বলতেই আমরা গোদা-বাংলা ব্যবহারকারীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকি, সেই বাজারও অন্তত বাংলা কবিতার জগতের আমূল কোনো পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়নি। বা, হয়তো এভাবেও বলা যেতে পারে, সবার জন্যে হঠাৎ করে এক সুবর্ণ সুযোগ ঘটিয়ে দেওয়া এই অর্থনৈতিক প্রস্তাবনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেননি আমাদের কবিতার প্রকাশকরা।

এই জায়গায় অবশ্য একটা বহুস্তরীয় রকমফের চোখে পড়বে আমাদের। বাংলা কবিতা প্রকাশনার ক্ষেত্রটা অত সরলসিধে নয়। যেহেতু কবিতা চিরকালই লোকে কম পড়ে, যেহেতু মুখে মুখে কবিতার লাইন এখন আর ঘোরে না, সে–কারণে এ নিয়ে বাজার ধরতে গেলে অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাহলে? কবিতার বই প্রকাশনার ঝুঁকি কীভাবে সামলান প্রকাশকরা? বস্তুত বাংলা কবিতার প্রকাশনার জগৎটি শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু পেশাদার প্রকাশক দ্বারা নির্মিত নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশকের ভূমিকা নিতে হয় স্বয়ং কবিকে এবং সেই সংখ্যাটিই বেশি। এই ব্যয়ভার নিয়োগের দু–টি ধরন আছে। এক, আমি কোনো পেশাদার প্রকাশনসংস্থাকে হাতে টাকা গুঁজে দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। সে এবার সব বুঝে নেবে। আর অন্য উপায়টি হল, লেখক স্বয়ং বইটি করছেন বন্ধুবৃত্তের মধ্যে। হয়তো বইটি কোনো বড়ো প্রকাশকের আনুকূল্যে প্রকাশিত না হয়ে, আত্মপ্রকাশ করছে কোনো লিটল ম্যাগাজিনের ব্যানারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের কাগজ বন্ধুত্বের মর্যাদায় সব বই কবির হাতেই তুলে দেয়। কবিতাগ্রন্থ ছাপার সংখ্যা সাধারণত তিন ধরনের। দু–শো, তিন–শো, পাঁচ–শো (প্রিন্ট অন ডিমান্ড বা পিওডি হলে আরও কম)। যেমন কড়ি, তেমন তেল। এই কবিতাবই এবার ছড়িয়ে পড়ে লেখকের ব্যক্তিগত বন্ধুতা, সম্পর্ক অনুযায়ী। এর প্রকাশক যদি হন পেশাদার, তবে সেই বইটি দেখা যায় বিভিন্ন জেলার বইমেলা এবং লিটল ম্যাগাজিন মেলায়।
কবিতার বই প্রকাশের একাধিক গল্প আছে। আছে তার ইতিহাস। কিন্তু কবিতাবই–এর বিপণন নিয়ে খুব বেশি সচেতনতা আছে বলে দেখা যায় না। স্বাভাবিক রুচির কারণেই এ–কাজটি কবির দ্বারা হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অসম্মানেরও বটে। যদি পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুত্বের হয়, তখন সৌজন্যবশত কবি তার বন্ধু–প্রকাশক, কিংবা লিটল ম্যাগাজিনের কোনো বন্ধু–সম্পাদককে বলতে পারেন তাঁর বই রাখবার কথা, টেবিলে কিংবা স্টলে। ব্যাস, বাংলা কবিতার বিপণনের দৌড় এতটুকুই! এর বেশি একটুও না। বিশ্বায়নের পরেও, এখনও পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ কবির কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছোনোর নির্বিকল্প পদ্ধতি। সবই ঠিকঠাক। মাঝের সরু সুতোর মতো সৌজন্যের হাসিটুকু সুস্থ সম্পর্কের ব্রিজ হয়ে যতদিন ভারসাম্য রক্ষা করবে, কোনো অসুবিধে নেই। কেমন ছিল এই ছবিটা একটু পিছিয়ে গিয়ে? বোধশব্দ পত্রিকারই (জানুয়ারি ২০১১) একটি সংখ্যায় শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম বই দিনগুলি রাতগুলি প্রকাশের কথা। তাঁকে না জানিয়েই কৃত্তিবাস–এর তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রকাশিতব্য কবিতাবই–এর বিজ্ঞাপন। নেহাতই যা ছিল এক খামখেয়ালিপনা। কাণ্ডটি করেছিলেন কৃত্তিবাস–এর তদানীন্তন সম্পাদক দীপক মজুমদার। পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পর শঙ্খ ঘোষকে জানিয়েছিলেন কৃত্তিবাস–এর নিজস্ব ফান্ড থেকে বইপ্রকাশের সমস্যার কথা। যাই হোক, কৃত্তিবাস থেকে সে–বই হয়নি শঙ্খ ঘোষের। কিন্তু এই কাহিনি জেনেই তার ‘ঘনিষ্ঠ’ সহপাঠী বন্ধু কমলরঞ্জন রায় বইপ্রকাশের উদ্যোগ নেন। তাঁদের পারিবারিক প্রকাশনা থেকেই বেরোয় দিনগুলি রাতগুলি। বইটির ব্যয়ভার কে বহন করে, সে–বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও এমন কথা লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ: ‘বইটি নাকি সে–ই বার করবে’। এ হল সেই সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্কেরই একখণ্ড ইতিহাস, যার ধারা বিশ্বায়ন পরবর্তী পৃথিবীতেও অনেকাংশে সক্রিয় রয়েছে।
ভাবতে ভালো লাগে, এক ভালোবাসার বোধ জড়িয়ে রেখেছে আমাদের বাংলা কবিতার বিপণনজগৎকে। এও কি কম পাওয়া? কিন্তু এর পাশাপাশি এই সত্যিও যে বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে— ‘কবিতা’, এই না–পণ্যটিও বাংলা বাজারের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে ভয়ানকভাবে পণ্য হয়ে ওঠে। ‘ভয়ানকভাবে’ বললাম এই কারণে, এ নিয়ে বিস্তর কূটকচালি–পরনিন্দা-পরচর্চার যে মহার্ঘ বাতাবরণ প্রাক্–বইমেলার বাতাসকে আমোদিত করে তোলে, উপেক্ষা করা যায় না তাকে কোনোভাবেই। বরং সেই আধারে কবি–প্রকাশক–পাঠকের ত্র্যহস্পর্শ কীভাবে জটিল রসায়ন তৈরি করে, সেসব জানতে পেরে কষ্ট হয় বই কী! আর এই সব কিছুর সঙ্গেই বিপণনের ব্যাপারটি অমোঘভাবে জড়িয়ে। অথচ ‘বিপণন’ হয়ে পড়ে এমনই এক বিষয়, যে–সম্পর্কে অতি সতর্ক সম্পাদকও কিছু বলেন না। জানান না তাঁর ভাবনার কথা। যেন এই নিয়ে কথা না বললেও চলে। আমাদের কবিতাভবন লেখেন বুদ্ধদেব বসু। লেখেন প্রেস–ছাপা ইত্যাদি নিয়ে কৌশলগত কথাবার্তাও। কিন্তু সেখানে কথা প্রসঙ্গে এক বারই ‘বিলি–ব্যবস্থা’ (প্রবন্ধসমগ্র, বুদ্ধদেব বসু, খণ্ড ১, পৃ. ১৪২) উল্লেখ করেন মাত্র। এই বিলি–ব্যবস্থার স্বরূপ ঠিক কী ছিল? এ নিয়ে তাঁকে কতটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে কিংবা হয়নি, জানা যায় না সে–কথা।

চলে আসা যাক নব্বই পরবর্তী দশকে। লিটল ম্যাগাজিন কিংবা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত কবিতার বই কোথা থেকে কিনব? পাতিরাম। না, সে বিশ্বায়নের ফসল নয়। বরং অনেক আগে থেকেই ছড়িয়ে রয়েছে তার বয়সের গাছপাথর। সে–ই দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছিল মফস্সলের কোনো তরুণের ছিপছিপে কবিতাপুস্তিকা সংগ্রহের নির্বিকল্প ক্ষেত্র। কিন্তু নানাবিধ সমস্যা এখানেও। ফলে গত বছর কয়েকে কলেজস্ট্রিটের ধ্যানবিন্দু পরিস্থিতির কিছুটা সুরাহা করলেও, রোগাপাতলা কবিতা পত্রিকা, ফোল্ডার কিংবা এক–দু–ফর্মা কবিতাপুস্তিকার সুস্থ বিপণনক্ষেত্রটি এখনও শহর কি মফস্সলের লিটল ম্যাগাজিন মেলা অথবা বইমেলা। সরকারি লিটল ম্যাগাজিন মেলা কলকাতাকে কেন্দ্র করে চলছে প্রায় দু–দশক। সম্প্রতি মেলাটি নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বর থেকে রবীন্দ্র–ওকাকুরা ভবনে স্থানান্তরিত করার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ উঠল, একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, অন্যান্য কারণের সঙ্গে এই সূক্ষ্ম কারণটিও সেখানে জড়িয়ে— নন্দন–রবীন্দ্রসদন চত্বরটি কলকাতার এমন প্রান্তে অবস্থিত, যেখান থেকে শিয়ালদহ কিংবা হাওড়া চলে যেতে অসুবিধে হয় না, তাই মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া কি উত্তরবঙ্গ থেকে আসা মানুষজন এই মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত বইগুলিরও যথার্থ বিপণন হয়। এবং লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনার একটি বড়ো অংশই যেহেতু কবিতা প্রকাশনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তাই কবিতার বিপণনের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা খাটে।
এ নিয়ে যে খুব বেশি চর্চা হতে দেখা যায় না, তা আগেই বলেছি। কেউ কেউ ভেবেছেন, তাঁদের মধ্যে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত একজন। এক জনই। ‘কেউ কেউ’, এ–কথা বললেও মণীন্দ্র গুপ্ত ছাড়া আর কোনো কবি–সম্পাদকের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তাঁর বিভিন্ন লেখালিখি, সাক্ষাৎকারে তিনি শুনিয়েছেন, লিখেছেন কবিতাবইনির্মাণ, প্রকাশনা ও বিপণনের কথা। জুন, ১৯৯১–এ প্রকাশিত চাঁদের ওপিঠে গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত বইয়ের বিরুদ্ধে জিহাদ প্রবন্ধে মণীন্দ্রবাবু লিখছেন: ‘পাঠক হিসেবে অনেক দিন ধরে মনে একটা ক্ষোভ জমেছে— বার বার মনে হয়, প্রতারিত হচ্ছি। সারা পৃথিবী ভরে পুস্তকশিল্পের মালিকেরা একদল লোক পুষে রেখেছে, যাদের কাজ হচ্ছে বই তৈরি করা, আর তার বাজার বানিয়ে বিক্রি করা। এরা সবাই সংগঠিতভাবে ঠকাচ্ছে আমাদের। তবে না জেনে ঠকাচ্ছেন মুদ্রণকর্মীরা, দপ্তরীরা, বিপণন–কর্মীরা; আর জেনে ঠকাচ্ছেন প্রকাশন সংস্থার মালিক, উপদেষ্টা, প্রচার কর্তা।’ স্পষ্টতই বাংলা কবিতার সীমাবদ্ধ জগৎ সম্পর্কে এ–মন্তব্য নয়। তবুও বই ব্যাবসার সামগ্রিক পরিসর সম্পর্কে মণীন্দ্রবাবুর এই বক্তব্য কি কোনোভাবে বাংলা কবিতার প্রকাশনাজগৎকেও ছুঁয়ে থাকে না? যখন এমন খবর ভেসে বেড়ায়, রয়ালটি সংক্রান্ত কারণে কোনো কবিকে এড়িয়ে যাচ্ছেন প্রকাশক কিংবা গোপন হচ্ছে মুদ্রণসংখ্যার হিসেব কিংবা প্রকাশককে কথা দেওয়া সত্ত্বেও একই সময়ে অন্য কোনো প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে বইটি— তখন আত্মপ্রকাশ ও বিপণনের ক্ষেত্রটি কলঙ্কিত হয় বই কী! আর ‘বিপণন’ কথাটিকে এখানে শুধু আক্ষরিক লেনদেন অর্থে না ধরে যদি বাংলা কবিতা–বাজারের ক্ষুদ্র পরিসরে ভেবে দেখি, তাহলে বুঝতে পারি, বিপণন শুধু একটি বই বিক্রি বা সেই বই কোথায় পৌঁছোল, তাকে ঘিরে নয়। অমুকচন্দ্রের বই বেরোল, তা হাতে নিয়ে পোজ দিলেন তমুকচন্দ্র, সে নাহয় দিতেই পারেন— বিষয়টি হচ্ছে, পোড়–খাওয়া যিনি বইটি হাতে তুলছেন, যদি তার সেই তুলে ধরার নেপথ্যে থাকে আন্তরিকতা, স্নেহ, ভালোবাসা— তাহলে অন্য কথা। কিন্তু এই ‘স্নেহ’ যে অধিকাংশ সময়েই নিম্নগামী হয়ে পড়ে! তখন আমি, যে–আমি কোনো একটি বইকে তুলে ধরলে নির্দ্বিধায় কিছু মানুষ তাকে গুরুত্ব দেবেই, সে–আমিকে তার দায়িত্বটি যথাযথ পালন করতে হবে। না হলে বাঁদরকেও শিব বলতে বলতে, তা–ই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে। অবশ্য তাতেও ক্ষতি কিছু নেই। কেননা যদি একজন পাঠক একটি গ্রন্থকে পড়বেন কি পড়বেন না, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও কোনো প্রচার বা বিপণন ব্যবস্থা দ্বারা চালিত হন, তবে তার আগে ‘সহৃদয়’ শব্দটি কদাচ বসবে না।

এমনই এক পরিস্থিতির কথা আমরা জানতে পারি জয় গোস্বামীর কলাম রানাঘাট লোকাল–এর সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা নিবন্ধ সূত্রে। ২০১৬–র জুলাই মাসে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদ প্রতিদিন–এর রোববার–এ। এমনিতেই জয়ের অকপট স্বীকারোক্তি তাঁর গদ্যকে অসম্ভব অনুভূতিবেদ্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এই রচনাও কোনোভাবেই তার ব্যতিক্রম নয়। জয় যে–কথা ওখানে বলেছেন, তাকে প্রকাশ্য লেখায় তো দূর, অতি ব্যক্তিগত পরিসরেও চট করে কেউ বলতে পারে না। জয় শুরুতেই বলছেন, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা, জেনে বা না জেনে তাতে জড়িয়ে পড়ার কথা। এরপর নিজের প্রতি চরম নির্মম হয়ে জয় লিখছেন: ‘আমি কি দুর্নীতি করিনি? হ্যাঁ, জেনে বুঝে? করেছি কি? আমার ক্ষেত্র কতটুকু? কবিতাসংসার। তাতে আর্থিক দুর্নীতি সম্ভব কি? অন্যের ক্ষেত্রে সম্ভব কি না জানি না— অন্তত আমার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। এই বছরই, জানুয়ারি মাসে।’ এবং এরপর আরও অকপট হয়ে সেই কাহিনি পাঠকের সামনে আনতে থাকেন। অচেনা এক সফল ব্যবসায়ী ও কবিতাপ্রয়াসী যুবক জয়কে তাঁর কবিতার বই উদ্বোধন করতে প্রেস ক্লাবে ডাকেন, এবং জাঁকজমক সহকারে সেই বইটির উদ্বোধন হয়। এরপর কবি যখন বইটি উদ্বোধন করে ওই কবিযশঃপ্রার্থী ‘ভদ্র, চল্লিশ উত্তীর্ণ’ ব্যক্তির কবিতা ও বই সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলে ফিরে এসে গাড়িতে উঠছেন, তখন ওই ব্যক্তি এগিয়ে এসে পূর্বনির্ধারিত কথানুযায়ী দশ হাজার টাকার খাম দিয়ে যান। যা ওই যুবকের ভাষায় ছিল ‘সম্মানদক্ষিণা’। এখন, জয়ের কোন বিষয়টি বেশি খারাপ লেগেছিল, সেটাও লেখাটি পড়লে আন্দাজ করতে পারা যায়। প্রথমত, ওই ব্যক্তির একটিও লেখা না পড়ে, তার কবিতার বই উদ্বোধনে রাজি হওয়া। দ্বিতীয়ত, ওই ব্যক্তির কবিতা সম্পর্কে ‘সবই ভাল ভাল কথা’ বলা। তৃতীয়ত, ওই ব্যক্তির কাছ থেকে পূর্বনির্ধারিত শর্তানুযায়ী দশ হাজার টাকা পাওয়া। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রথম দু–টি কাজ জয়ের করতে ভালো না লাগলেও নানা কারণে অতীতে তাঁকে করতে হয়েছে। চাইতে বা না চাইতে। এই অনুষ্ঠানটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে বেশি বিদ্ধ করেছে তৃতীয় কারণটি, অর্থাৎ দশ হাজার টাকা নেওয়া। সেই মনোদুঃখ থেকে জয় এরপর লিখছেন: ‘কবি শব্দটা আমার নাম ঘোষণা করার আগে যে–কোনও সভায় বলা হয়। কবি জয় গোস্বামী। সেই কবিতার বই উন্মোচনের আগেও বলা হয়েছিল। তারপরই আমার সাদা পাঞ্জাবি–পাজামা পরা চেহারাটি উঠে দাঁড়ায় বইটি হাতে ধরে। ‘কবি’ শব্দটি আমার নামের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত নয়, তা বুঝতে পারি, নিজের কবিতা পড়ে। কিন্তু, নৈতিকভাবেও আর এই শব্দটির সঙ্গে, কবিতা রচনা কাজটির সঙ্গে যুক্ত থাকার অধিকার আমি সেদিন হারালাম।’ দু–টি বিষয় লক্ষণীয়— এক, সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি যেন কবির বা যেকোনো বাঙালি ব্যক্তিত্বের সততার ব্র্যান্ড আর্কেটাইপ। যা সেই দিন কালিমালিপ্ত হল। এবং দুই, সেই কারণে ‘নৈতিকভাবে’ ‘কবি’ নামধারী উচ্চতা থেকে তিনি স্খলিত হলেন।
জয়ের জন্ম ১৯৫৪ সালে। বাবা ছিলেন আদর্শবান রাজনৈতিক কর্মী। মা স্কুলশিক্ষিকা। যে পারিবারিক ও চারিত্রিক আদর্শবোধের পাঠে ষাট–সত্তরের দিনগুলিতে বড়ো হয়েছিলেন জয়, খুব স্বাভাবিকভাবেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মূল্যবোধ তাঁর জীবনের মধ্যেও ছিল নিয়ত ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ, যতই ২০১৬ সালে দাঁড়িয়ে কবি এই নির্মম স্বীকারোক্তিটি করে থাকুন, এই স্বীকারোক্তিকরণের পশ্চাতে কিন্তু রয়ে গিয়েছে সত্তর–আশির দশকের মূল্যবোধের শেকড়টুকু, যাকে আঁকড়ে ধরে একজন মানুষ বেঁচে থাকেন। জীবনে সাফল্যের শিখরে উঠেও যাকে ঝেড়ে ফেলেন না। এবার এই সমস্ত কথা আলোচনার পর ওই নিবন্ধের সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ের এক কবির মত শুনে নেব। শ্রীজাত। ওটি প্রকাশিত হওয়ার দিন কয়েক পর, ১৬ জুলাই ২০১৬–র একটি ফেসবুক পোস্টে জয়ের কলামটির প্রতি অনুরাগের কথা জানিয়ে শ্রীজাত তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। লক্ষ করতে হবে, জয়ের থেকে পৃথক সময়বৃত্তে জন্মানো ও বেড়ে–ওঠা এক তরুণ কবি একই বিষয়কে কীভাবে অন্য আতশকাচে দেখছেন। এ–দৃষ্টি শুধু নব্বই দশকের এক কবিরই নয়, বিশ্বায়িত বাংলার এক মাল্টিডাইমেনশনাল সমাজ ব্যবস্থার প্রতিনিধিরও। সেই অবস্থান থেকে, শ্রীজাত ওই একই পরিস্থিতির সাপেক্ষে নিজের যে–মনোভঙ্গি ব্যক্ত করেন, তা তাঁর থেকে প্রায় দু–দশক আগে জন্মানো এক অন্য সমাজ পরিসরে বেড়ে–ওঠা জয় গোস্বামীর পক্ষে মেনে নেওয়া, অন্তত পুরোটা, একটু কঠিন তো বটেই। অথচ যুক্তিবোধের খাতিরে শ্রীজাতর প্রস্তাবনাও কাবিল–এ–তারিফ। শ্রীজাতর মতে, ‘তাঁকে (জয়কে) অনেক বেশি বিচলিত করেছে ওই আর্থিক লেনদেন, কারণ কবিতার মধ্যে কোথাও বাজার ঢুকে পড়েছে। আর সেখানেই নিজেকে কলুষিত মনে হচ্ছে তাঁর।’ এ কারণেই জয় নিজে ‘সম্মানদক্ষিণা’ কথাটিকে নামিয়ে আনছেন ‘ঘুষ’-এ। এবং এইখানেই শ্রীজাতর ভাষ্য জয়কে ডিফার করে জানাচ্ছে: ‘বিজ্ঞাপনী পরিভাষায় ‘ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্ট’ বলে একটা কথা চালু আছে বহুদিন। সোজা কথায়, অর্থের বিনিময়ে কোনও পণ্যের বিপণন করা, সেই পণ্যটিকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাজারে, ক্রেতাদের সামনে পৌঁছে দেওয়া। সাধারণত বিখ্যাত মানুষজনকে দিয়েই এ ধরনের বিপণন করানো হয়ে থাকে, সমাজে দশজনের কাছে যার মান্যতা আছে। …সাহিত্যগুণকে আলাদা করে রেখে দেখতে পারলে, বাজারে আসার পর বইও একটি পণ্য এবং তারও বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে, একটি কাব্যগ্রন্থের এন্ডোর্সমেন্টের জন্য একজন কালজয়ী কবির চাইতে ভাল অ্যাম্বাসাডর আর কেই–বা হতে পারেন?’ খুব স্পষ্টভাবেই শ্রীজাত বলেন, এর জন্য অর্থপ্রাপ্তিতেও কোনো অসম্মানের কিছু নেই। বরং একজন অভিনেতা, গায়ক কিংবা খেলোয়াড় অর্থ নেবেন, এবং কবির ভাগ্যে জুটবে শুধু ফুলের তোড়া আর মিষ্টি— এ–তত্ত্বে তিনি নারাজ। তাঁর মতে, ‘প্রতিষ্ঠিত কবিরাও, হ্যাঁ, মানবজাতির অংশ এবং বাজারের বাইরে নন। পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক তাঁদের প্রাপ্য।’ নিজস্ব মূল্যবোধে নির্ভর করে বিশ্বায়ন পূর্ববর্তী সময়ে জাত এক কবির যে–কাজ করে অপরাধবোধ জন্মায়, তা–ই আবার স্বাভাবিক এবং সমর্থনযোগ্য হয়ে ওঠে বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ের এক কবির যৌক্তিক মূল্যবোধে।

কবিতার বিপণনের আরেক প্রসঙ্গে আসি। পঞ্চাশের দশকে কৃত্তিবাসি কবিদের চরণ ও চারণা কবিতা পাঠকের কাছে এবং পরবর্তী সময়ে লিখতে–আসা তরুণদের কাছে নিঃসন্দেহে আকর্ষণের বিষয়। যাঁদের লেখা এত ভালোবাসি, জানব না তাঁদের জীবনের কোনো কোনো ঘটনা? কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে উঠে এসেছে এইসব দুরন্ত কবিতা! এতে তো ক্ষতি নেই। সমস্যা অন্য কোনোখানে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পড়তে বসে সমান্তরালে উঠে আসে তাঁর জীবনের নানা ঘটনাবহুল উপাখ্যান। এগুলিই আবার বঙ্গীয় কবিতাপ্রেমীর দল ‘মিথ’-এ পরিণত করেন এবং অজ্ঞাতে কখন সেই জীবনটাই হয়ে ওঠে ব্র্যান্ড–শক্তির বিপণন। শক্তি কোথায় যেতেন, কীভাবে পান করতেন, এসব তার কবিতাকে অতিক্রম করে কখনো সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন দেখা যায়, তাঁর সেই নিজস্ব জীবনভঙ্গি নকল করতে গিয়ে কবিতার ক্ষেত্রে ঝরে যায় পরবর্তী সময়ের কোনো কবি। আবার সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্ষেত্রটি বদলে গিয়েছে। পুরোটাই চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। এখানে আপনি পাবেন একজন কবির ‘নিভৃত’ কবিতাযাপনের মুহূর্ত, তাঁর ‘নিভৃত’ অবকাশযাপন, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে ‘নিভৃত’ ঘুরে বেড়ানো, কোনো অগ্রজ কবির সান্নিধ্যে কাটানো বিরল ‘নিভৃত’ মুহূর্ত। এমনকী আনন্দে আইসক্রিম চিবোনো বা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার ছবিও পাবেন! এবার এসব থেকে ‘নিভৃত’ শব্দটি সানন্দে ডিলিট করে দিন। এবং দেখুন, নিভৃতির আড়াল সরিয়ে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে কীভাবে কবিতার বিপণন গড়ে উঠছে নির্দ্বিধায়। সমস্ত ব্যক্তিগত পরিসর সরিয়ে কবি এবং পাঠকের মনন এসে একত্রে জড়ো হয়েছে এই সামাজিক দেওয়ালে।
ইন্টারনেট বা ফেসবুক নিঃসন্দেহে বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য বিপণনমাধ্যম। ব্যানার–ফেস্টুন যা পারে না, ফেসবুক তা ছড়িয়ে দেয়। মুখে মুখে যে–খবর ছড়িয়ে পড়ত, তা–ও আর তেমন ছড়ায় না, কারণ মুখগুলোর গতিবিধিই অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। সে–কারণেই এই ভার্চুয়াল দেওয়াল নিয়ে এসেছে প্রকৃত অর্থেই বিপ্লব। বিপণনের পদ্ধতিটি হয়ে উঠেছে অনেক সহজ। স্থানিক দূরত্বের সমস্যা আর কোনো সমস্যাই নয়। শুধু দেখার বিষয়টি হল, কোনটি বিপণন, আর কোনটি নিছক আত্মপ্রচার। প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাই মানুষের কাছে আজ সবচেয়ে বড়ো সংযমের বিষয়। কেননা কর্মজগতের, কর্ম–বাজারের যে কম্পিউটার–সংস্কৃতি আছড়ে পড়েছিল এ–বঙ্গভূমে নয়ের দশকে, তা আজ ফুলেফেঁপে স্মার্টফোনে ব্যাপৃত। অ্যানড্রয়েড আসবার পর এবং অম্বানি গোষ্ঠীর ‘জিও’ পরিষেবায় প্রায় সর্বস্তরের মানুষই এখন ‘নেট’-মুখী। ‘চোখে দেখা’ ও ‘কানে শোনা’-র এই অতীব লাভজনক, সুখকর মাধ্যমটি সে কোনোভাবেই এড়িয়ে থাকতে পারছে না। রাস্তায়, ঘরে, কর্মক্ষেত্রে— সব জায়গাতেই ভার্চুয়াল অস্তিত্বের অমোঘ উপস্থিতি তৈরি হয় কৃত্রিম অভিজ্ঞানে। ক্রমাগত এই টেক–স্যাভি মনন গড়ে তুলছে এমন এক অন্তর্জাল ব্যবস্থা, যেখানে তথ্য ও জ্ঞানের সহাবস্থানে, বিশ্বায়িত যোগাযোগে, উপস্থিতির মোড়কটিই পরিবর্তিত হচ্ছে বিপণনে। অন্যকে জানানোর যে–ইচ্ছা আগে শারীরিক ও মানসিক দেখাশুনো এবং ধাপে ধাপে গড়ে–ওঠা বোধের ওপর নির্ভর করে নির্মিত হত, আজ তার মধ্যে এসেছে জনপ্রিয় হওয়ার বাসনা। আমাকে তখনই সকলে মনে রাখবে, যখন আমি ক্রমাগত নিজেকে দেখিয়ে যাব। এভাবেই একটি প্রকাশনসংস্থার বিপণনপদ্ধতির সঙ্গে কত সহজেই এক হয়ে যায় কোনো কবির প্রোফাইলে নিজের মুখের বা ছবির বদলে তার বই–এর ইমেজ তুলে ধরার পদ্ধতি। অস্থির মন সবরকম ব্যস্ততার মধ্যেও একটি আঙুলের স্পর্শে পেতে চাইছে সফ্টওয়্যারের সফ্ট কর্নারটুকু। তার এই ব্যাকুল চাওয়ার সঙ্গেই নির্বিচারে সংক্রমিত হচ্ছে ব্যক্তি–সত্তা–বস্তুর বিপণন।
তবে এরও যুগে যুগে বিবর্তন আছে। চাঁদের ওপিঠে গ্রন্থের ‘কে থাকবে, কে যাবে?’ নামাঙ্কিত রচনায় মণীন্দ্র গুপ্ত লিখছেন: ‘প্রচার যদি শুধু কবিতারই হত তবে তাতে তেমন দোষ ছিল না। কিন্তু এখন প্রচার মানে আত্মপ্রচার— শেষ পর্যন্ত আত্মবিজ্ঞাপন, আত্মপ্রদর্শনী। কবিদের অদ্ভুত পোশাক, ন্যাকা কথা, বাঁকা কথা, মাতালের ভান ইত্যাদি ওই রোগটির উপসর্গ।’ রচনাকাল ১৯৮৬, অর্থাৎ তখনও বিশ্বায়ন আসেনি। এর ঠিক তিরিশ বছর পরে, ২০১৬–র জানুয়ারিতে একটি সাক্ষাৎকারে যশোধরা রায়চৌধুরী বলছেন: ‘এই আজকেই দেখলাম ফেসবুকে, একজন একজনকে লিখেছেন যে, আপনাকে দেখে তো কবি মনে হয় না। মেরি কমের মতো সেজেছেন। তার মানে এখন একজন বক্সার আর একজন কবিকে আলাদা করে চেনা যাবে না। অথচ এক সময়ে কবি মানে ছিল লম্বা লম্বা চুল। উসকো খুসকো চুল দিয়ে কবি চিনতাম আমরা। বা রঙিন পাঞ্জাবি পরলে কবি চিনতাম। কিন্তু এটা আজকাল আর করা যাবে না। একটা ছেলে যে আইটিতে কাজ করে আর একটা কবি দুজনের চেহারা পুরো এক। দুজনেই পিঠে একটা রুকস্যাক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই যে জিনিসটা এই জিনিসটা তো এসময়ের বৈশিষ্ট্য।’ তিরিশ বছরে পরিবর্তিত হয়েছে আর–পাঁচটা বিষয়ের মতোই, সংস্কৃতিজগতের দেখনদারির মনোভঙ্গি। তবু, একটু অন্যভাবে হলেও কি মণীন্দ্র গুপ্ত এবং যশোধরা রায়চৌধুরীর বয়ানে আমরা দেখতে পাই না একই জিনিসের পুনরাবৃত্ত রূপ? ‘বিপণন’ নেহাতই একটি অর্থনীতির শব্দ এবং কোনো বস্তুকে আশ্রয় করেই শব্দটি তাৎপর্য পেতে পারে। যদি ধরে নিই কবিতাই সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রোডাক্ট, তাহলে একটু থামতে হয়, মনে করতে হয় একটি কবিতাকে ঘিরে আছে আরও অনেক কবিতা, আরও অনেক কবিতাকে ঘিরে একটি বই এবং সবার উপরে দীপ্যমান সেই কবির ব্যক্তিত্ব, কৃতকর্ম— এসব মিলিয়ে আজ কবিতার বিপণন কি কোনো পারফর্মিং আর্টের থেকে কম? ভোগবাদ এখন আইটি সেক্টর আর কাব্যজীবনের বিপরীত গোলার্ধকে টেনে–হিঁচড়ে এক করে দিয়েছে। কবির জীবন শুধু তাই আর বীজের জীবন না থেকে, হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপিত জীবন। সেখানে কবিও বিপণনের এক অনিবার্য, নির্বিকল্প বস্তু–বিশেষ।

বিপণনের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলা কবিতার সম্পর্ক নিঃসন্দেহে প্রাচীন। এমন নয় যে, বিশ্বায়ন আসবার পরই কবি–কবিতার সঙ্গে তার বিলিব্যবস্থার যোগাযোগ হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ থেকে শুরু করে নব্বইটিরও বেশি পণ্যকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। এ–প্রসঙ্গে স্বপন চক্রবর্তী তাঁর একটি সাম্প্রতিক রচনায় (যাহা ভনে ভ্যানো–কবি) বলছেন, সেই তালিকার মধ্যে ছিল ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়াম, ভোলানাথ দত্তের কাগজ, জলযোগের মিষ্টি, শ্রীঘৃত, কুন্তলীন তেল… এত কিছু! আবার বাঙালি কবিদের মধ্যে কখনো–বা বিজ্ঞাপনের কপি লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ‘মনে করো, জুতো হাঁটছে, পা রয়েছে স্থির’— এই পঙ্ক্তিটি বাটা কোম্পানি ব্যবহার করায় নিশ্চয়ই তা জনমানসে তার আবেদন তৈরি করেছিল। আজকের দিনেও জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন–এর এই বিশেষ পংক্তিটি, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ কত সহজেই হয়ে ওঠে তেলের বিজ্ঞাপন। জীবনানন্দের কবিতার ইতিহাসচেতনা চটকে ঘন চুল পাওয়ার অবচেতন আকাঙ্ক্ষায় দৈনিকের প্রথম পাতায় অনায়াসে জায়গা করে নেয়। এমন তো নয়, ওই পংক্তিটি পড়ে লোকজন বনলতা সেন কিনতে ছুটবেন! এমন তো হয়নি, বাটার দোকান থেকে বেরিয়ে কেউ সোনার মাছি খুন করেছি খোঁজ করেছে! কবিতার কোনো বিপণন স্বাভাবিকভাবেই এতে হয় না। কেননা কবিতা এখানে কবিতাই নয়, পংক্তি এখানে পংক্তি নয়। একটি ক্যাচলাইন মাত্র। আর কবিতার যে–সমস্ত নন–রিডাররা এই জুতো কিংবা তেল কেনার সময় চমৎকৃত হয়ে বা অবজ্ঞাভরে বাংলা কবিতার দু–টি চিরস্থায়ী পংক্তিটি পড়বেন, প্রোডাক্টটি হস্তগত হলেই সুদূর তেলেনাপোতার মতো পংক্তিগুলি তাঁদের স্মৃতিপট থেকে উধাও হয়ে যাবে। হেমেন্দ্রমোহন বসু, কুন্তলীন–এর কর্ণধার, সাহিত্যিকদের মেধা ব্যবসায় লাগিয়েছিলেন বেশ সুকৌশলে। ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার পাওয়ার শর্ত একটাই ছিল, পুরস্কার পেতে গেলে গল্পে কুন্তলীন তেলের ব্যবহার থাকতেই হবে। শরৎচন্দ্র পর্যন্ত এই পুরস্কার জিতেছিলেন। পূর্বোক্ত রচনাটিতে স্বপন চক্রবর্তী লিখছেন, ‘বাণিজ্যের না হয় কবিতাকে দরকার, কবিতার কি দরকার আজকের দুনিয়াজোড়া পণ্যরতির?’ নিশ্চিতভাবে এর উত্তর, না। কবিতারও যেমন দরকার নেই, বাণিজ্যেরও বোধ হয় নেই। কুন্তলীন বা বাটা, কিংবা হালের কেওকার্পিনের বিজ্ঞাপন নেহাতই ব্যতিক্রম। বৃহত্তর বিপণনের ক্ষেত্রে কবিতার কোনো ব্র্যান্ড ভ্যালুই নেই। সাহিত্য প্রকরণের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন হয়েও এ–বিষয়ে তার চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে যায় নাটক, ছোটোগল্প অথবা উপন্যাস, তাদের যোগাযোগনিপুণতার জন্যে। তাহলে কি কবিতার যোগাযোগনিপুণতা নেই? এই কূটপ্রশ্নের উত্তরে একটা কথাই বলা যায়, কবিতাই হয়তো একমাত্র সেই শিল্পমাধ্যম, যার মধ্যে কোনো বাণিজ্যিকতা চলে না। এমনিতেই সাহিত্য–আঙিনায় এর বাজার ছোটো। উপরন্তু কবিতাকে জনমুখী করে তোলার বাণিজ্যে নামতে গেলে অনেকসময়ই দেখা যায় লেখা উত্তীর্ণ হচ্ছে না। নিম্নমেধার এবং মধ্যমেধার পাঠক সেই সমস্ত লেখা নিয়ে হইচই করলেও, কখনোই তা উৎকৃষ্ট শিল্প হয়ে ওঠে না। এ কারণেই পাগলী তোমার সঙ্গে হিট। বাজারসফল। অর্থাৎ এই লেখা যদি কাল–কে অতিক্রম করতে চায়, তাহলে তাকে তার বাজারভিত্তিক উপযোগিতার ওপর নির্ভর করেই করতে হবে। একে নিয়ে নামিদামি শিল্পীরা আবৃত্তি করবেন। ব্যবহার করবেন এই কবিতার মধ্যে থাকা পপুলিস্ট ইমেজগুলোকে। অথচ সূর্য–পোড়া ছাই নিয়ে তাঁদের মধ্যে এ–উৎসাহ দেখা যাবে না। ‘না–পড়া বিদ্যুৎশাস্ত্র হাতে / ক্রীতদাস চলে যায় কারাগার হারাতে হারাতে…’— এ তাঁদের বাজারে এঁটে ওঠার পক্ষে খুব–একটা সুবিধেজনক নয়। কোন কবিতা কালজয়ী হবে, প্রকৃতপক্ষে এ–সিদ্ধান্ত সময়ের। কোনো বিপণনপদ্ধতি একে তাৎক্ষণিক চিহ্ন দিলেও শাশ্বত চিহ্ন এঁকে দিতে পারে না।

আবার বিপণন কখন কবিতাকে ছাপিয়ে যায়? যখন শুধু লেখকের নামেই বই কাটে। এর সঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে পাঠকসত্তার অটুট ভরসা, তেমনি ‘অমুকচন্দ্র তমুক’ ব্র্যান্ড–নামের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। উনি খারাপ লিখতেই পারেন না— এই গোঁড়া বিশ্বাস থেকে অনেকসময়ই একজন নামি লেখকের দুর্বল লেখাও ‘শক্তিশালী’ বলে চিহ্নিত হয়ে যায়, অপরদিকে কোনো উদীয়মান তরুণকে সম্ভাবনাপূর্ণ রচনা নির্মাণ করেও শুনতে হয়, ‘তেমন হয়নি’।
তবে এই পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে ব্লগ, ব্লগজিন, ওয়েবজিন, ফেসবুক ইত্যাদি আসার ফলে। ভালো–ম¨ দুই দিকই আছে। প্রথমত, নেট–দুনিয়া সুপার কমিউনিকেটিভ। এমনকী যাঁরা স্বভাবলাজুক, তাঁরাও নির্দ্বিধায় একটি কবিতা পোস্ট করে দিচ্ছেন বা তাঁর বই সম্পর্কে বন্ধুদের জানাচ্ছেন। বন্ধুদের ভার্চুয়াল উষ্ণতা তাঁকে ‘তেমন হয়নি’-র নিরুত্তাপ উদাসীনতা থেকে যেমন মুক্ত করছে, তেমনি অকারণ উল্লাসে প্লাবিতও করে দিচ্ছে থেকে থেকে। যেহেতু দুনিয়াটা ভার্চুয়াল, তাই এর কোনো বাস্তবতাই প্রকৃত বাস্তবতা নয়। সবই প্রতিচ্ছবি। প্রতিরূপ। কোনো উৎসাহের গভীরে হয়তো আত্মগোপন করে আছে চূড়ান্ত নিস্পৃহতা। আমরা বুঝতেই পারছি না। কিংবা, বুঝতে চাইছি না। যোগাযোগপ্রণালীর ক্ষেত্রে ইন্টারনেট যেমন বিপ্লব এনে দিয়েছে, তেমনি জঞ্জালে ভরিয়ে দিয়েছে মানুষের ভাবজগৎকে। ‘ভাবার প্র্যাকটিস’ তাই এই অতিতথ্যের আক্রমণ–ভারাক্রান্ত যুগে প্রয়োজনহীন।
সম্প্রতি আশীষ লাহিড়ীর সংßৃñতির বাংলা বাজার বইটি পড়ছিলাম, সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখছেন— ‘মার্ক্স বলেছিলেন যে মিল্টন ‘প্যারাডাইস লস্ট’ লিখে পাঁচ পাউন্ড পেয়েছিলেন, কেননা তখনকার বাজারি মাপে ঐ কবিতার দাম ওর চেয়ে বেশি ছিল না। অথচ ঐ কবিতা না লিখে তাঁর উপায়ও ছিল না, কারণ একজন কবি কবিতা লেখে ঠিক সেই কারণেই যে–কারণে একটি মাকড়সা জাল বোনে। অর্থাৎ কবিতা না লিখে একজন কবির উপায় নেই, ওটাই তাঁর ‘কাজ’, তাঁর ‘স্বধর্ম’। তাঁর মস্তিষ্ক সেইভাবেই ‘প্রোগ্রামিত’। সুতরাং একমাত্র কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই তিনি মানবিক সার্থকতায় পৌঁছতে পারেন, দূর করতে পারেন সামাজিক অস্তিত্বের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অস্তিত্বের অনন্বয়; বলতে পারেন তাঁর নিজের কথা, ভাবতে পারেন তাঁর নিজের ভাবনা— বাজার তা নিয়ে কী ভাবল, না ভাবল তার পরোয়া না করে।’ (ভাবা না–ভাবার প্রযুক্তি) এই পরোয়া না–করবার মনের অবস্থা কবি কীভাবে পাবেন, যদি সেই অবস্থায় পৌঁছোনোর পথটাই অবলুপ্ত হয়ে যায়? যদি তাঁর মন সর্বদাই, বেঁচে থাকার প্রতিটি সামান্য ও অসামান্য গ্রন্থিতে বিপণনদর্শনের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে থাকে? অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন: ‘হাটের ধুলা সয় না যে আর, কাতর করে প্রাণ।’ বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন: ‘তবে এই হাটে আমি নিজে কিছু বেচিনি কখনো।’ শুধু হাটের ‘ধুলা’ নয়, সমগ্র হাটটিই এসে এখন চেপে বসেছে ঘাড়ের ওপর। বেচতে যেন আপনাকে হবেই!
শেষবেলায় এ–কথা মনে হতেই পারে, বাংলা কবিতার বিপণন নিয়ে আলোচনায় কবি, কবিতা লেখা, ব্যক্তিত্বের মিথ, কবির মন, পাঠকের মন, প্রযুক্তি— এতরকম দিগ্বিদিক উঠে আসছে কেন? জবাবে একটাই কথা বলবার, বিপণন বিষয়টি কেবল কবিতার বই ছাপা ও দোকানে দোকানে গিয়ে তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তির মন ও তার স্থানিক–
কালিক মনান্তর বিষয়টাকে নানা দিক থেকে ঘনিয়ে তুলেছে। যদি বাংলা কবিতার বিপণনের বাস্তব বর্তমান চরিত্রটি, মানে, বুদ্ধদেব বসু যাকে বলেছিলেন ‘বিলি–ব্যবস্থা’— সেদিক থেকে দেখা যায়, এককথায় তার পরিস্থিতির কথা চুকে যায়। কেননা পরিপ্রেক্ষিতটি খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়েও। বাংলা কবিতার পরিসর যেন একান্তভাবে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে এ–কথাই বলতে চেয়েছে— উৎকর্ষ বিপণনের এক ও একমাত্র মাপকাঠি। আদি–অকৃত্রিম চাহিদায় যখন কোনো ধীমান কবিতা পাঠক আগ্রাসী হয়ে সস্তা ও জনপ্রিয় বইগুলির মধ্যে থেকেই তুলে নেবেন তাঁর বহুকাঙ্ক্ষিত কবিতাবইটি— সেখানেই থাকবে বিপণন ব্যবস্থার ব্যর্থতা, থাকবে বিপণন ব্যবস্থার সার্থকতাও।
ঋণস্বীকার
প্রতিক্ষণ, একক মাত্রা এবং সংবাদ প্রতিদিন–এর রোববার পত্রিকার কয়েকটি নিবন্ধ এ–রচনায় সাহায্য করেছে। এ ছাড়া তিন বন্দ্যোপাধ্যায়— রঞ্জন, অভীক ও শুভ–র সঙ্গে কথা বলে বিশেষ উপকৃত হয়েছি।
বোধশব্দ, কবিতার বিপণন, ২০১৮
(পুনঃপ্রকাশ)
*ওয়েব পাঠকের সুবিধার্থে মূল লেখাটিএ সঙ্গে কিছু প্রাসঙ্গিক ছবি যোগ করা হল।
ছবি সৌজন্য: বোধশব্দ পত্রিকা, Wikipedia
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।