শঙ্খ ঘোষ

Sankhya Ghoshপ্রথম যখন পড়েছিলাম সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এরকম একটা লাইন: ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে / ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী’—আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটা মুগ্ধতার আবেশ তৈরি হয়েছিল তখন কিন্তু প্রথম রচনার প্রায় দুদশক পরে সকলেই আমরা আহত হয়েছিলাম যখন দেখি লাইনটি পালটে গিয়ে হয়েছে—‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে / বাসা বেঁধেছিল সাতটি অমরাবতীকে ঘটাল এই বদল? নিশ্চয় সুধীন্দ্রনাথ নিজে? কেননা তাঁর লেখায় তো আগেই পড়েছি, ‘উড়ে চলে গেছেশব্দ তিনটিউড্ডীনহতে পেরেছিল সাত দিনের চেষ্টায় কবিতালেখা যে নিরন্তর এক পরিশ্রমের কাজ, এই শর্তটাকে কত বারই প্রতিভাত করেছিলেন তিনি, সেই তথ্য আমরা জানি কিন্তু আমরা তখন অনেকেই কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততাকে ভালোবাসতে শিখছি উলটোদিকে সুধীন্দ্রনাথ ভাবছেন, কত কঠোর পরিশ্রমের সাধনায় মেলে একটি কবিতা এরকম একটা ধারণা যাঁদের আছে, তাঁদের কাছে এইরকম অপ্রত্যাশিত বদল পছন্দসই লাগেনি জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইতে জীবনানন্দের কয়েকটি কবিতার পাণ্ডুলিপি ছাপা হল যখন, সুধীন্দ্রনাথ তা দেখে ছদ্মহর্ষে বলে উঠেছিলেন—‘স্বতঃস্ফূর্ত কবিতারও এই দশা! আমাকেও কিন্তু এত বেশি কাটাকুটি করতে হয়নি লেখায়

ঠিক ঠিক কোনো তত্ত্বাশ্রয়ে নয়, আমার ব্যক্তিগত ঝোঁক ছিল ওইরকম স্বতঃস্ফূর্ত রচনার দিকে একেবারে  সূচনায় যাসব লিখেছি আমি, তাতে কাটাকুটির কোনো অবকাশ ছিল না তাই কবিতা মুদ্রিত হয়ে যাওয়ার পর, এমনকী তা লিখিত হওয়ার পরেও বদল বড়োএকটা ঘটাইনি বস্তুত, লেখায় বদল ঘটাবার কোনো সুযোগই আমার কাছে ছিল না কেননা তখনকার দিনে আমার একটা অভ্যাস ছিল, যেকোনো কবিতার মানসিক সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর, মনে মনে কয়েক বার বলে গিয়ে যখন মনে হত হয়ে গিয়েছে লেখাটা, মাত্র তখনই তাকে লিখিত রূপে নিয়ে আসতাম

অবশ্য এটাতে প্রমাণ হয় না যে বদল আমি ঘটাচ্ছি না কিছু মনে মনে কয়েক বার বলতে বলতে যখন মনে হত, হয়েছে লেখাটা, তখনই তাকে লিপিবদ্ধ যে করছি, তারও মধ্যে তো একাধিক গ্রহণবর্জনের সুযোগ থাকে এরকমও কি ঘটাইনি কখনো? কখনো কখনো সেরকম ঘটেছে নিশ্চয় কিন্তু স্মৃতিতে বা লিখনে তার কোনো চিহ্ন ধরা নেই অথচ সুধীন্দ্রনাথেরভর করেছিলথেকেবাসা বেঁধেছিল’-তে পৌঁছোনোর মতন বড়ো রকমের একটা বদল থেকে গেছেমুদ্রিত রূপেই—‘কবরনামে আমার সবচেয়ে পুরোনো লেখাটিতে কবিতাটির একেবারে শেষে একটি লাইন ছিল—‘মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে / অস্ত্র গোড়ো, আমায় কোরো ক্ষমাআমার কবিতাসংগ্রহ বা শ্রেষ্ঠ কবিতা লাইনটি আবার ফিরিয়ে এনেছি তার পুরোনো দশায় কিন্তু দিনগুলি রাতগুলি মুদ্রণগুলিতে একএক সংস্করণে এটা রয়ে গেছে সেই পুরোনো রূপেই তার কারণ এই যে, হঠাৎ মনে হয়েছিলমানুষ হবার জন্য যখন’-এর বদলটায় বড়ো বেশি প্রত্যক্ষ হয়ে যাচ্ছে কথাটা তাই বইতে নেওয়ার সময় লাইনটি ওইভাবে পালটে দিয়েছিলাম কিন্তু পরে আবার মনে হল রচনাকালীন সেই সময়টায় যেভাবে লিখেছিলাম, সত্যের খাতিরে সেই রূপটাই তো থাকা উচিত একএক সময় একএক রকমের যুক্তি তৈরি করে লাইনটার এই অদলবদল ঘটছিল কোনটা যে উচিত কাজ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি

দিনগুলি রাতগুলি প্রথম কবিতাটির বিষয়ে নানা জায়গায় আমি বলেছি বা লিখেছি যে ওর একেবারে প্রথমাংশটি লিখবার সময় আমি ভাবছিলাম, লিখছি বা লিখব একটা ডায়েরি কয়েক লাইন এগোবার পর মনে হচ্ছিল যে কবিতাই লিখছি একটা সেডায়েরি বা কবিতায় একেবারে প্রথমাংশের মুদ্রিত রূপে একটি শব্দ বর্জিত আছে কিন্তু ওই লেখাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় ঘোরের মধ্যে আমার জনপাঁচেক বন্ধুকে শুনিয়েছিলাম আজও পর্যন্ত তা যদি মনে মনে বলে যাই (খানিকটা অবিশ্বাস্য হলেও এটা ঘটে যায় কখনো কখনো), তাহলে বর্জিত ওই শব্দটা বর্জন করতে পারি না আমি এখন আমার মনে হয় যে ওই শব্দটি থাকা উচিত ছিল, যদিও তা থাকার কোনো পথ ছিল না

এরকম দুচারটি শব্দের গ্রহণ বা বর্জন কখনো কখনো ঘটেছে, একেবারে প্রথম দিকের কোনো কোনো লেখায় কিন্তু তার তালিকা বেশি বড়ো হবে না তবে কীভাবে এই গ্রহণবর্জন ঘটে তার একটা বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা বলিপতঙ্গনামে একটি কবিতা আছে মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয় বইটিতে মনে মনে সেটা তৈরি হয়ে গেছে ভেবে লিখে ফেললাম কাগজে কিন্তু লিখিত হওয়ার পর মনে হল, হয়নি কিছুই ছিঁড়ে ফেললাম কাগজটা কিন্তু সেই শব্দকটা ছাড়ল না আমায় মনে মনে আবার বলি, ‘এই তো হয়েছে আবার লিখি কিন্তু আবারও মনে হলহয়নি দুচার দিন পরে আবার মনে মনে বলি, ‘আশ্চর্য তো, মনে বলতে গেলে মনে হয় ঠিক হয়েছে, কিন্তু খাতায় লিখতে গেলেই আবার সমস্যা রহস্য নাকি?’ বুঝতে পারলাম রহস্যটা তৃতীয় বারের চেষ্টায় বলায় আর লেখায় শব্দগুলি যে একই চেহারায় আসছিল না, সেইটে টের পেতেই লিখিত রূপটা পালটে দিয়ে ভাঙাচোরা একটা গড়ন মেনে সেটা লিখতে পারায় কবিতাটি বেরিয়ে এল মনে মনে বলবার সময় আমি ভাবছিলাম, শব্দগুলিকে আলাদা আলাদা করে, ভেঙে ভেঙে পড়ছি কিন্তু লিখবার সময় তো সেভাবে লেখা হচ্ছে না কবিতা লিখবার স্বাভাবিক পদ্ধতি মেনেশব্দগুলির মধ্যস্থিত ফাঁকগুলিকে যে লেখাতেও আনতে হবে, সেইটে বুঝবার পর এর চেহারা পালটে গেল আমার কাছে

এরকম দুচারটে অদলবদলের বা ভাঙাচোরার কিছু ইতিহাস হয়তো আমার লেখায় পাওয়া যাবে কিন্তু সেটাকে আমার রচনাধর্ম বলা মুশকিল শেষের দিকের লেখাগুলিতে প্রথম দিকের চেয়ে একটু বেশিই পাওয়া যাবে বলে মনে হয় তারই একটি নমুনা:

Shankhya Ghosh Handwriting

 

 

 

বোধশব্দ, কবিতার মেরামতি, ২০২০
(পুনঃপ্রকাশ)

*ছবি সৌজন্য: বোধশব্দ পত্রিকা, সুস্নাত চৌধুরী

banglalive logo

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *