পথের কবি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী ছিল ১২ সেপ্টেম্বর। আমৃত্যু প্রকৃতির পূজারী, যন্ত্রণাপথের পথিক, একাকী যাত্রী বিভূতিভূষণ আমাদের অনন্তকালের সঙ্গী,
আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাঁর জন্মদিবসে বাংলালাইভের শ্রদ্ধার্ঘ্য…
বৈকালে মেঘ দূরদেশে রওনা দিল, দরিদ্র আলো ফুটে উঠল মহাকাশে, ভিজে ভিজে, জলে ধোওয়া নূতন ধান হতে তৈরি চালের মতো।
আমার ঘরের ওদিকে পাহাড়, সবুজে সবুজ। তার পূর্বে চঞ্চলা নদী, এখানে বলে ‘খোলা’। পাথর আর পাথর খোলার দেহে, মাঝে ঝিরিঝিরি জলের শব্দ।
জানলার পর্দা সরিয়ে চেয়ে আছি, উপত্যকায় চাঁদ উঠি উঠি তখন। কত রাত কে জানে! ঘড়ি নাই, চোখে আঠা আঠা তন্দ্রা। পাহাড়ের ঢালে রুপো রুপো আলো। দেখি জানলার বাইরে একজন বলিষ্ঠ মানুষ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, গায়ে মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, সরুপাড় মিলের ধুতি, হাতে একখানি ছড়ি। অবাক হয়ে চেয়ে আছি, একটু যেন ছায়া ছায়া দেহ। আমার দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলেন
—খোকা! যাবি বেড়াতে?
—এখন?! এই এত রাতে?!
—ভয় কী! আমি আচি তো! চল, তোকে গাচ চেনাব কেমন!
—কী গাছ?
—কেন, এলাচ গাচ! তুই চিনিস খোকা এলাচ গাচ?
—এখানে কি এলাচ হয় খুব?
—হয় তো! তারপর দেকবি কেমন পাখি আচে! এই বড় বড় মুরগির মতো!
—কী পাখি?
—ওরা তো কালিস বলে ডাকে শুনেচি!
—কালিস?
—হ্যাঁ রে!
বলেই কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল মানুষটির মুখ। চাঁদের আলোয় দুঃখি মানুষের মুখে অতীন্দ্রিয় ছায়া খেলা করে, প্রথমবার দেখলাম আমি। একটু চুপ করে থেকে বলে উঠলেন
—সবাই ওদের মারতে চায় জানিস খোকা! শিকার করে! কালিসের মাংস নাকি খুব ভালো খেতে।
—ইসস…
—খুব লোভ রে চারধারে! দেকচিস না কেমন মানুষকে ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া করার বিচার বসেচে।
—আপনি কি এখানেই থাকেন?
এ-কথা শুনে হা হা করে খোলার মতো হেসে উঠলেন তিনি, তারপর বললেন
—আমাদের কি ঘর আচে, খোকা!
—নাই?
—নাহ! কেউ আমাদের ভালবাসে না রে বাবু…
—তাহলে?
—সে জন্যই তো তোকে নিতে এলাম!
—কোথায় যাব, আপনার সঙ্গে?
—ওই যে দ্যাক, পাহাড়, তারপর একটা বরপের পাহাড়, তারপর ফুলের উপত্যকা, তার আগে ভালুকের দেশ, ওসব পার করে, সে এক দুনিয়া, বুজলি কিনা!
—ভালুকের দেশ?
—হ্যাঁ রে, এদিকে বলে ভুঁই-ভালু!
—তারপর?
—তারপর, মৃত মানুষের জগত! কতরকমের বাসনার মানুষ!
—আপনি জানলেন কী করে? একটু মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি! ওসব যে আমারই তৈরি রে!
ভারি অবাক হয়ে শুধোলাম
—আপনার তৈরি?
—হ্যাঁ রে! আমারই জগত! আমি মারি আবার বাঁচাই, আবার মারি, আবার বাঁচাই! সব আমার খেলা!
—আপনি কি লেখক?
উঁচু গলায় হেসে উঠলেন তিনি।
—ওসব লেকা টেকা তোদের ব্যাপার খোকা! বুজলি কিনা, এই নিয়েই নিজের জগত আমার!
তারপর একটু থেমে ফের বললেন
—যাবি? ওসবের পরেও এক অন্য ভুবন আচে! যাবি? সেকেনে কিচুই নাই! আবার সব আচে! যেমন তুই ভাববি! তেমন! যাবি? খোকা, যাবি না ?
তন্দ্রায় চোখ জুড়িয়ে এসেছে তখন। আমার মনে পড়ছে গত সন্ধ্যার কথা। সেই যে এখানকার গৃহস্বামী আগুন জ্বেলে বসতে দিলেন আমায়, ছাং দিলেন বাঁশের চোঙায়। আকাশে কুচি কুচি তারা, চাঁদ ওঠে নাই তখনও। ওসব আগুন নক্ষত্রের দেশে পরি নামে বলে শুনেছিলাম, হাঁ করে কতক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে তার মন ভাবছিলাম, সেই যাকে কখনও আমার বলা হল না পীরিতের কথা, সেই তার কথা, ভাবছিলাম।
সুঠাম মানুষটি ছড়ি দুলিয়ে আমার সামনে হাঁটছেন, তাঁর পদচিহ্নের দুপাশে ফুটে উঠছে অলীক ঘেঁটুফুল, আবার পরক্ষণেই হাওয়া-বাতাসের টানে ভেসে যাচ্ছে, পাকা তেলাকুচা ফলে থইথই গাছ, গহীন বাঁশবন, কাদের এক জীর্ণ ভিটার পাশ দিয়ে মরাদীঘি পার হয়ে আমরা হেঁটে চলেছি…অপরাজিতা কুসুমের মতো আকাশ,মাঝে মাঝেই মুখ ফিরিয়ে আমার পানে চেয়ে বলছেন,
—খোকা, পা চালা দিকি, ওদিকে খেয়া না পেলে এক কাণ্ড হবে!
বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করি,
—খেয়া? আমরা কি নদী পার হব?!
—কতা শোনও! যত সব ছেলেমানুষের কারবার! নদীর ওপারেই তো যাব!
—কী নদী?
স্মিত হাসি মুখে নিয়ে কেমন আধফোটা কুসুমস্বরে বললেন,
—ইছামতী!
একবার ভাবছি ফিরে যাই, পরক্ষণেই মন বলে, ইছামতী, ইছামতী! যাব কি ওই মানুষটির সঙ্গে, ঠিক বুঝতে পারি না। কী একটা পাখি ডাকছে, আধবোজা চোখে নিদ্রাদেবী যেন পিঁড়ি পেতে এসে বসেছেন…হিমশীতল দুধনীল রঙে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে মায়াভুবন!
জন্ম পৌষ মাসে, রাঢ়বাংলার এক অখ্যাত মফস্সলে। মূলত গদ্য লেখেন। ২০১৬-তে প্রথম বই 'অক্ষরকলোনি' প্রকাশিত হয় নাটমন্দির থেকে। প্রথম উপন্যাসের নাম 'নয়নপথগামী'। কাব্যগ্রন্থ 'আমি শুধু পাঁচ বছর চেয়েছিলাম।' দুটিই প্রকাশিত হয় ২০১৮-তে। ২০২০-তে বেরোয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'বাসাংসি জীর্ণানি'। এই বইগুলি সবই ধানসিঁড়ি থেকে প্রকাশিত।
এক কথায় অসাধারন! মনকে এক আলাদা জগতে নিয়ে গেল!