বাঙালির কাছে পাখি মানে টুনটুনি, শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে, বড়িয়া ‘পখ্শি’ জটায়ু।
এরা বাঙালির আইকন। নিছক পাখি নয়।
অবশ্য আরও কেউ কেউ আছে, সমগোত্রীয়। কারণ শুক যখন বলে, আমার কৃষ্ণ হ্যানো কারণে ত্যানো কারণে অসামান্য ও অতুলনীয়, তখন সারী প্রত্যেক বার দুরন্ত কাউন্টার-পংক্তি বলে নিখুঁত প্রমাণ করে, কৃষ্ণের ক্ষমতার পুরোটাই শ্রীরাধিকার কল্যাণে। তাই বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় দুই চরিত্র এবং নিশ্চিত ভাবেই প্রেমের চিরকালীন প্রতীক, তাঁদের দৈব খুনসুটি বজায় রাখেন দুইটি পাখির কল্যাণে।
হবেই, পাখি তো আর যে-সে জিনিস নয়, তারা উড়তে পারে, কথা বলতে পারে, এমনকি সত্যজিতের একটা গল্পে একটা কাক যা-সব দুরন্ত বুদ্ধিমান ব্যাপারস্যাপার করে, আর একটু হলেই সে নোবেল পেয়ে যেত। সত্যজিতের বাবা যে-কাকটির কথা লিখেছিলেন, সে শেলেট নিয়ে অঙ্ক কষতে গিয়ে পৃথিবীর সেরা একটি লাইন উপহার দিয়ে গেছে, যার রস বাংলা কথ্য ভাষা না জানা থাকলে উপভোগই করা যাবে না: সাত দুগুণে চোদ্দোর চার, হাতে রইল পেনসিল। সেই থেকে বাঙালি হাতে পেনসিল ধরে বসে ভাবছে, এর চেয়ে কি হ্যারিকেন ধরা ভাল ছিল? ওদিকে বাঙালির নাগাল থেকে লক্ষ্মী পালাচ্ছেন প্যাঁচায় চড়ে, সেই পাখিটি নিশাচর ও নিষ্ঠুর, একটু থিতু হয়ে বসে না। আর সরস্বতী নিয়ে এক কালে দুরন্ত গৌরব থাকলে কী হবে, এখন বাঙালির যা শিক্ষাব্যবস্থা, সরস্বতীর বাহন পাখিটি ক্রমাগত প্যাঁক দিচ্ছে।
পাখি শুধু ঝঞ্ঝাটে ফেলে না, উপদেশও দেয়। যত রাজপুত্র কোটালপুত্র সদাগরপুত্র রাত্তিরবেলা গাছের তলায় হা-ক্লান্ত হতাশ বিফলমনোরথ হয়ে জিরোতে গেছে, তাদের ওপরের ডাল থেকে নিখুঁত পরামর্শ দিয়ে অভিযানের পথে সাহায্য করেছে কারা? কারা এমন ক্লু দিয়েছে, যা ভেদ করতে ব্যোমকেশ লাগে না, ফেলুদাও নয়, সামান্য বুদ্ধি আর স্মৃতিশক্তি থাকলেই সূত্রগুলোকে দুয়ে-দুয়ে চার করে নিয়ে রাক্ষসপুরীতে গিয়ে ঘুমন্ত রাজকন্যাকে একদিনে উদ্ধার করে আনা যায়? এই পাখি-দম্পতি একেবারে বিশ্বকোষ, ওপর থেকে গোটা পৃথিবী বুঝে ফেলেছে, এখন নিচের তলাকে, অর্থাৎ নিকৃষ্ট জাতি মানুষকে সমৃদ্ধ করছে। নৃশংস রাক্ষসের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধও এর একটা কারণ হতে পারে। সাধে তো আর লালমোহনবাবু ‘জটায়ু” নাম নেননি। সে-ই প্রথম রাবণের সঙ্গে লড়াই করে, অত বয়স হওয়া সত্ত্বেও সিনিয়র সিটিজেন বলে বিরাম চায় না।
পাখির সাহস সাংঘাতিক, একরত্তি টুনি পর্যন্ত প্রতাপশালী রাজার সঙ্গে টক্কর নিতে ডরায় না। রাজার ঘরে যে-ধন আছে, টুনির ঘরেও যে সেই ধনই আছে, তা বলে সে সাম্য ও গণতন্ত্রের একেবারে ভিত্তিপ্রস্তরটি ছোটদের বুকে স্থাপন করে দেয়। স্বৈরাচারী রাজা তাকে জব্দ করার হাজারটা কায়দা করলেও, কিছুতে সফল হয় না। সমাজতন্ত্রে এ গল্পের একেবারে টকটকে লাল মলাটে স্থান হওয়া উচিত, কিন্তু এখনও খুব উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।
ওদিকে গরুড় কিছু কম যায় না, সে নিজের মা’র দুঃখ ঘুচিয়ে, তারপর পরম অধ্যবসায়ে নিজের কেরিয়ারকে এত উঁচুতে নিয়ে চলে গেছে, বিষ্ণুর রথের মাথায় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। সে বোধহয় একমাত্র বাহন, যে মাথার ওপর বিরাজ করে। সাপেরা তার ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তো বটেই। গরুড় অবশ্য পুরো পাখি নয়, তার গা-টা মানুষের, তাই তাকে সবাই পাখির ইতিহাস-বইতে নায়ক বলে না-ও মানতে পারেন। কিন্তু পাখি-হাইব্রিড সে একমাত্র নয়, হাঁসজারু এক দুরন্ত আইকন, যে গোটা ব্যাকরণেরই বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসে আছে। মাত্র দু’লাইনে সে যা শুরু করে দিয়েছে, তার রেশ ধরে বহু মানুষ যে-কোনও প্রথাগত ফর্ম ভাঙার সাহস পেতে পারে।
আর ট্যাঁশ গরুও গরু নয়, আসলেতে পাখি সে, কিন্তু ছবি দেখে সে কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে নারাজ। অবশ্য ঘুঘুপাখিও খাতায়-কলমে শান্তির দূত, কিন্তু তার এখন চাকরি-বাকরি নেই, গোটা বিশ্ব তাকে কাঁচকলা দেখিয়ে যুদ্ধবিগ্রহের দিকে চলে গেছে, তাই সে-ও ‘আসলেতে’ নিতান্তই ঘুঘু, যে ফাঁদ দেখতে পায়নি। সেই ফাঁদ থেকে সে উদ্ধার পাবে কি? ব্যাঙ্গমা ছাড়া কেউ জানে বলে তো মনে হয় না।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
আরো অনেক আছে তো। চড়াই পাখি ১২টা,ডিম পেড়েছে ১৩টা। ২ শালিখ নমস্কার, আপনি বড় পরিষ্কার।