সরস এবং সহজ বাংলাভাষায় বিজ্ঞান-বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন জগদানন্দ রায়। প্রতিবেশ ব্যাপারে তাঁর ছিল বৈজ্ঞানিক কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু এক আশ্চর্য মন। সেই মন নিয়েই বাংলার সাধারণ পাখির খোঁজ রাখতেন এই মানুষটি। পাখিদের সেই বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর ‘বাংলার পাখী’ নামক বইতে। বইটি এখন ‘পাতাবাহার’ প্রকাশনা থেকে নতুন চেহারায় বার হয়েছে। আমার প্রিয় বই। বইটি প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৩৩১ সালে।
গ্রন্থের শুরুর রচনাটির নাম ‘প্রথম কথা’। প্রথম কথার প্রথম বাক্যটি হল, ‘পাখি জগদীশ্বরের বড় সুন্দর সৃষ্টি। শকুন, হাড়গিলা বাদে।’ তারপর শ্রী রায় লিখেছেন, ‘আমাদের চোখের সম্মুখ দিয়া কত পাখি উড়িয়া যায়, বাড়ির কাছের গাছে বসিয়া কত পাখি কত রকম শব্দ করে, আমাদের মাঠে-ঘাটে কত রকম পাখি চরিতে আসে, কিন্তু আমরা তাহাদের সকলের নাম জানি না। তাছাড়া তাহারা কী খায়, কোথায় থাকে, তাহারও সন্ধান রাখি না। ইহা অন্যায় নয় কি? পাখিরা তো আমাদেরই প্রতিবেশী।’
পাখি যে আমাদের প্রতিবেশী, সে কথা ভাবনার দিক থেকে সত্য এবং প্রকাশের দিক থেকেও অনবদ্য নয় কি? মানুষ নিয়ে আমি যত লিখেছি – পশুপাখি নিয়ে তৎসহ, তত না হলেও, অনেক লিখেছি। রাস্তার কুকুর-বেড়াল যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের আমার খুব দয়ালু বলে মনে হয়। পাখি যাঁরা ভালবাসেন তাঁরাও দয়ালু।
এ কথার একটি বড় যুক্তি হল, মহাকবি বাল্মীকির কণ্ঠে যে প্রথম শ্লোকটি উচ্চারিত হয়েছিল, সেটি ব্যাধের তীরবিদ্ধ হয়ে কোঁচ বকের মৃত্যুর ফলে শোকপ্রকাশের বেদনার অনুভবে– কবির দয়ালু মনের আর্তিই শ্লোক হয়ে উঠেছিল। শোক থেকে শ্লোক। মহান কবির চোখে একটি কোঁচ বকের অন্যায়-মৃত্যু সামান্য ঘটনা নয়। এই কবিই তো রামায়ণ রচনা করবেন, নয় কি? পাখিকে বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতায় ব্যবহার করেছে ‘মহাভারত’– সেখানেও পাখিটি হল বক; বক যেখানে ধর্মের বেশ ধারণ করেছে। পঞ্চপাণ্ডবের পরীক্ষা নিয়েছে। বা কথাটা এই যে, ধর্মই বকের বেশ ধরেছে।
আবেগে-বিদ্যায়-জ্ঞানে-ভালবাসায়-জীবনদর্শনে পাখির দরকার পড়েছে কবিদের। পাখি-দেখা কবিদের যেন একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-দার্শনিক পাখিকে কী চোখে দেখছেন এবং সাধারণ মানুষই বা কী চোখে দেখছেন, তা এক গবেষণার বিষয়। বাংলার প্রায় প্রত্যেক কবির সঙ্গে পাখির যোগ আছে। গদ্যেও যাঁরা কবি, তাঁদেরও আছে। বনফুলের উপন্যাসের নাম ‘ডানা’। যা হোক, পাখি নিয়ে বাংলায় কবিতা হয়েছে অনেক; মহৎ কবিতাও হয়েছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’-
“ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।”
পাখির কাছে কবির এই আর্তি ও আবেদন কেন? ভগবানের কাছে নয়, পাখির কাছে। এ কথার শুনানি আপাতত মুলতুবি রইল। শুধু এইটুকু বলার, এ কবিতায় পাখিটির কোনও নাম নেই। এটি রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যের কবিতা – কিন্তু কাব্যের নামটি হল ‘বলাকা’– বলাকাতে কোঁচ বক এবং স্ত্রী-বক, ক্রৌঞ্চীর মৃত্যু-বিলাপ মনে রেখেই কি এই নাম?
নজরুলের একটি কাব্যের নাম ‘চক্রবাক’– সাদা বাংলায় এর নাম চকাচকি বা চখা। এ পাখির প্রেমদাম্পত্য চিরপ্রসিদ্ধ। এরা হাঁসজাতীয় পাখি। কিন্তু বকের কথাটা আর-একটু বলা চাই। সারস হল বকেরই জাত। কবি বিনয় মজুমদারের একটা লাইন–
“মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।”
কেন? জবাবটা নানাভাবে খোঁজা যেতে পারে। চখাচখি (চকাচকির)-র প্রেম সবাই জানেন। সারসের প্রেম আরও দুর্মর। বড় পাখি সারস। তবে এদের ছোট সাইজও হয়। জগদানন্দ লিখেছেন –
“আমাদের গ্রামের বাঁধের ধারে ছোটো জাতের সারসদের চরিতে দেখিয়াছি। বড় আশ্চর্যের বিষয়, ইহাদিগকে কখনই জোড়া ভিন্ন দেখা যায় না। একটা সারস একাকী চরিয়া বেড়াইতেছে ইহা কখনই দেখি নাই। শুনিয়াছি, স্ত্রী ও পুরুষ সারসের মধ্যে ভাবও নাকি খুব বেশি। এক জোড়া সারসের মধ্যে যদি কোনো রকমে একটি মারা পড়ে, তাহা হইলে অন্যটি শোকে অধীর হয় এবং কখনও আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া আত্মহত্যা করে।”
গল্পটা কি লোকশ্রুতি নাকি রক্তমাংসে সত্য? এটা যদি লোককাহিনি হয়, তা হলেও জীবনের সত্যই তাতে ফুটে ওঠে; যদি এ গল্প পাখিটির অস্তিত্বের সত্য হয়, তা হলেও হবে পাখি যে মানুষের জীবনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে তারই সত্য-ব্যাখ্যান।

মানুষ পশুপাখি কতটা ভালবাসে? যদি বাসে কেনই বা বাসে? এ কথার বৈজ্ঞানিক যুক্তি এক রকমের; সাহিত্যের যুক্তি অন্য রকমের। আবার বলতে পারি, সেলিম আলির পাখি দেখা আর চার্লস ডারুইনের পাখি দেখা এক নয়। তবে এঁরা দু’জনেই পাখির খুব কাছের মানুষ। মানুষ নিকটে গেলে সারস উড়ে পালাচ্ছে; বাস্তবত সারস তাইই করে; মানুষকে ভয় পায় এবং বিশ্বাস করে না। কিন্তু যে পাখির ওপর গবেষণা করে তাঁর ক্রমবিকাশ তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন ডারউইন সেই ফিঞ্চ (Finch) পাখি ডারউইনের সঙ্গে অত্যন্ত সহজ আচরণ করেছিল। এই পাখিগুলি ছিল চড়াই পাখির মতো ছোট ছোট পাখি; বাংলায় এদের নাম মুনিয়া। মুনিয়ার চেয়েও নির্ভীক আচরণ করেছিল একটি মকিং বার্ড (Mocking bird), যার বাংলা নাম হরবোলা হওয়া উচিত। সে কী করেছিল?
দ্বীপটির নাম গ্যালাপ্যাগস (Galapagos) – এখানেই ডারউইনের আসল গবেষণা দিশা পেয়েছিল; মুনিয়া পাখীর সঙ্গে বা কুলচড়ুইয়ের সঙ্গে (কুলচড়ুইও ফিঞ্চ) ডারউইনের নাম চিরকালের জন্য জড়িয়ে গিয়েছে– কিন্তু মকিং বার্ড (হরবোলা) বুঝিয়েছিল- এখানে কোনও পাখি ভয় করতে শেখেনি। হরবোলা অন্যসব পাখিদের সুর ও ভাষা নকল করতে পারে। সে এসে বসেছিল ডারউইনের জলপাত্রের উপর এবং বড্ড আরামে সেই পাত্র থেকে জলপান করেছিল। পাত্র হাতে ডারউইন যখন উঠে দাঁড়ালেন, হরবোলা তখনও জলপাত্রটির কানার ওপর দিব্যি বসে রইল।
পাঠকের হয়তো মনে পড়বে, শ্রীমতি হার্পার লী লিখিত উপন্যাস ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’ (To Kill a Mockingbird), পাঠকের হয়ত আরও অনেক পাখির নাম মনে পড়বে- শেলির নাইটিঙ্গল; পারস্যের সুফি ও রোমান্টিক কবিদের বুলবুল (যা নজরুলেরও বুলবুল) এবং মনে পড়বে লালন শাহের দেহতত্ত্বের মূলসূত্র পাখির রূপকে ধরা রয়েছে– ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’)। আর কী মনে পড়বে?

মনে পড়বে মহাকবি জীবনানন্দের পাখিজন্মের কথা। শালিকের বেশে তিনি এই বাংলায় জন্ম নিতে চেয়েছেন; সংবেদনের দিক থেকে তিনি মহাকবি বাল্মীকির সমগোত্র। আবেগ তরঙ্গের সাম্যে এই দুই কবিই সমান্তর। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যে পাখিই নায়ক বা নায়িকা– মানুষ পার্শ্বচরিত্র; এমনটি কারও কাব্যে দেখা যায় না। পাখি বাদ দিলে জীবনানন্দের সাহিত্য ও জীবনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রথম কবিতার বই “ঝরা পালক”। পাখিরই পালক। পাখিই জীবনানন্দের শান্তি ও সান্ত্বনা; বিদীর্ণ হৃদয়ের শুশ্রুষা। ঘুঘুর ডাকের মধ্যে তিনি শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা জানি, ঘুঘুর ডাকের মধ্যে শান্তির সঙ্গে এক ধরনের বিষাদ রয়েছে। শান্তি ও বিষাদে মাখামাখি।
জীবনানন্দে পেঁচাও বিমর্ষ। চিলের কান্না মানুষের হৃদয়ের বিদীর্ণ বেদনার চেয়েও গভীর। বনলতা সেন পক্ষীবংশীয় নারী– সে কারণে তার দুই চোখ পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য বনলতাকে পক্ষীবংশীয় বলেছেন। তা হলে মানুষ আর পাখিতে তফাত কোথায়? আমরা পাখিকে শেখাই নাকি পাখি আমাদের শেখায়? যদি বাইবেল্ বা কোরানের কথা ধরি তা হলে, কাক হল সৃষ্টির আদি পাখি। আদমের পুত্রকে মানুষের মৃতদেহ মাটিতে সমাধি দিতে শিখিয়েছিল সে। আদমের দুই পুত্র, এক কন্যা– বোনের উপর অধিকার নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কলহ হয়, মারামারি বাধে এবং একভাই আর-এক ভাইকে হত্যা করে বসে। ঘাতক ভাইটি আপন ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তখন কাক এল। দুটি কাকে লড়াই হল। একটি কাক মরল। তখন অপর কাকটি মৃত কাকটিকে মাটিতে সমাধি দিল; উপনিষদেও পাখির গল্প আছে। সে খুব প্রসিদ্ধ গল্প।
ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন বই হল ‘শুকসপ্ততি’– গল্পের বই। সত্তরটি গল্প আছে। একটি টিয়া সেই সব গল্প শোনাচ্ছে। লোকসাহিত্য ও ছড়া পাখিকে ঘিরে প্রচলিত।জগদানন্দ পানকৌড়ি নিয়ে রচিত ছড়ার দু’পঙক্তি উদ্ধৃতি দিয়েছেন। পানকৌড়ির ছড়াটি এ রকম:
“পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় ওঠ না।
তোমার শাশুড়ি বলে গেছে বেগুন কোটো না।”
এখানেও মানুষে-পাখিতে তফাত নেই; কারণ পাখি বেগুন কুটতে বসেছে, এ চিত্রকল্পই বা কেন! এখন প্রশ্ন, এ জগৎ কি মানব-কেন্দ্রিক– নাকি নিসর্গই সব? পাখি নিসর্গেরই অংশ। মানুষ এক আশ্চর্য জীব, জলাতঙ্ক সত্ত্বেও কুকুরদের ধ্বংস করেনি। যদি বাদুড় থেকে করোনা ছড়িয়ে থাকে, তা সত্ত্বেও বাদুড়দের সবংশ ধ্বংস করবে না মানুষ। পাখি পোষার মাধ্যমে পাখিদের রক্ষা করে চলেছে মানুষই। মানুষ বিষয়ে ইসলামী শাস্ত্রে খোদার উক্তিটি এরকম:
Had I not to create you, I would not have created the universe.
খ্যাতনামা গল্পকার ও ঔপন্যাসিক আবুল বাশারের জন্ম মুর্শিদাবাদে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম গদ্যের বই 'ফুলবউ'। তারপর লিখেছেন বেশ কিছু গল্প প্রবন্ধ ও উপন্যাস। ১৯৯৪ সালে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। 'অগ্নিবলাকা', 'মরুস্বর্গ', 'আকাশলীনা' ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই।