রাজার প্রহরী

এক দেশে এক রাজা। তাঁর চার রানি, দশ রাজপুত্র-রাজকন্যা! হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া না থাকুক, গ্যারেজ-ভরা দামি দামি গাড়ি, বিশাল রাজপ্রাসাদ। রাজা কিন্তু এসব বৈভব ছেড়ে লোকালয় থেকে একটু দূরে একটা ছোট্ট বাংলোতে থাকেন। আর তাঁর পছন্দের গাড়ি বলতে একটা জিপ। চারদিকে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা রাজ্য। না আছে কোনও শিল্প, না আছে তেমন চাষবাসের ব্যবস্থা।

আছে অনেক ফলের বাগিচা, কমলালেবুর বাগান। সেই ফল দিয়ে জ্যাম জেলি স্কোয়াশ তৈরি করে বোতলে ভরে রফতানি হয়। তাই ওই দেশের বাইরেও ‘ড্রুক’-এর নাম অনেকেই জানে। তাতে দেশের দারিদ্র্য ঘোচার মতো আয় হয় না। তবু কিন্তু ড্রুক, মানে শান্ত ড্রাগনের দেশে প্রজারা খুব খুশি। সারা এশিয়ায় নাগরিকদের খুশির মাপকাঠিতে ভুটান সব সময় সবার সেরা। 

ব্যাপারটা কী? একটু কালটিভেট করতে হচ্ছে! চল পানসি ভুটান! 

আসলে আনন্দবাজার পত্রিকার বেড়ানোর ক্রোড়পত্রে একটা ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতে হবে। তো কলা বেচার সঙ্গে সঙ্গে যদি রথও দেখা হয়ে যায়! রওনা হলাম প্রতিবেশী পাহাড়ি দেশে, যাকে বিদেশ ভাবতে অসুবিধেই হচ্ছিল। একটু একটু বোঝা গেল যখন আলিপুরদুয়ার দিয়ে ভারতের সীমান্ত পার হয়ে ছবির মতো সুন্দর শহর ফুন্টশোলিংয়ে পৌঁছলাম। পুঁচকে শহরটা ভূটানের সিংহদুয়ার। রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরদিন পারমিট নিয়ে থিম্পু যাত্রা। তেমন কড়াকড়ি কিছু নেই, পাসপোর্টও লাগে না। কিন্তু এলেম নতুন দেশে, এই অনুভূতিটা হয়। ছোট্ট একটা বাসে আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে চলা। ন্যাড়া ন্যাড়া পাহাড়। আহামরি কিছু সৌন্দর্য চোখে পড়ে না।

 

রাজধানী শহর থিম্পু কিন্তু ছোটর ওপরে বড় সুন্দর! ফুন্টশোলিং আর থিম্পুতে যে হোটেলে ছিলাম, দুটোই ভাল, অন্যান্য জায়গার হোটেলের থেকে বেশ আলাদা রকমের। শহরের চরিত্রও আলাদা। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখি এক ট্রাফিক পুলিশ নাচের ভঙ্গিতে ট্রাফিক সামলাচ্ছে। সে যে কী মজার দৃশ্য, ভাবা যায় না! পুলিশও নৃত্যশিল্পী! এইজন্যই ভুটানের মানুষের মনে এত খুশি খুশি ভাব থাকে। সবকিছুর মধ্যেই একটা আনন্দ খুঁজে পায়। 

dancing traffic guard in Bhutan
থিম্পুর সেই নৃত্যরত ট্রাফিক পুলিশ

পরের দিন থিম্পু একটু ঘুরে দেখব, তার পরে যাব ভূটানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর পারো দেখতে। হোটেলে বলে একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বাইরে বেরিয়ে দেখি পোর্টিকোয় একটা গাড়ি দাঁড়ানো। কিন্তু ড্রাইভার কই? পাশে একজন সুবেশ, সুদর্শন ভদ্রলোক কারও অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, “এই গাড়ির ড্রাইভারকে দেখেছেন?” উনি হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, “আমিই ড্রাইভার উগেন দোর্জি।” 

“আপনি ড্রাইভার?” ভূটানি জাতীয় পোশাক পরা সুঠাম চেহারার হাসিমুখের ভদ্রলোকটিকে আর যাই হোক, ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার বলে ভাবতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আমার মুখের ভাব দেখে হাসিমুখে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, “কোনও চিন্তা নেই। আমি গাড়িটা ভালই চালাই!” একটু লজ্জা পেয়ে উঠে বসলাম। মারুতি ওমনি গাড়ি। আমার লেখার কথা ভেবেই সামনের সিটে বসে প্রচুর প্রশ্ন করে যাচ্ছি, আর দোর্জিবাবু হাসিমুখে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। বোঝা গেল বেশ ভালই পড়াশোনা করা লোক। অত্যন্ত মার্জিত ভাষা, বিনীত ব্যবহার। 

Ugen Dorje
উগেন দোর্জি

বললাম, “আমার একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে। আপনাদের দেশ এত ছোট, জাতীয় সম্পদও বেশি কিছু নেই, লোকের আয় কমের দিকেই। তবু সবাই এত খুশি থাকেন কী করে?” উগেন দোর্জি হাসতে হাসতেই বললেন, “আসলে আমাদের এই ভূটানের লোকেদের চাহিদা বড় কম। আমরা খুব অল্পতেই খুশি। তাই বেঁচে থাকার আনন্দেই আমাদের দিন কেটে যায়। আর আমাদের দেশটা খুব সুন্দর। আমরা দেশকে যেরকম ভালবাসি, আমাদের রাজাকেও তেমন ভালবাসি, সম্মান করি। জানি যে উনি সবসময় আমাদের পাশে আছেন। এটা আমাদের বড় ভরসা দেয়।”

“কিন্তু আপনাদের রাজা তো শুনেছি খুব কড়া মেজাজের শাসক। ভূটানি পুরুষদের জাতীয় পোশাক ‘ঘো’ আর মহিলাদের ‘কিরা’ ছাড়া আর কিছু পরা নিষেধ। পুলিশ ছাড়া আর কেউ প্যান্টশার্ট পরতে পারবে না। অল্প বয়সে বড় চুল রাখতে পারবে না। দেখলেই রাজার কোটাল চুল কেটে দেবে! (এই নিয়ে খবর হয়েছিল আনন্দবাজারে। আমাদের তখনকার বার্তা সম্পাদক অমিতাভ চৌধুরী হেডিং করেছিলেন, ‘ভূটানে চুলে টান’) তা ছাড়া টিভি দেখা বারণ, রাজনীতি করা বারণ, এরকম অনেক রকমের বাধানিষেধ আছে যে!” 

দোর্জি বললেন, “দেখুন এগুলোকে আমরা ঠিক বাধা-নিষেধ বলে মনে করি না। বললাম না, রাজা আমাদের কাছে ভগবান। যে সব নিয়মকানুন উনি আমাদের জন্য করেছেন, তার সবক’টা উনি নিজে মেনে চলেন। রাজা চাইলে বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু আমাদের দেশটা গরিব, তাই আমাদের রাজাও বড়লোকের মতো থাকেন না। রাজকীয় জীবনযাপন করেন না, এটাই আমাদের গর্ব।” 

“আপনি কি কখনও রাজাকে দেখেছেন? শুনেছি নাকি ওঁকে প্রায় দেখাই যায় না!” 

উগেন দোর্জি সেই হাসি মুখেই বললেন, “হ্যাঁ দেখেছি বৈকি! নিজের চোখে দেখেছি শুধু না, চোখে চোখে রেখেছি।” এর পর হেঁয়ালি ছেড়ে বললেন, “আমি রাজার সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলাম। ব্যক্তিগত দেহরক্ষী।”

আমি তো হাঁ! ভদ্রলোক বলেন কী? এ যে অদ্ভুত যোগাযোগ! কিন্তু দেহরক্ষী বলতেই যে গম্ভীর বলিষ্ঠ রহস্যময় চেহারা চোখে ভাসে, তার সঙ্গে এঁর তো কোনও মিলই নেই! 

“রাজার দেহরক্ষী হলেন কীভাবে?”
“রাজাকে এত শ্রদ্ধা করতাম যে, সবসময় মনে হত ওঁর কাছাকাছি যদি থাকতে পারতাম, ওঁকে যদি সব সময় দেখতে পারতাম! সেটা করতে হলে সবচেয়ে ভাল উপায় ওঁর দেহরক্ষী হিসেবে নাম লেখানো।” 

dipankar chakraborty with ugen dorje
উগেন দোর্জির সঙ্গে লেখকের পরিবার

উগেন দোর্জি জানতেন সেটা মুখের কথা নয়! নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করলেন কঠোর শরীরচর্চা। আগেও প্রতিদিন ব্যায়াম করতেন, এবারে লম্বা লম্বা দৌড় আর জগিং স্টাইলে হাঁটা শুরু করলেন। সেই অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া। শরীর হয়ে গেল একেবারে নির্মেদ। তখন নানা রকমের মার্শাল আর্ট শিখলেন। জুজুৎসু, তায় কুয়ান দো, ক্যারাটে, কুংফু! 

দোর্জি বলে চলেছেন, “চোখ কান সব সময় খোলা রাখছি, রিফ্লেক্স যেন চাবুকের মতো হয়। অস্ত্র চালাতে শিখলাম। পিস্তল, রাইফেল তো বটেই, তা ছাড়া নানা রকমের ছুরি আর ভোজালি চালানো। রেশমি রুমাল ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে ধারালো ছুরির আলতো টানে সেটাকে দু’ভাগে কাটার কারসাজি। এই সব ট্রেনিং নিয়ে যখন নিজের ওপর একটা আস্থা এল, তখন গেলাম রাজপ্রাসাদে পরীক্ষা দিতে। প্রথমবারে পারিনি ঠিকই, কিন্তু দমেও যাইনি। জানতাম খুব কঠিন পরীক্ষা, লেগে থাকতে হবে। পরের বারে পেরে গেলাম। শুধু তাই না, রাজামশাইয়ের আমাকে এতই ভাল লেগে গেল, তিনি আমাকে একেবারে খাস দেহরক্ষী করে ফেললেন। এইভাবে আমার স্বপ্ন পূরণ হল।”

ঝকঝকে ইউনিফর্ম পরা নিজের চেহারা তখন আয়নায় দেখে তরুণ উগেন দোর্জি নিজেই মুগ্ধ। মুগ্ধতা লেগে থাকত পাড়ার মেয়েদের চোখেও। পরে সেই মেয়েদেরই একজন হলেন দোর্জি-গৃহিণী।

ভিনদেশি শ্রোতা পেয়ে দোর্জি তাঁর সেই জীবনের কথা বলে চললেন। হুইটনি হিউস্টন আর কেভিন কস্টনারের ‘দ্য বডিগার্ড’ ছবিটা দেখেছিলাম টান টান উত্তেজনা নিয়ে। সে দিন ভূটানের রাজপ্রহরীর কথাও শুনছিলাম একই রকম মনোযোগ দিয়ে। যেন রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চার!

“যাঁকে ভগবানের মতো মনে করতাম, তাঁর দেখভালের দায়িত্ব আমার ওপরে, তাঁর নিরাপত্তা আমার হাতে! মনে হল ওঁর জন্য আমি প্রাণ দিতেও পারি। তবে রাজা তো বেশি বের হতেন না, তাই আমার কাজেও তেমন চ্যালেঞ্জ ছিল না। একবার শুধু শ্রীলংকা গিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সফরে। আমারও সেই প্রথম আর সেই শেষ বিদেশে যাওয়া।” 

তবে বিদেশি অভ্যাগতরা ভূটানে এলে দোর্জির দায়িত্ব বাড়ত। সে বার যেমন এসেছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। “ওঁর ছেলেমেয়েকে একটা ফুলের বাগান দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাহুল আর প্রিয়ঙ্কা। যেমন ফুটফুটে চেহারা, তেমন মিষ্টি ব্যবহার। খুব ভাল লেগেছিল।”

আর একটা ঘটনা দোর্জির মনে পড়ে গেল। 

“সে দিন রাজা ভূটানের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাবেন বলে বেরিয়েছেন। পাহাড়ে হঠাৎ ধস নেমে রাস্তা বন্ধ। গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল, আমরা নামলাম গাড়ি থেকে, রাজাও নামলেন। হঠাৎ দেখি পাথরের পাশ থেকে একটা পাহাড়ি সাপ তেড়ে আসছে রাজার দিকে। আমি দৌড়ে গিয়ে সেটার লেজ ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, তার পরে কোমর থেকে ছুরি বার করে ছুঁড়ে মারলাম। কিন্তু ছুরি ওর মাথায় না লেগে গায়ে লাগল। ফনা তুলে আবারও যখন এগিয়ে আসছে, তখন খাপ থেকে রিভলবার বার করে সাপের ফনায় গুলি করলাম। সেবার আর মিস্ হয়নি। রাজা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে অনেক টাকা ইনাম দিয়েছিলেন, অনেক উপহার দিয়েছিলেন। টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু উপহারগুলো রেখে দিয়েছি। আমার ছেলেপুলে নাতি-নাতনিরা ওগুলো দেখবে আর তাদের গর্ব হবে।” 

কী কাণ্ড! এ যে মেঘ না চাইতে জল! গিয়েছিলাম বেড়াতে, সেখানে এমন একজনের দেখা পেলাম যাঁর কাছে ভূটানের রাজার হালহকিকত সব জানা হয়ে গেল! জিজ্ঞেস করলাম, “ওরকম একটা দারুণ অ্যাডভেঞ্চারাস জীবনযাপনের পর এই সাদামাটা ট্যাক্সি চালাতে, ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগছে?” 

আবার হাসলেন দোর্জি। বললেন, “বিপজ্জনকভাবে বাঁচার একটা সময়সীমা আছে‌। আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম, বয়স বাড়ছে, রিফ্লেক্স কমে যাচ্ছে। শরীর-মনে আর সেই ক্ষিপ্রতা নেই। তাই সময় থাকতে থাকতে অবসর নিলাম। জমানো যা টাকা ছিল তা দিয়ে একটা ট্যাক্সি কিনলাম। এখন নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবনযাত্রা। ভালই আছি।” 

উগেন দোর্জির কথা এখনও মনে পড়ে। সেবার কলকাতায় ফিরে এসে প্রথমেই ওঁর সঙ্গে মোলাকাতের পুরো বিবরণ লিখে ফেলেছিলাম। আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় অ্যাঙ্কর স্টোরি বেরিয়েছিল.. ‘নিদ্রিত ড্রাগনের দেশে রাজার ছিল এক প্রহরী’।

সেটা ছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। ইতিমধ্যে ভূটানের যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। রাজতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রও চলছে বর্তমান রাজার কল্যাণে। তবে সে অন্য কাহিনি।

 

*সমস্ত ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

Dipankar Chakraborty

দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।

3 Responses

  1. খুব ভালো লাগলো পড়তে এই নিদ্রিত ড্রাগনের দেশের খাস রাজরক্ষীর কাহিনী। আপনার সাবলীল বর্ণনা পুরো ব্যাপারটাকে একেবারে চোখের সামনে যেন তুলে ধরল।

  2. দীপংকর যাতে হাত দেন তাতেই সোনা ফলে। সহজ সরল বর্ণনায়
    রাজা, রাজার প্রহরী ও রাজার রাজ্যকে চমৎকার ফুটিয়েছেন দীপংকর। আরও লিখুন তিনি, এই আজি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *