ভোলা কিছুতেই যাবে না। অনেক বুঝিয়েও যখন রাজি করানো গেল না, তখন পিন্টু বললো বিরিয়ানি খাওয়াবে। বিরিয়ানির নাম শুনে ভোলা কিছুটা নরম হয়ে বললো, ঠিক আছে, যেতে পারি তবে সঙ্গে চিকেন চাপ দিতে হবে। পিন্টু রাজি। ভোলাকে বইমেলা নিয়ে যাওয়ার জন্য ও সব কিছুই করতে পারে। ভোলা হল আমাদের পাড়ার সুধা স্যাকরার একমাত্র আদরের ছেলে। সব কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও বইএর সঙ্গে কোনওকালে কোনও সম্পর্ক ছিল না ওর। ভালো ভালো খাবার খাওয়া আর জমিয়ে ঘুম – এই ছিল ভোলার রোজনামচা। এই খাওয়া আর ঘুমের বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে সেটা কখনো কল্পনাতেও ভাবে না সে। সামনের মাসে ভোলার বিয়ে। সকাল থেকে রাত সে এখন তার নতুন বউ-এর স্বপ্নে বিভোর। সেখানে বই-এর জায়গা কোথায় ? এই ভোলাকে বইমেলা নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জটা পিন্টুই নিয়েছিল। পিন্টু ভোলার মামা, ওরা দুজনে একবয়সি হলেও স্বভাবে একেবারে দুই মেরুর। পিন্টু বই পড়তে ভালোবাসে। গ্রামের পত্রিকায় দু একটা কবিতাও প্রকাশ পেয়েছে। সেই পিন্টু একেবারে জোর করেই ভোলাকে বইমেলা নিয়ে চললো।

মেলার গেটের সামনে এসেই ভোলা বেশ ঘাবড়ে গেল। বিশাল একটা গেট, হাজার লোকের মেলা। নাগাড়ে সবাই ভিতরে ঢুকছে এবং বাইরে আসছে। পিন্টু বললো আরে, গেট দেখেই ঘাবড়ে গেলি ? ভিতরে চল, দেখবি কেমন বই-এর রাজত্ব। ভোলা পিন্টুর সঙ্গে ভিতরে ঢুকল এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। চারদিকে শুধু দোকান আর দোকান, আর সেই সব দোকানে থরে থরে সাজানো আছে শুধুই বই। এত বই কোথায় তৈরি হয় ? কারা লেখে এত বই ! ভোলা চন্ডীতলার মেলায় গিয়েছে, রক্তান গাজীর মেলাতেও ঘুরেছে কিন্তু এ যে একেবারেই অন্যরকম। চন্ডীতলার মেলায় জিলিপি, খেলনা, কাপ প্লেট ইত্যাদি সবকিছুরই দোকান আছে কিন্তু বইএর দোকান নেই। তাছাড়া সেখানে এভাবে জিনিস হাতে নিয়ে দেখাও যায় না, এখানে তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইটা পড়াও যায়।  পিন্টু ভোলাকে নিয়ে এগিয়ে চললো। ভোলার একটু রাগই হচ্ছিল। পিন্টু তাকে নিয়ে এক একটা স্টলে ঢোকে, সেখানে সাজিয়ে রাখা অনেক বইএর মধ্যে থেকে দুএকটা তুলে বিজ্ঞের মতো দেখে যথাস্থানে রেখে দিয়ে পরের স্টলে চলে যায়। সবজির বাজারে ফুলকপি দেখার মতো বই দেখতে থাকে পিন্টু। চারপাশের মানুষগুলোও পিন্টুরই মতো বিজ্ঞ হয়ে বই দেখে চলেছে, কিন্তু কেউ একটা বইও কিনছে না। প্রত্যেককে দেখে মনে হচ্ছিল তারা বই ছাড়া বোধহয় থাকতেই পারে না, সবাই খুব খুব পড়াশোনা করে।

স্টল ছেড়ে বেরোলে মেলার মাঠেও বই। সেখানে আবার গ্রামের মনোহারি চাচার মতো কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে বই ফেরি করছে। তার বড়ো ঝোলায় ভর্তি বই। ভোলা কী করবে বুঝতে পারছিল না। তার বই দেখতে ইচ্ছে করলেও, তার চেনা জানা বই একটাও দেখতে পাচ্ছিল না। সত্যনারায়ণের পাঁচালী, জোকস বা বিরিয়ানি রান্নার বইগুলো কোথায় পাওয়া যায় কে জানে! ভোলা তার জানা বইগুলো হন্যে হয়ে খুঁজছিল, পিন্টু বললো, কি রে? বই পছন্দ হল? ভোলা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো, না, অন্য স্টলে চল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের প্রচ্ছদের মতো আমাদের অভ্যাস, সংস্কৃতিও অনেকটাই বদলে গেছে। দুপুরে বাড়ির বিধবা পিসির ছাদে আচার রোদে দেওয়া, জ্যাঠিমা কাকিমাদের বিন্তি খেলা বা মা, ঠাকুমাদের শরৎ, বিভূতি, তারাশঙ্কর নিয়ে দুপুর কাটানোর দিন আর নেই। বালিশে ঠেস দিয়ে বুকের ওপর বই রেখে পড়ার দৃশ্য আজ স্বচ্ছন্দে মিউজিয়মে ঠাঁই পেতে পারে। একসময় উপন্যাস, গল্প, কবিতায় মজে থাকা বাঙালি মহিলাদের বেশিরভাগই এখন মোবাইল বা টিভিকে সঙ্গে নিয়ে  দুপুর কাটান। নীরবে নিভৃতে ওই নির্দিষ্ট যন্তরটাকে সঙ্গী করেই তারা আজ খুবই ব্যস্ত। সেখানে কবি, সাহিত্যিকদের প্রবেশাধিকার নেই। ভোলার বাড়িতেও একই ছবি। কালে ভদ্রে তাদের বাড়িতে যদি বই কেনা হয় তাহলে সেটা হলো রান্নার বই। উচ্ছের কোর্মা, করলার চাটনী বা ন্যাদস মাছের চাটনির পদ ওই বই থেকেই ভাতের থালায় উঠে এসেছে। কিন্তু ভোলা !  সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করার ফাঁকে সে তো অনেক বই পড়েছে, যেমন, পাঁজি, হাজার জোকস, রকমারি তিনশো খানা প্রশ্ন উত্তর, কুমার শানুর একুশটা হিট গান ইত্যাদি। সামনে বিয়ে বলে সেদিন ট্রেন থেকে সে পাঁচশোটা প্রেমের এস.এম.এস’ নামে বইটা কিনেছে, এ বইটা তার কাজের বই। তাছাড়া পিন্টুর চাপে এখানে আসার আগে উদয় তাকে কানে কানে বলেছে যে, বইমেলায় বড়োদের বইও পাওয়া যায়। উদয় তাকে বেশ কিছু বড়দের বই পড়িয়েছে। সেসব বইও তো দেখা যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ হন্যে হয়ে ঘুরেও ভোলা তার প্রিয় বইগুলোকে খুঁজে পেল না। এবার একটু বিরক্ত হতে শুরু করলো ভোলা। পিন্টু বললো, চল বিরিয়ানি খাবি তো? বিরিয়ানির নাম শুনে এবশ্এয ক লহমায় ভোলার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

কিন্তু খেতে গিয়ে আবার আর এক বিপত্তি। বড় ছোট চুলওলা একদল ছেলে মেয়ে গীটার নিয়ে তারস্বরে গান করছে। বসার জায়গা নেই। ভোলা অবাক হয়ে ওদের দেখতে দেখতেই বিরিয়ানি চিবোতে লাগলো। কিন্তু বইমেলায় এরা গান করছে কেন সেটা বুঝতে পারল না। এরা কি নাম করা শিল্পী? চন্ডীতলার মেলায় অবশ্য বেশ কিছু লোক গান করতে আসে, সেসব গাজন-এর গান। ওই মেলায় তরজাও হয় কিন্তু এরকম গান তো চন্ডীতলার মেলায় হয় না। তাছাড়া, বইমেলায় তাহলে গানও হয়? বিরিয়ানির মুরগির ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে তন্ময় হয়ে এসব কথাই ভাবছিল ভোলা, হঠাৎ পাশ থেকে একটা লোক ঘাড়ের কাছে এসে বললো,  ‘দাদা নেবেন নাকি একটা’? চমকে উঠে ভোলা দেখল, একটা লোকের সারা দেহে ঝোলানো রয়েছে বই, শুধু তার মুখটাই দেখা যাচ্ছে, লোকটা নিজেই যেন একটা চলন্ত বই-এর দোকান। লোকটাকে অবাক হয়ে দেখতে গিয়ে তার বাড়িয়ে দেওয়া বইটা দেখতে পায়নি ভোলা। যখন চোখ পড়ল তখন একলহমায় তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, এই তো সেই বই – এতক্ষণ ধরে প্রতিটা স্টলে তো এই বইই সে খুঁজেছে। একরকম ছোঁ মেরেই বইটাকে কেড়ে নিল ভোলা। বইটার চকচকে প্রচ্ছদের ওপর বড় বড় হরফে লেখা, ‘দজ্জাল বউকে কীভাবে সামলাবেন’।

জলদ গুপ্ত লেখেন না, ভাবেন। নিজেকে মনে করেন মুদির দোকানের মালিক। কোথায় কোন মশলা আছে শুধু সেটুকুই উনি জানেন, খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী কাগজে মুড়ে দিয়ে দেন...ব্যস। সিধুজ্যাঠার মত অনেক কিছু করার ক্ষমতা থাকলেও অন্যদের অসুবিধা হবে বলে কিছুই করেন নি। কবিতা, নাটক লিখতে পছন্দ করেন আর পাগলের মত পছন্দ করেন সঙ্গীত। পাহাড়ি জঙ্গলের টিলায় বসে হেঁড়ে গলায় গান আর দিনে ১৫ কাপ চায়ের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত। আদিখ্যেতাকে ঘেন্না করেন, তর্ক করতে ভালোবাসেন। এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন যেখানে কোন লেখক থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *