শীতকাল কবে আসবে, সুপর্ণার মতো আমিও ভাবতে থাকি হরবখত। না, না। তিনমাস ঘুমোব বলে নয় অবশ্য। শীত এলেই ভোরের কুয়াশামাখা রাস্তায় দু’হাত দিয়ে নিজেকেই জড়িয়ে ধরে হাঁটব বলে… হাঁটতে হাঁটতে দূরে কুয়াশা-মোড়া হাইওয়ের ধারে, গাছের নীচে, ধোঁয়া-ওঠা এক ভাঁড় চায়ের উত্তাপ নেব বলে। শহরের তখন সবে ঘুম ভাঙছে!

হেঁটে বাড়ি ফিরে সবে এক কাপ ফেনাওলা কফি নিয়ে বসেছি, মা নিয়ে হাজির নলেন গুড়ের গন্ধে ম ম করা পাটিসাপটা… হ্যাঁ, এই জন্যেই তো শীতকাল! রকমারি সবজি, রোদ্দুর, কমলালেবু, আর তার সঙ্গে পিঠে পিঠে আর পিঠে! মায়ের হাতের পাটিসাপটা, আস্কে পিঠে, গোকুল পিঠে, ওই যে ক্ষীর দিয়ে বানানো, ওইটে আমার সবচেয়ে প্রিয়… আরও কত কী! মায়ের বানানো নানারকম পিঠের জন্যেই বছরশেষে শীতকাল আসার অপেক্ষায় থাকা। কোনওটা নোনতা, কোনওটা মিঠে, কোনওটা নিজের মনগড়া, সে গল্প অন্য কোনওদিন…
পিঠের কথায় মনে পড়ল। সেবার শীতে দিদির সঙ্গে ওর শ্বশুরবাড়ি গিয়েছি। দিদির শাশুড়ি ওপার বাংলার মানুষ। ঘরে ঢুকতেই অদ্ভুত সুন্দর মিষ্টি একটা গন্ধ। রান্নাঘরে আটপৌরে করে শাড়ি পরে মাসিমা বানাচ্ছেন কিছু একটা। কিছুক্ষণ পর হাতে করে নিয়ে এলেন এক আশ্চর্য মিষ্টি…
“এ আমার বাপের বাড়ির সম্ভার, বুঝলি? বিবিখানা পিঠে… সে অনেক গল্প, অনেক ইতিহাস… বিক্রমপুর, জানিস তো? সেই ঢাকা বিক্রমপুরের কথা…”

পাশে বসে শুনতে লাগলাম। বিয়ের পর প্রথম হেঁশেলে ঢোকার পর, এই পিঠে বানিয়ে রান্নার পরীক্ষা দিয়েছিলেন মাসিমা। ব্যাপারখানা এই রকম, যদি পিঠের স্বাদে-গন্ধে-বর্ণে পাশ করে যান, তবেই নতুন বউয়ের হাতে দেওয়া হবে ভাঁড়ার আর রান্নাঘরের চাবি! গল্প শুনতে শুনতে পিঠের টুকরো মুখে গিয়ে হৃদয় গলে গেছে স্বাদ আর গন্ধে। এ স্বাদ তো বারবার পেতে মন চায়, অতএব পদ্ধতি তো জানতেই হয়…!
মাসিমা বললেন, ওঁর ঠাকুমা নিজে হাতে শিখিয়েছিলেন পিঠে তৈয়ারের পদ্ধতি এবং স্বাদ বাড়ানোর কিছু কায়দা। এক কাপের মতো আতপ চাল গুঁড়ো, হালকা গন্ধ ওঠা পর্যন্ত কড়াইয়ে নেড়ে নিতে হবে। ভুললে চলবে না… লাল হবে না, শুধু গন্ধ বেরনো পর্যন্ত।
এবার ওই এক কাপ চালের গুঁড়োর সঙ্গে এক চামচ ময়দা (এটাও স্বাদ বাড়াবার কায়দা) মিশিয়ে নিতে হবে। তাতে দিতে হবে এক কাপ নারকেল কোরা আর আন্দাজমতো নুন। সঙ্গে একটু গোলমরিচের গুঁড়ো আর এলাচ গুঁড়ো।

অন্যদিকে, দুটো ডিম আর ৩/৪ কাপ নতুন গুড়ের সঙ্গে ১/৪ কাপ ঘি মিশিয়ে নিতে হবে। তখনকার দিনে তো শিলনোড়া আর হাতের জোর সম্বল ছিল, এখন ঘরে ঘরে মিক্সার আর হ্যান্ড বিটার। তাই দিয়ে খুব ভাল করে ফেটিয়ে নিতে হবে। মাসিমার যদিও এখনও হাতের ওপরই ভরসা বেশি। ওদিকে চালের গুঁড়োর মিক্সচার আর এদিকে ডিমের মিক্সচার, দুটো একত্রে আবার ফেটিয়ে নিয়ে, একটা পাত্রে একটু ঘি বুলিয়ে ঢেলে খুব খুব ঢিমে আঁচে কুকারের ভিতরে নুন বা বালি দিয়ে একটা পাত্রে রেখে বা মাইক্রোওয়েভে কনভেকশন মোডে প্রায় ৫০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা বেক হবে। ব্যাস…!
এই হল মাসিমার বলা পদ্ধতি।
পুরনো দিনের গল্প শুনতে শুনতে সেদিন মনে হচ্ছিল, দিন বদলায়! সেদিন যে বৌমাকে রান্নাঘরে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল, আজ তিনি নিয়ম ভেঙে নিজের বৌমার জন্যে এক থালা বিবিখানা পিঠে নিয়ে এলেন!

তাহলে বাড়িতে বসে যে পিঠে বানাব, তার উপকরণের লিস্টি তো করে ফেলতে হবে!
উপকরণ:
এক কাপ আতপ চাল গুঁড়ো
দু’চামচ ময়দা
এক কাপ নারকেল কোরা
৩/৪ কাপ খেজুর গুড়
১/৪ কাপ ঘি
দুটো ডিম
সামান্য নুন
১/৪ চামচ ছোট এলাচ গুঁড়ো
১/৪ চামচ গোলমরিচ গুঁড়ো
প্রয়োজন মতো ব্যাটার পাতলা করতে একটু দুধও লাগতে পারে। আর শেষে পিঠের সঙ্গে টাকনা দিয়ে খাবার জন্যে খেজুর গুড়। ব্যাস। লিস্টি রেডি…
এবার বেক করার কালে আমি স্বদেশ আর বিদেশ ফিউশন করে মাফিন মোল্ডে ঢেলে দিয়ে বেক করে ফেললাম। কনভেকশন মোডে, ১৬০° সেলসিয়াসে প্রায় ৫০ মিনিট। তারপর গন্ধতে যদিও অপেক্ষা করা দায়, তবু ১০ মিনিট প্রায় অপেক্ষা।
তারপর? ওই ওপর থেকে নলেন গুড় দিয়ে খাবার ব্যাপারটা ছবি-সহ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি!
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।