স্টেশন থেকে নেমেই রতনের মুড়ির দোকান। ব্যবসাটা শুরু করেছিল মদনের স্বর্গগত বাপ রতন সেই সিধুবাবুর আমল থেকে। তারপর স্টেশন দিয়ে কত ট্রেন চলে গেল – কয়লার ইঞ্জিন থেকে ইলেকট্রিক ট্রেন হল। সিধুবাবু, জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবু পেরিয়ে এখন দিদির সরকার। কিন্তু দোকানের নামটা চেঞ্জ হয়নি – ‘রতনের মুড়ি’। বাপ স্বর্গে গেলেও নামটা ফেলে গেছে ওই দোকানে।

শুরুটা করেছিল রতন স্টেশনের ধারে অস্থায়ীভাবে। শুধু সন্ধেবেলায় একটা টিমটিমে লম্ফ (কেরোসিনের ছোট বাতি) জ্বেলে কয়েক ঘন্টা। ঠোঙায় করে মুড়ি আর আলুর চপ। দুটো আলুর চপ তখন পাঁচ পয়সা। প্লাটফর্মটা অনেক নিচু ছিল। সারাদিনে কয়েকটা মাত্র ট্রেন। ট্রেন আসার আগে টংটং করে ঘন্টা বাজত। আর এখন তো ব্যাপারই আলাদা, উচুঁ প্ল্যাটফর্ম, কম্পুটারাইজড অ্যানাউন্সমেন্ট, প্রচুর ট্রেন। স্টেশন চত্বর এখন সবসময় গমগমে। চারিদিকে কত বাড়িও হয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে রতনের মুড়ির দোকানও কলেবরে যথেষ্টই বেড়েছে। যেহেতু দোকানের নামে ‘রতন’ আছে, অনেক খদ্দের মদনকে রতন বলে ভুল করে।

স্টেশনের ধারে এই দোকানটা খুব চালু দোকান। মদন ওই প্রোডাক্ট লাইনটা আরও অনেক বাড়িয়ে নিয়েছে। মুড়ি, আলুর চপ তো আছেই তার সঙ্গে পেঁয়াজি, বেগুনি, সিঙ্গাড়া, ঘুগনি, চা, ডিম সেদ্ধ। তবে মেন প্রোডাক্ট কিন্তু এখনও সেই মুড়ি। রতনের মুড়ি নাকি বাজারের সেরা। আর হবে নাই বা কেন? মদন জহুরি লোক। মুড়ির ঠিক ঠাক চালটা এখনও নিজেই কেনে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মদনের বৌ, কাত্যায়নী নিজে হাতে বাড়িতে খোলায় বালি দিয়ে মুড়ি ভাজত। তবে সব ব্যবসার মতো একটু টেকনোলজি আপগ্রেড করে এখন মুড়িটা মেশিনে ভাজিয়ে আনে।

আরও পড়ুন: অবলম্বন (গল্প)

কত রকমের মুড়ির খদ্দের। মুড়ি যারা খায়, তারা জানে মুড়িকে কত ভাবে খাওয়া যায়। যেমন শুকনো মুড়ি সঙ্গে চপ, পেঁয়াজি, সিঙ্গাড়া বা বেগুনি কাঁচা লঙ্কা পেয়াঁজ দিয়ে, আস্তে আস্তে তারিয়ে তারিয়ে। কেউ আবার এগুলোই মুড়ির সঙ্গে মাখিয়ে নেয় একসঙ্গে কাঁসিতে। আবার আর-এক প্রজাতি আছে যারা শুকনো মুড়িতে জল ঢেলে চপ, সিঙ্গাড়া বা ঘুগনি আলাদা করে চাখনা দিয়ে খায়। সব ক্ষেত্রেই একই জিনিস কিন্তু খাওয়ার প্রণালী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট। খদ্দেরদের এই বিহেবিয়ারটা মদন খুব ভাল বোঝে। আর জিনিসের দাম বাজারের বাকি দোকানগুলোর চেয়ে কম। আলুর চপের দাম এখনও জি এস টি নিয়ে দু’টাকা, বাজারে বি পি এল (বিলো পোভার্টি লাইন) চপ নামে চলে। স্বভাবতই ‘রতনের মুড়ি’ যে বিখ্যাত তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। জিনিসের গুণমানও তারিফ করার মতো। কামড় দিলেই বোঝা যাবে যে  কোন মালটা রতনের দোকানের আর কোনটা নয়। মানে ম্যানেজেমেন্টের ভাষায় যাকে বলে ব্র্যান্ডিং। তাই ‘রতনের মুড়ি’র একটা ব্র্যান্ড ইমেজও তৈরি হয়ে গেছে বাজারে।

তাছাড়া মদন ছেলেটা খুব সৎ। আজ পর্যন্ত বাজারে কোনও দুর্নাম নেই। ক্রেতা যদি বলে খেতে ভাল নয়, মদন ফিফটি পার্সেন্ট ছেড়ে দেয়। মানে পুরো গুডউইলের ব্যাপার। মদন বিজনেসের এই সুক্ষ্ম  বিষয়গুলো খুব ভাল বোঝে। যদিও ক্লাস ফোরের পর আর পড়েনি। কিন্তু মদনের বৌ, মানে কাত্যায়নী আবার উল্টো। আগে মদনের খড়ের চালের ঘর ছিল। এখন দোতালা পাকা বাড়ি, শখ করে পুরো দোতালাটা আবার টাইল বসানো, বৌয়ের নাকি টাইলসের খুব শখ, খুব শৌখীন কি না!  নতুন শখ হয়েছে পান খাওয়া। গ্রামের কোনও বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন হলে একদম বেনারসি পরে যাওয়া চাই। সেই কাত্যায়নীর খুব শখ একজোড়া হিল দেওয়া জুতো পরার যদি একটু লম্বা দেখায়। মদন কত করে বারণ করল, কে কার কথা শোনে। ঘুরে মদনকে বলে – “তুমি ইস্টাইলের কি বোঝো? বড় বড় কথা বলছ যে বড্ডো”? মদন আর কিছু বলেনি, শহর থেকে বৌকে হিল তোলা একজোড়া জুতো এনে দিয়েছিল। সেই জুতো পরে এক বিয়ে বাড়ি যাবার পথে কাত্যায়নী একেবারে দুম ফটাস, গেল ডান পা টা ভেঙে। দোষটা যদিও মদনের, ও পাশ দিয়েই হাঁটছিল সময় মতো ধরে ফেললে এই দুর্ঘটনাটা ঘটতো না। মদন চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু অত বড় বপু, তাই শেষ রক্ষা হয়নি। বলে না ওই কপাল আর কি!  তারপর তিনমাস পুরো বেডরেস্ট। সেই থেকে ওই হিলের ‘ইস্টাইল’ এর অ্যাডভেঞ্চার একেবারে বন্ধ। আরে বাবা, হাসার কিছু নেই, মানুষ তো ঠেকেই শেখে, নাকি। যদিও অন্য ঠাটবাট ঠিক বজায় থাকে – যেমন বাড়িতে কাজের লোক, লিপস্টিক, নেল পালিশ ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল নাকি আবার কাত্যায়নীর হ্যাপি বার্থডেও হয়। যদিও সে জানে না তার প্রকৃত জন্মদিন কবে তবুও আধার কার্ডের হিসাবেই বার্থডে পালন করে।

কত রকমের মুড়ির খদ্দের। মুড়ি যারা খায়, তারা জানে মুড়িকে কত ভাবে খাওয়া যায়। যেমন শুকনো মুড়ি সঙ্গে চপ, পেঁয়াজি, সিঙ্গাড়া বা বেগুনি কাঁচা লঙ্কা পেয়াঁজ দিয়ে, আস্তে আস্তে তারিয়ে তারিয়ে। কেউ আবার এগুলোই মুড়ির সঙ্গে মাখিয়ে নেয় একসঙ্গে কাঁসিতে। আবার আর-এক প্রজাতি আছে যারা শুকনো মুড়িতে জল ঢেলে চপ, সিঙ্গাড়া বা ঘুগনি আলাদা করে চাখনা দিয়ে খায়। সব ক্ষেত্রেই একই জিনিস কিন্তু খাওয়ার প্রণালী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট। খদ্দেরদের এই বিহেবিয়ারটা মদন খুব ভাল বোঝে। আর জিনিসের দাম বাজারের বাকি দোকানগুলোর চেয়ে কম।

সেই কাত্যায়নীর হঠৎ একদিন মনে হল যে দোকানে না আছে তার নাম, না মদনের। এইটা একদম ঠিক হচ্ছে না। সে মদনকে বলল দোকানের নাম চেঞ্জ করে ‘কাত্যায়নীর মুড়ি’ রাখতে হবে। আর মদন যেন আর সাইকেল চেপে দোকানে না যায় কারন এতে তার ‘পেসটিক’ (পড়ুন প্রেস্টিজ) জড়িত৷ তার জন্যে একটা ভটভটি  মানে মোটর সাইকেলও কিনতে হবে। মদন বলে মুড়ির সঙ্গে কাত্যায়নী নামটা ঠিক যায় না৷ কাপড়ের দোকান বা নিদেনপক্ষে মিষ্টির দোকান হলেও চলত৷ মদন ফোর পাস হলেও ক্রেতার মনের কথাটা কিন্তু সার বোঝে৷ মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট তো অনেকেই পড়ে কিন্তু সত্যি সত্যি বোঝে কজন? মদন বৌকে সেটাই একটু বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু বুঝলে তো৷ সে গ্রামের মাধ্যমিক পাশ হাতুড়ে অশোক ডাক্তারের নতুন দোতলা বাড়ি, হিরো হন্ডার উদাহরণ টেনে আনে৷ আরে কে বোঝাবে ডাক্তারি আর তেলেভাজার ব্যবসা এক নয়, গলায় স্টেথোর সঙ্গে ভটভটিটা মানায়, চপ-মুড়ির সঙ্গে নয়৷ শেষমেশ সব পরিবারে যা হয় — বৌয়ের কথাই শেষ পর্যন্ত থাকে৷ বাড়িতে নতুন মোটর সাইকেল আসে। দোকানের নতুন নাম হয় ‘কাত্যায়নীর মুড়ি’। বেচারি রতন, বৌমার এই কীর্তিকলাপে স্বর্গ থেকে হাসে আর ভাবে – দ্যাখ যদি চালাতে পারিস।

মদন এখন লুঙ্গি-গেঞ্জি ছেড়ে ভোল পাল্টে প্যান্ট-শার্ট পরে মোটর সাইকেলে করে দোকানে যায়। জিনিসপত্রের দাম ও একটু বাড়ানো হয় কাত্যায়নীর কথায়, মোটর সাইকেল বা তেলের দাম তো তুলতে হবে৷ খদ্দের ভাবে মদনের আবার হলটা কী? দোকানের নাম রতন থেকে কাত্যায়নী, মদনের সাইকেল থেকে মোটর সাইকেল বা লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছা থেকে শার্ট-প্যান্ট। বি পি এল চপ এখন আই পি এল। কিন্তু লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা, তাই যা হবার তাই হল। এক বছরের মধ্যে ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়। মদন তো জানত এটা হবারই ছিল। কাত্যায়নীও অবশ্য যে বোঝেনি তা নয়। তবে ওই ইগো। ভুলটা স্বীকার কেন করবে?

মদন বৌয়ের সঙ্গে আজ প্রায় বিশ বছর ঘর করছে। তাই জানে কীভাবে এই সিচুয়েশনটা হ্যান্ডেল করতে হয়। সে বৌয়ের হ্যাপি বার্থডের দিন একটা শাড়ি আর একটা কেক নিয়ে বৌকে আদর করে বলে – “কাতু, তুই তো জানিস দোকান এখন আর তেমন করে চলছে না। তোর আইডিয়াটা খুব ভাল, কলকাতায় হলে এখন তো একটা পাঁচতলা বাড়ি হয়ে যেত। কিন্তু এটা তো গেরাম। তোকে বোঝার ক্ষমতা এদের নেই। তাই বলি কি, আমি দোকানের পুরানো নামটাই ফিরিয়ে আনি আর যেমনভাবে চলছিল তেমনভাবেই চালাই। পরের বছর দোকান আবার যখন রমরমা চলবে, তখন জন্মদিনে তোকে একটা সোনার হার গড়িয়ে দেব। আর তোর নামেও একটা মেনু নতুন ছাড়ব– কাত্যায়নী স্পেশাল চপ। আলুর সঙ্গে ফুলকপি, নারকেল, গাজর, কড়াইশুঁটি দিয়ে নিরামিষ চপ। বাজারে খুব চলবে দেখিস”। আসলে কাত্যায়নীকে একটা সম্মানজনক ভাবে নিজের করা ভুল থেকে বেরোনোর সুযোগ করে দেয় মদন। আর এই প্রস্তাব লুফে নেয় কাত্যায়নী। সেও জানে ভুলটা ওই করেছে, যাক মুখে স্বীকার করতে হল না, ইগোটা তো রইল৷ মুখে একটা কপট অভিমান এনে ঘাড়টা একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে — “ঠিক আছে, তোমার কথা কি কখনও অমান্য করেছি”?

‘রতন’ দোকানে ফিরে আসে, মদন সাইকেল, গেঞ্জি-লুঙ্গিতে ফিরে যায়, আই পি এল চপ আবার বি পি এলে শুধু সময়টা এক বছর এগিয়ে যায়। আস্তে আস্তে ক্রেতারাও ফেরত আসে। ‘রতনের মুড়ি’ আবার স্বমহিমায় যে ফিরবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু পরিবর্তন বলতে সাইন বোর্ড থেকে কাত্যায়নীর ডিমোশন হয়ে মেনুর মধ্যে প্রবেশ। তবে কাত্যায়নী চপ কিন্তু বাজারে দারুণ হিট, পুরো ইউনিক জিনিস।

এক বছর পর, কাত্যায়নীর জন্মদিনে মদন একটা সোনার হার কেনে। হারটা পেয়ে মদনের বৌ যেন একটু অনুতাপে ভোগে আর বলে তার জন্যেই ব্যবসায় এত ক্ষতি হয়ে গেল। মদন একটু হেসে বলে – “আরে জীবনে লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ তো লেগেই থাকে। আসলে সবকিছুই একটা উপলব্ধি, সেই উপলব্ধি থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনে পথ চলতে হয়, সেখানে প্রকৃত ভাল বা মন্দ বলে কিছু নেই। আরে পুরো জীবনটাই একটা লাভ, সামান্য অর্থক্ষতি তার কাছে কি এমন! আর একটা কথা হল শিকড়৷ দুঃখের বিষয় আমরা মাঝে মাঝেই ভুলে যাই কোথা থেকে উঠে এসেছি৷ শিকড়কে ভুলে গেলে তো নিজেকেই ভুলে যেতে হয় রে কাতু৷” জানিনা, একটা ফোর পাস লোক এই জীবনবোধ কোথা থেকে পায়। কখনও কখনও মনে হয় পুঁথিগত বিদ্যা মানুষকে উপার্জনক্ষম করে তোলে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত জীবনবোধ বোধহয় মানুষ শেখে জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। দুবেলা যার একসময় পেটপুরে খাবার মিলত না, সে আজ গাঁয়ের অন্যতম ধনী ব্যক্তি৷ মদন বলে  কাত্যায়নীর জন্যে যে ক্ষতি হয়েছে তা মোটেই সত্যি নয়, বরং যে প্রাপ্তি হয়েছে সেটা অমুল্য। আসলে মানুষের সমস্যাটাই হল, কী হারিয়েছে তার হিসেবে করা। হারানো বা না পাওয়ার তো কোনও শেষ নেই, কিন্তু প্রকৃত প্রাপ্তির হিসেব খুব কম লোকেই করে আর যারা করে তারাই জীবনে সুখী৷  চুপ করে কথাগুলো শোনে কাত্যায়নী। কেউ তো কখনও ওকে এইভাবে জীবনবোধ ব্যাখ্যা করেনি। তারপর হাতের হারটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে। সত্যিই কি খুব দামি এটা? মনে তো হয়না, শুধু খুব চকচক করে এই যা! “এই নিয়ে যাও এইটা, আমার আর লাগবে না গো, শুধু তুমি পাশে থাকলেই হবে।”

ছবি সৌজন্য: মৌমিতা মালিক

লেখক আই আই টি খড়্গপুর থেকে এম টেক ও পরে আই আই টি দিল্লী থেকে এম বি এ করেছেন ও এম আই টি থেকে সার্টিফিকেশন কোর্স ও করেছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা ও সেখানেই কর্মরত। উনি ওখানকার বাংলা সংস্কৃতি জগৎ ও বাঙালি কম্যুনিটির সক্রিয় সদস্য। লেখক ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কবিতা, ছোট গল্প, গান, চিত্রনাট্য, ছোট নাটক লিখেছেন। ওনার লেখা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ পরিচিত মুখ। ইউটিউবে ওনার লেখা গান গেয়েছে সানফ্রান্সিস্কো বে এরিয়ার বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড - বং কানেকশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *