গত শতকের তিনের দশক বাংলা গানের ক্ষেত্রে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা গানে সর্বার্থে আধুনিকতা প্রথম এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অথচ রবীন্দ্র-পরবর্তী সমসাময়িক বাংলা গান কী ভাবে যেন ‘আধুনিক’ নামে চিহ্নিত হয়ে গেল। ১৯৩০ সালে রেডিওতে ‘আধুনিক’ কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হয় এবং তারপর তা ব্যাপক ভাবে চালু হয়ে যায়।

১৯৩০ সালেই বাংলা ছবি সবাক হয়। নাটকের পথ ধরেই সিনেমাতেও গানের প্রয়োগ ঘটল প্রধানত মনোরঞ্জনের কারণে। ক্রমশ তা বাড়তে থাকল।  আগে ছিল গীতিকার সুরকার একই ব্যক্তি। তিনের দশকেই দেখা গেল একজন গান লিখছেন, আর একজন সুর করছেন, আর তা গাইছেন অন্য একজন। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই ধরনটাই বজায় রইল। এইভাবে বেসিক রেকর্ড আর ছায়াছবির গানের জন্যে বহু গীতিকার-সুরকারের প্রয়োজন হল। বেশ কিছু ভালো গীতিকার সুরকার শিল্পী ক্রমশ উঠে এলেন। তিনের দশক, তারপর চার – পাঁচের দশকেও প্রতি মাসে বিবিধ রেকর্ড বেরিয়েছে এইচএমভি, কলম্বিয়া, হিন্দুস্তান, মেগাফোন, সেনোলা প্রভৃতি রেকর্ড কোম্পানি থেকে। তবে গানের চরিত্র আস্তে আস্তে বদলে গিয়েছে। আগের আগমনী-বিজয়া, বাগানবাড়ির গান, ভক্তিগীতির জায়গা নিল মূলত আধুনিক গান। প্রকাশিত বেসিক রেকর্ডের মধ্যে অধিকাংশই আধুনিক।

Hemanta Mukhopadhyay
স্বর্ণকণ্ঠ শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য – cinestaan.com

ছয়ের দশক থেকে প্রতি মাসে রেকর্ড প্রকাশ ক্রমশ কমে যেতে থাকে। স্ফীত হতে থাকে পুজোর রেকর্ড। তাছাড়া বসন্তে গ্রামোফোন কোম্পানি ‘বসন্ত বন্দনা’ নামে নতুন রেকর্ড বার করত। বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গ্রামোফোন কোম্পানিই মুখ্য প্রকাশক। পাঁচ-ছয়ের দশক থেকে পুজোর নতুন গান নিয়ে আলাদা একটা উন্মাদনা আগ্রহ দেখা যেতে লাগল। আগে এমনটা ছিল না, জানা যায় স্বর্ণকণ্ঠ শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা থেকেই। বলছেন: “পুজোর গান নিয়ে এমন হইচই আগে হত না। তখন প্রায় প্রতি মাসেই বাংলা গানের রেকর্ড বের হত। একটি উদাহরণ দিচ্ছি — ১৯৪৪ সালে আমার আধুনিক গানের চারটি ও রবীন্দ্রসংগীতের একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। সেজন্য সেসময় পুজোর গানের ব্যাপারে এতটা উন্মাদনা ছিল না। আমি কোনোদিনই পুজোর গানের জন্য আলাদা করে উত্তেজনা, উন্মাদনা বা দুশ্চিন্তায় থাকি না।” এ কথা বলার পরও কিন্তু হেমন্তকে কবুল করতে হয়, “তবে পুজোয় গান হবে না — এমন কথা ভাবতেই কষ্ট হত। তাই বাংলা ও হিন্দি ছবি নিয়ে আমার সেই ব্যস্ততার দিনেও আমি পুজোর গান করেছি (আমার পুজোর গান, এইচএমভি-র শারদ অর্ঘ্য, ১৯৩২)।” ঠিক কথা, পুজোর গানের আমেজই আলাদা।

একটা সময় রেডিওতে আধুনিক গানের ‘অনুরোধের আসর’ অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল। তখন যে-কোনও গান শোনা এখনকার মতো এত সহজ ছিল না। রেকর্ড প্লেয়ার খুব কম লোকের বাড়িতেই থাকত। সুতরাং রেডিওই প্রধান ভরসা। রেডিওতে পুজোর নতুন গান বাজত। তারপর পুজোর প্যান্ডেল প্যান্ডেলে বাজত পুজোর গান। এইভাবে ছড়িয়ে পড়ত বিভিন্ন শিল্পীর নতুন গান।

Sachin dev Burman
আগরতলা থেকে মুম্বই গিয়ে খ্যাতির শিখরে উঠলেন শচীনদেব বর্মণ। ছবি সৌজন্য – theindianexpress.com

আগরতলা রাজপরিবারের ছেলে শচীনদেব বর্মন মুম্বই গিয়ে সুরকার এসডি বর্মন নামে বিখ্যাত হলেও প্রথম থেকেই বাংলা আধুনিক গেয়েছেন। তার বেশিরভাগই বেরিয়েছে পুজোতেই। প্রথমে শচীনদেব ছিলেন হিন্দুস্তান কোম্পানির শিল্পী। ১৯৩২-এ প্রথম রেকর্ড। চারের দশকের শেষে শচীনদেব এইচএমভি-র শিল্পী হন। ১৯৩২ থেকে প্রায় আমৃত্যু শচীনদেব বাংলা আধুনিক গেয়েছেন মূলত নিজের সুরে। অন্য সুরকার হলেন সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। গীতিকার ছিলেন অজয় ভট্টাচাৰ্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সহধর্মিনী মীরা দেববর্মন। শচীনদেবের সুর ছিল প্রধানত লোকসংগীত ও উচ্চাঙ্গসংগীত নির্ভর। তাঁর একটু আনুনাসিক কণ্ঠ, নাটকীয় গায়নশৈলির একটা মেজাজ ছিল। তাঁর বহু পুজোর গানই সমাদৃত হয়েছে, যেমন — ‘মম মন্দিরে'(১৯৩৬),  ‘মন দিল না বঁধূ'(১৯৫৬), ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ (১৯৬০)।

Pranab Roy
প্রণব রায়ের কথায় পুজোর সাড়া জাগানো গান এমনি বরষা ছিল সেদিন। ছবি সৌজন্য – bangadesh.com

মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম রেকর্ডে ‘সাঁঝের তারকা আমি’ গেয়ে সাড়া-জাগানো শিল্পী যূথিকা রায় নানা পুজোর গান উপহার দিয়েছেন। অবশ্যই উল্লেখ্য প্রণব রায়ের কথায় কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’। খুব বেশি গান না করলেও একটিমাত্র গানের জন্যেই স্মরণীয় গীতশ্রী গীতা দাশ। ১৯৩৮-এর পুজোয় গেয়েছিলেন ‘ছিল চাঁদ মেঘের পারে।’ অজয় ভট্টাচার্যের কথায় এখানে পুষ্পচন্দ্রিকা রাগ তৈরি করে অসামান্য সুর করেছিলেন হিমাংশু দত্ত। এ গানের অভিঘাত এমনই যে পরে একাধিক শিল্পী এ গান ফিরে ফিরে গেয়েছেন, মানে রিমেক করেছেন। ভালোবাসার আর এক মধুর গান পুজোয় শোনালেন গৌরীকেদার ভট্টাচাৰ্য- ‘এনেছি আমার শতজনমের প্রেম।’

Salil Chowdhury
সলিল-হেমন্ত জুটি বাংলা গানের জগতে নতুন দিগন্তের সূচনা করল। ছবি সৌজন্য – thestatesman.com

১৯৩৮-এ সংগীত জগতে প্রবেশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। তারপর সুদীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেছেন। কতই না স্মরণীয় গান উপহার দিয়েছেন তাঁর স্বর্ণকণ্ঠে। তার অনেকগুলিই বেরিয়েছে পুজোতেই। চারের দশকের শেষে এক নতুন গানের কারিগরকে সামনে নিয়ে এলেন হেমন্ত। নবীন সলিল চৌধুরীর কথায়-সুরে শোনালেন নতুন ভাব, নতুন আঙ্গিকের গান: ‘কোনও এক গাঁয়ের বঁধু।’ বাংলা গানের যেন দিকবদল ঘটল। গানের বিষয়, সুর-আঙ্গিক সবই অভিনব। তৈরি হল এক সার্থক জুটি: সলিল-হেমন্ত। নানা পুজোয় এই জুটির কাছে পাওয়া গেল নানা মন-ভোলানো গান: ‘পথ হারাব বলেই এবার’ (১৯৫৮), ‘রানার’ (১৯৫১), ‘পাল্কির গান’ (১৯৫২), ‘শোনও কোনও এক দিন’ (১৯৬৯) ইত্যাদি। এখানে রানার আর পাল্কির গান — দুটি কবিতা, যথাক্রমে সুকান্ত ভট্টাচাৰ্য ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা।

Gouriprasanna
গানের কথায় সঙ্গীতজগত জয় করলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। ছবি সৌজন্য – thedailystar.com

কবিতায় সুরারোপের ক্ষেত্রেও সলিল নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন। তাঁর লেখা গভীর, তাছাড়া সুরে দেশি ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের চমৎকার মেলবন্ধন। আর এক ব্যতিক্রমী সুরকার নচিকেতা ঘোষের আলাদা মেজাজের সুরে হেমন্ত এক পুজোয় গাইলেন ‘কোন পাখি ধরা দিতে চায়’ (কথা: মুকুল দত্ত)। আর এক পুজোয় ‘যদি জানতে চাও’ (কথা: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার)। গণনাট্য সঙ্ঘের পরেশ ধরের রচনা ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’ ১৯৫৩-র পুজোয় একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ছবি আঁকলেন হেমন্ত। নিজের সুরে হেমন্তের উল্লেখযোগ্য পুজোর গান – ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’ বা ‘অলির কথা শুনে’ (কথা: গৌরীপ্রসন্ন, ১৯৬০)। নবীন এক শিল্পী – সুরকার সতীনাথ মুখোপাধ্যায় একদিন হেমন্তকে এসে অনুরোধ করলেন যদি তাঁর সুরে হেমন্ত পুজোয় গান রেকর্ড করেন। হেমন্ত তাঁকে বিমুখ করেননি। গৌরীপ্রসন্নর কথায় ১৯৫৬-র পুজোয় হেমন্ত গাইলেন ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই।’ যেমন মরমী সুর, তেমনই দরদী গায়ন। হেমন্তের মূলধন ছিল তাঁর মধুর কণ্ঠ, স্পষ্ট উচ্চারণ, সুমিত আবেগ।

১৯৩৯ সালে এলেন আর এক অসামান্য শিল্পী জগন্ময় মিত্র। প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরীর কথায়, কমল-সুবল দাশগুপ্তের সুরে জগন্ময় ভালোবাসার কত না নিবিড় গান শুনিয়েছেন। যেমন, ‘চিঠি’ (১৯৪২), ‘সাতটি বছর আগে পরে’ (১৯৪৮)। মেলোডিসম্পন্ন সুর, তেমনই নরমভাবে গেয়েছেন জগন্ময় মিত্র। ‘যদি ভুলে যাও মোরে জানাব না অভিমান’ গেয়ে সংগীতজগতে পা রেখেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচাৰ্য। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। প্রথমদিকে আধুনিক, পরের দিকে ভক্তিগীতি গেয়েছেন সমান নৈপুণ্যে। রাগভঙ্গিম গানে অভ্যস্ত ধনঞ্জকে দিয়ে ছয়ের দশকে সলিল চৌধুরী গাওয়ালেন অভিনব ছন্দবিন্যাসে ‘অন্তবিহীন এই অন্ধ রাতের শেষ।’ এর উল্টোপিঠের গান সুপরিচিত ‘ঝনন ঝনন বাজে’ রাগের আশ্রয়েই শুরু হয় — কলাবতী রাগ। কিন্তু অন্তরাতে সুরে ছন্দে গান দিক বদলায়।

Kamal-Firoza
কমল ও সুবল দাশগুপ্তের সুরে ফিরোজা বেগমের গান মাতিয়ে দিল বাঙালি শ্রোতাদের। ছবি সৌজন্য – observerbd.com

ত্রিসপ্তকব্যাপী কণ্ঠে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের অন্যান্য উল্লেখ্য পুজোর গান ‘চামেলি মেলো না আঁখি’ (১৯৫৮), ‘বিদায় নিতে কী এলে’ ও  ‘আমি চেয়েছি তোমায়’ (১৯৫৬),  ‘এইটুকু এই জীবনটাতে’ (১৯৬০)। ধনঞ্জয়, সলিল চৌধুরী ছাড়া যেসমস্ত গীতিকার সুরকারের গান গেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন প্রণব রায়, শ্যামল গুপ্ত, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুধীন দাশগুপ্ত, রতু মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল ভট্টাচাৰ্য, সুনীলবরণ, অনল চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, প্রবীর মজুমদার।

Utpala Sen
সুরের জাদুকর সতীনাথ মুখোপাধ্য়ায় ও তাঁর সহধর্মিণী সুগায়িকা উৎপলা সেন। ছবি সৌজন্য – pinterest.com

চারের দশকে ‘একহাতে মোর পুজার থালা’ গেয়ে প্রতিষ্ঠা পান সুধীরলাল চক্রবর্তীর শিষ্যা উৎপলা সেন। তাঁর চর্চিত কণ্ঠের এক অন্য মাধুর্য ছিল। সলিল চৌধুরীর ‘প্রান্তরের গান আমার’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ড করলেও বিশেষ কারণে তা প্রকাশিত হয়নি। তখন উৎপলা সেনকে দিয়ে গানটি গাওয়ান সলিল। উৎপলা অসাধারণ গেয়েছিলেন। উৎপলার বেশি গান সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে। তাছাড়া গেয়েছেন নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সুরে আর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় দাশগুপ্ত প্রমুখের কথায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য পুজোর গান: ‘ময়ূরপঙ্খী ভেসে যায়’, ‘এতো মেঘ এতো যে আলো’ ইত্যাদি।

পুজোর গান: একাল ও সেকাল (১)

Swapan Shome

স্বপন সোম এ কালের বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত গবেষক। গান শিখেছেন মোহন সোম, মায়া সেন ও সুভাষ চৌধুরীর মতো কিংবদন্তীদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে 'দেশ' পত্রিকায় সংগীত সমালোচনা করেছেনl গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক', 'সানন্দা', 'আজকাল', 'এই সময়', 'প্রতিদিন' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায়l

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *