আগের পর্বের লিংক: [] []

আমরা সে অর্থে বাংলা ব্যান্ড প্রজন্ম। বছর দশ আগে যখন বাংলা ব্যান্ডের সিন রমরম করছে, আমাদের যৌবনও চড়চড় করে উড়ছে আকাশে। আহা কী সব দিন! গোলপার্কের নজরুল মঞ্চটাই যেন সন্ধ্যা হলে উডস্টক। অসংখ্য কালোকালো মাথা, গাঁজার ধোঁয়া, অসাবধানী চুমু পেরতে পেরতে ড্রামসের তালেতালে গর্জে উঠছে যৌবন। আধুনিকতা, যা হারিয়ে আজ আমরা এই পলিটিক্যালি কারেক্ট একটা সমাজ বানিয়েছি, তা যৌবনের সহজ সরল প্রেমের মতোই লেকের আশপাশে বেড়ে উঠছিল, হ্যাঁ, ব্যান্ডের হাত ধরেই তো। টেলিভিশন চ্যানেলে ব্যান্ডোদাদের রকস্টার ইমেজ আছড়ে পড়ছিল মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। ছড়িয়ে খানখান হচ্ছিল ‘সভ্য-সুশীল-ভদ্র’ নৈতিকতা। একটা বেহিসেবিপনা, একটা তুমুল কেয়ারলেসনেস ভর করেছিল আমাদের। যৌনতা বা নেশা নিয়ে ট্যাবুগুলো ফটাফট ভেঙে যাচ্ছিল। প্রতি সন্ধ্যা তাই বাঁধা থাকত ফসিলস-ক্যাকটাস-চন্দ্রবিন্দুদের নামে…

হয়তো এক দশক আগের বাংলা ব্যান্ডের এই স্বপ্নে অনেক ভুল ছিল, হয়তো সবচেয়ে বড় ভুল, শুধু যৌবনের সৎ আবেগকে পুঁজি করে, ইতিহাস না-জেনে বা তিনটে কর্ড জেনেই গান বাঁধতে আসা অনেকের। এ রকম অনেক ফাঁকফোকর হয়তো ছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ফিরে তাকালে মনে হয়, অন্তত, আজকের থেকে আধুনিক ছিল সেই সময়টা। মধ্যবিত্ত আজকের রিগ্রেসিভ সিরিয়ালের বদলে এই রকস্টার অ্যাটিটিউড বুঝতে বাধ্য হচ্ছিল।

ক্যাকটাস বেঁধেছিল, ‘তুমিও বোঝো আমিও বুঝি/ বুঝেও বুঝি না’-এর মতো গান, যা নাগরিক ডুয়াল স্ট্যান্ডার্ড প্রেমকে খুবলে আনছিল, ডিস্টরশন গিটার যে একটা সময়ের ভাষ্য তা আমরা অনুভব করে অজান্তেই আধুনিক হয়ে উঠছিলাম। তারপর গোলপার্কের রাস্তায় টুপটাপ প্রেম ঝরে গেল, অঞ্জন দত্ত সে প্রেম তুলে রাখলেন ম্যাডলি বাঙালি ছবিতে। বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম যখন সারারাত, নানা রকম বাজনা শোনা- দেশ বিদেশের গান শোনা- ব্যান্ডের দাদাদের সঙ্গে কত কত আলোচনা-রিহার্সালের পর রিহার্সালে কত কত সময় ব্যয়। তাকে ঘিরে কত কত প্রেম, কত কত বন্ধুত্ব ভাঙা-ঝগড়া-রাগ-অশান্তি-নেশা- ফের সকালে আবার একজোট হয়ে বেজে ওঠা কোনও নতুন কলেজ ফেস্টে।

আসলে, আশি-নব্বইয়ের আন্তর্জাতিক কলকাতার অন্যতম চিহ্ন ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন, লিটল ম্যাগাজিন, গ্রুপ থিয়েটার- এই সবটা নিয়েই কলকাতার ইন্টেলিজিনশিয়ার উত্তরাধিকার বাংলা ব্যাণ্ড। এর প্রায় সমসময় বিশ্বায়ন ঘটবে, ডিজিটাল ব্যবস্থা মুক্ত-অর্থনীতির দ্যোতক হয়ে ঘোষণা করবে ভবানীপুরের বদলে সাউথসিটিই আগামীর কলকাতা। আর এই সময়েই বাংলা ব্যান্ড যৌবনের চিৎকার হয়ে নজরুল মঞ্চে ঘোষণা করল, ‘বাইসাইকেল চোর’, ‘আনন্দ সেন বই পড়তেন’, ‘পড়াশোনায় জলাঞ্জলি ভেবে করছ ছি-ছি-ছি’…।

এক ধরনের নাগরিক হতাশা আর মেনে না-নেওয়ার কথাই বারবার ঘোষণা করছিল যৌবন। চারপাশে যেটা চলছে, সেটা মেনে নিতে পারছে না এইসব ছেলেমেয়েরা, বোঝা যাচ্ছিল তারা খোলা বাজারের হাওয়ার সঙ্গে প্রগতিশীল একটা বোধ থেকে লড়তেই জামায় বব মার্লে আর ট্যাটুতে জিমি হেন্ডরিক্স ঝুলিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছিল, তারা কি পারবে স্পনসর-বিহীন সত্যিকারের সময়-বদল? পারলে কীভাবে?

Nabarun Bhattacharya 1
আমার রক শুনতে ভাল লাগে, স্পষ্ট বলেছিলেন নবারুণ

এঁদের কেউ কেউ আজ আর বেঁচে নেই, কেউ বিদেশে, কেউ ইতিহাস, কেউ প্রতিষ্ঠান, কেউ একই রকম দ্রোহপুরুষ। আমরা, যারা ৯০-এর মার্ক্স ও কোকোকোলার সন্তান, আজও সকালে উঠে মাথা ভালো কাজ না করলে হার্ড রক ব্যান্ড শুনি। শুনি ডেথ মেটাল। দেখি বেশ ঝকঝকে লাগছে। মনে পড়ে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক সেমিনারে গেছিলাম সেই সময়ে। রক মিউজিক কি গান? এ নিয়ে জোর হইচই উঠেছিল। বয়স্করা আমাদের ‘বেয়াদপ ছেলেছোকরা’র তকমায় উড়িয়েই দেন। কিন্তু সেখানে আমাদের সমর্থন করেছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। সোচ্চারেই বলেছিলেন, ‘আমার রক মিউজিক শুনতে ভালো লাগে। সকালে উঠে প্রায়ই শুনি…’

আমরা সত্তর দশক দেখিনি। কিন্তু রক মিউজিকের মধ্যে ছিল একটা সত্তরের গর্জন, তা টের পেয়েছিলাম। টের পেয়েছিলাম কেউ কেউ এ সমাজটা মেনে নিতে পারেনি, ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল এই সবকিছু। পারেনি, গানে রেখে গেছে সে বার্তা। এসব গান তারই প্রমাণ…। আমাদের এরপর আধুনিক হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। হয়তো ভুল ছিলাম আমরা, কিন্তু ঠিকভাবে ঘুমনোর থেকে সেই ভুল সচলতা খারাপ ছিল না…

 

আশির দশকের বিকল্প চিন্তকদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন কবি ও অধ্যাপক অভীক মজুমদার। প্রসঙ্গত তিনি জানালেন, সুমনের আবির্ভাবের আগে বাংলা সিনেমা বা সাহিত্যের আধুনিকতার সঙ্গে বাংলা গানের আধুনিকতাকে মেলাতে অসুবিধে হচ্ছিল। মহীনের ঘোড়াগুলির একটা আবছা প্রভাব সে সময় ছিল ঠিকই। কিন্তু যে সময়ে মহীনের ঘোড়াগুলি বা নগর ফিলোমেল কাজ করছে, সে সময়টায় ‘মিডিয়া-বিপ্লব’ না থাকায় খুব প্রচার পাচ্ছিলেন না তাঁরা। একটা ছোট গোষ্ঠীতে ঘুরছিল গানগুলি। তাই রেকর্ডগুলো কোনওরকমে জোগাড় করেই গানগুলি শোনা হত। তবে গানগুলির সংখ্যাও ছিল খুব কম, আর গানগুলির আধুনিকতাও খুব স্পষ্টভাবে ধরা দিচ্ছিল না।

Bengali Music scene from 1990s
বাংলা গানের আধুনিকতার কুয়াশা আরও ঘন হচ্ছিল একক বা সমবেত যে কোনও সংযোগেই

রবি ঠাকুরের হাতে গড়ে ওঠা ‘নির্জন এককের গান’ একদিকে, আর অন্যদিকে কলকাতার রসগোল্লা বা পার্টিজান গানের রেজিমেন্টেশান-এর কোনওটাই আমাদের যৌবনকে ধরতে পারছিল না। ভূপেন হাজারিকা বা ক্যালকাটা কয়ার তাঁদের মতো করে চেষ্টা করছিলেন। এর পাশে আমাদের কিছুটা মুক্তি দিচ্ছিল সত্যজিতের কিছু সিনেমার গান, নাটকের কিছু গান, যেখানে ‘মারীচ সংবাদ’ বা ‘তিন পয়সার পালা’ আছে, কিন্তু গোদার বা বুনুয়েল ফিল্মক্লাবে দেখে ফিরে এসে বাংলা গানের আধুনিকতার কুয়াশা আরও ঘন হচ্ছিল একক বা সমবেত যে কোনও সংযোগেই। তাই সুমনের গান তথা সাংস্কৃতিক উপস্থিতিতে এই আস্ত সময়টাই ধরা দিল যেন, আর গানগুলি হয়ে গেল অজান্তে ‘আমাদের’!

সাম্প্রতিক দুনিয়ার সঙ্গে সংলাপের ভিত্তিতে আমরা সুমনের মধ্যে দিয়ে একটা নতুন ধারার বামপন্থা তথা ‘ইন্ডিভিজুয়ালিটি’ খুঁজে পেলাম।  কবিতা আর গানের দূরত্ব ক্রমেই ঘুচে যেতে লাগল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নতুন অনুষঙ্গে। পাগলের মতো আমরা সুমনকে অনুসরণ করতে থাকলাম। সুমন ফেনোমেনায় অনেকেই গাইতে এলেন, যেমন অঞ্জন সুমনের ঘনিষ্ঠ হয়েও নিজের স্বকীয়তাতেই কিছু গান গাইলেন, যা আমাদের মনে ধরল। এরপর ‘চন্দ্রবিন্দু’,  ‘ফসিলস’ বা ‘দোহার’ সংস্কৃতি বা ভাষাকে আবার সময়ের সঙ্গে মেলালো বিভিন্নভাবে। আমার শিলাজিতের ‘ফিসফিস’ অ্যালবামটিও কিন্তু ইন্টেরেস্টিং লেগেছে। কিন্তু সুমনের প্রস্তুতি আর প্রতিভা বিরল হওয়ায় আজ তার অভাবে আবার একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। বাংলা ভাষার চর্চার ধারা যদি সাবলীলভাবে না রাখা যায়, তবে চিন্তা সাবালক হবে না। কাজেই শেকড় বা শহর থেকে আন্তর্জাতিক ধারার প্রবাহমানতা বাধাপ্রাপ্ত হবেই এবং হচ্ছেও। অতীতকে এই কর্পোরেট-বর্তমানে ফিরিয়ে আনাই তাই এখন প্রধান লড়াই।

নব্বই-পরবর্তী ব্যান্ডের দাদারা অনেকেই তাই আজ চুলটুল কেটে বিয়েটিয়ে করে সুখী সংসারী। মাঝেসাজে দেখা হলে, নিজেরাই লজ্জা পায়। কেউ চাকরি করে, কেউ বিদেশে চলে গিয়েছে। মূলধারার ব্যান্ডরা সিনেমাতেই গান বেশি লেখেন। দশ বছর আগের সেই স্মৃতিগুলো কি তবে ভুল ছিল? আনমনে রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে ভাবি… ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবু সন্ধ্যা হয়ে আসে আমার কলকাতায়। হঠাৎ পরের মোড়ে দেখা হয়ে যায় একদল কলেজ ছাত্রের সঙ্গে, তারা জানায় তারা একটা পোর্টাল করছে, তাতে নিজেরাই গান গেয়ে পোস্ট করেছে এবং প্রচুর লাইক পেয়েছে। আমাকে তারা অনুরোধ করে এ প্রজন্ম নিয়ে কিছু কথা বলতে, ফোনের ক্যামেরা অন করে হঠাৎ। আমি দেখি সন্ধ্যা নামছে আমার শহরে। আমি বলি, আমার একটু তাড়া আছে, একটু পরে নজরুল মঞ্চ উডস্টক হয়ে উঠবে…

 

ছবি সৌজন্য: Facebook, Pinterest

পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *