তোমার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল, শঙ্খবাবু
সবাই তোমায় আপনি বলে, মনে মনেও তেমনটা কি?
তুমি আমার পরিযায়ী যে জীবনে খাটাও তাঁবু
অরণ্যে হোক, পর্বতে হোক, আমি তোমায় তুমিই ডাকি

লোকে বলে জাতির বিবেক, সেটাই তোমার সার পরিচয়
মানছি আমি শক্ত বড় ধারণ করা এই উপাধি
বুঝতে পেরেই তোমার জন্য রাখছি লিখে এ পঙক্তিচয়
আমিষ তোমার পছন্দ নয়? তোমার জন্য ছন্দ রাঁধি

তোমার কাছে প্রেম যা আছে, সমস্তটাই দার্শনিকের?
মানবপ্রেমের আলোক জ্বালাও এ সভ্যতার স্তরে স্তরে
তোমার যত প্রেমের কথা, সব মানুষের দিগ্বিদিকের
আমায় তুমি প্রেম শেখাবে? হাত ধরেছি বিষম জোরে

সে হাত আমার ছাড়িয়ে নিলে, ছড়িয়ে গেলে সবার মাঝে
আমায় তোমার আসক্তি নেই, বেশ বুঝেছি এই কথাটা
তোমার জন্য শ্রদ্ধা রাখি, বুকের ভেতর সরোদ বাজে
তাই তো তোমায় পড়ার পরে লুকিয়ে খুলি গোপন খাতা

কী আছে সে খাতায় জানো? জ্যান্ত প্রেমের অগ্নিশিখা
নেভাতে চাও? হাত পোড়াবে, অতই সহজ নয় তো দহন
তুমি শোনাও ধ্যানের বোধি, আমার সবই ধ্যাত্তেরিকা
মানবপ্রেমের বার্তা পাঠাও, কী সাতকাহন কী সাতকাহন!

এমন করে বলতে তো নেই, বিঁধতে তো নেই এ বিদ্রুপে
বরং তোমায় পুজোই করি, নিজের কাছেও যা নিরাপদ
তোমার জন্য আসন পাতি, সাজি নিজের সহজ রূপে
এই লেখাকেও পরিয়ে দিলাম আমার খাতার শ্বেত প্রচ্ছদ

সেইখানে খুব অসুখ ঢাকা, বিষণ্ণ তাই সেই মলাটও
তারও অধিক অসুখ দেশের, তোমার হাতেই ওষুধ তো তার
সবই জানি সবই বুঝি প্রেমেই তুমি প্রেমকে কাটো
এখন তুমি পরিত্রাতা, পবিত্র এক বিশুদ্ধতার

সভ্যতাকে আরোগ্য দাও, এমনি তোমার সে শুশ্রুষা
রুগ্ন মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে পঙক্তিদু’টির মধ্যিখানে
আঁধার কালো রাত্রিশেষে চক্রবালে জাগাও ঊষা
কাউকে কিছু না-ই বা বলো, যে জানে সে সত্যি জানে

এই জানাতে গর্বিত হই, সরিয়ে রাখি কাঙালপনা
কবি আমার মস্ত বড়, কলম জুড়ে কাজের বোঝা
একা একাই হৃদয় ভরে অক্ষর যে কী আলপনা
আমি যেমন তোমায় দেখি, আমায় দেখা নয়কো সোজা।

তোমায় আমায় চেনা ছিল, যেমন প্রিয় আমার ভিটে
সেইখানে সেই বাবলা গাছে ফুল আসত বছর বছর
তবুও তোমায় খুঁজেই গেছি, খুঁজেই গেছি কী নিভৃতে
বাবলা গাছের আঠাই যেন, যেমন আঁটো তেমনি নাছোড়

সেই আঠাতেই জড়িয়ে আছি, আমার একার তুমি-আমি
তার কী খবর রাখো তুমি? মানছি তুমি অনেক বড়
জানি তোমার পঙক্তিগুলি গভীরতায় ভীষণ দামি
তবুও বলি এক পলকে তোমার-আমার স্বর্গ গড়ো

সত্যি যদি না পারো তা, করব না আর পীড়াপিড়ি
তোমার মতোই থাকো নাহয়, আমিও থাকি নিজের তালে
তোমার কাছে পৌঁছব যে– নেই তো আমার তেমন সিঁড়ি
কিংবা থাকলে থাকতে পারে ভবিষ্যতের প্রাচীনকালে

মানছি তুমি মহান কবি, সভ্যতাকে আগলে রাখো
সবাই যখন ধ্বংস হবে, তারপরে সেই ধ্বংসস্তূপে
আবিষ্কৃত হতেই পারে তোমার আমার অলীক সাঁকো
প্রণয় যখন প্রত্নতত্ত্ব, গুছিয়ে রাখা অন্ধকূপে

তাই তো তোমায়, শঙ্খবাবু, যাই ডেকে যাই বারেবারে
আমার এমন প্রগলভতায় চাইছি ক্ষমা মাথা নুয়ে
রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের অকূল পারাবারে
তোমার আমার এই কবিতা সেই বারিধিই দিচ্ছে ধুয়ে

এই ধোয়াটাও মাপের ব্যাপার, সমুদ্রজল যেমন নোনা
সেই নোনাটাও মাপের আবার, না যেন হয় নুনেই তেতো
এত বিরাট, নিজেই তুমি সে-সত্তাটির মাপ জানো না
কোথায় কাকে বাসছ ভাল, তা জানলে তো হয়েই যেত

এতই যদি হিসেবপাতি, শব্দচয়ন এমন মাপা
এ দুই হাতে ধরছি বাতি, শিখাটি যার অল্প কাঁপা

সভ্যতার এ রাত্রিকালে দাও আমাকে ভোরের চাঁপা

মন্দাক্রান্তা কবিতা লিখছেন নব্বইয়ের দশক থেকে। তাঁর জন্ম কলকাতায়। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়েও ফাইনাল পরীক্ষা দেননি। কবিতার টানে প্রথাগত পড়া ছেড়ে মননচর্চা শুরু। প্রথম বই ১৯৯৯ সালে 'হৃদয় অবাধ্য মেয়ে।' সে বছরই এই বই আনন্দ পুরষ্কার এনে দেয় তাঁকে। এরপর 'বলো অন্যভাবে', 'ছদ্মপুরাণ', 'উৎসারিত আলো', 'এসবই রাতের চিহ্ন' প্রভৃতি একের পর এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসও লিখেছেন তার পাশাপাশি। 'ঝাঁপতাল', 'দলছুট', 'ঋতুচক্র' পাঠকমহলে বহুল সমাদৃত হয়।

5 Responses

  1. “সেই আঠাতেই জড়িয়ে আছি, আমার একার তুমি-আমি”…আমরা ভাবি, কবি সেই ভাবনাকে রূপ দেন। শঙ্খ ঘোষের সাথে এই আঠাতেই কি জড়িয়ে নেই আপামর বাঙালী! কবি পাঠকের এই আনতি জানেন, আর তারই প্রতিফলন ঘটান এমন এক অসামান্য লেখায়। সহজ ছন্দের ভেতরে যে কাঠামো-কাঁপানো হাওয়া হু হু বয়ে যাচ্ছে, সেই হাওয়াতেই নাও ভাসানোর ঝুঁকি নেয় এই কবিতা এবং আশ্চর্যভাবে পেরিয়েও যায় অনতিক্রম্যকে। এই কবিতা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *