কোনও কোনও কবি অন্তরালে অবস্থান করাকেই শ্রেয় বিবেচনা করেন। নিজের কবিতাটুকু কেবল সামনে আনেন তাঁরা, তা-ও যদি কোনও প্রকাশক তাঁর পাণ্ডুলিপি প্রার্থনা করেন, তবেই। এই রকম এক কবি হলেন অভীক মজুমদার। নব্বই দশকের কবি তিনি। অভীক নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সারস্বত কর্মযজ্ঞের মধ্যে যুক্ত থাকলেও, নিজের কবিতাকে সবসময় আড়ালেই রাখেন। প্রায় সকলের অগোচরেই অভীকের একের পর এক কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের কোনও চেষ্টা কবির তরফ থেকে ঘটেনি।
অভীকের কবিতার কারুকর্ম অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাঁর লেখায় অবস্থান করে। ‘লিরিকবাহিনী’ তাঁর প্রথম কবিতার বই। তারপর একে একে এসেছে ‘বারুদসংকেত’, ‘মিড ডে মিলের থালা’, ‘সিন্ধুলিপি’। বইগুলি প্রকাশ পেয়েছে আর পাঠকের চোখের সামনে থেকে কী করে যেন অন্তর্ধান করেছে। ‘সিন্ধুলিপি’ নামক বইটি তো কলেজ স্ট্রিট খুঁজে কোথাও পাওয়া যায় না আর। সপ্তর্ষি প্রকাশনের এই কাব্যগ্রন্থ কি তাহলে এত চাহিদা তৈরি করেছিল, যে সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, তা তো নয়। কারণ বইটির নাম-ই জানেন না বেশিরভাগ পাঠক। ‘সিন্ধুলিপি’ বেরিয়েছিল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে। সে-বছরই জুনে প্রকাশ পেল মাত্র বারো পৃষ্ঠার একটি কবিতা পুস্তিকা, সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক এক উদ্যোগে। অভীক মজুমদারের সেই পুস্তিকা ‘ভিক্ষাপাত্র’, কিন্তু কলেজ স্ট্রিটের ধ্যানবিন্দু নামক বই-বিপণি থেকে পাঠকরা সাগ্রহে সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। মাত্র দশ টাকা মূল্যের সেই পুস্তিকায় অভীকের কবিতায় যেন এক নতুন ভুবন খুলে গেল। এবং সেই থেকে নূতনতর ভুবনের দিকে তাঁর যাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলল। ‘পাগলের সঙ্গ করো’ নামক কবিতার বই ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দে’জ় পাবলিশিং থেকে বেরনোমাত্র সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে-বইয়ের প্রথম কবিতাটিই পাঠককে বিমুগ্ধ করে দেয়। আমি কবিতাটি সকলের পড়ার জন্য না-দিয়ে পারছি না।
কথোপকথন
অন্ধকে বসিয়ে আসি নক্ষত্রলোকের নীচে
কথোপকথন শোনা যায়
যে প্রান্তরে আমাদের আদর পরব ঝরে
হলুদ পাতায়
তাকে আমি গানে বেঁধে রাখি…
তাকে আমি নৌকা থেকে ডাকি
দৃষ্টিহীনা আয়…
শেষ লাইনটিতে পৌঁছে আমাদের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। কত অল্প আয়োজনে এই প্রেম মুগ্ধতার যন্ত্রণা প্রকাশ করলেন কবি। হ্যাঁ, প্রেম মুগ্ধতারও একটি যন্ত্রণাবোধ আছে। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই সেই জটিল অনুভবের সঙ্গে পরিচিত।
জানুয়ারি ২০১৯-এ বেরল অভীকের আরও একটি ক্ষুদ্র কবিতাগ্রন্থ, যার নাম ‘ঢোলে কত্তালে লুকোচুরি খেলা’। সেখানে আছে মাত্র কুড়িটি কবিতা। কিন্তু আমি সেই কুড়িটি কবিতার একটিকেও আমার স্মরণযোগ্যতা থেকে সরাতে পারিনি। এতই অসাধারণ সেই কবিতাগুচ্ছ। এ বইও দ্রুত দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেল। কীভাবে, কে জানে! খবর নিয়ে জানলাম, স্বয়ং লেখকের কাছেও তার একটিও কপি নেই। আমি তখন সেই প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আবার এক কপি বই সংগ্রহ করতে পারলাম বহু চেষ্টায়। কারণ আমার নিজের কপিটি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
এরপর এল ২০২০ সাল। সেবছর জানুয়ারিতে বেরল একইসঙ্গে অভীক মজুমদারের দু’টি বই, যথাক্রমে ‘অলৌকিকা’ ও ‘আদর করি ঝড়ে’। প্রকাশকরা হলেন ঋত ও ধানসিঁড়ি। প্রায় পাশাপাশি বেরনো সত্ত্বেও ‘ঢোলে কত্তালে লুকোচুরি খেলা’, ‘অলৌকিকা’ ও ‘আদর করি ঝড়ে’ সম্পূর্ণ পৃথক তাদের ব্যক্তিত্বে। একই সময়কালে রচিত অথচ এত আলাদা ধরনের কবিতা অভীক কীভাবে লিখলেন, তিনটি ভিন্ন কাব্যগ্রন্থে, ভেবে আমি হতবাক!
অভীকের কবিতার মধ্যে প্রেম কখনও পদার্পণ করেছে সদর্পে—আবার কোথাও কোথাও সেই প্রেম নিজেকে লুকিয়েও রেখেছে। অভীকের কবিতার মধ্যে এসেছে সময়। এসেছে রাজনীতি। কিন্তু সেসব কবিতা কখনও উচ্চরোলে নিনাদিত নয়। সমাজের ওলটপালোট অভীকের কবিতা সন্তর্পণে ধরে রেখেছে। মনোযোগী দ্বিতীয় পাঠে সে-জিনিস ধরা পড়বে। কারণ অভীকের কবিতায় সঙ্কেতধর্ম উপস্থিত থাকে। উপস্থিত থাকে অবচেতনের ক্রিয়া ও উদ্ভাসন।
গত পঁচিশ বছরের বাংলার তরুণ কবিতায় সঙ্কেতধর্মের উপস্থিতি ক্রমে কমে এসেছে। অবচেতনের বিস্ময়কর উত্থানও প্রায় চোখে পড়ে না। সেখানে অভীক একটি ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই। তরুণ কবিতায় যা আমরা প্রধানতঃ পাই, তা কখনও চমকপ্রদ ছন্দেমিলে বাঁধা কোনও বিবরণাত্মক ক্রিয়া। অথবা কখনও ছন্দের হাত ছাড়িয়ে নেওয়া সরাসরি বার্তাদান।
জানুয়ারি ২০১৯-এ বেরল অভীকের আরও একটি ক্ষুদ্র কবিতাগ্রন্থ, যার নাম ‘ঢোলে কত্তালে লুকোচুরি খেলা’। সেখানে আছে মাত্র কুড়িটি কবিতা। কিন্তু আমি সেই কুড়িটি কবিতার একটিকেও আমার স্মরণযোগ্যতা থেকে সরাতে পারিনি। এতই অসাধারণ সেই কবিতাগুচ্ছ।
অভীকের অধিকাংশ কবিতায় ছন্দমিলের ব্যবহার আছে। কিন্তু সেই ছন্দমিল ব্যবহার এক লুক্কায়িত কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে। অভীক মিল প্রয়োগ করেন তাঁর কবিতায়, কিন্তু মিলগুলি থাকে অনেকটা দূরে দূরে। প্রথমবার পাঠ করলে ধরা যায় না কোথায় গুপ্ত হয়ে আছে তাঁর মিলপ্রয়োগ। আবারও বলি, অভীক প্রধানতঃ ছন্দেই লেখেন। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত তিনটি ছন্দকেই তিনি ব্যবহারে আনেন। ছ’মাত্রার ছন্দে, বিশেষভাবে, তাঁর কারুকৃতি অবাক করে দেয়। কিন্তু ছন্দে তো আরও অনেক কবিই লেখেন! এবং সার্থকভাবেই ছন্দমিল ব্যবহার করেন তাঁরা। স্তবকবন্ধও নির্মাণ করেন নির্ভুলভাবে। এমন প্রবল দক্ষতাবাহী কবি কিন্তু উপস্থিত আছেন আমাদের এই সময়ের কবিতাজগতেই। কিন্তু অভীকের ব্যবহার করা ছন্দের একটি বিশেষত্ব আছে। কী সেই বিশেষত্ব?
এজ়রা পাউন্ড বলেছিলেন, ছন্দ হচ্ছে words cut into time. অভীক কী করেন? অভীক ছন্দের একেবারে উৎসে তাঁর হাত রাখেন। ছন্দের উৎস কী? ছন্দের উৎপত্তিস্থল বা ছন্দের মাতৃভূমি কোথায়?
শ্বাসে। শ্বাসপ্রশ্বাসের যে গতি, সেখানেই জন্ম নেয় ছন্দের ক্রিয়া। অর্থাৎ বাইরের ছন্দকৌশল ও মিলজ্ঞাপনের চমৎকৃতির দিকে অভীক নিয়ে যান না তাঁর কবিতাকে। অভীকের কবিতা পাঠকের শ্বাসপ্রশ্বাসের উপর চাপ দিয়ে পাঠককে কখনও শ্বাস আটকে রাখতে, কখনও শ্বাস ফেলতে বাধ্য করে। এর ফলে কবিতায় এক অপূর্ব শ্রুতিসৌন্দর্য গঠিত হয় ও কবিতাটির গতিবেগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
এই শ্বাসনিয়ন্ত্রণের খেলাটি তৈরি করেন অভীক তাঁর কবিতার লাইন সাজানোর মধ্যে দিয়ে। পাঠক তখনও মাত্রাপূর্ণ হবে ভেবে অপেক্ষা করছেন। হঠাৎই অভীক তাঁর লাইনকে ভেঙে নীচে নিয়ে এলেন, শ্বাস পূর্ণ হল না পাঠকের, লাইনের শেষে এসে তবে পাঠক তাঁর শ্বাস ছাড়তে পারলেন। যে-কারণে, বললামই তো, অভীকের অধিকাংশ কবিতা ভাঙা ভাঙা লাইন আশ্রয় করে এগিয়ে চলে। প্রত্যেকটি ভাঙা লাইনের শেষে এক সাসপেন্স দেখা দেয় যা পাঠককে পরবর্তী লাইনের জন্য উদগ্রীব করে তুলতে পারে। পাঠকের সঙ্গে চলে ছন্দের দম নেওয়ার খেলা। ছন্দের স্বরূপকে অনেক ভিতর থেকে জানতে পারলে তবেই এমনভাবে ছন্দকে দিয়ে অভীষ্ট ক্রীড়ারীতি নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয়। ‘ঢোলে কত্তালে লুকোচুরি খেলা’ নামক মাত্র কুড়িটি কবিতাসম্পন্ন পুস্তিকাটির ভিতরে এর অজস্র প্রমাণ লুকিয়ে আছে।
অভীকের কবিতার মধ্যে প্রেম কখনও পদার্পণ করেছে সদর্পে—আবার কোথাও কোথাও সেই প্রেম নিজেকে লুকিয়েও রেখেছে। অভীকের কবিতার মধ্যে এসেছে সময়। এসেছে রাজনীতি। কিন্তু সেসব কবিতা কখনও উচ্চরোলে নিনাদিত নয়।
হ্যাঁ, লুকিয়ে আছে। অভীক তাঁর কবিতার ছন্দমিলকে কখনও গোটা গোটা করে বাইরে আনেন না। অন্তরালে থেকে পাঠকের শ্রুতির মধ্যে কাজ করে চলে তারা। এবং শ্বাস আটকে থাকার জন্য পাঠক পুরো কবিতাটি শেষ পর্যন্ত না-পড়া অবধি নিস্তার পান না।
অভীক নিজেকেও লুকিয়ে রাখেন। কবিতা বিষয়ে। অভীককে ঘন ঘন কবিতা সভায় কাব্যপাঠ করতে দেখা যায় না। আমার নিজের, অভীকের একটি একক কবিতাপাঠের অনুষ্ঠান শোনার খুব আগ্রহ আছে। কীভাবে পড়েন অভীক তাঁর কবিতা? কেমনভাবে শ্বাস নেন? যতিচিহ্ন এলে কতটুকু থামেন? কী উপায়ে উচ্চারণ করেন ভাঙা লাইনের পাঠ? এসব জানতে আমি অতি উৎসুক হয়ে আছি।
কবি শঙ্খ ঘোষের ছাত্র অভীক মজুমদার। শুনেছি, শঙ্খ ঘোষ, একবার তাঁর বাড়িতে, একটি সন্ধ্যায়, অভীকের এক একক কবিতাপাঠের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ছিলেন নির্বাচিত কয়েকজন শ্রোতা। আমি সেই শ্রোতাদের মধ্যে ছিলাম না। তাই অভীকের নিজকাব্যপাঠ শোনার দুর্মর আকাঙ্খা আমার থেকেই গেছে। কোনও প্রকাশক কি অভীকের একটি একক কবিতাপাঠের আয়োজন করতে পারেন না? ওইরকম অল্পকয়েকজন শ্রোতা উপস্থিত থাকবেন যেখানে? আশায় রইলাম।
আমি এখন অভীক মজুমদারের একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি পাঠকের সামনে, পাঠক বুঝতে পারবেন প্রকৃত সঙ্কেতধর্মী কবিতা কাকে বলে। ‘ভিক্ষাপাত্র’ নামক দশ টাকা দামের পুস্তিকার প্রথম কবিতাটিই তুলে দিলাম।
মহাকাল
হাঁটি হাঁটি।
শুয়ে পড়ি। তোমার দরগার পাশে
জোনাকি, অশ্বত্থঝুরি, জলাশয়। সবই
লক্ষ করি
থমকে যদি দিতে কাল, অনন্ত বিকেল
হব। ভিক্ষাপাত্র ধরি।
সপ্তাশ্ব আকাশে ওই।
পদাঘাতে চূর্ণ হল ঘড়ি।
অভীকের কবিতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ বলতে কিন্তু আমি এতক্ষণ ভুলে গেছি। অভীকের কবিতায় দরগা, পীর, কীর্তন, ফকির বারবার এসে পড়ে। এসে পড়ে বাংলার লোকায়ত সঙ্গীতজীবনের অনুষঙ্গ। শ্রীখোল, করতাল আসে। আসে বাংলার ব্রত, পরব, পার্বণ। তারই সঙ্গে সঙ্গে চলে তারাজগৎ, জ্যোৎস্নালোক, সূর্যকিরণ, জলস্রোত, অরণ্যাণী, তুষারাবৃত পর্বতচূড়া। অভীকের কবিতার সঙ্গে সঙ্গে চলে নারীরা। যুবতীরা। চলে ভিক্ষুকরা। সমগ্র বাংলাকে নিয়ে অভীক তৈরি করেন তাঁর কবিতার পৃথিবী। সে এক নিসর্গজ্যোতি। তাই আমরাও অভীকের কবিতার কাছে আমাদের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে অপেক্ষা করি।
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
খুব ভালো লাগলো