অন্যমন: সুন্দরম ছেড়ে দিয়েছেন তো বললেন, আবার ফিরলেন কবে?
মনোজ মিত্র: ওই যে পার্থ বাড়ি এসে বলল আবার দলে ফিরতে, তখনই… যখন নিউ আলিপুর কলেজে ছিলাম, আবার যাওয়া-আসা শুরু করি। ১৯৭২ সালে থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘চাকভাঙা মধু’ দেখেনি পার্থ… তারপর সুন্দরমে আর নাটকও করেনি, কোনও যোগাযোগ রাখেনি দলের সঙ্গে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সুন্দরম তালাবন্ধ ছিল, ঘরে ঝুলকালি, বাড়িঅলার কাছে ঋণ… দু’টিই বেড়ে গিয়েছিল; সব আবর্জনা ঝেড়েঝুড়ে আবার দলের দরজা খুলি পঁচাত্তরে; করি ‘পরবাস’, সাতাত্তরে ‘সাজানো বাগান।’
অন্যমন: তার মানে আগে সাজানো বাগান মঞ্চে অভিনয়, তারপরে সিনেমা বাঞ্ছারামের বাগান…
মনোজ মিত্র: ঠিক তাই..। সিনেমা তো হলে এল ১৯৮০ সালে আর ঢাকুরিয়া পুলের গায়ে অবনমহলে ‘সাজানো বাগান’-এর প্রথম অভিনয় হয়েছে ৫ এপ্রিল ১৯৭৭। ভালো লাগেনি আমার। ওই নাটক ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে লিখতে বসি…নতুন চেহারায় ‘সাজানো বাগান’-এর প্রথম অভিনয় মুক্ত অঙ্গনে, ৭ নভেম্বর, ১৯৭৭। আজ অবধি সুন্দরম সেই নাটকটিই অভিনয় করে চলেছে।

১৯৭৯ সালের জুলাই বা অগস্টে অ্যাকাডেমিতে ‘সাজানো বাগান’ হচ্ছিল, ইন্টারভ্যালে হঠাৎ খবর পেলাম তপন সিংহ আর অরুন্ধতী দেবী নাটক দেখছে। নাটক দেখে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তপন সিংহ মশাই ডেকে পাঠান আমাকে, ওঁর বাড়িতে যাই। বললেন, উনি ‘সাজানো বাগান’ ফিল্ম করতে চান। আমার দিক থেকে না-বলার কোনও কারণ নেই। কথা ছিল ভূত-জমিদার ছকড়ি আর ছকড়ি-পুত্র নকড়ি এই দুটো চরিত্রই করবেন উত্তমকুমার, আর আমাকে করতে হবে বাঞ্ছারাম। আমাকে সামনা-সামনি দেখে উনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, আগের সন্ধ্যায় মঞ্চে যে বাঞ্ছারামকে দেখেছেন সে আমিই।
যাইহোক, লোকেশন ইত্যাদি সব ঠিক হয়ে যাবার পর, ১৯৮০-র জানুয়ারিতে শুটিং শুরু হবার দিন দশেক আগে উত্তম অনুরোধ করলেন শুটিং পিছিয়ে মার্চে শুরু করা হোক, কিন্তু তপন সিংহ রাজি হলেন না। উত্তমের সময় না হলে অন্য কেউ করবে অভিনয়, কিন্তু পেছনো যাবে না। তখনই উত্তমকুমারের জায়গায় এলেন দীপঙ্কর দে। উত্তমকুমার আদালতে গেলেন, ইনজাংশান বের করে আনলেন। তপন সিংহের উকিল সওয়াল করলেন সিনেমার জন্য বাগান বাছা হয়ে গেছে বারুইপুরের শাসনে। মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলে সেখানে শীতের সর্ষেফুল আর পাওয়া যাবে না। ইনজাংশান উঠে গেল।
অন্যমন: সিনেমার অভিনয়, শরীর ভঙ্গি আর নাটকের অভিনয় আর শরীর সঞ্চালনে কোনও বিশেষ তফাৎ–
মনোজ মিত্র: একটা ঘটনা বলি। বারুইপুরের লাগোয়া শাসন গ্রামের এক বাগানে বাঞ্ছারামের বাগানের শুটিং চলছে। ভোরবেলা, পুকুরের ওপারে ক্যামেরা, এপারে আমি। এক শটে অনেকগুলো কাজ– পুকুরে নামা, দুটো ক্যানেস্তারায় জল ভরা, বাঁকে টিন দুটো বাঁধা, বাঁক কাঁধে খানিকটা দূরের কপিক্ষেতে গিয়ে, বাঁক নামিয়ে ক্ষেতে জল ছিটনো– ছবির প্রথম দৃশ্য। আমি পুকুরে নামলাম, ঠিকঠাক জলও ভরলাম, কিন্তু আর উঠতে পারছি না। এঁদো পুকুরের কাদায় পা বসে যাচ্ছে।

ভুলটা আমারই। শটের আগে পা টিপে-টিপে নেমে যখন মহড়া দিয়েছি, টিনে জল ভরিনি। অথচ ভরা উচিত ছিল। পরিচালক তপন সিংহ মশাই বিরক্ত। আমার জীবনের প্রথম সিনেমা অভিনয়ের প্রথম শট আমার কারণেই পণ্ড হল। কিন্তু আমি শিখলাম অনেক, জলভরা ক্যানেস্তারা বাঁকে নিয়ে সত্যিকারের পুকুর থেকে ওঠার যে সত্যি ভঙ্গি তা তো নাটকে করিনি কোনওদিন, সেখানে তো পায়ের নিচে শক্ত পাটাতন!
আবার আর একটি ঘটনা, একদিন বাঞ্ছারামের মেক-আপ তোলার আর অবসর পাইনি, মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি থার্ড বেল বাজতে, ভাবছি এই সিনেমার মেক-আপেই হয়ে যাবে। আর তাছাড়া কী সুন্দর, পরচুলা বলে মনেই হয় না এত পাতলা, মুখেও কত অসংখ্য বলিরেখা, যাতে মনেই হবে এ থুত্থুরে বুড়ো। রূপসজ্জাশিল্পীকে বললাম, ‘দূর তোমার ও মোটা তুলির ধ্যবড়া দাগ আর ছোবড়ার মতো পরচুলা আমার পছন্দ হয় না।’
আমাদের দলের মেক-আপ আর্টিস্ট অবাক হলেন, বুঝি কিছু বিরক্তও– এই চুল পরিয়ে দেহটাকে ফাঁপিয়ে না তুললে, পেছনদিকের দর্শকেরা দেখবে কতটুকু? স্টেজে তো আপনি বেশিরভাগ সময়েই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন, তাহলে? আর এই সিনেমার জন্য করা মুখের এই সরু-সরু লাইনের একটাও চোখে পড়বে ওই শেষের সারি থেকে? এমন একটা জবাব পাওয়ার খুব দরকার ছিল আমার, বুঝলাম স্বাভাবিকতার মাপকাঠি যে সিনেমা ও নাটকে দু’রকমের, সেই সাধারণ হিসাবটাই গুলিয়ে ফেলেছি।

শুধু পরচুলা বলে নয়, থিয়েটারের সব কিছুই বড় মাপের। অভিনয়ও তাই আলাদা রকমের। এই তফাৎটাও অভিনেতাকে ভেবেচিন্তে বের করে নিতে হয়। সত্যিকারের বাজারে গিয়ে আমি যেমন চেঁচিয়ে কাউকে ডাকব, মঞ্চে কী আর ঠিক তেমন হবে? আবার ফিল্মেও কী অন্যরকম হবে না? তবে মূল অভিনয়ের ধরনটা কিন্তু একই থাকে, মাধ্যম অনুযায়ী নিজেকে একটু-আধটু বদলে নিতে হয়।
এইখানে একটা কথা বলে নিই, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ আমার অভিনীত প্রথম ছবি, কিন্তু প্রথম শুটিং নয়। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ শুরু হবার আগে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ময়না তদন্ত’-তে কয়েকদিন শুটিং করেছিলাম। তবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব প্রথম আসে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ। আর প্রথম মুক্তিও পায় ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ই। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার অল্পদিনের মধ্যে আমি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। আর একটি কথাও মনে পড়ছে, ৮০ সালে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ মুক্তি পেলে সৌমিত্রদা লিখেছিলেন, ‘করেছ কী? তোমার প্রশংসায় তো কান পাতা যাচ্ছে না।’
অন্যমন: আপনি কিন্তু এখনও বললেন না, দলের ছেলেদের অভিনয় শেখাবার জন্য আপনি কী-কী পদ্ধতি ব্যবহার করেন?…গলার রেঞ্জ বাড়াবার কোনও ট্রেনিং?…
মনোজ মিত্র: এতক্ষণ ধরে ওই প্রশ্নেরই তো উত্তর দিয়ে যাচ্ছি নানান উদাহরণ সহযোগে (হাসি)…। অবশ্য এইটা বলতে পারেন, এতক্ষণ উদাহরণ দিয়েছি, উত্তর দিইনি। সত্যি বলতে কী, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যে কোনও নাট্যদলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা আমার মনে হয় না। নিজেকে নিজে তৈরি করতে হয়; কথাটা হল, তোমার অভিনয় ভাল লাগছে কী লাগছে না, কী করলে তা ভাল লাগবে, ওই সূত্রটি কোনও অভিনেতাকে নিজেকেই আবিষ্কার করতে হবে।
ধরা যাক, কেউ বাজারে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে তার বন্ধুকে ডাকছে, সে কী আর গলার তালিম নিয়ে তাকে ডাকে, ওই স্বাভাবিকতা অভিনেতাকে ভেবে-ভেবে আয়ত্ত করতে হয়, স্বাভাবিকতা শিখতে কী আমরা কাউকে স্কুলে পাঠাই?

আরও একটা কথা, কেউ ধরে অভিনয় করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় সহ-অভিনেতার সংলাপ শেষও করতে দিই না, কথার পিঠে কথা চাপিয়ে দিই। তা করলে চলবে না। অন্যের কথা শুনতে হবে, মগজে নিতে হবে, কোন কথাটা বুঝতে কতটুকু সময় লাগবে, এইসব হিসাব অনেক সময়েই আমাদের থাকে না, ফলে নাটক মারা যায়। এই যে অভিনয়ের টাইমিং তা অভিনেতাকেই ভেবে ঠিক করতে হয়, এক-এক অভিনেতার এক-এক রকম টাইমিং, এ তাঁর নিজস্ব ব্যাপার, এ তাঁকেই আবিষ্কার করতে হয়, শেখান যায় না।
তবে হ্যাঁ, রিহার্সাল তো দিতেই হয়। অনেকে মিলে যখন নাটকটা হয়, যখন এটা যৌথশিল্পকর্ম, তখন তো রিহার্সাল দিতেই হবে। না হলে একে অন্যের সঙ্গে বোঝাপড়া তৈরি হবে কী করে? আসলে উদ্দীপকের পরে প্রত্যক্ষণ, তারপরে প্রতিক্রিয়া; কিন্তু আমাদের অনেকের অভিনয় দেখে মনে হয়, উদ্দীপনার পরেই প্রতিক্রিয়া ঘটছে, প্রত্যক্ষণ বলে কিছু নেই। আর এই পুরো ব্যাপারটাই নিজে-নিজে উদ্ভাবন করতে হয়। এ কোনও স্কুলে শেখান যায় নাকি! শেষ সারিতে বসে যে দর্শক, তাকে শোনাতে গলা কতটা তুলবে, শরীর কতটা নাড়াবে তা তো ওই অভিনেতাকেই ঠিক করতে হবে…তাই না?
অন্যমন: এইবার তিনটে ছোট-ছোট প্রশ্ন, প্রথম, আপনার পড়া তিনটি শ্রেষ্ঠ নাটক?
মনোজ মিত্র: মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, জগন্নাথ আর ক্যাপ্টেন হুররা…
অন্যমন: তিনটি শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা?…
মনোজ মিত্র: টিনের তলোয়ার, মঞ্জরী আমের মঞ্জরী আর রাজরক্ত…
অন্যমন: শ্রেষ্ঠ অভিনেতা? একজনের নাম বলবেন, প্লিজ…
মনোজ মিত্র: উৎপল দত্ত…
অন্যমন: তাই! মানে আপনি অহীন্দ্র চৌধুরী, শম্–
মনোজ মিত্র: হ্যাঁ, আমি ওই নামগুলি মনে রেখেই বলছি, উৎপল দত্ত। ওইরকম টাইমিং সেন্স আমি আর দেখিনি। উত্তমকুমারের টাইমিংও খুব ভাল, তবে উৎপল দত্ত, উৎপল দত্তই। ওইরকম আর হয় না…।
অন্যমন দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করে আপাতত অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। ভালবাসেন বাংলা নাটক, কবিতাও। সময় কাটাতে নানা লিটল ম্যাগাজিনে টুকটাক লেখালিখি তাঁর শখ। বই পড়া আর বন্ধুদের সঙ্গে রবিবারের আড্ডাটি ছাড়া তাঁর এক মুহূর্ত চলে না।