[তিনটি ঘরের পাশে ফাঁকা জায়গায় আলো জ্বলে। সন্ধ্যেবেলা। ফাঁকা জায়গাটিতে একটি ছোট বার কাম সেলার দেখা যায়। সেলারে কাচের ভেতরে মদের বোতল ও গ্লাস সাজানো। সেলারের সামনে একটি ছোট বার টেবিল। টেবিলের একপাশে দুটি তিনটি লম্বাকৃতি বসার জায়গা। তার একটিতে সুরেশ মোরে বসে আছেন। হাতে পানীয় ভর্ত্তি গ্লাস। তার পাশের সিট-এ চিত্রনাট্যকার শাহাদাত শরাফ (বয়স ৩০-৩৫) বসে। তার হাতেও একটি গ্লাস। টেবিলের ওপার থেকে সেলারের সামনে দাঁড়িয়ে জয়দেব একটি বোতল থেকে শরাফের গ্লাসে ঢালছে। জয়দেবের ঢালা শেষ হলে শরাফ হাত বাড়িয়ে বারটেবিলের ওপরে রাখা বরফের ক্রেট থেকে তিনচার টুকরো বরফ বার করে নিজের পানীয়ের গ্লাসে ফেলে। ফেলতে ফেলতেই বলে]

শরাফ:- ভিকিভাই নেই, আমরা শুরু করে দিলাম, এটা কি ঠিক হচ্ছে?

সুরেশ:- আরে ভিকিই তো আমাদের এখানে বসিয়ে দিয়ে গেল। বলল একটা-দুটো খেতে। তাই (গ্লাস তোলে)

শরাফ:- ভিকিভাই গেল কোথায়?

সুরেশ:- ওদের কি ফ্যামিলি মিটিং চলছে। শিব-জিকে কোন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে নাকি ওদের কথাবার্তা চলছে। এক একজনের এক একরকম মত।

জয়দেব:- (সে পানীয় খাচ্ছে না। সে একটা সফট ড্রিংক বানাতে বানাতে বলে) শিবাজী পার্কের শ্মশানটাই তো এ বাড়ির কাছে হবে নাকি?

সুরেশ:- ভিকি তো পবনহংস পবনহংস করছিলে।

শরাফ:- ওটা কোথায়?

জয়দেব:- ভিলে পার্লেতে।

সুরেশ:- অ। (শরাফের দিকে তাকান) তুই এখন কটা স্ক্রিপ্ট লিখছিস শরাফ?

শরাফ:- না দাদা এখন একটাই। এই ভিকিভাইয়ের জন্য নেক্সট প্রোজেক্টটা লিখছি।

সুরেশ:- ওটার ডিরেকটার কে?

শরাফ:- অভিমন্যু মেহতা।

সুরেশ:- ও। ওর লাস্ট সিনেমা তো ভালে ব্যবসা দিয়েছিল। কী যেন নাম ছিল সিনেমাটার?

শরাফ:- মোহব্বত কা লাস্ট জংশন। 

সুরেশ:- ঠিক ঠিক। ভিকিই তো ওটার হিরো ছিল। অম্বালিকা সিং ছিল হিরোইন

শরাফ:- জি দাদা।

সুরেশ:- তোর তো তাহলে অনেক স্ক্রিপ্ট লেখার কথা এখন।

শরাফ:- না দাদা পাচ্ছি কই? এই তো ভিকিভাই এইটা লেখার জন্য আমার নাম হাউসে সাজেষ্ট করেছিল। নইলে এটাও পেতাম না। ওদের নিজেদের লোক ছিল।

সুরেশ:- থিয়েটার লিখছিস না?

শরাফ:- নাঃ দাদা (থামে) ওই টুকটাক। নাটক লিখে কি আর পয়সা হয় সুরেশভাই?

সুরেশ:- কেন ওই জিম্মি কামাথের দলে তুই লিখতিস তো। কী যেন নাম ছিল থিয়েটারটার? আমি দেখেছিলাম একটা শো।

শরাফ:- ইন্ডিয়া ইয়া ভারত। পৃথ্বীতে দুশো শো হয়েছিল দাদা।

সুরেশ:- তাহলে?

শরাফ:- ও বাদ দাও। নিজেদের থিয়েটারের ঘরের ঝামেলার গল্প বলতে আর ভালে লাগে না। (একচুমুক খায়) লিখে কি হয়? লেখার কোনও মূল্য আছে এ মুলুকে? এ যা ইন্ডাস্ট্রি, শেক্সপীয়র যদি এখন বেঁচে এখানে লিখতে আসতো, তারও নাম দিয়ে দিত স্ক্রিপ্টরাইটার। প্রোডিউসাররা বলতো, ‘উও উইলিয়াম কো বোলাও, জবরদস্ত স্ক্রিপ্ট লিখতা হ্যায়’। নাটক আর স্ক্রিপ্টের ফারাকই বোঝে না এরা।

সুরেশ:- হিরো ওরিয়েন্টেড ইন্ডাস্ট্রি। কি করবি বল? আমার ‘আপনা গুণা’ যখন হিট করল, তারপর সব ছবিতে আমি নাগাড়ে ভিলেন। তারপর আবার ‘বরষোঁ কা ধামাকা’ হিট করার পর সব ছবিতে আমি কমেডিয়ান।

শরাফ:- আরে তাও তো তুমি আম্বেদকরের বায়োপিকে অভিনয় করার পর কতরকম ক্যারেকটার করলে।

সুরেশ:- এই এই। ওই আম্বেদকরের পার্ট করার পর বলতে পারিস কেরিয়ারে অনেকগুলো ভ্যারিয়েশন হল। নানারকম পার্ট জীবনে করলাম।

শরাফ:- এখন তো দাদা তুমি এম.পি। তোমর আর চিন্তা কী?

সুরেশ:- আর এম.পি। হাউসেই যাওয়ার টাইম পাই না। এই তো এখন হাউস চলছে, আমি এখানে।

শরাফ:- আরে দাদা তোমার নাম আছে ওখানে, এটাই যথেষ্ট। এন.এস.ডি-তে আলকাজিসাব নাকি একটা কথা বলতেন স্টুডেন্টদের, ‘আমি থাকি না থাকি, জানবে প্রত্যেক মুহূর্তে আমার উপস্থিতি রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ের প্রতিটি কড়িবরগায় উচ্চারিত হচ্ছে’। (সুরেশ হাসে) মজাক নেহি দাদা, এহি সাচ বাত হ্যায়। (একচুমুক খায়) অনেক ভাল ছিল আমার এন.এস.ডি-র টাইম। জানো দাদা ‘টু জেন্টলম্যান অফ ভেরোনা’ অ্যাডাপ্ট করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ‘দো দোস্ত, দো সিতারে’। বাজাজসাব কত প্রশংসা করেছিলেন আমার প্লে দেখে।

সুরেশ:- চিন্তা করিস না শরাফ। দিন পাল্টাচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিট হয়ে যাওয়ার পর লেখা আর কনসেপ্টের দাম বাড়ছে। নিজেকে ন্যাশনাল প্লেয়ার ভাবিস না। বা লোকাল প্লেয়ার। ইন্টারন্যাশনাল প্লেয়ার ভাব।

(ভিকি আসে হন্তদন্ত হয়ে। সে একটা গ্লাসে পানীয় ঢালে)

ভিকি:- স্যরি। তোমাদের একটু বসিয়ে রাখলাম। আসলে ডিসপিউট মেটেনি। এখনও ডিসকাসন চলছে।

সুরেশ:- ডিসপিউটটা ঠিক কোথায়?

ভিকি:- আরে আমি মুক্তেশ্বরে নিয়ে যেতে চাইছিলাম। ভিলে পার্লেতে। দিদি রাজি হচ্ছে না।

সুরেশ:- অরুণা কী বলছে?

ভিকি:- মা-জি কিছু বলছে না। কিন্তু দিদি  বলছে বডি ওরলিতে নিয়ে যাবে।

সুরেশ:- কেন?

ভিকি:- আরে আমাদের মা-কে ওরলির প্রেয়ার হলে কবর দেওয়া হয়েছিল। দিদি এখন চাইছে পিতাজির দাহ প্রেয়ার হলের কাছাকাছি হোক। বলে – এখন দুজনে নাকি কাছাকাছি থাকবে, কোনও মানে হয়?

জয়দেব:- কবর মানে? নীলোফার-জি কি মুসলিম ছিলেন নাকি?

সুরেশ:- আরে না, ক্রিশ্চান। জয়দেব ক্রিকেটের বাইরে দেখছি কোনও খবর রাখে না।

জয়দেব:- দাদা, আমি জন্মানোর আগে উনি মারা গেছেন। উনি বড় হিরোইন আমি শুনেছি। কিন্তু ওনার কোনও সিনেমা দেখিনি। কিন্তু ভিকিভাইয়ের অনেক সিনেমা আমি দেখেছি।

ভিকি:- চলো এখন ওরলিতে। সি.পি ফোন করেছিলেন। বলছিলেন রাস্তায় ট্র্যাফিক থাকলেও আমাদের জন্য যতটা পারবেন ওপেন রাখবেন। (শরাফকে বলে) শরাফ, দেখতো ওই ওয়াইন বটলগুলোর পাশে একটা ছোট মিউজিক সিস্টেম আছে। ওটা  অন কর।

জয়দেব:- আমি করে দিচ্ছি ভিকিভাই।

(জয়দেব খুঁজে নিয়ে মিউজিক সিস্টেম চালায়। হালকা কোনও সুর আসে। ভিকি বসে। চুমুক দেয়। শরাফ উঠে বার টেবিলের ওপাশে সেলারের কাছে যায়। নিজের গ্লাস ভর্ত্তি করে। জয়দেব সুরেশের খালি গ্লাসে হুইস্কি ঢালে। সুরেশ চুমুক দেন)

সুরেশ:- তাহলে কি ফাইনাল হল, ওরলি?

ভিকি:- জানি না। মা-জি আবার ওরলিতে নিমরাজি। বলছে শিবাজী পার্ক কাছে। ওটাই ভাল হবে।

সুরেশ:- ও, তাহলে তো ফাইনাল  ডিসিশন হয়নি। তুই চলে এলি?

ভিকি:- দিব্যা আছে। ও কথা বলছে। আমার আর ভাল লাগছিল না। ফালতু যত ক্যাঁচাল। পোষায় না।

(মদ খায়। জয়দেবকে বলে)

আমার মা কতবড় হিরোইন ছিলেন তুই ভাবতে পারবি না জয়দেব।

জয়দেব:- জানি ভিকিভাই। আমার মা খুব ফ্যান ছিলেন নীলোফারজির।

ভিকি:- মা ছিলেন ক্যাথলিক ক্রিশ্চান। আর পিতাজি হিন্দু ক্ষত্রিয়। সারা ভারত যখন রাস্তায় এইসব ধর্ম টর্ম নিয়ে মারামারি করছে, আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রি এগুলো কোনওদিন পাত্তা দেয়নি।

সুরেশ:- নেভার। অনেক উদাহরণ আছে। কিশোরকুমার-মধুবালা, সুনীল দত্ত-নার্গিস থেকে আজকের সঈফ-কারিনা।

ভিকি:- আমার মা ছোটবেলায় বেশি সময় পেতেন না আমাকে দেখার।  আমি একটু বড় হয়ে যাওয়ার পরে তিন শিফটে শুটিং করতেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও মা সিনেমায় কাজ করেছেন।(গ্লাসে চুমুক দেয়। আপনমনে হাসে) শালা, জীবন কি অদ্ভুত তাই না? ছোটবেলায় ভাবতাম পেইন্টার হব। মা কাজে যাওয়ার আগে আমাকে রোজ হাতে কাগজ আর প্যাস্টেল ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতেন। আর রাতে শুটিং থেকে ফিরে আমার আঁকা দেখতেন। আমিও ভাবতাম বড় হয়ে জবরদস্ত চিত্রকর হব। (কপালে টোকা দেয়) এটা-এইটা কেউ বদলাতে পারে না। আমাদের যা ফ্যামিলি, অ্যাকটর না হয়ে উপায় ছিল না। ঢুকে পড়লাম ডিরেকটার বিনোদ বাত্রার ফিল্মে অ্যাসিস্ট করতে। পিতাজিই বাত্রাজিকে বলে ঢুকিয়ে দিলেন। অথচ দ্যাখো, আমার দিদি ঠিক পড়াশোনা শেষ করল। সিডনি-তে গিয়ে ল পড়ল। আর আমি, এইসব চক্করে ঢুকে হতভাগা অ্যাকটার হয়ে গেলাম।

পরবর্তী অংশ প্রকাশিত হবে ১২ মার্চ ২০২১ 

আগের পর্বের লিঙ্ক [] [] [] [] [] [] [] [] []

জন্ম ১৯৬৯, ২৫ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর। পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। পরবর্তীতে সিটি কলেজে অধ্যাপনা। নাটককার, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্রাভিনেতা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গীতিকার সম্পাদক। 'কালিন্দী ব্রাত্যজন' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার ও 'ব্রাত্যজন নাট্যপত্রের' প্রধান সম্পাদক। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী। পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। উল্লেখ্য সত্যেন মিত্র পুরস্কার, শ্যামল সেন স্মৃতি পুরস্কার, দিশারী পুরস্কার, রমাপ্রসাদ বণিক স্মৃতি পুরস্কার, খালেদ চৌধুরী স্মারক সম্মান, অন্য থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ নাট্য নির্মাণ সম্মান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র-সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি সম্মান। তাঁর সম্পাদনায় 'গিরিশ কথা' ও 'শিশির কথা' দু'টি বই তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, প: ব: সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন এবিপি আনন্দ 'সেরা বাঙালি ২০১৯' সম্মান। পেয়েছেন বাংলার নাট্যশিল্প জগতের সর্বোচ্চ সম্মান 'দীনবন্ধু মিত্র পুরস্কার'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *