
প্রথম যখন লক ডাউন শুরু হল তখন আমরা অনেকেই সারাদিন বাড়িতে বসে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এক দিকে বাড়ির কাজ, অন্যদিকে অফিসের। শপিং এ যাওয়া থেকে সিনেমা, বন্ধুদের সঙ্গে কফি কিংবা লঙ ড্রাইভ সব বন্ধ। তাই মন সতেজ রাখতে সোশ্যাল মিডিয়া বা টিভি র পর্দায় চোখ। ওয়েব সিরিজ এর আকর্ষণ দূরে সরিয়ে একদিন দেখলাম শিল্পী যুগল সৌরেন্দ্র ও সৌম্যজিতের লাইভ অনুষ্ঠান। সুদর্শন এই দুই তরুণ সঙ্গীতশিল্পী, নিজেদের বাড়িতে বসেই সঙ্গীত সৃষ্টি করছেন, ছড়িয়ে দিচ্ছেন সুরের মূর্ছনা এই অসময়েও।
সত্যজিৎ রায় বা মান্না দের জন্ম বার্ষিকী হোক বা রবীন্দ্র জয়ন্তী, সবেতেই তাদের সুরের পরশ আমাদের ছুঁয়ে রইল। কানের ভেতর দিয়ে সত্যিই মরমে ছুঁয়ে গেল বড় আশা করে ও উই শ্যাল ওভার কাম এর যুগলবন্দী। বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের ঘুরে দাঁড়ানর গান। তারপর এল সেই বিধ্বংসী ঝড় আম্ফান, বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াতে সেদিনও তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন সঙ্গীতের ভাষা। বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে তাদের নিবেদন be for Bengal বলে এক আশ্চর্য তারকাখচিত সমাবেশ যেখানে শিল্পী কবিতা কৃষ্ণামূর্তি থেকে রেখা ভারদ্বাজ, পণ্ডিত হরিহরন থেকে পাপন, গান ভালবেসে বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন, অনলাইনে আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। নিজেদের অ্যালবাম প্রকাশ হোক অথবা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্বালে লাইভ শো সবই করেছেন অনলাইন। রাগ পাহাড়ি থেকে ভানু সিংহের পদাবলি, পরীক্ষা নিরীক্ষাও করছেন নানারকম।
বেশিরভাগ শিল্পীই অপেক্ষা করছেন আবার কবে মঞ্চের পর্দা উঠবে আর জোরালো আলোর নীচে বসে সারি সারি শ্রোতার সামনে তারা সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারবেন। এই মহামারি শেষে একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে।
যেমনটি করে চলছেন পণ্ডিত পূর্বায়ন চ্যাটার্জি। নিজের সেতারের তান সীমাবদ্ধ রাখেননি কোনও গণ্ডিতে। কখনো সঙ্গীতশিল্পী স্ত্রী গায়ত্রী কে সঙ্গী করে আবার কখনো বা বিখ্যাত শঙ্কর মহাদেবন, বা পণ্ডিত যোগেশ শামসি বা সেল্ভা গণেশকে নিয়ে এসেছেন এই ডিজিটাল মঞ্চে। একে এক শহরে বসে একেকজন শিল্পী নিজের গান পৌঁছে দিচ্ছেন প্রযুক্তির হাত ধরে। কেউ ড্রাম বাজাচ্ছেন আবার কেউ বা ট্যাবলেট-এর সাহায্য়ে সৃষ্টি করছেন সুর। সুমন বা অঞ্জন দত্তের গানও এই অনলাইন মাধ্যম ধরেই আবার চলে এসেছে আমাদের মনের কাছাকাছি। রূপম ইসলাম তো ঘরে বসেই আস্ত কন্সার্ট করে ফেললেন। আবেগে, মননে এও কি কম বড় পাওনা আমাদের?
শ্রোতা হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কতখানি পরিশ্রমসাপেক্ষ এই সঙ্গীত পরিবেশন এই অতিমারীর আবহে। বিদেশে এই অনলাইন পরিবেশন শুরু হয়েছিল আগেই। আমাদের দেশে বাংলা গান নিয়ে এই আয়োজন মূলত শুরু হয় অতিমারীর কারণে গৃহবন্দি হবার পর। গান শুনতে আমরা সকলেই হয়ত ভালবাসি কিন্তু গান শোনার পদ্ধতি টা আমূল পালটে গেছে গত কয়েক বছরে। ক্যাসেট, সিডি, পেছনে ফেলে এখন অ্যাপের মধ্যেই গানের জগত। তার মাধ্যমে এই লাইভ শো অ্যারও কঠিন। শুধুমাত্র আয়োজনের আয়াসই নয়, শ্রোতার মনের কাছে পৌঁছে যাওয়াও একটা চ্যালেঞ্জ।
রাতারাতি প্রযুক্তি কে আয়ত্ত নয়, নিজের ক্যামেরা তে ভিডিও করতে শিখতে হচ্ছে অনেককেই। খেয়াল রাখতে হচ্ছে প্রেক্ষাপট, আলোর ব্যবস্থা বা সাজগোজ নিয়ে। ইন্টারনেটের খামখেয়ালিপনাও রয়েছে, থাকবেই। হ্যাঁ এটা ঠিক যে একটিমাত্র অনুষ্ঠান করে হাজার হাজার শ্রোতা কে দেশে বিদেশে শোনান যাচ্ছে নিজের পরিবেশন, এই অনলাইন মাধ্যমে, কিন্তু তাদের হাততালি সেখানে শোনা যাচ্ছে না। এই উপস্থাপনা কখনওই মঞ্চের বিকল্প হতে পারে না। প্রেক্ষাগৃহে শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখা হয়ত সহজ, কিন্তু বাড়ির আবহে? যেখানে প্রিয় পোষ্য থেকে হোয়াটস্যাপ সবই শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নিতে উৎসাহী? দু মিনিট শুনেই যেখানে চলে যাওয়া যায় পরের ভিডিও তে? তাই লাইভে শ্রোতার মন্তব্য পড়া বা তাদের চাহিদা অনুযায়ী সঙ্গীত পরিবেশন এর কথা ভাবতে হচ্ছে অনেককেই। শ্রোতার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সেখানে যে তিনি কার গান কতক্ষণ শুনবেন।
সোশ্যাল মিডিয়া এক সঙ্গে এনে দিচ্ছে নানান ধরনের সুর। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা এখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। নতুন শিল্পীরা মনে করছেন এ এক সব পেয়েছির দেশ। স্বনামধন্য শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র বাড়িতে ফোনে তানপুরা বাজিয়ে একদিন পরিবেশন করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত “ওদের সাথে মেশাও”। সুরের ধারায় ঋদ্ধ হলাম আমরা। শিল্পী নিজেই সোশ্যাল মিডিয়া তে লিখলেন “শিখতে হবে, নাহলে পিছিয়ে পড়ব যে”। এই তাগিদ থেকেই অনেকে গান গাইছেন। সব স্বাভাবিক কবে হবে, আদৌ হবে কিনা, এমনটাও ভয় পাচ্ছেন অনেকেই। তবু সুর কে ছেড়ে বা প্রিয় শ্রোতাদের ছেড়ে থাকতেও মন উচাটন। শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত অসুস্থতা কে জয় করে উঠতে সেই সঙ্গীতের সাহায্যই নিচ্ছেন।
এদিকে বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে প্রিয় শিল্পীদের কাছে পৌঁছে যাবার একটা হাতছানি শ্রোতাদের কাছে ও প্রিয় হয়ে উঠছে। যে প্রিয় শিল্পী ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তিনিই যখন শ্রোতার মন্তব্য পড়ে উত্তর দিচ্ছেন, তখন আনন্দিত হচ্ছেন সকলেই। কেউ আবার পাচ্ছেন টপ ফ্যান এর শিরোপা। মফস্বল থেকে এসে রবীন্দ্র সদন এ অনুষ্ঠান শোনা যার কাছে স্বপ্ন ছিল, তিনি ই ইন্টারনেট এর হাত ধরে পৌঁছে যাচ্ছেন শিল্পীর অন্দরমহলে। খুশি বিদেশে বা প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালিরাও। ব্রুসেলস থেকে সুদীপ্তা ঘোষ বা ফ্লোরিডা থেকে মহাশ্বেতা মুখার্জি চোখ রাখছেন ইউ টিউব বা ফেসবুকের পাতায়। কাজের শেষে রাতে বিশ্রাম করতে গিয়ে চণ্ডীগড়ের শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি যেমন চোখ রাখেন সৌরেন্দ্র সৌম্যজিতের গানের দিকে। তাঁর সব ক্লান্তি হরণ করে ওই গানের সুরই।
সোশ্যাল মিডিয়া এক সঙ্গে এনে দিচ্ছে নানান ধরনের সুর। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা এখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। নতুন শিল্পীরা মনে করছেন এ এক সব পেয়েছির দেশ।
সঙ্গীত শিল্পী শমীক পাল আবার মনে করছেন অনলাইন কন্সার্ট এ শ্রোতাদের মন বোঝা বেশ কঠিন। মঞ্চে শ্রোতা ও শিল্পীর মধ্যে যে মনের যোগ সৃষ্টি হয়, লাইভ অনুষ্ঠানে তা বেশ কষ্ট সাপেক্ষ। উনি এটা মনে করিয়ে দিলেন যে মঞ্চে আলোর কাজ করেন যে শিল্পী, যিনি বাদ্য যন্ত্র বাজান বা সুর সংযোগ করেন, তাদের সবার পেশা কিন্তু এই সঙ্গীত কে ঘিরে। এই মুহূর্তে ভীষণ অনিশ্চিত তাদের দিন যাপন। তাই অনলাইন সঙ্গীত পরিবেশন কে অনন্যোপায় হয়েই বেছে নিতে হচ্ছে তাদের। নবীন সঙ্গীতশিল্পী প্রিয়ঙ্কর মজুমদার আবার মনে করেন রাতারাতি সবাই অনলাইন এর পথ বেছে নিয়েছেন লকডাউনের একাকীত্ব থেকে বাঁচতে। সুর সাধনাই সেখানে মুল। নেটওয়ার্ক এর সমস্যা বা ফোনের গুণগত মানই সব নয়। কিন্তু শান্তিনিকেতন এর বাউল গান বা মেদিনীপুরের পটের গান করেন যে শিল্পী, প্রযুক্তির এই আলো তাদের কাছে পৌছবে কি? তাই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তিনি এই শিল্পী ও বাদ্য যন্ত্রী দের পাশে দাঁড়াতে চান। সঙ্গীত কে ঘিরেই স্বপ্ন দেখতে চান।
এই মহামারি শেষে কবে আবার মঞ্চের সামনে বসে গান শুনব আমরা জানি না। বিদেশে বা দেশে পুজোর অনুষ্ঠান বন্ধ প্রায় সব জায়গাতেই। বেশিরভাগ শিল্পীই অপেক্ষা করছেন আবার কবে মঞ্চের পর্দা উঠবে আর জোরালো আলোর নীচে বসে সারি সারি শ্রোতার সামনে তারা সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারবেন। এই মহামারি শেষে একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে। তার আগে অবধি একটু তাদের পাশে থাকি নাহয়? নাহয় ঘরে বসেই সামান্য মূল্যে টিকিট কিনে অনুষ্ঠান শুনি। যাঁরা সুর দিয়ে আমাদের মন ভরিয়ে তোলেন তাদের একটু সময় বা সম্মানদক্ষিণা দিতে যদি সকলে এগিয়ে আসি, এই দুর্যোগও কেটে যাবে। যারা আমাদের মন ভাল রাখার সুরের জাদুকর, তাদের জীবনে একটু হলেও যেন সুর ফিরিয়ে দিতে পারি। বাংলা গান ছড়িয়ে পড়ুক আটলান্টা থেকে অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুর। এই সুরের ভাষা, ছন্দের ভাষা আমাদের সব দুর্যোগ দূর করুক।
কর্পোরেট সংস্থায় এইচ আর-এর ভূমিকায় যুক্ত সিলভার পছন্দ গান, খাওয়াদাওয়া আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। লেখালেখি করেন শখে আর অনুরোধে।