আগে খুব অসুবিধে ছিল যাতায়াতের। এখন এখান থেকে গদখালি টানা বাস যায়। খুব কপাল খারাপ না থাকলে একটা সিট পেয়েই যায় মিথিলেশ। ইঞ্জিনের ওপর বসেও চলে যায় মাঝে মাঝে। ড্রাইভারের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। আটটা চব্বিশের বাসে ড্রাইভার মানে হয় স্বপন, নয় পটা। স্বপন চুপচাপ, তাকে দেখলে মনে হয় এই দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা তার মাথায় চাপানো। পটা ততটাই মুখর, সে মাঝে মাঝেই মিথিলেশকে শাসানির ভঙ্গিতে বলে-
– এই পড়ালেখার লাইনটা ছাড়া, দুনিয়ার সব লাইনই চষা হয়ে গিয়েছে, বুঝলেন স্যার…
মিথিলেশ জানে ‘স্যার’ শব্দটা ঠিক মাস্টার মানুষকে সমীহ থেকে বলে না পটা, স্যার বলার সময় ওর চোখে কেমন আক্রোশ আর খুন খেলা করে। তবু, পটাকে ঠিক ভয় করে না মিথিলেশ। শুধু পটাকে কেন, কাউকে বা কিছুকেই ওর ভয় নেই আজকাল। গত ভাদ্রে ও বিয়াল্লিশ ছুঁয়েছে।আর কি ভয় মানায় ওকে?
মিথিলেশের চেহারায় অবশ্য সেই অকুতোভয় ব্যাপারটা নেই। বাবা-কাকা ভাইয়ের তুলনায় বেশ খানিকটা বেঁটেই সে, রংটাও ওদের মতো টকটকে ফরসা নয়, সিমেন্টের কাছাকাছি। পদবীটা না বললে আর পাঁচটা বাঙালির থেকে ওকে আলাদা করা যাবে না। কিন্তু মিথিলেশ প্রসাদ ঝা বললে বেশিরভাগ লোকই কৌতূহলী চোখে তাকায়। এটা ঠিক, কয়েক পুরুষ আগে মিথিলেশরা দ্বারভাঙ্গায় থাকত। পণ্ডিত বংশ। ওর এক পূর্বপুরুষ, পার্বতী প্রসাদ ঝা হরিনাভি টোলে পড়াতে চলে আসেন পণ্ডিত রামশরণ তর্করত্নের ডাকে। সেই হরিনাভি থেকে আরও দক্ষিণে সরতে সরতে দু’পুরুষ আগে ওরা থিতু হয়েছে রত্নেশ্বরপুরে। এই রত্নেশ্বরপুর থেকে গদখালি ডাইরেক্ট বাস সার্ভিস এখন। আর গদখালিতে নেমে খেয়া পার হলেই তো অবন্তীনগর।
***
ঝিল্লিকে বলেছিল মিথিলেশ চাকরি পাবার কথা। চল্লিশ পেরিয়ে চাকরি পেলে খুশির সঙ্গে যতটা নির্লিপ্তি মিশে থাকা উচিত, সেইরকমই কেঠো গলায় খবরটা দিয়েছিল। কিন্তু ঝিল্লি সেই শুনে এত উত্তেজিত হয়ে উঠল, এত উল্লাস বেজে উঠল তার গলায়, সামনাসামনি তক্ষুনি তাকে দেখতে ইচ্ছে করল মিথিলেশের। স্বামী পুত্র নিয়ে জম্পেশ গৃহিণী ঝিল্লি মিথিলেশের জন্যে এতটা আবেগ জমিয়ে রেখেছে বুকের ভেতর?মিথিলেশ তো ভেবেছিল, যা ছিল তার দিক থেকেই ছিল।ঝিল্লির দিক থেকে কিচ্ছু না। ঝিল্লির উচ্ছ্বাস দেখে ওর এই প্রথম চাকরি পাওয়ার জন্যে দারুণ আনন্দ হচ্ছিল। এতক্ষণ চাকরি পাওয়াটা ওর কাছে অকূল সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে তীর পেয়ে যাওয়ার মতো একটা মরণবাঁচন সমস্যা ছিল।শুধু তীর ছাড়া ও আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। ঝিল্লির সঙ্গে কথা বলবার পরেই ও প্রথম তীরে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে চতুর্দিকে দেখার অবকাশ পেল। দেখল কী আশ্চর্য আকাশ, বেলাভূমি, জীবন, চাকরি পাওয়া, আর? আর ঝিল্লি।
তারপর থেকে ও যতবারই ঝিল্লিকে ফোন করত, কেবলই ওর নতুন চাকরি, ওর স্কুল নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করত। ওর উদ্দেশ্য ছিল ঝিল্লির গলা থেকে আনন্দের তাপ নেওয়া। যেমনভাবে দুর্গাপুজোর সময় আরতির প্রদীপের উত্তাপ নেয় মাথায় আর বুকে। এইরকম একদিন ঝিল্লি মিথিলেশকে জিজ্ঞেস করল:
– তোর স্কুল তো অনেক দূর। তুই কীসে করে যাস?
সেই মুহূর্তে মিথিলেশ তার দ্বিতীয় আনন্দের খনি খুঁজে পেল। সে তার বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার রাস্তাটুকু যৎসামান্য তথ্যের ভিত্তিতে এমন রঙিন করে তুলল, যে মনে হতে পারে সেটা কোংকন রেলযাত্রা বা খাণ্ডালা যাবার মতো কোনও প্রসিদ্ধ পর্যটনপথ। কিংবা কাঞ্চনকন্যা ট্রেন ধরে আলিপুরদুয়ার যাবার মতো অসামান্য কোনও যাত্রাপথ। অরণ্য, পাহাড়, ঝরনা, চা বাগান– কী নেই সেখানে? যারা সে পথে যায়নি, তারা জানে না কী হারাচ্ছে।
রত্নেশ্বরপুর থেকে গদখালি- ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা তো বটেই। আগে এই রুটে কোনও বাস ছিল না। অটোতে, ট্রেকারে ঝুলে ঝুলে যেতে হত। রত্নেশ্বরপুর থেকে জায়গা পাওয়া অসম্ভব ছিল। এখন ডায়রেক্ট বাস। মিথিলেশের চাকরি আর এই নতুন বাসরুট- দুয়ের বয়স প্রায় একই। সেই বাস সীতাকুণ্ডু পেরিয়ে, বুড়োবকুলতলা থেকে ছেড়ে আসে। রত্নেশ্বরপুর থেকে উঠে বসার জায়গা তবু একটা পেয়েই যায় মিথিলেশ। বেশিরভাগই স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভিড়, এঁড়িগেঁড়ি কোলে মা, মিস্ত্রি-মজুর, চ্যাঁভ্যাঁ– তারই মধ্যে কিছু না পেলে ড্রাইভারের পাশে ইঞ্জিনের ওপর বসে যায় মিথিলেশ। একবার বসে পড়তে পারলেই নিশ্চিন্ত। তখন পথের দু’পাশটা ওর। ও মনে মনে টুকে নিতে থাকে দু’পাশের গাছপালা, দোকানঘর, মাঠ, পুকুর, খেতে কাজ করতে করতে থমকে দাঁড়ানো বউ-ঝি, ন্যাংটা ছেলের পাল, সিপিএম-তৃণমূলের দফতর, গুপ্তরোগ, যৌন রোগের পোস্টার, সব… সব কিছু।
স্কুলে টিফিনের ঘণ্টা পড়লে ওর মনের মধ্যেও ঘণ্টা বাজে ঢং, ঢং, ঢং… ও ছাড়া পাওয়া পাখির মতো উড়তে উড়তে নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়। কী করবে কী করবে, ভাবতে ভাবতে ঝিল্লিকে ফোনে ধরে।
– জানিস কোথায় দাঁড়িয়ে তোকে ফোন করছি?
– জানি তো। নদীর ধারে…
– বল তো কী নাম নদীর?
– কী?
– বিদ্যাধরী
– বিশ্রী নাম। নদীর নাম দে ঝিল্লি।
মিথিলেশ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। ঝিল্লি! ঝিল্লি! ঝিল্লি নদী! ও আজই গণপতি স্যারকে জিজ্ঞেস করবে পশ্চিমবঙ্গে ঝিল্লি নামে কোনও নদী ছিল কিনা। গণপতির ভূগোলে অনার্স ছিল। মঙ্গলকাব্যগুলোও দেখে নিতে হবে। মধ্যযুগে কি ঝিল্লি নামের কোনও নদী ছিল?
– ওয়াও! দারুণ বলেছিস তো। ঝিল্লি নদী। অবন্তীনগরের ঝিল্লি নদী।
ঝিল্লি তখন নখে পালিশ লাগাতে লাগাতে ফিস ফিসিয়ে বলবে
– আমি একদিন যাব আমার নামের নদীর কাছে…
ও এমনভাবে বলবে যেন এই নদীটার নাম বহুকাল ধরেই ঝিল্লি নদী, যেন ও এখুনি এই নাম দেয়নি নিজে নিজে। মিথিলেশ বাঁ হাতে ফোন ধরে আছে, ডান হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে চিৎকার করে বলল ‘ইয়েস!’ তার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে এইভাবে উল্লাস প্রকাশ করে। মিথিলেশ আজ ওর জীবনের তৃতীয় আনন্দের উৎস আবিষ্কার করেছে। ঝিল্লি আসবে। ঝিল্লি একদিন অবন্তীনগরে আসবে! (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব আগামী সোমবার, ১৮ জুলাই ২০২২
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
Bhalo lagchhe
এতদিনে শুরু করলাম। জমে যাবে মনে হচ্ছে।