আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪]

হিরন্ময়ের কথা আমার সব মনে আছে। হিরন্ময়ই জানত আমার মনের খবর। কিন্তু সে তো অদৃশ্য হয়ে গেল এক রাতে। হিরন্ময়ের গল্প অনেক হিরন্ময়ে মিশে গেছে। আমার এমন কোনও গল্প নেই যে তা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমার একটা গোপন সত্য আছে, তা আমার বুকের কোটরে সঞ্চিত আছে। সেই সত্যের সাক্ষী ছিল হিরন্ময়। তারপর সব শূন্য। 

নীলমাধবের আবাসন ছিল কাকলি গানের বাড়ি, তা আমি ভুলব কী করে? কিন্তু কাকলি গানের বাড়ি না থেকে কী হয়েছে আমার, তা আমি সাহস পেলে বলব। আমার অত সাহস নেই। কাকলি গানের বাড়ি থেকে ভেসে আসা গান আমি এখনও মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পাই। নীলমাধব বলে:
– রূপবাণী সিনেমা হলটা নেই, কত সিনেমার স্মৃতি, এখনই, হংসমিথুন, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, আরে আমি নীলাচলে মহাপ্রভুও দেখেছি রূপবাণীতে। ক’দিনের জন্য দিয়েছিল, ভাবলাম ঐটাই দেখব। 
– তোমার সাহস ছিল। সব মা কাকিমাদের ভিতরে তুমি চন্দনাপাখিকে নিয়ে ম্যাটিনি শোয়ে ওয়াল সাইড। বলে কার্তিক হাসল। নীলমাধব বলে:
– সে এখন ভিলাইয়েই  থাকে। পুজোয় এসেছিল, প্যান্ডেলে দেখা হয়েছিল। 
কথা হল? কার্তিক জিজ্ঞেস করে।
হল তো। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হাজ়ব্যান্ডের কাছে। কনট্রাকটরি করে বেজায় মোটা হয়েছে।   সিঙ্গাপুরে শপিং করতে গিয়েছিল, ইওরোপ যাবে, আমাকে চিনতেই পারল না! নাকি চিনল না, তা সে-ই জানে। চন্দনাকে নিয়ে পালিয়েছিল, আমি বেঁচেছিলাম। 

আমার বিরক্তি লাগে এইসব শুনতে শুনতে। কেন, তা সময়েই বলা যাবে, যদি আমার মনে জোর আসে, সাহস হয়। আসলে সাহস নয়। কিছু কিছু কথা মনের ভিতরে রেখে দিতে হয় আমৃত্যু, সব কথা সকলকে বলা যায় না। সব কথা বলার নয়। জীবনের সঞ্চয় তো কিছু থাকে। ব্যাঙ্কের লকারে রাখা সোনার গয়নার মতো। অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে পারে না কখনও।    

পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ধনী নীলাম্বর পালের এ অঞ্চলে আবির্ভাবের সময় আমি গ্র্যাজুয়েট হচ্ছি। চাকরির খোঁজ করছি। নীলাম্বরের পুত্রের সঙ্গে আমার তখন অত মেলামেশা ছিল না। সুতরাং নীলমাধব কী করেছে তা আমার জানা ছিল না। তবে কুণ্ডু ডাক্তারের মেয়ে চন্দনাকে আমি চিনতাম। কুণ্ডু ছিল হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। তেমন পশার ছিল না। তার হোমিওপ্যাথি ডিসপেন্সারিতে ওষুধ বিক্রি হত। আমি কতবার ব্রায়োনিয়া থার্টি, আরনিকা মাদার টিংচার, নাক্স কিনে এনেছি। আমার বাবা বাড়িতে হোমিওপ্যাথি চর্চা করতেন বই পড়ে। সেই বই, ‘সহজে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা’ এখনও বাড়িতে আছে। বাবার স্মৃতি। বাবার সেই ব্যাগটাও আছে, যার ভিতরে অজস্র শিশি ছিল নানা ওষুধে ভরা।

তখন যেমন নকশাল আমল। বিপ্লব করতে ভাল ছেলেরা ঘর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। কলকাতায়ও খুনোখুনি লেগে থাকত। সেই বিপ্লব থেকে, প্রতিবাদ থেকে ছেলেদের দূরে রাখতে সেক্স ম্যাগাজিনের বড় আয়োজন করে দিয়েছিল যেন সরকারই। সরকারের মদত ছিল যে, তা এখন বুঝতে পারি। নকশাল আন্দোলন দমন হল, প্রচুর লাশ পড়ল, স্তিমিত হলো যুব বিদ্রোহ।

কিন্তু কথা সেইটা নয়, কথা হল কুণ্ডু ডাক্তারের মেয়ে চন্দনাকে নিয়ে। মেয়েটা সুন্দরী ছিল, মানে ফর্শা, লম্বাটে মুখ, একটু বাদামি ভাব ছিল চোখে। লম্বা ছিল না বেশি, কিন্তু শরীর ছিল বাড়ন্ত। সবকিছুই যেন বেশি, যা দিয়ে পুরুষ আকর্ষণ করতে পারে। তার নাম চন্দনাপাখি হয়ে গিয়েছিল, কারণ সে উড়ে উড়ে বেড়াত। কতজনের সঙ্গে প্রেম ছিল তার! মানে সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া। তখন ছিল পর্দা ঢাকা কেবিন। এখন সে সব আছে কি না জানি না। পর্দা ঢাকা কেবিনই ছিল অনেক যুবক যুবতীর প্রথম চুম্বনের জায়গা। বেয়ারাকে ভালো বকশিস দিলে অনেক সময় থাকা যেত। আমার নিজের অভিজ্ঞতা না থাকুক, কলেজের  সহপাঠীদের মুখে এসব শুনেছি। সুতরাং  কুণ্ডু ডাক্তারের মেয়ে চন্দনা নীলমাধবের সঙ্গে সিনেমায় যাবে, এ আর নতুন কী কথা। হতেই পারে।

টাকায় বশ ছিল সেই মেয়ে। শেষে বিয়ে করে পালিয়ে গেল ভিলাই। যাকে বিয়ে করল, তার না ছিল চাকরি, না ছিল ব্যবসা। ছেলেটি ভিলাই গেল বড় ভাইয়ের কাছে। বড় ভাই কনট্রাকটরি করত সেখানে। কতকালের কথা এসব। আমাদের পাড়ার ইতিহাস কত। আমার তো একটিই প্রেম ছিল কিশোরবেলার, শ্যামাশ্রী। বলতেই হল। না বলে পারছিলাম না। সেই প্রেম হারিয়ে গেল। তারপর বিবাহের আগে পর্যন্ত   আর কিছু হয়নি। ভীতু ছিলাম। আর ভাবতাম। কত কী না ভাবতাম, শ্যামাশ্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। চিরকাল কি দেশের বাড়ি থাকবে? আবার ফিরে আসবে শহরে। এই শহরেই দেখা হয়ে যাবে। দেখা হলে আমাকে বলবে, এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি কবিতা পড়তাম, গল্প পড়তাম সেই বয়সে। এখন আর তত পড়া হয় না। মনে হয়, আগেই সব ভাল ছিল, এখন সব খারাপ। আমিও নীলমাধব! হায়!

নীলমাধব আর গুণেন সরকার সহপাঠী ছিল। গুণেন সবদিন আসেন না। তাঁর দুই মেয়ের একটির এখনও বিয়ে দিতে পারেননি। এমনিতে একটু কমজোরি মানুষ, টাকা পয়সা বিশেষ রাখতে পারেননি। সংসার বড় ছিল, বাবা মা ভাইবোন। সব দায়িত্ব শেষ হলে নিজে বুঝলেন, তেমন কিছু নেই যা দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কিন্তু মানুষটি তেজিয়ান। ঠোঁট-কাটা। তাঁর ছোট মেয়ে একটি বেকার যুবকের সঙ্গে প্রেম করে। কথাটা নীলমাধবই বলেছে। গুণেনের ছোট মেয়েকে সে চেনে। তাকে এক যুবকের সঙ্গে এখানে ওখানে দেখেছে। কিন্তু নীলমাধবই একটি কমবয়সী মেয়েকে নিয়ে যে হেথাহোথা ঘুরে বেড়ায়, গোপনে সিনেমা হলে ঢোকে, গুণেন তা আমাদের বলেছে। আমরা গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি সে কথা। 

আমার বাবা বাড়িতে হোমিওপ্যাথি চর্চা করতেন বই পড়ে। সেই বই, ‘সহজে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা’ এখনও বাড়িতে আছে। বাবার স্মৃতি। বাবার সেই ব্যাগটাও আছে, যার ভিতরে অজস্র শিশি ছিল নানা ওষুধে ভরা। কিন্তু কথা সেইটা নয়, কথা হল কুণ্ডু ডাক্তারের মেয়ে চন্দনাকে নিয়ে।

নীলমাধব হল ফরিদপুরের মধুতলার পালোধী বংশ। মস্ত জমিদারি ছিল তাদের। বিলাসী জীবন ছিল। তাদের রক্তেই আছে এমন ভোগের স্পৃহা, তা কি এপারে এসে  ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে? বংশের মর্যাদা রক্ষা করছে সে। বলে, তার ঠাকুরদা তিনজন মেয়েমানুষ পুষত। তিনজনের ভরণপোষণ দিত। তারা আসেনি কেউ।  বুড়ি হয়ে গিয়েছিল। খান সেনারা কচুকাটা কেটেছিল। এ নিয়ে জুড়ানচন্দ্র রায়ের মত অবশ্য অন্য। জুড়ানের প্রধান পরিচয় হল, সে সব জানে। যশোর জেলার ঝিনাইদহ থেকে আসা জুড়ান জানে কাদের মেরেছিল খান সেনারা। কে দেখিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তারা এপারে, কিন্তু তার কাছে কোনও কিছুই অজানা নয়।  

বিকেলের আলো কমে এলে পার্কে কী হয় তা নীলমাধব শোনায়। কত চেনা মেয়েকে দেখেছে সন্ধের পর পার্কে…। নীলমাধবের কথা শুনে মনে হয়েছিল, ইঙ্গিত গুণেনের দিকে। তাঁর মেয়ে বিকেলে এই পার্কে আসে কিনা জানেন না তিনি। মেয়ে বিকেলে বেরয় টিউশনি করতে, ফিরতে রাত আটটা-সাড়ে আটটা। তাহলে কি মেয়ে আসে এখানে কোনও কোনও দিন? যদি আসেও, নীলমাধব জানবে কী করে?

নীলমাধব একটি বছর পঁচিশের যুবতীর সঙ্গে আইনক্সে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, এই সংবাদ গুণেন জানেন। তাঁর বড় মেয়ে গিয়েছিল সিটি সেন্টারে। ওরা অমনি যায়। হয়তো কিছু কেনে, হয়তো কেনে না। উইন্ডো শপিং করা বলে একে। দেখেও সুখ। জামাই আইটি-র চাকরি করে। খারাপ বেতন পায় না। কথাটা সে তার বোনকে বলেছিল:
– বাবার বন্ধু না লোকটা? বিয়েতে মুক্তোর হার দিয়েছিল, হাত ধরাধরি করে সিনেমায়  ঢুকে গেল শপিং করে। কী কিনল জানিস মেয়েটা?

গুণেন কথাগুলো আমাকে বলেছে। গুণেন শুনেছে তার বউ সুষমার কাছ থেকে। সুষমা শুনেছে তার ছোট মেয়ের কাছ থেকে। শপিঙের সময়ই দেখেছে গুণেনের বড় মেয়ে, একেবারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। সে কথা বলতে গিয়েও সরে এসেছিল তাদের কথা শুনে। মেয়েটির জিন্স, টপ, আন্ডার গারমেন্টস।
ধ্যাত! তা হয় নাকি?
– হয় রে। দামী ব্রা কিনল মেয়েটা, লোকটাকে কার্ড ফেরত  দিল।
ইসস! কী যে বলিস তুই দিদি।
– আরে আমি তো মেয়েটার পাশেই দাঁড়িয়ে। তোর জামাইবাবু একটা শার্ট কিনেছিল, পে করছিলাম। দামী ব্রা প্যান্টি দুই সেট, জিন্স, টপ। পে করে কার্ড ফেরত দিল লোকটাকে।

কথাগুলো গুণেন বলেছে আমাকে। গুণেন আমাদের সকালের আড্ডায় আসে, আবার আসেও না। ইচ্ছে মতো তার আসা না আসা। কথাগুলো আমি কাউকে বলতে পারিনি। বলার দরকারই বা কী? নীলমাধবের কানে উঠে গেলে, আমাদের দল ভেঙে যাবে। একটি দলে অনেকরকম মানুষ তো থাকে। ভালমন্দ মিশিয়েই তো জগত। আমি জুড়ান রায়কে ঠিক পছন্দ করতে পারি না। তারা ওপারে সব খুইয়ে এসে এপারে কিছু করতে পারেনি। নীলাম্বর পালোধী বুদ্ধিমান মানুষ, তাই নিয়ে আসতে পেরেছে প্রায় সবটাই। কিন্তু জুড়ানের এখানেই আপত্তি। না সব লুটের মাল। লুটের গয়না কিনত লোকটা। উদ্বাস্তু শিবিরের খবর। খবর চাপা থাকে না। মৃত্যু সংবাদ যেমন অসত্য হয় কম, খারাপ সংবাদও অসত্য হয় না সব সময়। 

যশোরের ঝিনাইদহের বোসরা এসেছে দমদম। তারা বিনিময় করতে পেরেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার ছ’মাস পর। তখন এদিক থেকে অনেক বাঙালি মুসলমান নতুন দেশ বাংলাদেশে চলে গিয়েছিল। তাদের  নিয়ে তো কেউ কিছু বলেনি! বরং তাদের সুখ্যাতিই করত লোকে। জুড়ান নিজে যায় তাদের বাড়ি। এক জেলার মানুষ তো। জুড়ান রায়ের কথা থাক। সে আমাদের প্রাতর্ভ্রমণ দলের নয়। গুণেন এলেই নীলমাধব এই পার্কের সন্ধ্যার কথা তোলে কোনও সূত্র ছাড়াই। তাহলে কি নীলমাধব চিনতে পেরেছিল গুণেনের মেয়েকে? তাই তাকে ভয় দেখায় এইসব কথা বলে? নীলমাধব বলে, আরে ভাই, ফুর্তি করবে তো তেমনি জায়গায় যাও, পাড়ায় কেন? সমাজটাকে তো বাঁচাতে হবে?

নীলমাধব হল ফরিদপুরের মধুতলার পালোধী বংশ। মস্ত জমিদারি ছিল তাদের। বিলাসী জীবন ছিল। তাদের রক্তেই আছে এমন ভোগের স্পৃহা, তা কি এপারে এসে  ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে? বংশের মর্যাদা রক্ষা করছে সে। বলে, তার ঠাকুরদা তিনজন মেয়েমানুষ পুষত। তিনজনের ভরণপোষণ দিত। 

আশ্চর্য কথা! নীলমাধব বলে:
– পাড়ার ভিতরে এসব না করে, ভিক্টোরিয়ার বাগানে যাক না এরা, যা চটকাচটকি করার সেখানে গিয়ে কর।
– ওই ভাবে বলছ কেন? চাকরি নেই, বয়স হয়ে যাচ্ছে, এদের জীবনে আছে কী? গুণেন বলেন।  
– চাকরি নেই বলে ফস্টি নস্টি করতে হবে? ফস্টি নস্টিতে চাকরি পাওয়া যায়? নীলমাধব বলে:
– তোমার মেয়ে যদি এসব করে, তুমি অনুমতি দেবে তো?
আসলে কথাটা বলা, কথাটা তোলা হয়ত গুণেন সরকারকে চমকানোর জন্য। গুণেনের মেয়ে তাকে দেখেছে ডায়মন্ড প্লাজ়া শপিং মলে, গুণেন তুই চুপ করে যা। নীলাম্বর পালোধীর পুত্র নীলমাধব পালোধীর ভিতরে পিতৃপুরুষের রক্ত চাগাড় দিয়ে ওঠে যে, তা আমাকে বলেছেন সুমিতাভ মৈত্র। সুমিতাভ কে? লেখক সুমিতাভ মৈত্র। তাঁকে দেখলে মনে প্রশান্তি আসে। তাঁর কথা বলব।  

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *