আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬]

সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে নীলমাধব। প্রায়ই বলছে, চঞ্চলচন্দ্র লোকটাকে তাড়াতে হবে। সে এ পাড়ার  আদি বাসিন্দা। তার অধিকার আছে পাড়ায় কে থাকবে, কে থাকবে না, তা নির্ধারণ  করার। পালোধীরা এখানকার কতকালের মানুষ, পার্টিশন হল, তার আগে থেকে তারা আছে। চঞ্চলচন্দ্র বহিরাগত।

ভাবলাম বলি, তখন ওই বাড়ির নাম ছিল হ্যারিয়েট মিউজিক  স্কুল, জানেন তা? কিন্তু বললাম না। ডাহা মিথ্যে বলার কারণ  লুটের গয়না, অন্তত জুড়ানের মতে। আমার মতে কাকলি গানের বাড়ি মুছে দেওয়া। কিন্তু মুখে ফতোয়া দিলে হয় না তো।  চঞ্চলচন্দ্রকে কী করে তাড়াবে নীলমাধব? থানা পুলিশ করে?  অভিযোগ আছে কোনও? আর চঞ্চলচন্দ্র কতটা ক্ষমতাশালী তা আমি জানি না। নীলমাধব যে থানায় ভেট পাঠায় বিভিন্ন সময়ে অসময়ে, তার ফল পেতে পারে চঞ্চলচন্দ্রকে উচ্ছেদ করে। কিন্তু তার জন্য তাকে ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন করে বলতে হবে চুক্তি নবীকরণ না করতে। বলতে হবে উঠে যাওয়ার নোটিস দিতে। আইন আদালত আছে। প্রশাসন আছে। পুলিশের ক্ষমতা শুধু দুর্বলের উপর প্রয়োগ করা যায়।

নীলমাধব একদিন বলল, ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন করেছিল। বাইরের লোক এসে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। আবাসনের একটা নিয়ম আছে, সেই নিয়ম সকলকে মানতে হবে।
ফ্ল্যাটের মালিক কী বলল?  জিজ্ঞেস করলাম আমি।
নীলমাধব জবাব দিল না। মানে খুব সুবিধে হয়নি। ফ্ল্যাটের মালিক নিশ্চয়ই জানে সেই কাকলি গানের বাড়ির কথা। তারও আগে হ্যারিয়েট মিউজিক স্কুলের  কথা। জমি বাড়ি কিনতে হলে তার  অতীত সন্ধান করতে হয়। কোন হাত থেকে কোন  হাতে গেছে। কতবার হস্তান্তর হয়েছে। সেই অনুসন্ধানেই সব জানা গেছে নিশ্চয়ই। 

আবাসনের নিয়ম থাকতেই পারে। ভিখিরি প্রবেশ নিয়ে আপত্তি হতেই পারে। তা ভেঙে  দিচ্ছে  চঞ্চলচন্দ্র। আমি চুপ করে থাকি। আমি কেন নীলমাধবের পক্ষে  বলব? আমি থাকি পুরনো ফ্ল্যাট বাড়িতে। সেখানে নিয়মের বালাই নেই। গলিতে কত ফেরিওয়ালা আসে, কখনও কখনও ভিখিরিও, কিন্তু নীলাম্বর আবাসনের  অনেক  নিয়ম।  নিয়ম থাকলেই কেউ না কেউ তা ভাঙে। ভাঙার  ভিতরেও আনন্দ আছে। বহু আবাসনে নীচে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে রাখা রেজিস্টারে নাম-ধাম লিখে ঢুকতে হয়। সিসি টিভির আওতায় থাকতে হয়। সেইটাই স্বাভাবিক। তবু খুন জখম কি হয় না? সুতরাং নীলমাধব যা বলছে তার বিপক্ষে বলারও কিছু আছে। কাকলি গানের বাড়ি।   

নীলমাধব বলল:
– শালা টেররিস্ট কিনা কে জানে! আবদাল্লা তার নাম। আমাদের  সংবিধানে মুসলমান নিয়ে আপত্তি রেখেছি আমরা। 
– সংবিধান মানে? আমি জিজ্ঞেস করেছি।
কো-অপারেটিভের সিদ্ধান্ত। নীলমাধব বলল।
– আবদাল্লা  সন্দেহভাজন, টেররিস্ট।    

– টেররিস্ট? হতেই পারে। কত টেররিস্ট ধরা পড়ছে কত জায়গায়। মুর্শিদাবাদ, মালদা, হুগলি, বর্ধমান, হাবড়া মসলন্দপুর। আমি অনুচ্চ স্বরে বললাম। বললাম। বলেই ফেললাম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। হাবড়া মসলন্দপুর! নীলমাধব সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে আছে। বলল:
– হাবড়া, মসলন্দপুর, বনগাঁর দিকে এসব হয়েছে বলে জানি না। কে বলল? 
না না না। হাবড়া-মসলন্দপুর না। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম হাবড়ার সঙ্গে মসলন্দপুর জুড়ে দিয়ে। দুই স্টেশন পরপর, একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় নামটি।  আমি এমনভাবে বলেছি, যাতে নির্দিষ্ট  কিছু না হয়। হাবড়া বা মসলন্দপুর। সংশয়পুর। কিন্তু আমার কথায় পাত্তাই দিল না নীলমাধব। বলল:
– আপনি তো জুড়ানের মতো বলছেন। জানলেন কোথা থেকে? নীলমাধব আমাকে জেরা করতে থাকে। সম্বোধন বদলে গিয়ে আপনি হয়ে গেছে, মানে নীলমাধব ক্ষুব্ধ। 
– খবরের কাগজেই পড়েছি।  আমি  বললাম।  
– খবরের কাগজে কবে বেরল? দেখুন মশায়, আমার অত লুকোছাপা নেই। বন্ধুর বাড়িতে যাই হাবড়া নয় মসলন্দপুর। ওদিকে তো টেররিস্ট ধরা পড়েনি।
নীলমাধব আমাকে চাপা গলায় বলল। 
– আমিও তো ডেফিনিট করে বলিনি। সামলাতে লাগলাম।  
– জুড়ান যা বলে তা আমি জানি। কানে সব এসেছে, সব খবর  রাখি। বলল নীলমাধব। 
– কী বলে? আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল জিজ্ঞাসাটি। 
– কী তা আপনি জানেন ভাল। আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে যেন নীলমাধব।
– ওর সাহস খুব বেড়েছে, থানায় গেলে বুঝবে।
 

আমি চুপ করে থাকলাম। নীলমাধব সব জানে? গুণেন আর আমি ছাড়া আর কে জুড়ানের কথা জানে? গুণেন যে নীলমাধবের বিরোধী তা কে না জানে। আমি সাবধানী মানুষ। জুড়ানের সঙ্গে বসেছি, জুড়ান আমার বাড়ি এসেছে রাত্তিরে, গোপনে, তা কি নীলমাধব জানে? কথাটা আমি গুণেনকে বলেছি। একজনকে তো বলতে হয়। না বললে জানার সুখই পাওয়া যায় না। কথায় বলে না, জ্ঞান যত বিতরণ করবে, জ্ঞান তত বেড়ে যাবে। কোনও কিছু জানা তো জ্ঞানেরই নামান্তর। গুণেন কি তাহলে নীলমাধবকে বলেছে? তা হয় কী করে?

হাবড়ার আসল খবর, মানে দুঃস্থ পরিবারের মেয়েকে নিয়ে নীলমাধবের লাম্পট্যের কথা তো গুণেনই বলেছে। এখন কার্তিক দত্ত কেন, সকলেই জানে নীলমাধবের ফুর্তির কাহিনি। জানে নীলমাধবের মাধ্যমেই। তাহলে জুড়ানের কথা সকলে জানে? জুড়ানের সঙ্গে সকলের যোগ আছে? সকলেই বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন সময়ে জুড়ানের কাছে খবর নেয়? আবার আমাদের ভিতর কেউ কেউ ডাবল এজেন্ট। জুড়ানের কথা নীলমাধবকে জানিয়ে দেয়, সঙ্গে আমাদের কথাও। কে তিনি কে জানে, সাবধান থাকতে হবে। ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই। নীলমাধব বলল: 
– জুড়ান তো হুন্ডির এজেন্ট। 
– মানে? আমি জিজ্ঞেস করেছি।
– হুন্ডিতে টাকা পাঠায় বাংলাদেশিরা। জুড়ান এখানে তা ঠিক লোকের কাছে দিয়ে দেয়। 
আমি চুপ করে থাকলাম। আর কথা নয়। কথায় কথা বাড়ে। নীলমাধব আবার ফিরে এল চঞ্চলচন্দ্রে। ভিখিরি আবদাল্লার কথায়। বলল:
– থানায় বলেছি ওদের সম্পর্কে। ভিখিরি আর চঞ্চলচন্দ্র, দুজনেই থানার সন্দেহের তালিকায় ঢুকে গেছে। 
– বাংলাদেশি ক্রিমিনাল হতে পারে, গা ঢাকা দিয়ে আছে। রাজাকার, ব্যাঙ্ক লুট করে পলাতক, চিট ফান্ডের মতো টাকা তুলে পলাতক, লুটের গয়না নিয়ে…। আমি যেন বিদ্রূপের সুরে বলে ফেলতা ফেলতেও, কথা থামিয়ে দিলাম। অতটা সাহস হল না। তবু সাহস যে ফিরে আসছে তা সত্য। তার মানে, ভ্রূ কুঞ্চিত করে নীলমাধব আমাকে দেখছে।

ফ্ল্যাটের মালিক কী বলল?  জিজ্ঞেস করলাম আমি। নীলমাধব  জবাব দিল না। মানে খুব সুবিধে হয়নি। ফ্ল্যাটের মালিক নিশ্চয় জানে সেই কাকলি গানের বাড়ির কথা। তারও আগে হ্যারিয়েট মিউজিক  স্কুলের  কথা। জমি বাড়ি কিনতে হলে তার  অতীত সন্ধান  করতে হয়। কোন হাত থেকে কোন  হাতে গেছে। কতবার হস্তান্তর হয়েছে। সেই অনুসন্ধানেই সব  জানা গেছে নিশ্চয়। 

– মানে শুনলাম একজন মার্ডারার লুকিয়ে ছিল কলকাতায়, মুজিব হত্যাকারী। আমি কথা ঘুরিয়ে  দিলাম। বুঝতে পারছিলাম নীলমাধবের চোখে চোখ রাখতে পারছি এক এক লহমায়।  আমার সাহস বেড়েছে। নীলমাধব জিজ্ঞেস করল:
– কে বলল, কোন কাগজে বেরিয়েছে?
– আমি তো খবরের কাগজেই পড়েছি। উত্তর দিলাম। 
– ফলস। এসব খবর বানায় কাগজওয়ালারা। তারা সব কানাডা, ইউএসএ, মেক্সিকোতে আছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে, ইন্ডিয়া তা দেয়নি। নীলমাধব বলল।
এবার আমি আর তর্ক করলাম না। সবই তো আমার শোনা কথা। জুড়ানের কথা তো বলা যাবে না। নীলমাধব বলল:
– এই সব কথা বিপজ্জনক। দেশের পক্ষেও বিপজ্জনক, বলবেন না। ভারত কোনও মার্ডারারকে আশ্রয় দেয় না। 
– না, লুকিয়ে ছিল। বললাম।
– লুকিয়ে কতদিন থাকবে? পুলিশের সন্দেহের খাতায় ঢুকে গেলে রেহাই নেই। 
– সন্দেহের খাতা থাকে থানায়? কার্তিক দত্ত জিজ্ঞেস করল।
– থাকে তো বটেই। সব থানার আছে। প্রত্যেকটা লোকের তথ্য, সন্দেহভাজনের পাশে রেড মার্ক করা থাকে। নাহলে প্রশাসন চলবে কী করে?

আমার মনে হতে লাগল নীলমাধবের কথারও সত্যতা আছে। আবার জুড়ানেরও। তবু চুপ করে থাকাই ভাল। এর ভিতরে নীলমাধব দু’দিনের ট্যুরে সস্ত্রীক মায়াপুর ঘুরতে গেল। গুণেন সরকার বলল:
– ধম্মো করতে গেল। এবার নিশ্চয় লোকটা দূরে কোথাও একা একা যাবে, খুব মদ খাবে, ফুর্তি করবে। 
আমাদের ঈর্ষা হতে লাগল। এক একজন এক এক রকম কথা বলল হাবড়ার পরিবার নিয়ে। আমরা জানতাম হাবড়া, নীলমাধব বলল, মসলন্দপুর। সেখানে নীলমাধব যখন যায়, মেয়েটিকে নিয়ে আলাদা ঘরে চলে যায়। এ কথা নীলমাধবই বলেছে কার্তিক দত্তকে। মেয়ে নীলমাধবের জন্য পাগল।  নীলমাধবকে না দেখলে সে পারে না। ছুটে আসে কলকাতা। অদ্ভুত জীবন। 

নীলমাধবের সঙ্গে থাকি প্রাতর্ভ্রমণে। নীলমাধব না থাকলে তার খুব সমালোচনা করি। গুণেন সরকারের কথা সত্য হল। সাত দিনের জন্য নীলমাধব হিমাচল প্রদেশে গেল। আকাশে উড়ে। এখন মার্চ মাস, কলকাতায় গরম পড়ে গেছে। কিন্তু হিমাচলে তুষারপাত হচ্ছে, তা দেখেছি টেলিভিশনে। আমি কোনওদিন তুষারপাত দেখিনি। জানি, শীতের চেয়ে উপভোগ্য ঋতু আর নেই। আমি জানি নীলমাধব একা যায়নি। সঙ্গে হাবড়ার সেই কচি মেয়েটি গেছে। খবর সব জুড়ান কিংবা গুণেন দেবে। ওরা না দিলে নীলমাধব নিজেই দেবে। কাউকে বলবে। সে আমাদের জানিয়ে দেবে। 
জুড়ান বলল:
– সব ফাঁস হয়ে যাবে। বশির মল্লিকের মেয়ে নিয়ে ও ফুর্তি মারছে। আসলে বশিরকে ও ব্ল্যাকমেল করছে, ভয় দেখিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে পারছে। 
আমার মনে হল, কথাটি অসত্য নাও হতে পারে। নাহলে কেন একটি ২৩-২৪ বছরের মেয়ে একটা বুড়োর সঙ্গে বেড়াতে যাবে, রাত্রিবাস করবে? নীলমাধব পারে এ কাজ করতে। নিরূপায় হয়ে  সেই পলাতক আসামী রাজাকার কিংবা হত্যাকারী তার যুবতী কন্যাকে নীলমাধবের হাতে তুলে দিয়েছে। ইশ! খুব অন্যায়। একেই কি পাপের শাস্তি বলে? জেলখানা, বন্দিদশার পরিবর্তে এ আর এক বন্দিত্ব।  

আনন্দময় মুখ নিয়ে ফিরে এল নীলমাধব। এবার আমাকেই যেন শুনিয়ে বলল, তার একটি প্রেমিকা হয়েছে। কমবয়স। তাকে নিয়েই গিয়েছিল সে। নীলমাধব বলল:
– আপনি কাউকে বলবেন না, আবার বলতেও পারেন। আমার ওয়াইফ জানলেও কিছু বলবে না। পুরুষ মানুষের এসব থাকতে হয়। না হলে তার পৌরুষ কোথায়? যাকগে। আমার লাভার আমাকে খুব ভালবাসে। শি ইজ বিউটিফুল অ্যান্ড সেক্সি। শি ক্যান ডু এভরিথিং। খুব যত্নও করেছে। হট ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে কোমরের ব্যথা সারিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডায় কোমরে মোচড় লেগেছিল। লাইফ হো তো এইসা। সিনেমার মতো। সিনেমার নায়করা এমনই লাইফ লিড করে। মোবাইলে সব ছবি আছে। একদিন বাড়ি আসুন দেখাব। এখানে হয় না, চমকে যাবেন।

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *