বাঙালির নববর্ষ আর পয়লা বৈশাখ মিশে যায় শুভেচ্ছা বিনিময়ে, মিষ্টিমুখ আর স্বাদে আহ্লাদে। বৈশাখী আড্ডা, নতুন জামার গন্ধের সঙ্গে জুড়ে থাকে রকমারি খাওয়াদাওয়া। শিল্প-সংস্কৃতি আর খাওয়াদাওয়া এক নিশ্বাসে বললেই যে পরিবারের কথা প্রথমে মনে আসে, তা হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। এই ঠাকুর পরিবারেরই একজন অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। বাংলা নতুন বছর শুরু করা যাক ওঁর লিপিবদ্ধ করা অঢেল রেসিপির মধ্যে থেকে কিছু রান্না দিয়ে। যে সমস্ত রান্নায় নামীদামি রেস্তোরাঁর ছাপ নেই, আছে মা ঠাকুমাদের আঁচলের ছায়া আর ভালবাসা।
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পূর্ণিমা দেবীর মধ্যম কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য নারীদের মতোই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তিনি। বাবা রসায়নে পণ্ডিত আর মা তুলি ক্যানভাস হাতে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু প্রজ্ঞাসুন্দরী বেছে নিলেন রান্নাকে, রসায়ন আর আর্টকে মিলিয়ে দিলেন রান্নাঘরের চার দেওয়ালে গন্ধে-বর্ণে-স্বাদে… তার আগে, রান্নাঘর ছিল হেলাফেলার জায়গা। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেখিয়ে দিলেন, গান-বাজনার মতো রান্নাও এক শিল্প, তার পিছনেও রয়েছে নিপুণ বিজ্ঞান। আঠারো শতকে দাঁড়িয়ে এই চিন্তাও একধরনের বিপ্লব বৈ কি!
যে রান্নাঘর মানে কালিঝুলি মাখা দেওয়াল, কুটনো কোটা, বাটনা বাটা, খুন্তি নাড়ানো, যেমন তেমন একটা অবহেলিত জায়গা, তাকেই এক নতুন রূপ দিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী, সাজিয়ে তুললেন শিল্পসৃষ্টির গবেষণাগার হিসেবে।
অসীম ধৈর্য্য, যত্ন আর নিপুণতার সাথে লিখলেন বাংলার প্রথম নিরামিষ ও আমিষ রান্নার বই! তবে বইয়ের আগে, ‘পূণ্য’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন ঠাকুরবাড়ি থেকে, যাতে থাকত আমিষ নিরামিষ নানারকম রান্নার রেসিপি।
 
বিবাহ সূত্রে ভারতের নানান জায়গায় ঘুরতে হত প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীকে, আসাম, বিহার, ওড়িশার নানা অঞ্চলে। সেই সুযোগে উনি শিখে নিতেন সেখানকার আঞ্চলিক রান্নাগুলো। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্যদের মতো, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজ্ঞাসুন্দরী বিদেশি রান্নাও আপন করে নিয়েছিলেন। আবার তাঁর স্বরচিত খাবারও ছিল হরেকরকম। রবি ঠাকুরের জন্মদিনে যেমন, ফুলকপি দিয়ে বানানো ‘কবি সম্বর্ধনা বরফি’ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, তেমনই প্রিয় মানুষদের নামে বানিয়েছিলেন ‘সুরভি পায়েস’, ‘দ্বারকানাথ ফিরনি পোলাও’, ‘রামমোহন দোলমা পোলাও’ ইত্যাদি।
 
 
শুধু রান্না নয়, রান্নার সঙ্গে থাকত বাজারদর, আর বিশেষ দিনে রান্না করার পর লেখা হত ‘ক্রমণী’, যা এখনকার মেনু কার্ডের সমতুল্য। কখনও কখনও অতিথিরা পাশ্চাত্য কায়দায় সেই ক্রমণী থেকে বেছে নিতে পারতেন পছন্দসই খাবারও।
 
তাঁর সেই বইতে তিনি শিখিয়েছিলেন, টাকা দিলেই যে ভালো রান্না পাওয়া যায় তা নয়, স্বাদু রান্না মরশুমি আনাজ এবং স্বল্প মশলাতেও বানানো যেতে পারে। ওঁর রান্নায় ব্যবহৃত শব্দ এবং ভাষা একদম গ্রামবাংলার নিজস্ব ভাষা, তাই পাঠকের সুবিধের জন্য শেষে জুড়ে দিয়েছিলেন তার পরিভাষাও…
বাংলার সেই প্রথম রান্নার বই থেকে তুলে আনলাম কিছু রান্না, একদম সাধারণ অথচ সুস্বাদু — ডাল, ঝোল, পোড়া, অম্বল ও পরমান্ন…. 
 
রইল —
 
১. ঝিঙ্গা পাতপোড়া
২. ছোলার ডালের দুধে মালাইকারি
৩. কই মাছের পাতখোলা
৪. গোলাপি জামের অম্বল
৫. মাংসের কালিয়া জগুরথ
৬. খইয়ের পরমান্ন
 
Jhinger paat pora
ঝিঙ্গের পাত পোড়া

ঝিঙ্গা পাত পোড়া

 
কচি ঝিঙে চারটে
সর্ষে বাটা ১০ গ্রাম
গোলমরিচ বাটা -৫ গ্রাম
খাবার সোডা – এক চিমটে
তেল – দুই বড় চামচ
নুন স্বাদ মতো
 
কচি ঝিঙে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে তাতে খুব মিহি করে বাটা সর্ষে, গোলমরিচ আর একটু খাবার সোডা মাখিয়ে কলাপাতা দিয়ে ভালো করে মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে। সেকালের নিভু নিভু উনুনের আঁচ যদি নাও থাকে, একটা তাওয়া গরম করে আঁচ কমিয়ে তার ওপর দিয়ে এপিঠ ওপিঠ ভালো করে সেঁকে নিতে হবে, যাতে ঝিঙে নরম হয়ে যায় আর কলাপাতাটা কুঁচকে একটু পোড়া পোড়া হয়ে যায়। তারপর ঝিঙে আর সমস্ত মশলা পাতা থেকে ছেঁচে নিয়ে নুন তেল দিয়ে মেখে গরম ভাতে খাও।
 
Cholar Daler dudhe malaikari
ছোলার ডালের দুধে মালাইকারি

 ছোলার ডালের দুধে মালাইকারি

 
ছোলার ডাল ২৫০ গ্রাম
জল ৭৫০ গ্রাম
তেজপাতা ৩ টে
আদা এক ইঞ্চি মতন
গোটা পেঁয়াজ খোসা ছাড়ানো ছোট ছোট ৫টা
ধনে বাটা ৫ গ্রাম
শুকনো লংকা বাটা ৩ টে
দই ১২৫ গ্রাম
মালাই ১২৫ গ্রাম
ছোট এলাচ ২টো
লবঙ্গ ৩ টে
দারচিনি এক ইঞ্চি
ঘি ৪ টেবিল চামচ
কাঁচা লংকা, নুন আর মিষ্টি স্বাদ মতো
 
ছোলার ডাল ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করতে হবে, যাতে দানাগুলো আস্ত গোটা গোটা থাকে। পাত্রে ঘি গরম করে, তাতে তেজপাতা আর গোটা গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে, একে একে বাটা মশলা, দই, মালাই দিয়ে কষতে হবে। মশলার উপর ঘি ভাসতে শুরু করলে ডাল দিতে হবে, আর তার সঙ্গে গোটা গোটা ছোট পেয়াঁজ। খুব ঢিমে আঁচে বেশ কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে। ডাল আর মশলা মিশে গেলে নামিয়ে নিন, গরমাগরম রেডি, সুস্বাদু ছোলার ডালের দুধে মালাইকারি!
 

 কই মাছের পাত খোলা

 
কই ৪ পিস
হলুদ 
রসুন ২ কোয়া
শুকনো লংকা – দুটো
বড় পেঁয়াজ দেড় খানা
আদা আধ ইঞ্চি
ভিনিগার ১ চামচ
তেঁতুল ৫০ গ্রাম
 
তেল ৫০ গ্রাম
নুন
কলাপাতা আর কাঠি
 
হলুদ, নুন, শুকনো লংকা, রাই সর্ষে, পেঁয়াজ , আদা খুব মিহি করে বেটে রাখতে হবে। মশলা শুকনো শুকনো রাখতে হবে।
একটু ভিনিগার কিংবা অল্প জলে তেঁতুল গুলে স্রেফ কাইটা নিতে হবে। তারপর বাঁশের এক দিক ছুঁচলো একটা কাঠিতে মাছগুলো পেট বরাবর গেঁথে (একটার মাথার দিকে পরেরটার লেজ থাকবে) সব মশলা আর তেঁতুল মাখিয়ে কলাপাতা দিয়ে মুড়ে দিতে হবে। ওদিকে একটা কড়াই বা প্যানে তেল গরম করে আঁচ কমিয়ে কলাপাতা মোড়া মাছটা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ১০-১২ মিনিট পর একটু পোড়া গন্ধ বেরোলে উল্টে দিতে হবে, এর পর থাকবে আরও পাঁচ সাত মিনিট। তারপর আবার খুব সাবধানে উল্টে মিনিট পাঁচ রেখে নামিয়ে ফেললেই রেডি। প্রায় কুড়ি মিনিট লাগবে সবটাতে, খুব নরম আঁচে হবে কিন্তু সবটা!
আমি স্বাদ মতো একটু চিনিও মিশিয়ে নিই মশলায়, রেসিপিতে না থাকলেও।
Golapi jamer ambal
গোলাপি জামের অম্বল

গোলাপি জামের অম্বল

 
ছোট রসগোল্লা ১০ টা
নতুন তেঁতুল দুই ছড়া
শুকনো লংকা ১ টা
হলুদ ১/২ চামচ
সর্ষে ১ ছোট চামচ ফোড়নের জন্য
 

প্রথমে হলুদ আর লংকা বেটে রাখতে হবে। একটু গরম জলে রসগোল্লাগুলো ডুবিয়েই তুলে রাখতে হবে পাশে। ওদিকে তেঁতুল জলে ভিজিয়ে কাই বের করে তাতে মশলা বাটাটা মিশিয়ে আঁচে বসাতে হবে। এই গোলাটা ফুটতে শুরু করলে রসগোল্লা দিয়ে খানিক ফুটিয়ে নিয়ে নামিয়ে রাখতে হবে। একদম শেষে ঘি গরম করে সর্ষে ফোড়নটা ওতে দিলেই অম্বল রেডি!

(আমি এই অম্বলে স্বাদ মত অল্প একটু চিনি মেশাই)
Mangser kaliya
মাংসের কালিয়া জগুরথ

মাংসের কালিয়া জগুরথ

 
মাংস ১ কিলো
ঘি ২০০ গ্রাম
দই ৩০০ গ্রাম
দুধ ২৫০ গ্রাম
বাদাম- খোসা ছাড়ানো ১২৫ গ্রাম (আধ কাপ মতন)
বড় পেঁয়াজ চার পাঁচটা 
আদা আর ধনে ১০-১২ গ্রাম করে বাটা
এলাচ, লবঙ্গ তিনটে করে ফোড়নের জন্য
 
বাটার জন্যে আরও ২টো এলাচ, লবঙ্গ আর
দারচিনি এক ইঞ্চি
গোলমরিচ ৫-৬ টা
 
একটা পাত্রে ঘি গরম করে তাতে গরম মশলা ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের গন্ধ বেরোলে মাংসগুলো দিয়ে চারপাশ লালচে করে ভেজে খানিকটা জল দিতে হবে (ওই তিন কাপ মতন) সেদ্ধ করার জন্য, সঙ্গে পেঁয়াজ কুচি এবং স্বাদ মতো নুনও। মিনিট পনেরো পর মাংস সেদ্ধ হলে, ঢাকা খুলে আদা আর ধনে বাটার রসটা কাপড়ে ছেঁকে নিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর জল শুকিয়ে এলে ক্রমাগত নেড়ে নিয়ে মাংস বেশ লাল লাল ভাজা ভাজা হলে, দুধে গুলে রাখা দই আর বাদাম বাটা মিশিয়ে দিতে হবে, সঙ্গে যাবে গরম মশলা আর গোলমরিচ বাটাটাও। ক্রমাগত নেড়ে নিয়ে, ঘন হয়ে এলে নামিয়ে ভাত বা রুটির সঙ্গে পরিবেশন করুন গরম গরম…
khoi-er paramanna
খইয়ের পরমান্ন

খইয়ের পরমান্ন

 
খই ২ মুঠো
জল এক কাপ
দুধ ১ লিটার
কিশমিশ ২ টেবিল চামচ
বাদাম ৩ বড় চামচ
ছানা/ পনির ১০০ গ্রাম
রাবড়ি ২ হাতা
গোলাপ জল ২ চামচ
 
দু মুঠো খই জলে ভিজিয়ে নরম হলে চটকে চেপে জল ঝরিয়ে রাখতে হবে। ওদিকে বাদাম ভিজিয়ে খোসা ছাড়িয়ে বেটে নিতে হবে, আর কিশমিশটাও ধুয়ে ভেজাতে হবে। তারপর দুধটা আঁচে দিয়ে, ফুটতে শুরু করলে ভেজানো খই দিয়ে মিনিট দশেক ফোটানোর পর, চিনি, কিশমিশ আর বাদাম বাটা দিয়ে নাড়তে হবে। দুধ ঘন হয়ে অর্ধেক হয়ে এলে, ছানা বা পনিরের ডুমো করে কেটে রাখা টুকরোগুলো মিশিয়ে তাঁর সঙ্গে রাবড়িটাও মিশিয়ে দিন, ব্যস পরমান্ন রেডি। ওহ, গোলাপ জলের গন্ধ তো দিতেই হবে, ভুললে হবে না।

দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে সের, ছটাক, তোলা, পোয়া, ‘দাগ দেওয়া’ এসব বদলে আজকের ভাষায় লিখলাম। নতুন বছরে হারিয়ে যেতে বসা পুরনো ঐতিহ্যেরই স্বাদ রইল নতুন মোড়কে।পয়লা বৈশাখ ভালো কাটুক সবার… শুভেচ্ছা!

 

 

ছবি সৌজন্য: লেখক

Shruti Gangopadhyay Author

শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *