জানালা (প্রথম পর্ব) 

কিন্তু সত্যিই গেল একদিন। প্রেমটা যেমন ঘটা না করেই হয়েছিল, ব্রেক আপটাও তেমনই ঘটা না করেই ঘটল। বার্কলেতে মাস্টার্স করার সুযোগ এসে গেল দময়ন্তীর।
– তুই অ্যাপ্লাই করছিস বলিসনি তো দামু। কণাদের গলায় অভিমান।
– আরে পাব ভেবেছিলাম নাকি।
– কী করবি এখন?
– আমার বার্কলে দেখার শখ ছোটবেলা থেকে। শুধু অ্যাকাডেমিক্‌সের জন্য নয়, কী জায়গা একবার ভাব! স্টুডেন্ট অ্যাকটিভিজ়মের ঘাঁটি, ফ্রিডম অফ্‌ স্পিচ নিয়ে ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন ইতিহাস হয়ে আছে। সে প্রতিবাদের ট্র্যাডিশান থেকে গেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় টানা দু’দিন ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা, ঘর থেকে টেনে বার করেছিল নির্বিরোধী অ্যামেরিকানদের। একটা ক্যাপিটালিস্ট দেশে এমন সচেতনতার জন্ম দিয়েছে যে প্রতিষ্ঠান, তার মাটিতে, হাওয়ায় নিশ্চয় জাদু আছে। আমি সেই জাদুটা চিনতে চাই।
– আর আমরা?
– কী আমরা? দু’ বছরের ব্যাপার। তুই চাকরি খুঁজছিস, শিগগিরি একটা পেয়ে যাবি। আমি তো ফিরে আসছিই।

না। ফিরে আসেনি দময়ন্তী। প্রথম প্রথম ঘন ঘন চিঠি আসত, কণাদ মুখিয়ে বসে থাকত বিদেশি স্ট্যাম্প লাগানো সেই চিঠির জন্য, তার উপরে লাল কালিতে লেখা থাকত– SWAK (sealed with a kiss)। অনেক গল্প থাকত সেই চিঠিতে। তার রুমমেটদের গল্প, টিচারদের গল্প, তার রাস্তায় নামার গল্প। টিয়ানআনমেন স্কোয়্যার সবে ঘটেছে তখন। নতুন কী কী রান্না শিখেছে, তার রেসিপি পাঠাত। বলত, তোকে অনেক দেশের খাবার রেঁধে খাওয়াতে চাই, তুই বড় কুয়োর ব্যাঙ। তোর মনটা একটু ওপেন হওয়া দরকার। 

তারপর চিঠি আসা কমতে লাগল, উঠে গেল শিলমোহর। দময়ন্তী থেকে গেল পিএইচডি করতে। ততদিনে বাবা মারা গেছেন, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। কণাদ বম্বেতে চলে গেছে চাকরির খাতিরে। তাদের ফিজ়িক্যাল দূরত্ব মনের দূরত্বও বাড়াতে থাকে, নিশ্চিতভাবে। সেই ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ-হীন জীবনে যোগাযোগের সূত্রগুলোও ছিল সীমিত। তারপর একদিন অবশ্যম্ভাবীভাবে এল একটা খাম। তাতে ছবি। দময়ন্তীর সঙ্গে এক যুবকের। ঠিক অ্যামেরিকান দেখতে নয়। ছবির পিছনে লেখা– Andre, TA from my political science class. সঙ্গে একটা চিরকুট। তাতে লেখা – আই লাভ হিম। 

বেশিরভাগ লোকই দেবদাস হয় না। কণাদও হয়নি। ছ’মাস পরে মাকে লিখল, তোমাদের যে পাত্রী পছন্দ তাকেই বিয়ে করব। আমার মেয়ে দেখার কোনও দরকার নেই। 

আরও পড়ুন: প্রচেত গুপ্তর ছোটগল্প: অমলা এসেছেন

– আমাজনে ডিজাইনার মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে। কিনব ভাবছি। বাসবদত্তা বলে।
– সত্যি পারিস তোরা। শ্মশানে যাবার খাটটাও আগে থেকে অর্ডার দিয়ে দিস। অর্ণব ফোড়ন কাটে।
– দ্যাখ, মাস্ক এখন পোশাক। শার্ট, সালোয়ার যদি পছন্দ করে কেনা যায়, মাস্ক নয় কেন?
– ঠিক বলেছিস। রিনি বলে। এখন কোভিডের সঙ্গে সহবাস লোকে খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছে, এই তো সেদিন বিজ্ঞাপন দেখলাম কোন এক ক্যাটারিং সার্ভিসের। আমাদের রান্নার স্বাদ পাওয়া থেকে কোভিডও আপনাকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
– দূর, আর ভাল লাগছে না, বেরিয়ে পড়ব এবার। কাঁহাতক এরকম বন্দি হয়ে থাকা যায়? আমি তো কাল মলে গিয়েছিলাম। অর্ণব বলে।
– তোর ফ্রাস্ট্রেশান বুঝছি। কিন্তু তাই বলে ইরেস্পন্সিবল হোস না। তোর বাবা এখনও বেঁচে। তাঁর কথাটা মাথায় রাখিস। 

বন্ধুদের মন্তব্যগুলো কণাদের গায়ে পড়ে ঠিকরে যাচ্ছিল। রাজু আজ বিগ বেনের ছবি লাগিয়েছে পিছনে। সেদিকে দেখেও দেখছিল না সে। সে দু’চোখ ভরে দেখছিল একটা জুম ঘরকে। বয়স আশ্চর্যভাবে দময়ন্তীকে ছুঁতে পারেনি। হ্যাঁ চোখে একটা চশমা লেগেছে, কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু রুপোলি রেখা একটা আভিজাত্য এনেছে চেহারায়। কিন্তু হাসিটা সেই তিরিশ বছর আগের, মুখ খুললে এখনও সেই ঝিলিক, যে ঝিলিকে বুঁদ হয়ে থাকত সহপাঠী থেকে শিক্ষক সবাই। অন্তত কণাদের তাই মনে হল। -কলকাতা কবে এলি? রাজ প্রশ্ন করে।
– লকডাউনের আগেই এসেছি, মায়ের শরীরটা খারাপ।
– আর হাব্বি?
– আন্দ্রে ওখানেই।
– এতদিন এসেছিস, যোগাযোগ করিসনি?
– কারও ফোন নাম্বার ছিল না। সত্যজিৎ অনেক খেটে আমার কন্ট্যাক্ট যোগাড় করেছিল।
– মাসিমা কেমন আছেন? তোকে বলছি। কণাদ প্রথমে বোঝেনি যে দময়ন্তী প্রশ্নটা তাকেই করেছে।
– মা চলে গেছেন বছর পাঁচেক। তোরা কি একই বাড়িতে আছিস?
– না। মা ওই বাড়ি বিক্রি করে সল্টলেকে একটা ছোট ফ্ল্যাটে উঠে গেছেন বাবা মারা যাবার পর। আমি এলে এখন ওখানেই উঠি। 

 

আরও পড়ুন: ঋভু চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: কিস্তি

দময়ন্তী বেশীক্ষণ ছিল না কলে। মাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে বলে ড্রপ করল। পরদিন তিন্নিকে ফোন করে কণাদ। আমাকে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড বানিয়ে দিবি?
– বাঃ কণাদ, তুই তো বেশ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছিস এখন টেকনোলজিতে! ব্যাকগ্রাউন্ড করেছিস! কিন্তু হাওড়া ব্রিজ কেন? রিনি কলকল করে।
– রাজ আমাদের সবসময় বিদেশে নিয়ে যায়, আমি ভাবলাম একটু নিজের শহরে থাকি। সেটাও কম সুন্দর নাকি?
– খুব সত্যি কথা, ভাল করেছিস। আমরা হাওড়া ব্রিজ দেখতে দেখতে বেড়াতে যাবার কথা ভাবি। আর একজন বলে ওঠে। 

বন্ধুদের মন্তব্যগুলো কণাদের গায়ে পড়ে ঠিকরে যাচ্ছিল। রাজু আজ বিগ বেনের ছবি লাগিয়েছে পিছনে। সেদিকে দেখেও দেখছিল না সে। সে দু’চোখ ভরে দেখছিল একটা জুম ঘরকে। বয়স আশ্চর্যভাবে দময়ন্তীকে ছুঁতে পারেনি। 

বন্ধুরা মেতে যায় গসিপে, আড্ডায়, গল্পে। কেউ জানতেও পারে না, এই ব্যাকগ্রাউন্ড শুধু একজনের জন্য। শুধু আর একজনই জানে সেদিন দু’ঘণ্টা গঙ্গার বুকে নৌকো থেকে হাওড়া ব্রিজের পেছনে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কত কবিতা শুনিয়েছিল সে দময়ন্তীকে। আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছিল সেদিন। নদীর ঘাটে নেমেছিল যখন, তখন দু’জনেই ভিজে কাক। পরের সপ্তাহে ব্যাকগ্রাউন্ডে কেঁদুলি। দময়ন্তীর মনে আছে নিশ্চয় বাউলদের কাছ থেকে ধার করা গাঁজা নিয়ে মাঠের মধ্যে শুয়ে এক আকাশ তারাকে সাক্ষী রেখে দময়ন্তীকে প্রোপোজ করেছিল কণাদ।
– তোকে কে বিয়ে করবে? ডরপোক কাঁহিকা। নেশা জড়ানো গলায় বলেছিল দময়ন্তী। তারপর কী মনে হতে গড়িয়ে কণাদের বুকের উপর চলে এল।
– দুঃখু হল বাবুর? পাগল। সময় কি পালিয়ে যাচ্ছে বিয়ে করার? তারপর চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়েছিল কণাদকে। কণাদের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়।

এটা একটা খেলা হয়ে গেল। প্রতি সপ্তাহে ব্যাকগ্রাউন্ড পালটে যেতে লাগল। তিন্নি ধরে নিল এটা বাবার একটা খেয়াল। বকখালি, শান্তিনিকেতন, সিমলিপাল, গ্যাংটক, পুরী। সবজায়গায় ওরা একা ছিল না, কিছু ছিল বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়া। কিন্তু সব জায়গার সমুদ্র, জঙ্গল, গাছপালার কাছে তারা দু’জন ফেলে এসেছে অনেক ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত, অনেক কথা, অনেক কবিতা। 

দময়ন্তী এই ব্যাকগ্রাউন্ডগুলো নিয়ে কখনও কোনও মন্তব্য করেনি। হয়তো বোঝেনি ইঙ্গিতটা। একটু হতাশ হয় কণাদ। কী আশা করেছিল সে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে এক রাতে, হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল।
– ঘুমিয়ে পড়েছিস?
– না।
– কেমন আছিস? বৌ কি করে? ছেলে মেয়ে?
– হঠাৎ, জানতে চাইছিস এতদিন পরে?
– আমরা তো একে অপরের থেকে অনেক দূরে চলে গেছিলাম। এখন আবার কলকাতায় ফিরেছি। তোর সঙ্গে এক জীবন পরে দেখা হল, তাই জানতে চাইছি। কেন, পারি না?
– দূরে যাওয়াটা তোর ইচ্ছেয়। আর তুই তো পরিযায়ী পাখি, আবার দুদিন পরে ফিরে যাবি।
– সেটা খুব নিশ্চিত নয়।
– মানে? এই প্রথম কণাদ চমকায়। কী বলছে দময়ন্তী?
– আন্দ্রে আর আমার সেপারেশান হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। আমি এখন কলকাতাতেই আছি। 

আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছিল সেদিন। নদীর ঘাটে নেমেছিল যখন, তখন দু’জনেই ভিজে কাক। পরের সপ্তাহে ব্যাকগ্রাউন্ডে কেঁদুলি। দময়ন্তীর মনে আছে নিশ্চয় বাউলদের কাছ থেকে ধার করা গাঁজা নিয়ে মাঠের মধ্যে শুয়ে এক আকাশ তারাকে সাক্ষী রেখে দময়ন্তীকে প্রোপোজ করেছিল কণাদ।

ধাক্কাটা সামলাতে কণাদের কয়েক সেকেন্ড লাগে।
– কী বলছিস কী? কী করে হল?
– আজ এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আজ তোর কথা শুনি? 

দময়ন্তীর গলায় কিছু একটা ছিল। নিমেষে ভেসে গেল কণাদের যুগান্ত জুড়ে জমিয়ে রাখা অভিমান। হোয়াটস্যাপের আড়াল থেকে অনেক দিনের পুরনো দুই বন্ধু উজাড় করে দিল নিজেদের মন। কণাদ বলল পরমার কথা, তিন্নির কথা, তার গত তিরিশ বছরের কথা। দময়ন্তী শুনল আর বলল তার ছেলে মেয়ের কথা। তোলা রইল তার অ্যামেরিকাবাসের ইতিহাস। তোলা রইল তার চৌকাঠ পেরবার গল্প।

– রাজ ইজ় কোভিড পজিটিভ। 

গ্রুপে পোস্ট করা সত্যজিতের চার শব্দের মেসেজটা সবাইকে এক ধাক্কায় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দ্যায়। রাজ বন্যা-কবলিত সুন্দরবনের বাসিন্দাদের জন্য রিলিফ নিয়ে গিয়েছিল। একটা এনজিও-র সঙ্গে ও অনেকদিন যুক্ত, তাদের হয়েই গিয়েছিল। রিলিফের কাজ হল, কিন্তু নিজে ফিরল অসুখ নিয়ে। বন্ধুরা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। রাজ বিয়ে থা করেনি, একা থাকে। তাকে কী করে খাবার পৌঁছে দেওয়া যায়, টেস্ট করার জন্য নিয়ে যাওয়া যায়, তার জল্পনা কল্পনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্ধুরা। মধ্যবয়স পার হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ একটা পারপাস পেয়ে গেল একসঙ্গে কাজ করার। অনেকদিন পর। 

– আচ্ছা, রাজের কিছু হবে না তো? ওর সিভিয়ার অ্যাজ়মা আছে, ইনহেলার নিয়ে ঘোরে। কণাদ তার ভয়টা ব্যক্ত করে দময়ন্তীর কাছে।
– না না চিন্তার কোনও কারণ নেই। রাজ আমাদের থেকে অনেক বেশি যত্ন নেয় শরীরের। দময়ন্তী আশ্বস্ত করে কণাদকে। একটু পরে লেখে।
– আন্দ্রের ইওসিনোফেলিক অ্যাজ়মা আছে। ওর বাবার থেকে পাওয়া।
– তুই আন্দ্রের থেকে আলাদা হয়ে গেলি কেন? কণাদ প্রশ্ন করে।
– যেটা আমাদের জড়িয়ে দিয়েছিল, সেই লতাটা আলগা হয়ে গেল। যে আমাদের উত্তাপ দিত, সেই আগুনটা নিভে গেল। এখন শুধু পোড়াকাঠে চিহ্ন লেগে আছে। অফ্কোর্স ছেলেমেয়েরা আছে, যারা আমাদের এক সময়ের ভালবাসার প্রমাণ। 

আজ ছিল দময়ন্তীর বলার পালা। বলল তার সেই জীবনের গল্প যেটা কণাদের অজানা। বলল তাদের ভালবাসার গল্প, ছেলেমেয়ের গল্প, অ্যাকটিভিজ়মের গল্প।

 

আরও পড়ুন: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ছোটগল্প: পাঠজন্ম

– আন্দ্রে খুব ভাল প্রফেসর। ওর পড়ানো, ব্যাক্তিত্ব, ওর পারসোনালিটি ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে ঘুরত। তারা খুব সহজেই ওর ফ্যান, ওকে আইডলাইজ় করত অল্প আলাপেই। কোন মানুষের এতে ইগো বুস্ট না হয়? কাজ নিয়ে সাঙ্ঘাতিক জড়িয়ে পড়ল। আমি একা একা ছেলেমেয়েদের বড় করতে লাগলাম নিজের প্রফেশনাল জীবনটার সঙ্গে ব্যালেন্স করতে করতে। কানাঘুষোয় কিছু কথা কানে আসছিল। প্রথম প্রথম পাত্তা দিইনি। আমূল বিশ্বাস করতাম আন্দ্রেকে। তাই পোস্ট ডকের সঙ্গে তার অ্যাফেয়ারের প্রাথমিক চিহ্নগুলোকে অস্বীকার করতে চেয়েছি। পেরেওছি, যতদিন না অমোঘ সত্যের মত ইমেল, চ্যাটের টেক্সট আমার হাতে এসে পড়ল।
– তারপর? কণাদ রুদ্ধশ্বাসে টেক্সট পড়ছিল।
– তারপর যেমন সিনেমায় দেখিস, গল্পে পড়িস, তেমন। প্রথমে অস্বীকার করল, তারপর প্রমাণগুলো দেখাতে ক্ষমা চাইল, বলল ওটা একটা ফ্লিং। ছেড়ে দেবে মেয়েটিকে, আমি যেন ওর কাজের জায়গায় কিছু না বলি। আবার বিশ্বাস করলাম, আবার ঠকলাম। আমাদের কথা হবার এক বছর পরেও মেয়েটার সঙ্গে ওর সম্পর্ক একই জায়গায় রয়ে গেল। আমাদের সম্পর্ক তেতো হতে লাগল, ছেলেমেয়েরা আমাদের যুদ্ধের ক্রসফায়ারে ঝাঁজরা হতে লাগল। আমি সব সইতে পারি, কিন্তু ছেলেমেয়েদের মনে ক্ষত তৈরি করতে পারব না। যেই ওরা কলেজে ঢুকে গেল, বেরিয়ে এলাম।
– ছেলেমেয়েরা? তারা মেনে নিয়েছে?
– তাদের নিজেদের জীবন তৈরি হচ্ছে। তারা বোঝে। আমি মাঝে গেছি, একটা বাড়ি রেন্ট করে থেকেছি।  গত এক বছরই পারিনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে দময়ন্তী। তারপর লেখে, একটা তোর লেখা কবিতা পাঠা। একটা স্মাইলি ইমোজি পাঠায় কণাদ।

– আমি কবিতা লিখি না আর। 
– হোয়াট?? কেন?
– জানি না, সুর হারিয়ে গেল, কলমের কালি শুকিয়ে গেল, কথাদের আসা বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ হয়নি, ধীরে ধীরে হল।
– আমি তোকে দুঃখ দিলাম বলে?
– শঙ্খ ঘোষের সঙ্গীনি পড়িসনি? 

তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়
তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়। 

কী কারণ, তা কি ওরকম নিশ্চিতভাবে বলা যায়? 

– হুম্‌ম্‌
– একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
– কী?
– তুই আমাকে ছেড়ে গেলি কেন? 

রাজ বন্যা-কবলিত সুন্দরবনের বাসিন্দাদের জন্য রিলিফ নিয়ে গিয়েছিল। একটা এনজিও-র সঙ্গে ও অনেকদিন যুক্ত, তাদের হয়েই গিয়েছিল। রিলিফের কাজ হল, কিন্তু নিজে ফিরল অসুখ নিয়ে। বন্ধুরা কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। রাজ বিয়ে থা করেনি, একা থাকে। তাকে কী করে খাবার পৌঁছে দেওয়া যায়, টেস্ট করার জন্য নিয়ে যাওয়া যায়, তার জল্পনা কল্পনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্ধুরা। 

দময়ন্তী অনেকক্ষণ ধরে লেখে, লেখে আর কাটে, কাটে আর লেখে। কণাদ অপেক্ষা করে। তারপর চারটে শব্দ ফুটে ওঠে স্ক্রীনে।
– তোকে মুক্তি দেবার জন্য। 

রাজ বেঁচে গেল, ভোগান্তি হল অনেক যদিও। একদিন রাজের সেরে ওঠা সেলিব্রেট করল সবাই জুমের আড্ডায়। বাসবদত্তা গান গাইল, গিটার বাজাল অর্ণব, কণাদ কবিতা পড়ল। যে যা পারল, কোক, ওয়াইন, হুইস্কি ভরা গেলাসে তুলে বলল – উল্লাস। কিছু প্রায়-প্রৌঢ় মানুষ একটা যুদ্ধজয়ের পার্টি করল।  

কিন্তু একটা পরিবর্তন আসতে লাগল। যে আগ্রহ, উত্তেজনা ছিল নতুন করে তিরিশ বছর আগের যৌবনটাকে ছোঁবার, সেটা আস্তে আস্তে কমতে লাগল। কেউ তো আর সে অতীতে থেমে নেই। লোকে এক বছর ধরে সাবধান হতে হতে সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করে গেছে। সবাই খেয়াল করল ভারতবর্ষের অবস্থা নিয়ে লোকে ঠিক যতটা ভয় পেয়েছিল, ততটা খারাপ কিছু হয়নি। ধীরে ধীরে সবাই রাস্তায় নামল আবার। এ সবের মধ্যে হর হর মহাদেও শব্দে দামামা বাজিয়ে এসে গেল ভ্যাক্সিন।

– আমি কালকে প্রথম শট্‌ পাচ্ছি। রিনির গলায় খুশি।
– আমি নেক্সট উইক। আবার কাজ, আবার সিনেমা, মল, শপিং। সত্যজিতের কথাতেও একই স্বস্তির ছোঁয়াচ। 
– আবার লোকের সঙ্গে দেখা। জুমের সামনে বসে বসে মাথা ধরে যায়। বাসবদত্তা পারলে এখনই বেরয়।
– মাস্ক আর ছ ফুট দুরত্বটা থাকে যেন। রাজ মনে করিয়ে দ্যায়। সে সবে কোভিড থেকে উঠেছে। তাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
– এই মিটিংটা আমরা আর করব না? কণাদ ধীরে ধীরে বলে।
– না না তা কেন। এটা চলুক যেমন চলছে, যে যেমন পারে আসবে। 

সত্যজিৎ মুখে যাই বলুক, জুমের জনসমাগম দ্রুত ক্ষীণ হতে থাকে। দময়ন্তীও সেদিন মুখ খোলার পর বিশেষ চ্যাটে আসে না আজকাল। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় একদিন পর। ও কি লজ্জা পায়? এক রাত্রে কণাদ লেখে, 

তুই যদি আমার সাথে পথ হাঁটিস
তাহলে আমি পৃথিবীর শেষ সীমানা পর্যন্ত যাব
তুই যদি আমার আজ থেকে কাল হতে পারিস
তবে পরশুও আমি তোর ঘুম ভাঙাব
তুই যদি আমাকে বাঁচাতে পারিস
তবে আমি তোর হাতেই মরব
তোর জন্যে দরজা খুলে রেখেছি
আগুন পেরিয়ে তুই আসবি বলে। 

চ্যাট রুমে কোনও আলো জ্বলে নি। 

যে আগ্রহ, উত্তেজনা ছিল নতুন করে তিরিশ বছর আগের যৌবনটাকে ছোঁবার, সেটা আস্তে আস্তে কমতে লাগল। কেউ তো আর সে অতীতে থেমে নেই। লোকে এক বছর ধরে সাবধান হতে হতে সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করে গেছে। সবাই খেয়াল করল ভারতবর্ষের অবস্থা নিয়ে লোকে ঠিক যতটা ভয় পেয়েছিল, ততটা খারাপ কিছু হয়নি। 

এক শনিবার কণাদ জুম রুমে ঢুকে দেখে কেউ আসেনি। একজনও নেই। এই প্রথম। পনেরো মিনিট স্ক্রিনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরতে যাবে, ঠিক সেই সময় টুং করে একটা আওয়াজ হয়। দময়ন্তী ঢোকে রুমে।
– জানতাম তুই একাই থাকবি, তাই এলাম।
কণাদ দময়ন্তীর মুখের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা বলতে চায় সে।
– আমি অ্যামেরিকাতে ফিরে যাওয়া ডিসাইড করেছি। গত একবছরে আমার চিন্তাকে পুরোপুরি নড়িয়ে দিয়ে গেছে এই ভাইরাস। একটাই জীবন, সেটা মারাত্মক অনিশ্চিত। আমাদের সবারই। যে সময়টুকু বাকি আছে আমি ছেলেমেয়েদের ছেড়ে থাকতে চাই না।
– আর আন্দ্রে? কণাদের গলাটা শুকিয়ে আসছে।
– সবারই জীবনে একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া উচিত। আর একবার চেষ্টা করতে চাই। আর আন্দ্রের সঙ্গে থাকতে না পারলেও নিজের হাতে যে জীবনটা তিরিশ বছর ধরে তৈরি করেছি, সেটা থেকে আমি পালিয়ে আসব কেন?
– তাহলে… কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় কণাদ।
– কী তাহলে?
– নাহ, কিছু না। ভাল থাকিস, সাবধানে থাকিস, বেস্ট অফ্‌ লাক। 

দময়ন্তীকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে আসে জুম থেকে। তারপর দময়ন্তীর নম্বরটা ব্লক করে হোয়াটস্যাপ থেকে। চুপ করে বসে থাকে, অসহ্য গরম লাগছে, মাথাটা ঘুরছে। একটা অবসাদ ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে।
– পারু, পারু। ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকে পরমাকে, একটু চেঁচিয়েই।
তার ডাকে কী একটা ছিল, পরমা তার কাজ ফেলে দৌঁড়ে আসে।
– কী হয়েছে কণাদ? এ কি তোমার চেহারাটা এরকম লাগছে কেন? শরীর ঠিক আছে?
– আমার খুব ভয় করছে পারু। পরমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে কণাদ।
– কী হয়েছে? পরমার গলায় আতঙ্ক।
– সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, সবাই চলে যাচ্ছে। তুমি প্লিজ কোথাও যেও না। কণাদের গলায় শিশুর আর্তি। 

আমি অ্যামেরিকাতে ফিরে যাওয়া ডিসাইড করেছি। গত একবছরে আমার চিন্তাকে পুরোপুরি নড়িয়ে দিয়ে গেছে এই ভাইরাস। একটাই জীবন, সেটা মারাত্মক অনিশ্চিত। আমাদের সবারই। যে সময়টুকু বাকি আছে আমি ছেলেমেয়েদের ছেড়ে থাকতে চাই না।

পরমা আচমকা ব্লাউজের বোতামগুলো খুলে ফেলে। তারপর কণাদের মুখটা তার দুই অনাবৃত বুকের মাঝে গুঁজে দ্যায়। কণাদের চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে তার বুক, পেট, নাভি। সে কণাদের মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে, দূর পাগল, আমি কোথায় যাব? একটু পরে শান্ত হয় কণাদ। পরমাকে বলে, আমি শোব পারু। আমাকে নিয়ে চল। 

পরমা আস্তে আস্তে হুইল চেয়ারটা ঠেলে শোবার ঘরের দিকে নিয়ে যায়। তিন বছর আগে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের পর এই হুইল চেয়ারটাই তার পৃথিবী। লকডাউনের জন্য সবসময় ভাইরাস দরকার হয় না। পরমা তাকে যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দেবার পর বলে, আমি আজ এ ঘরে শোব।
– ঠিক আছে, তোমার কাজ সেরে এস। আর শোবার আগে ঘরের জানলাটা বন্ধ করে দিও। আজ রাতে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা। ঘরের মধ্যে জল চলে আসতে পারে। 

ডঃ আনন্দ সেনের জন্ম কলকাতায়। হিন্দু স্কুল ও পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে স্নাতকস্তরের পড়া শেষ করেই পাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই বাসা। পেশায় ডেটা সায়েন্টিস্ট হলেও কবিতা লেখা আজও প্যাশন। আরও এক প্যাশন বাংলা থিয়েটার। প্রবাসে থেকেও নিয়মিত থিয়েটারের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ। নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন ই-পত্রপত্রিকাতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *