আমার এক বন্ধু দীপক রায় এঙ্গেলসের ‘অ্যান্টি টুরিং’-এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। তখন মাঝে মাঝেই এক একটা বিদেশি শব্দ ছুঁড়ে দিয়ে বলত, বাংলাটা কী হলে ভালো হয়? তখনই হাড়ে হাড়ে টার পেয়েছিলাম পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দের প্রতিশব্দ বানানো কত কঠিন। পরীরা যতই নরমসরম হোক পরিভাষা তৈরির করা এক মানসিক ব্যায়াম। উলটোপালটা ব্যায়ামে হাড়গোড় ভাঙ্গে তাই পরিভাষা তৈরির বৈজ্ঞানিক নীতিটাও জানতে হয়। ঐ সময়েই একদিন দেখা গেল self-identical শব্দটা নিয়ে বন্ধুবর খুব ভাবিত। কী হবে বাংলা প্রতিশব্দ? দু-মাথা এক হতেই পছন্দসই শব্দটা বেরিয়ে এল – ‘স্বয়ংসম’।
সম্প্রতি বিতান ভৌমিক উত্তরাধুনিকতা নিয়ে নিয়ে পর্বান্তরে প্রতি সংখ্যায় লিখে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ফোনাঘাতে জর্জরিত হয়ে বুঝেছি সেও পরিভাষা প্রতিশব্দের সমস্যায় বিব্রত। বিষয়টা জানা নেই বলে কোনও উপকারে লাগতে পারিনি, তবে পাঠক হিসেবে আমার কী সমস্যা হচ্ছে সেটা বুঝেছি। সুকুমার রায়ের হ য ব র ল- এর ব্যকরণ সিং বলেছিল গানের ভেতরে শিশিবোতল ছাড়া আর কিছুই তার শক্ত লাগেনি। বিতানের লেখায় শিশিবোতলের ছড়াছড়ি। সেগুলো ঐ পারিভাষিক শব্দ। ঐ সময় আমি আবার কয়েকটা ব্যকরণ বই লিখছিলাম। পাঠকরা আমাকে ছাগল ভাবুন, ক্ষতি নেই। আমারও কিন্তু পারিভাষিক শিশিবোতলগুলো শক্ত লেগেছিল।
বাংলায় লাখা উত্তরাধুনিকতার অন্য বইপত্রে একই ধারণার জন্য অনেকসময় অন্য পারিভাষিক শব্দ দেখা গেছে। পরিভাষার এই অসমতা ভুলভুলাইয়া আরও প্যাঁচালো হয়েছে। ধাক্কা খেয়ে তিনটে জিনিস বুঝেছি, পরিভাষা বানাতে হয়, অনেকসময় পরিভাষা কঠিন লাগে, এক ধারণার একাধিক প্রতিশব্দ সমস্যার জটিলতা বাড়ায়। পরিভাষা নিয়ে সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম, এ-সব সমস্যাই অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। এ ব্যাপারে দুচের কথা লেখা যাক।
পরিভাষা কী, কেন
স্কুলে আমরা অনেক সমার্থক শব্দ পড়ি। আকাশ, গগন, নভ / জল, পানি, উদক। ভয়, ভীতি, আতঙ্ক – এমনধারা অনেক কিছু। পঞ্জিকায় যে বস্তু সম্বন্ধে লেখা হয় – কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিযেধ, কলকাতায় তাকেই আমরা বলি কুমড়ো। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় বলা হয় ‘ডিংলা’। শেকসপিয়ার ইংলণ্ডে না জন্মে বাংলায় জন্মালে লিখতেন নামে কী আসে যায়”, কুমড়োকে যে নামে ডাকো না কেন গড়াগড়ি সে খাবেই…”। কিন্তু সবক্ষেত্রে এমনটা চলেনা। প্রতিদিনের চারপাশের জগত বর্ণনা ছেড়ে আমরা যখন নির্দিষ্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রবেশ করি, তখন সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ, সংজ্ঞার্থ সুনির্দিষ্টভাবে জানা বোঝার দরকার হয়। পদার্থবিদ্যায় ‘ভর’ যদি ‘ভার’ হয়, তাহলে শুধু আকারেই বদলে যায় না প্রকারেও বদলে যায়। ভর-কে ভরই বলতে হবে। জীববিদ্যায় ‘কলা’ বললে বানরদের প্রিয় ফলটিকে বোঝায় না, একই ধরণের কোশসমষ্টি বোঝায়। একে ‘কলা’ই বলতে হবে। কদলী বললে ডাহা ফেল। ক্যাটারিং প্রযুক্তিতে ‘মেনু’ বলতে খাদ্যতালিকাই বোঝায় অন্য কিছু নয়। আবার কম্পিউটার প্রযুক্তির কাঠামোয় ‘মেনু’ অন্য অর্থ ধরে, এবং সেই একটি অর্থই ধরে।
এগুলো পরিভাষা। জ্ঞানের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিভাষা যুক্ত। জ্ঞানক্ষেত্রের কোনো বিষয় বা ধারণাকে পরিভাষা ছাড়া প্রকাশ করা যায় না। পরিভাষার একটিই অর্থ। পারিভাষিক শব্দের কোন ব্যঞ্জনা নেই। “না বলা বাণী রয়েছে যেন অধর পরে আঁকা” – প্রিয়ার ক্ষেত্রে এটা সম্ভব, কিন্তু পরিভাষার বাণী স্পষ্ট, নির্দিষ্ট, একমুখী। কোনো শব্দ জ্ঞানের ক্ষেত্রে পারিভাষিক, কিন্তু সেই ক্ষেত্রের বাইরে গিয়ে ব্যঞ্জনার কোন স্থান নেই। চোখে বিদ্যুৎ খেলে যেতে পারে, পদার্থবিদ্যায় সে-বিদ্যুৎ নেহাৎ অপদার্থ। রাজশেখর বসুর মন্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে –
“ভাষা একটি নমনীয় পদার্থ, তাকে টেনে বাঁকিয়ে চটকে আমরা নানা প্রয়োজনে লাগাই। কিন্তু এরকম জিনিসে কোন পাকা কাজ হয় না, মাঝে মাঝে শক্ত খুঁটির দরকার, তাই পরিভাষার উদ্ভব হয়েছে। পরিভাষা সুদৃঢ়, সুনির্দিষ্ট শব্দ। তার অর্থের সংকোচন নেই, প্রসারণ নেই। আলংকারিকদের কথায় বলা যেতে পারে, পরিভাষার অভিধাশক্তি আছে; কিন্তু ব্যঞ্জনা আর লক্ষণার বালাই নেই। পরিভাষা মিশিয়ে ভাষাকে সংহত করতে না পারলে বিজ্ঞানী তার বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেন না।”…
পরিভাষা প্রচলন ও সমতাবিধান
বাংলায় নিছক অস্তিত্বশীল অর্থে পরিভাষার অভাব নেই। বাংলা পরিভাষার নিন্দুকেরও অভাব নেই। অভাব দুটি জিনিসের: বাংলায় বিদ্যাচর্চার সদিচ্ছার আবং পরিভাষা সমতার বা প্রমিতকরণের। প্রথম অভাবটা ক্ষমতা ও অর্থনীতি থেকে জাত ভাষামনস্ত্বের বিষয়। দ্বিতীয়টা ভাষার অবয়ব পরিকল্পনার অঙ্গীভূত।
পরিভাষার সমতাবিধানের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যাসাগর গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করেছিলেন। শিক্ষাবিভাগের ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা এইচ উড্রো-কে এক চিঠিতে তিনি লেখেন – “মিঃ প্র্যাটের সঙ্গে আমি একমত, মাতৃভাষার সবকটা পুস্তকে একই পরিভাষা ব্যবহার অবশ্য কর্তব্য। শিক্ষাবিভাগের হস্তক্ষেপ ছাড়া এরকম ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা অসম্ভব। শিক্ষাবিভাগের দ্বারা পরিভাষার একটি পুর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন সব কটি বিদ্যালয়ে সেই পরিভাষা অনুযায়ী রচিত পাঠ্যপুস্তকই কেবল পাঠ্য হবে এই নির্দেশ দেওয়া দরকার।” পরিশেষে বিদ্যাসাগর পুর্ণাঙ্গ পরিভাষার তালিকা নির্মাণের দায়িত্ব সানন্দে নিতে চান। ১৮৫৭ সানে এই চিঠিটা লেখা হয়েছে। দাড়শ বছর পরেও কিন্তু বাঙালি শিক্ষিত সমাজের উদাসীনতায় সে কাজ হয়নি। বাংলা পরিভাষা সম্বন্ধে হাস্যকর গালগল্পে বাতাস এখন আরও ভারী।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে মাতৃভাষা লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একই শিরোনামের এই নিবন্ধের অংশবিশেষ পুনঃপ্রকাশিত হল।