বাংলাভাষায় যদিও জাত আর পাত একই সঙ্গে উচ্চারণ করা হয়, আসলে জাতের চেয়েও জাতির সঙ্গে পাতের সম্পর্ক বেশি নিবিড়। এই যেমন বাঙালি জাতির দোলে ফাগের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা মার্কামারা খাবারের তালিকা। এর সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ভোজের মতই এর প্রস্তুতিপর্বও শুরু হয় আগের রাত থেকেই – পাড়ার দশকর্ম ভান্ডার থেকে সিদ্ধি পাতা কিনে নিয়ে আসা দিয়ে।

সিদ্ধিপাতা কিনে নিয়ে এসে, জলে ভিজিয়ে রেখে দিয়ে স্রেফ ভুলে যেতে হবে। বারবার ঢাকা খুলে দেখে কোনওরকমের সিদ্ধিলাভের আশা বৃথা। অন্তত ঘন্টা আটেক জলে না ভিজলে, কিচ্ছুটি হবার জো নেই। তাছাড়া পাতা ভিজিয়ে রেখেই আবার বেরিয়েও পড়তে হবে, বাকি মালমশলা সংগ্রহ করতে। কাজু, কিসমিস, খেজুর, পেস্তা, পোস্ত, মাখা সন্দেশ, কাঁচা বাদাম, গোলাপজল, চিনি কিনে ফেলতে হবে। দুধের দোকানে আগেভাগে পরের দিনের ফরমায়েশটা করে আসতে হবে যাতে ওপাড়ার বাঁড়ুজ্জে বা পালেরা সবটা সাবড়ে দিতে না পারে। বাড়ি ফিরে আবার কাঁচা বাদামগুলো ভিজিয়ে দিতে হবে।

ওদিকে দোলের দিন ভোর না হতেই বাজারের আমিষ থলেটা নিয়ে খাসির দোকানের লাইনে দাঁড়াতে হবে। তারপর সামনের পা, না সিনা, পেছনের পা নাকি গর্দান, মেটে বেশি না চর্বি কম, এইসব সুক্ষ্ম হিসেব মুন্না কিংবা হাদিসকে বুঝিয়ে নিজের কাজটুকু হাসিল করতে হবে। বাড়ি ফিরে আসল কাজ। মিশন সিদ্ধিলাভ। সারারাত জলে ভিজে নেতিয়ে পড়া পাতাগুলো ওই জল থেকে ছেঁকে তুলে প্রথমে বাটতে হবে। জলটা আলাদা করে তুলে রাখা থাকবে। ওটা পরে কাজে লাগবে। তারপর একে একে কাজু, কিসমিস, ভেজা খোসা ছাড়ানো বাদাম, খেজুর, পেস্তা, পোস্ত সব বাটা হবে। এর মধ্যে পোস্তটা কাজু আর কাঁচা বাদামের সঙ্গে বাটা চলবে কিন্তু বাকি উপাদান সব ঘোরতর স্বাধীনচেতা, তাদের আগে না ঘাঁটানোই ভালো। পরে ঘাঁটাতেই হবে। এবার একটা বড় ডেকচিতে বাটনা, মাখা সন্দেশ, চিনি ঢেলে, তাতে দুধ মিশিয়ে ডাল কাঁটা দিয়ে খুবসে মেশাতে হবে। চিনি গুলে গেলে সিদ্ধিভেজা জলটা দিয়ে আর এক প্রস্থ ঘাঁটানো চলবে। শেষকালে কয়েক ফোঁটা গোলাপজল। এরপরই আসল পরীক্ষা। খেতে যতই ভালো লাগুক, বেশি চাখা চলবে না। নইলে ওই চাখতে চাখতেই কখন যে আকাশে বাতাসে ভেসে, হুশ করে দোলের দিনটা কাটিয়ে একেবারে পরের দিনে চোখ খুলবেন, তার তল পাবেন না। তার চেয়ে বরং সমঝে চলাই ভালো, কারণ দুপুরে আবার খাসি। আর সিদ্ধি আর খাসির মাঝে বড়দের পায়ে আবির দিয়ে ফুটকড়াই, মঠ, মুড়কির যে ইন্টারিম কোর্স চলবে, তাও নেহাত ফেলনা নয়। তবে এত মিষ্টি খেয়ে মুখ মেরে এলে মুড়কিতে একটু ঝাল চানাচুরও মিশিয়ে নেওয়া চলে।

দোলের খাসির তো আর রেসিপি হয় না, পাড়া মাতানো গন্ধই তার স্বাদের সূচক। আবিরে রঙে বেলুনে সিদ্ধির মৌতাতে যখন দিনটা গোলাপি ঠেকতে শুরু করেছে তখনই, ঠিক তখনই এবাড়ির জানলা ওবাড়ির ঘুলঘুলি সেবাড়ির উঠোন পেরিয়ে নাকে এসে লাগবে সেই স্বর্গীয় ঝোলের বেদর্দ গন্ধ যা নাকে এলেই ছোটবেলা বড়বেলা স্মৃতি বিস্মৃতি সব একাকার হয়ে যায়। সে ঝোল আদা জিরের হোক কিংবা ধনে জিরের। পেঁয়াজ রসুন টমাটোর হোক কিংবা শুকনো লঙ্কা আর মৌরি বাটার। দোলের খাসির ঝোল হচ্ছে দেবানন্দের গলার রুমাল – আদি ও অকৃত্রিম।

দোলের কঠোর পরিশ্রমের পর শরীর মন বেয়ে যে ঘুমের বান ডাকবে, সেই ঘুমকে নির্লজ্জ তোল্লাই দিতে, পুরো রং না ওঠা আঙুলে প্রথম পাতের নিম বেগুনটা এক ঝটকায় সাবড়ে দিয়েই ভাত ভেঙে ধোঁয়া ওঠা খাসির ঝোল ঢেলেই একে একে মাংসের টুকরোগুলো লাইন দিয়ে থালার এক দিকে সাজিয়ে রাখতে হবে। তারপর তর্জনি মধ্যমা আর বুড়ো আঙুলের চাপে ঠুস করে আলুটা ভাঙতেই ফুস করে খানিকটা ধোঁয়া বেরিয়ে আসবে আলুর পেট থেকে। আলুতে ঝোলেতে ভাতেতে মেখে মাংসের একটা ছোট টুকরো ভেঙে মুখে দিলেই মনটা গুনগুন করে বলে উঠবে – থাক না এমনই গন্ধে-বিধুর মিলনকুঞ্জ সাজানো…।

পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় আকারে স্থূল, প্রকারে কুল এবং জোকার-এ মশগুল। ভালোবাসেন মার্ভেল, ডিসি, আর যা কিছু ফিশি। পূর্বজন্মে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে বাংলার নেশায় বুঁদ। পরজন্মে গল-দের গ্রামে খোলা আকাশের নীচে গোল টেবিলে নৈশভোজের আসরে বসে বুনো শূকরের রোস্ট খেতে চান।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *