বাঙালির বারোমাসে তের পার্বণ। আর তার মধ্যে সেরা পার্বণ হলো দুর্গাপুজো। বাঙালির কাছে পার্বণ  মানে  ভুড়িভোজ। তাই দুর্গাপুজো মানে যেমন নতুন জামা, বেড়ানো, পুজাবার্ষিকী তেমনি কবজি ডুবিয়ে খাওয়া।

এখনও কলকাতার বেশ কিছু সাবেকি বাড়িতে প্রথা মেনে দুর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয়। সেই সব ভাগ্যবানদের দিন শুরু হয় মাকে অঞ্জলিদানের পরে ফলপ্রসাদ দিয়ে। দুপুরে মায়ের ভোগ তো প্রসাদ হিসেবে থাকেই। তার সঙ্গে থাকে লুচি, কুমড়োর ছক্কা, ঘি-ভাত, নারকেলের কুচি দেওয়া সোনা মুগ ডাল, পাঁচ রকমের ভাজা, বাসন্তী পোলাও,  জিরে-আদাবাটা দিয়ে রাঁধা পনির নয়- নির্ভেজাল বাঙালি  ছানার ডালনা, খেজুর-কিশমিশের চাটনি আর শেষপাতে পায়েস। দেবীকে প্রদত্ত ভোগ যেমন তিন দিন ভিন্ন থাকে, তেমনি পুজোতে উপস্থিত ভক্তদের জন্যেও মেনু এক থাকে না।

পুজোর কথা বলতে গেলেই আমার  ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আমার জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলায় হলেও সেই অর্থে ‘দ্যাশের বাড়ি’র স্মৃতি আমার কাছে একেবারেই ধূসর। ছেলেবেলার পুজোর স্মৃতি বলতে মনে পড়ে বালিগঞ্জের ভাড়াবাড়িতে নমো নমো করে ঘটপুজোর স্মৃতি। দেশভাগের পরে ভিটেমাটি ছেড়ে আমার পরিবার থিতু হয়ে বসতেই ঠাকুর্দা, ঠাকুমায়ের ইচ্ছেতে নতুন করে আমাদের ভাড়া বাড়িতে শুরু হয়েছিল দুর্গা মূর্তির বদলে ঘট পুজো। পুজোর ক’টা দিন আত্মীয়স্বজনে ভরপুর থাকতো আমাদের বাড়ি। বাড়ির সংলগ্ন বাগানে শিউলি, টগরফুলের গাছ ছিল। ভোর রাত্তিরে উঠে ডালি ভর্তি করে পুজোর ফুল তুলতাম ভাইবোনেরা মিলে। শিউলিফুলের গন্ধের সঙ্গে পুজোর গন্ধ যেন মিলেমিশে একাকার।

সে সব দিনে নতুন জামাকাপড় পরা, ঠাকুর দেখতে যাওয়া ছাড়া আমাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল পুজোর ভোজ। তি নদিনে তিন রকমের ভোগ বিতরণ করা হতো। আলাদা উনুনে ভোগের রান্না করতেন বাড়ির মহিলারা। অতিথিদের জন্য পুজোর ক’দিন রাঁধতে আসতেন ভবানীপুর অঞ্চলের ‘উড়িয়া পাড়া’  থেকে ওড়িশার বামুন ঠাকুরেরা। সপ্তমীর দিন খিচুড়ি, আলু-ফুলকপি ভাজা, লাবড়া, চাটনি, পাপড়ভাজা আর শেষ পাতে কাওনের চালের পায়েস থাকত। অষ্টমীতে অন্নভোগ হত না, তাই লুচি হতো। সঙ্গে চার-পাঁচ রকমের ভাজা, কিশমিশ দেওয়া মিষ্টি স্বাদের ঘন ছোলার ডাল, জিরে-আদাবাটা দিয়ে রাঁধা বাঁধাকপির স্বাদু ঘন্ট, আর নানাবিধ মিষ্টি। নবমীর দিন কাজু, কিশমিশ দেওয়া পোলাউ-এর সঙ্গে নয় রকমের ভাজা, দু’রকমের তরকারি। পুজোর ক’টা দিন দেবীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হলেও, অতিথিঅভ্যাগতের জন্য নবমীর দিন ইলিশ ও রুইমাছের পদ থাকতো। দশমীর দিন বিসর্জনের পরে গুরুজনদের প্রণাম ও ছোট এবং সমবয়সীদের মধ্যে কোলাকুলি করার প্রথা ছিল। ওই দিন রাতে আত্মীয়কুটুম্বদের নিয়ে পংক্তিভোজনের এক  রীতি ছিল আমাদের পরিবারে। বরাবর দেখেছি সেদিনের রান্না আমার ঠাকুমা ও মাকে করতে। হাতে হাতে পরিবারের অন্য সদস্যারা জোগাড় দিলেও মূল রান্না করতেন ওঁরা দুজন। দশমীর পংক্তিভোজনের রান্নার নানা পদের মধ্যে কয়েকটি পদ ছিল বাধ্যতামূলক। যেমন নারকেল কুচি এবং জিরে-আদাবাটা দিয়ে মানকচুর ডালনা, কখনও আবার তাতে চিংড়িমাছও দেওয়া হতো, পাঁঠার মাংস, আমআদা দিয়ে কাঁচা তেঁতুলের টক আর সুগন্ধী চালের পায়েস। 

দশমীর পর থেকে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ‘বিজয়া’র দেখা করতে যাওয়ার চল ছিল। লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত তাই বাড়িতে লোকজনের আসাযাওয়া নিয়মিত ভাবে লেগে থাকত। অতিথিকে নোনতা এবং মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা বাঙালির ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ত। আমাদের বাড়িতে এই উপলক্ষ্যে রান্নাঘরে, খাজা, গজা,  নারকেল বা তিলের নাড়ু, মালপোয়া, কুচো নিমকি, এবং স্বাদু ঘুগনি বানানোর ধূম পড়ে যেত। আখের গুড় দিয়ে নারকেল কোরা পাক দেওয়ার গন্ধে সারা বাড়ি সুবাসিত আর ছেলেপুলেদের নোলা শক্‌শক্‌!! বাজারের মিষ্টি বা নোনতা দুটোরই প্রবেশ নিষেধ ছিল ওই সময়ে আমাদের বাড়িতে।

 
বাড়িতে তৈরি গজার পাকপ্রণালী:
উপকরণ: ময়দা ২কাপ; চিনি ১ টেবলচামচ; সাদা তেল ১/২ কাপ, সিরার জন্য চিনি ১কাপ;
গুঁড়ো দুধ ১/৪কাপ; নুন সামান্য; ভাজার জন্য তেল প্রয়োজনমতো।
প্রণালী: প্রথমে ময়দা, এক টেবলচামচ চিনি, নুন ও গুঁড়ো দুধ দিয়ে শক্ত করে মেখে নিন। ময়দার মণ্ড ৫ মিনিট ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন। এবারে মণ্ড থেকে গোলা তৈরি করে পুরু করে রুটি বেলে নিন। একই মাপে ছুরি দিয়ে গজার আকারে কেটে নিন। একটি কড়াইতে তেল গরম করে গজাগুলি ছেড়ে দিন ও মাঝারি আঁচে ভাজতে থাকুন। বাদামি রং ধরলে টিস্যু পেপারের উপর রাখুন। এবারে সিরা বানাতে ১ কাপ চিনি ও আধা কাপ জল একটি পাত্রে ফুটিয়ে নিন ও নাড়তে থাকুন। সিরা ঘন হয়ে এলে গজাগুলি সিরায় ফেলে নাড়তে থাকুন। গজাগুলির গায়ে সিরা সেঁটে গেলে নামিয়ে নিন।     

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *