*পরের পর্বের লিংক: []

ওই যে, নীল শার্ট কালো ট্রাউজার। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি, চওড়া ছাতি– পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি নিশ্চয়। জিমে পাকানো শরীর। দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার কামানো। গাল নীলাভ, বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। প্রিন্স রহিমুদ্দিন লেন থেকে বেরিয়ে দু’পাশ ভাল করে দেখে, লেফট-রাইট করে রাস্তা পেরিয়ে, তিনটি ঝুরি নামানো বটগাছের তলায় পাঁচ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে, টালিগঞ্জ থানার সামনে ফুটপাথে বসা জুতো পালিশওলার দিকে এগিয়ে গেল– ‘পালিশ…তাড়াতাড়ি…ভালো করে…’

পাহাড়ে চড়া যাদের শখ, তাদের কেউ-কেউ ওকে চেনে। ছোটখাট কয়েকটা অভিযান করে কিঞ্চি নাম হয়েছে ওর। তবে যারা সেলস-এ কাজ করে, তারা সবাই ওকে চেনে। রঞ্জন মজুমদার। বড় বড় কোম্পানি ওকে পেতে চায়। আপাতত, সে টুইটার মোবাইলের রিজিওন্যাল সেলস হেড। তবু, বোঝাই যাচ্ছে, সমস্যায়।

জুতো এমনকিছু নোংরা হয়নি যে, এখনই জরুরি ভিত্তিতে পালিশ করাতে হবে। এতটাই তাড়াতাড়ি, গুছিয়ে বাক্য শেষ করবার সময় নেই । বোঝাই যাচ্ছে ও কিছু ভাবতে চাইছে, জুতো পালিশ একটি ফিকির মাত্র। এও বেশ  বোঝা যাচ্ছে, জামার ভেতরে মোটা কিছু পরেছে। গরম জামা হতে পারে, যাকে আজকাল চলতি কথায় থার্মাল বলা হয়। কিন্তু চামড়ায় টান লাগলেও, এখনও কলকাতায় এমন কিছু শীত পড়েনি যে, ওইরকম মোটা গরম জামা পরতে হবে। তবে কী রঞ্জনের জ্বর?

পালিশ-বাক্সের কাঠে ডান-পা রেখেই রঞ্জন আবার গলা ছেড়ে বলল, ‘ভালো করে, ভালো করে…’ 
উত্তর ছুটে এল, ‘আমি ভালো পারি না, অন্য কোথাও যান।’ ঈশানকোণে আঙুল তুলল পালিশওলা মুচি। তার চোখের জমি সাদা ব্লটিং পেপার, কালচে ঠোঁট দু’টুকরো জোড়ালাগা পাথর!

আগেকার রঞ্জন হলে এখনই পালটা চালাত। ওর টিমের সবাই জানে ক্যাপ্টেনের চালু কথা– ‘কেউ অপমান করলে সঙ্গে-সঙ্গে ব্যাট চালাবি। জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের যে কোনও দোকানের বিরিয়ানি থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভের যে কোনও ঝুপস-এর মিষ্টি গজা, সব সামলানো যায়। কিন্তু দেখবি অপমান হজম হয় না। অ্যাসিড হবেই… প্রথমে বুকের ভেতর চাপ, তারপরেই অম্বল…। পাল্টা চালালে চাপ হবে, কিন্তু পরেরটা হবে না…’

 

আরও পড়ুন: দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে: কবেকার কলকাতা শহরের পথে

 

সেই রঞ্জন, আজ, এখন হতভম্ব। রাস্তা পার হবার সময়েই মনে হয় তার কেটে গেছে। বারদুয়েক ঠোঁট নড়ল। দূর-নিয়ন্ত্রিত রোবটের মতো পা সরিয়ে নিল তক্ষণা। সে কী হেলাফেলা করে কথা বলল! অধঃস্তন সবাইকে সে সম্মান দিয়ে কথা বলে। তাকে সবাই বলে টিমম্যান, টিমলিডার। এজন্যই তার সাফল্য। যেখানে গেছে, চড়চড় করে সেলস বাড়িয়েছে। তবু কেন ছিটকে বেরলো, ‘পালিশ… তাড়াতাড়ি… ভালো করে…?’ কিছু কী দাবড়ানি ছিল কথায়? গুণী মানুষের বলটু একটু ঢিলে হয়। তাই বোধহয় খ্যাঁক করে উঠেছে।

যুক্তি দিয়ে কথাটা ভাবতে পেরে মাথাটা কিছু হালকা। ডান-পা নামিয়ে, লোকটির দিকে তাকাল রঞ্জন। নিচে লুঙ্গি, ওপরে ফতুয়া। ডানদিকের রগের কাছে কালো দাগ বেশ গভীর। অন্যদিকে তাকিয়ে পথচারীদের উদ্দেশে লোকটি হাঁক পাড়ল– ‘পালিশ, পালিশ…’ অর্থা সে খালি আছে। অর্থা সে রঞ্জনকে বলতে চায়, বাপু হে তুমি কেটে পড়। অতএব, শরীর ঠেলতে-ঠেলতে আবার বটগাছের তলায়। এখন তার কী করবার কথা ছিল?

রঞ্জন মজুমদারের যখন এমন হুতুলি-কুতুলি দশা, চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল খালি ট্রাম। আকাটের মতো শব্দ করতে-করতে। দরকার না থাকলেও খালি ট্রামে উঠে পড়া রঞ্জনের শখ। ট্রামের বাঁ পাশের সিটে বসে কলকাতা দেখতে দারুণ লাগে। গেট লক্ষ্য করে ছুটে আসা যাত্রীদের ভঙ্গিও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। আজ সে দাঁড়িয়েই রইল। বাঁদরওলা গেল শিস দিতে-দিতে। বাচ্চা বাঁদরটি তার কাঁধে, ধেড়ে দুটি রাস্তায় জোরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কলেজ ইউনিফর্ম পরা তিনজন পা ঘষটাতে-ঘষটাতে চলে গেল। হাওয়ায় উড়ে এল ছেলেটির গলা।
– মার্কল ট্রি… ক্রিপটোগ্রাফি…

– অরফ্যান ব্লক ব্যাপারটা…। মেয়েটি হাত নেড়ে বলল।
– মালার মতো চেইন ফর্মেশন করে দিলে… অন্য ছেলেটি বলল।
বোঝাই যায় ওরা ব্লকচেইন-এর ব্যাপারে কথা বলছে। কিন্তু এইসব টুকরো কথার একটিও রঞ্জনের কানে ঢুকল না। বস্তুত, সামনের চলমান জগতের সব ঘটনাই সে দেখেছে। আবার দেখেওনি, শোনেওনি। অথচ, যারা ওকে চেনে, সবাই বলবে, দেড় বছর আগেও রঞ্জন এমন অন্যমনস্ক ছিল না। আর কিছুতে না হোক, তার মতো কম্পিউটার ওস্তাদ ব্লকচেইন নিয়ে মাথা ঘামাবে না, ভাবাই যায় না।

ওর টিমের সবাই জানে ক্যাপ্টেনের চালু কথা– ‘কেউ অপমান করলে সঙ্গে-সঙ্গে ব্যাট চালাবি। জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের যে কোনও দোকানের বিরিয়ানি থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভের যে কোনও ঝুপস-এর মিষ্টি গজা, সব সামলানো যায়। কিন্তু দেখবি অপমান হজম হয় না। অ্যাসিড হবেই… প্রথমে বুকের ভেতর চাপ, তারপরেই অম্বল…। পাল্টা চালালে চাপ হবে, কিন্তু পরেরটা হবে না…’

সে সময়ের রঞ্জন আজ বলেই বসত– এই মেয়ে শোনও!
ওরা হয়তো কোনও ক্যাফেতে ঢুকত। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে টুইটার মোবাইলের সেলস হেড বুঝে নিত ওদের দৌড়। সহজ কথায় বুঝিয়ে দিত মোদ্দা ব্যাপারটা। কথার ফাঁকে বুঝে নিতে চাইত আগামীতে কে সেলস-মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট করলে উন্নতি করবে। আজ কিছুই করতে ইচ্ছে করল না। সে এখানে এসেছে কেন? মনে পড়ছে না। কোথায় যাবার? তাও বুঝতে পারছে না। ছন্দছুট মনের ভেতরও মানুষের একটা কোনও বোধ কাজ করে যা, খাদের কিনারায় পৌঁছে যাওয়া মানুষকেও জীবনের দিকে ফেরায়। বিজ্ঞানীরা এখনও তার তল পায়নি। সেই গভীর থেকে বার্তা পেল রঞ্জন। মনে-মনে গুনতে শুরু করল এক-দুই-তিন-চার… 

প্রতিটি সংখ্যা উচ্চারণের সঙ্গে বুকের ভেতর শব্দ উঠছে ঢিব ঢিব। যেন বাঁয়া তবলায় টোকা দিচ্ছে কেউ! প্রতিটি তালে মাথার আলসেমি খসে-খসে যাচ্ছে। হালকা আলো ফুটতেই শালিকগুলো যেমন উসখুস করে ওঠে জানালার গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা পেয়ারা গাছটার ডালে, ঘেঁটে যাওয়া যুক্তি নড়েচড়ে বসছে। যেন ভোর হচ্ছে খুলির ভেতর! ঠিক তখনই কথাটা গায়ে বিঁধল,… অন্য কোথাও যান।

পিছন ফিরে আবার যেতেই পালিশওলা ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। ক্রিমের শিশির ঢাকনা খুলে চোখ সরু করে দেখে নিল ভেতরটা। তারপরেই আঙুল ডুবিয়ে পরখ করল ঘনত্ব।
– সন্ত রুইদাস বলেছেন, বিকেলে কাউকে ফেরাতে নেই…। কোনও খদ্দের পাবে না। যা মাথায় এসেছে বলে দিল রঞ্জন।
– আঁ.. ক্যায়া?
শিশিটা হাতেই রয়ে গেল লোকটির। এমন নিয়মের কথা ওর বাপ-চাচা-বড়ে ভাই-নানা-নানি কেউ কোনওদিন বলেনি। নিশ্চিত ওর মাথা গুলিয়ে গেছে। গ্রাহ্য না করে বটগাছের তলায় ফিরে এল রঞ্জন। আর কী আশ্চর্য! ঠিক তখনই–

 

আরও পড়ুন: অমর মিত্রের উপন্যাস: কাকলি গানের বাড়ি

 

মধ্য ষাট নিশ্চয়ই। শীর্ণদেহ। পাকা পেয়ারা নাড়াচাড়া করলে যেমন অনুভূতি হয়, এ ভদ্রমহিলার গালে হাত বুলোলে নিশ্চয় তেমনই শান্ত নিরামিষাশী লাগবে নিজেকে। ত্বকের রঙ? তিন কাপ প্রথম ফুটের জলে এক চামচ পাতা-চা ঢেলে এক মিনিট রাখার পর তিন চামচ দুধ ঢাললে যে রঙ খুলবে, এ সেই বর্ণ। তামাটে বলা ঠিক হবে না। চুল অধিকাংশই কালো, সামনের কিছু অংশ হঠা রুপোলি। কোমরছোঁয়া। ঠিক মাঝখানে নয়, কিছু বামদিকে হেলা সিঁথি। এখন সিঁদুর না থাকলেও এককালে যে থাকত, বেশ বোঝা যায়। কপালে রুপোলি চূর্ণ কেশ। নাকের দু-পাশ বেয়ে গভীর বলিরেখা, অথচ কী মসৃণ ললাট! চোখের আয়তনে তেমন কোনও হেরফের নেই যে আলাদা করে উপমা ভাবতে হবে, তবে দৃষ্টির তরঙ্গ নিশ্চয় অন্তর্ভেদী। কারণ, চোখে চোখ রাখলেই ভেতরটা গুরগুর করে। চোখের পাতায়-পল্লবে বিষণ্ণতা লেগে আছে। চায়ের কথা ভাবতেই এদিক-ওদিক মাথা ঘোরাল রঞ্জন। কোনও দোকান নজরে এল না। ঝুপড়ি দোকানও নেই। অদ্ভুত অসংসারী এলাকা। 

ভিক্ষা চাইছি না বাবা। ছেলে বউ রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে… ওই যে বাসস্টপের সামনের বেঞ্চিটায় বসেছিলাম। বলেছিল, সিনেমা দেখে ফেরবার পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু আর কী আসবে?
ভদ্রমহিলার গলায় কোনও কাতরতা নেই, দুশ্চিন্তা লেগে নেই। শান্তগলায় কথা ক’টি বললেই যেন চলমান কলকাতার কেউ একজন দৌড়ে এসে ওঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। উনি আরও কীসব বলে যাচ্ছেন। রঞ্জনের কানে কোনও কথা ঢোকেনি। মুখচ্ছবি দেখেই ছ্যাঁ করে ফিরে এসেছে সাড়ে চার, না-না, ঠিক পাঁচ বছর আগের সেই বিকেল।     (চলবে)

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *