আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭] [১৮]

ক’দিন বাদে শুনলাম নীলমাধবের দাওয়াইয়ে কাজ হয়েছে। সেই পথের ভিখিরি আবদাল্লা পাড়া ছেড়ে চলে গেছে মনে হয়। ২১ নং বাড়ির নীচে শুয়ে থাকত প্রায় সারাদিন। চঞ্চলচন্দ্র তাকে ডাকতে এলে উঠত, তাঁর পিছু পিছু যেত মণিমালিকা বহুতলে। মণিমালিকা নীলমাধবের বউয়ের নাম। বহুতলের এই নাম নিয়ে খুব সমস্যা হয়েছিল, কিন্তু নীলমাধব পেরেছে। তার জেদে প্রোমোটার রাজি হয়েছে। আমাদের দিন যায় এইসব নিয়ে। কিছুই ঘটে না, আবার ঘটেও। 

এর ভিতরেই  কারও ছেলে, মেয়ে  কিংবা জামাই বিদেশ চলে যায়।  কারওর ছেলে আবার বিদেশ থেকে ফেরে। বিমল রায় ঘুরে এল ছেলের কাছ থেকে। ছেলে থাকে ইতালিতে। তিনি ইতালির বিবরণ দিলেন ক’দিন ধরে। রোম। ভ্যাটিকান। না, তিনি বাই সাইকেল থিফ সিনেমা দেখেননি, সুমিতাভ মৈত্রর কথায় বললেন। আমি দেখেছি টেলিভিশনে কোন একটা চ্যানেল ঘুরতে ঘুরতে। খুব ভাল লেগেছিল। দেখলে আর কী সুবিধে হত? হেসে বললেন প্রাক্তন জয়েন্ট সেক্রেটারি,
– আমার ছেলেও তো দেখেনি, কী হয়েছে।
নীলমাধব বলল,
– আমরা মশাই সাধারণ মানুষ। অত বুঝিনে। সোফিয়া লোরেনের সিনেমা দেখেছিলাম একবার। ইংলিশ সাবটাইটেল দেখব না নায়িকার রূপ দেখব? ধুস, আমাদের সুচিত্রা উত্তমই ভাল। 

নীলমাধব রিপোর্ট করল, চঞ্চলচন্দ্র তার ক্ষমতা বুঝতে পেরেছে। একেবারে চুপ করে গেছে। এখন সেই আবদাল্লাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে মনে হয়। আবদাল্লার বাড়ি কোথায় ছিল কেউ জানে না। নীলমাধব বলল,
– টেররিস্ট, টেররিস্ট। আবদাল্লা নামেই ধরা যাচ্ছে টেররিস্ট। চঞ্চলকে পুলিশ নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, কেন ভিখিরিকে ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। চঞ্চল বলেছিল, খাওয়াতে। পুলিশ বিশ্বাস করেনি। রেড মার্ক করেছে চঞ্চলচন্দ্রের নামের গায়ে। 

জুড়ান রায়ের সঙ্গে আমার এখন দেখা হয় প্রায় সব রবিবার। আমার সাহস বেড়েছে। আমার যে কেন মনে হয়, জুড়ানের কথা ধ্রুব সত্য? হুন্ডির কথা আমি জুড়ানকে বলতে হা হা করে হাসল সে।
– আরে আমি টাকা চেঞ্জ করি। মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স পেয়েছি। শালা বলে কী? আমি রিটায়ার্ড লোক, বউয়ের নামে লাইসেন্স। অসুবিধে কী ?

– আমি যে তোমার সঙ্গে…
– ও কি তোমার বস অনুতোষ? ভয় কর কেন? ও ধরা পড়বেই।জুড়ান বলে। 
– নাকি চঞ্চলচন্দ্র? আমি উলটে জিজ্ঞেস করলাম। 
হা হা করে হাসল জুড়ান।

আমরা গাছের ছায়ায় পার্কের বেঞ্চে বসে আছি। জুড়ানের হাসিতে দিঘির জলের উপর ভেসে থাকা রৌদ্র যেন ঝলক দিয়ে উঠল। একঝাঁক পাখি উড়ে গেল দূরে কোথায়। হাওয়া দিল। বেশ ভাল লাগল ওই হাসি। তাহলে জুড়ানের কথাই ঠিক। জুড়ান বলল, বশির মল্লিককে চোখে চোখে রেখেছে পুলিশ। ধরছে না, কেন না আরও বড় কারওর জন্য অপেক্ষা করছে। বশিরের কাছে কারা যায়, কারা আসে, তা নোট রাখছে থানা। সিসিটিভি বসানো আছে নিশ্চয়। ছবিই কথা বলবে যে নীলমাধব সেখানে মাসে ক’বার যায়। আর কে কে যায় বশির মল্লিকের বাড়ি।

পুলিশ আরও তথ্যপ্রমাণ চাইছে। সেই প্রমাণ দেবে বাংলাদেশ সরকার। তথ্যপ্রমাণ না পেলে তো পুলিশ কিছু করতে পারে না। তা ছাড়া নীলমাধব টাকা ছড়াচ্ছে। টাকায় টিঁকে আছে। টাকা সব লুটের। মুক্তিযুদ্ধের সময় কম লুট হয়েছে? একটু থেমে জুড়ান বলল, তাকে নেমন্তন্ন করেছে নীলমাধব। কার্ড দিয়েছে। কেন দিয়েছে? না, ভয় পেয়েছে মনে হয়। অথচ বিরাম ঠাকুরই ফলস। বিরাম ঠাকুরের জন্ম চট্টগ্রামে। ফরিদপুরে কিছুতেই নয়। বিরাম ঠাকুরের ফলোয়ার সব বারাসতের বার্মা কলোনিতে। ফরিদপুরে তাঁর কোনও শিষ্যই নেই। বিরাম ঠাকুরের জন্মোৎসবে জুড়ান নিমন্ত্রিত হয়েছে শুনে আমি অবাক। তাহলে কি নীলমাধব হার স্বীকার করে নিচ্ছে? তারই লক্ষণ এইটা। কথাটা কার্তিক দত্তকে বলতে সে বলল,
– পাশের জেলার লোক তো, তাই প্রত্যেকবার কার্ড পাঠায়।
– জু
ড়ান অত খারাপ কথা বলতেও?  অবাক হয়ে জিজ্ঞেস  করলাম আমি। 

নীলমাধব খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। মাথা ঠান্ডা বলেই এত সম্পত্তি করতে পেরেছে। একটা কার্ড বই তো নয়। ক্লাবের ছেলেরা দিয়ে আসে। জুড়ান খারাপ কিছু প্রকাশ্যে বললে ক্লাবের ছেলেরা ছাড়বে না। তবে জুড়ানেরও ফলোয়ার আছে। পয়সা নেই, কিন্তু অনুগামী আছে। কী করে আছে? না সে বারাসতের কালেকটরের অফিসে চাকরি করে। অবসরের পরও চাকরি করছে। জেলাশাসক তাকে ছাড়েননি। এ পাড়ার কার যেন জমি দখল করে নিয়েছিল মাইকেল নগরের একটি বদ লোক। জুড়ান এসডিও সায়েবকে বলে পুলিশ দিয়ে তাকে শায়েস্তা করে জমি উদ্ধার করে দিয়েছে। সে সায়েবদের অনেক কাজ করে দেয়। সায়েবরাও জুড়ানের কথার মূল্য দেয়। জুড়ানকে ভালবাসে। যাই হোক, আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম বিরাম ঠাকুরের জন্মোৎসবের জন্য। গুণেন আমাকে বলল,
– বশির মল্লিক আর তার মেয়ে আসতে পারে। এবার মিলিয়ে নেবেন, নীলমাধব কী ছবি আপনাকে দেখিয়েছিল। 
– সেই ছবি আমি ভুলে গেছি। আমি বললাম। 
– মনে হচ্ছে ভুলে গেছেন। আসলে ভোলেননি, দেখলেই মনে পড়ে যাবে। গুণেন বলল। 

আমরা গাছের ছায়ায় পার্কের বেঞ্চে বসে আছি। জুড়ানের হাসিতে দীঘির জলের উপর ভেসে থাকা রৌদ্র যেন ঝলক দিয়ে উঠল। এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল দূরে কোথায়। হাওয়া দিল। বেশ ভাল লাগল ওই হাসি। তাহলে জুড়ানের কথাই ঠিক। জুড়ান বলল, বসির মল্লিককে চোখে চোখে রেখেছে পুলিশ, ধরছে না, কেন না আরও বড় কারওর জন্য অপেক্ষা করছে পুলিশ।

মণিমালিকা আবাসন। নামটি শ্বেতপাথরে সোনালি অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। এর নাম কাকলি। কাকলি আবাসন কিংবা শ্যামাশ্রী আবাসন হতে পারত। শ্যামাশ্রীর কথা ইদানীং খুব মনে পড়ে। আবছা কুয়াশার ভিতর থেকে মুখ বাড়ায় কিশোরী। কচি কলাপাতা রঙের ফ্রকের উপর সাদা বুটি। মাথার চুলে কোঁকড়ানো ভাব। জ্বলজ্বলে চোখ। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। বেণির গোড়ায় লাল ফিতের ফুল। চলে গেল আর মিশে গেল কুয়াশার ভিতর। তাকে নিয়ে আর একটি গল্প আমি লিখতে শুরু করেছি। একটু একটু করে লিখছি। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমি তো লেখক নই। সম্পাদক আমাকে তারিখ নির্দিষ্ট করে দেননি জমা দেওয়ার। সুতরাং আমি শ্যামাশ্রীকে মনে মনে  সাজিয়ে দিচ্ছি। ওর মুখে গান বসাচ্ছি। তুমি নির্মল কর…। সুমিতাভ মৈত্র শুনে বলেছেন মন শান্ত করে লিখতে। যত সময় লাগে লাগুক। 

বিরাম ঠাকুরের আবির্ভাব উৎসবে আমরা প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গীরা একসঙ্গে প্রবেশ করেছি মণিমালিকা আবাসনে। লাউডস্পিকারের বিরাম ঠাকুরের গান হচ্ছে। সুরেলা গলা। আমরা কমিউনিটি হলে গিয়ে বসেছি। মঞ্চে ঠাকুরের মস্ত ছবি। ধূপ ধুনো, ফুল, মালা। মাথার পর মাথা। হল ভর্তি হয়ে গেছে নিমন্ত্রিত মানুষে। সকলেই এলাকার। অনেকে মর্নিংওয়াকের আলাদা দল। নীলমাধব সকলকেই বলেছে। জুড়ান রায়, সুমিতাভ মৈত্র আসেননি। চঞ্চলচন্দ্র তো ননই। মঞ্চে বিরাম ঠাকুরের ছবির নীচে যে গাইছে, সে বড়জোর উনিশ-কুড়ি। গুণেন সরকার এসেছে। গুণেন আমার পাশে। তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
– হাবড়ার মেয়েটি। নীলমাধবের সহচরী। দেখুন চিনতে পারেন কিনা! এই মেয়েই তো হিমাচল প্রদেশ ঘুরে এল।

– কই? আমি চমকে উঠলাম।
ওই যে গাইছে, তুমি নির্মল কর, মঙ্গল কর, মলিন মর্ম মুছায়ে। 

আহারে! ভোরের সময় এই গান শুনতে আমি শ্যামাশ্রীদের বাড়ির সামনের গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। বুক কেঁপে উঠল। ভোরের বাতাসে ভেসে আসছে শ্যামাশ্রীর গান। দু’চোখ বন্ধ করলাম। একেবারে সেই কণ্ঠস্বর। ভুল হবার নয়। গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, যেমন আলাদা করে চেনা যেত, তেমনই ছিল কিশোরী শ্যামাশ্রী। তাকে চেনা যেত। আলাদা করা যেত সকলের থেকে। আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা…, মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়। শেষ গানটি ছিল ‘এই লভিনু  সঙ্গ  তব সুন্দর হে সুন্দর। আলোকে মোর চক্ষু দুটি, মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি… শ্যামাশ্রী আর আমি রেডিওপার্ক থেকে ফিরছি, ও গাইছে সেই গান।

আমি গায়িকাকে ভাল করে দেখতে লাগলাম। কচি কলাপাতা রঙের উপর সাদা বুটি কামিজ। থ্রি কোয়ার্টার হাতা। শ্যামাঙ্গিনী। শ্রীময়ী। সামনে দুই বেণি। চোখ বন্ধ করে সমাধিস্থ হয়ে যেন গাইছে। এবার সে নতুন গান আরম্ভ করল। সেই গান। আমার জীবন নদীর ওপারে, এসে দাঁড়ায়ো দাঁড়ায়ো বধূ হে। আমি তরীটি বাহিয়া আসব, তুমি চরণখানি বাড়ায়ো হে…। শ্যামাশ্রী ফিরে আসছে, ফিরে আসছে। গানের ভিতর দিয়ে আমি শ্যামাশ্রীকে দেখতে থাকি। 

এ কে? আমার চশমা যেন ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। কাচে কুয়াশা জমে যাচ্ছে। শ্যামাশ্রী। মধ্যের ৫০ বছরের কোনও হিসেব নেই। বড়জোর দু’তিন বছর গেছে। গুণেন বলল,
– মেয়েটা খুব গুণী। খুব ভাল গায়। কিন্তু শয়তান নীলমাধবের যুবতী দাসী। 
আমার চোখ জ্বালা করতে লাগল। বললাম
– থাক। পরে কথা হবে। এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়।

গুণেন বলল,
– সেই মেয়েই। আপনার মনে নেই। নীলমাধব ওকে টেলিভিশনে চান্স করিয়ে দেবে, নীলমাধব ওকে সিনেমার প্লেব্যাক করাবে, নীলমাধব ওর সিডি বের করে দেবে, এইসব বলে পটিয়েছে। নাহলে কি মেয়ে এমনিতে নীলমাধবের সঙ্গে ঘোরে?  
– এসব কথা কে বলল? নীলমাধব তো হুগলির মেয়ে নিয়ে হিমাচল প্রদেশে গিয়েছিল। এ নয়। আমি হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।
– না। এইই, আপনি ভুলে গেছেন। গুণেন বলল। 
– একদম না। সেই মেয়ের গায়ে দিনেমারের রক্ত, নীল চোখ। আমি চাপা গলায় বললাম। 
– বানিয়ে বলছেন, আড়াল করতে চাইছেন। গুণেন প্রায় ক্রুদ্ধ স্বরে বলল। 
– সেই মেয়ে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি  লম্বা। এ সে নয়।
– ছবিতে কি হাইট মাপা যায়? নীলমাধবের কথা মিথ্যে। গুণেন  বলল। 
– নীলমাধব বলেছে প্রায় তার মাথায় মাথায়। আমি বললাম। 
– বশির মল্লিকের মেয়ে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি নয়। ক্যামেরার কারসাজি আপনি বুঝতে পারেননি। কিংবা হাইহিল ছিল। লম্বা বেঁটে কোনও ব্যাপার না। ছবিতে সব করে দেওয়া যায়। গুণেন  বোঝাতে  লাগল।
– থাক, গান শুনতে দেন। আমি বললাম। 
– শিগগির সিডি বেরিয়ে যাবে, তখন শুনবেন। এই মেয়েই সেই মেয়ে। 
উফ, গুণেন আমাকে গান শুনতেই দেবে না।  একই  কথা বলে যাচ্ছে। বলছে, বশির মল্লিক ধরা পড়ে গেলে কি মেয়েটার সিডি বেরবে? সকলেই তো বাংলাদেশে চালান হয়ে যাবে। 

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *