আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩]

অপরাধীর শাস্তি  হবে, কিন্তু  অপরাধ  প্রমাণ  করতে হবে তো।  কথাটা  বলতে গিয়েও  বলতে  পারলাম না। অপরাধ  কি  প্রমাণ  করা যায় ? জুড়ানের  বোন  রাখি  রিফিউজ  করলে তাকে চাউলি  বলে ডাকত  নীলমাধব।  তাকে  একদিন  ধরে  জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল নীলমাধব, অপরাধের  কথা  বলতেই পারেনি জুড়ানের  বাবা। এইটা আমি  জানি। কিন্তু  সে ঘটনা  তো  মুছেই  গেছে।  তা নিয়ে কথা হতে পারে না।  কিন্তু  এইটা  সত্য  জুড়ানের  বিদ্বেষ  নিয়ে আমি কোনও কথা বলতে পারি না। জুড়ান একটা সত্য  গোপন থাকার বিপক্ষে একটা  মিথ্যে  হয়ত প্রতিষ্ঠা  করতে চাইছে পঞ্চাশ বছর ধরে। আগের  সেই  অপরাধের বিচার এখন হবে না। জুড়ানে  আমার আকর্ষণ তীব্র। নতুন কী  খবর এনেছে সে? আমি উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, আবার ভয় ভয় লাগছিল। জুড়ান মানে সেই মার্ডারার, বাংলাদেশ, শেখ মুজিবের হত্যাকারী…কিন্তু সবটাই ওর কথা। এমন কোনও প্রমাণ নেই যাতে বোঝা যায় ও সত্য বলছে। বরং কার্তিক দত্তর কথা সত্য মনে হচ্ছে। 

 

নীলমাধব লোকটা দুঃশ্চরিত্র, অহং সর্বস্ব, ক্ষমতালোভী।  কিন্তু এমন লোক কম নেই এ পাড়ায়। তাহলে নীলমাধবকে দাগিয়ে দেব কেন? দেবে জুড়ান কেন না তার বোনের সম্ভ্রমে হাত দিয়েছিল নীলমাধব। কিন্তু  এমন হয়ে  থাকে।  যৌবনের  পাপ ধুয়ে  মানুষ কি নির্মল  হয় না। লেভ তলস্তয়ের রেজারেকশন উপন্যাসে কাউন্ট  যেমন  করেছিল। সব কিছু  ত্যাগ করে সাইবেরিয়া  যাত্রা  করেছিল অপরাধী নারীর সঙ্গে।  সেও  নির্বাসন দিয়েছিল  নিজেকে।  নীলমাধব যদি  ক্ষমা প্রার্থনা করে জুড়ান কি  তার রাজাকার পর্বের  ইতি  ঘটাবে?  কিন্তু  নীলমাধব  কাউন্ট নন।  নীলমাধব  নিজের পাপ  ধুয়ে  ফেলতে  সাধু  হয়ে যায়নি। আরও  অধর্ম  করছে টাকার  জোরে। গুণেন সরকার জীবনে একবারই ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তার বস চাকরির ক্ষতি করে দিতে পারত। কিন্তু  তা করেনি। অথচ নীলমাধব কর্পোরেশনের বোরোর ক্যাশ বাবু। ক্যাশিয়ার ছিল। ঘুষ নয়, বাঁধা উপরি ছিল। তার কিছুই হয়নি। সে উচ্চ কন্ঠে  ঘুষের সাফাই  দেয়,  আয় করতে জানতে হয়, পুরুষের ধর্ম আয় করা।   

জুড়ানের সামনে ধূমায়িত চা। বিস্কুট। মিষ্টি দিয়েছিলাম ফ্রিজ থেকে বের করে, জুড়ান তরিবৎ করে খেল।   বলল, তার সুগার আছে কি নেই, সে জানে না, পয়সা দিয়ে টেস্ট করায় না, টেস্ট করালে অনেক রোগ বেরবে, সুতরাং টেস্ট না করাই ঠিক। যে কোনও মানুষের ভিতরই যে কোনও রোগ পাওয়া যেতে পারে খোঁজ করলে, যেমন নীলমাধব, তার যৌন রোগ হয়েছিল, বারাসতে গিয়ে চিকিৎসা করেছিল ডাঃ পালোধীর কাছে।

কে ডাক্তার পালোধী?  জিজ্ঞেস করলাম। 

বিখ্যাত ডাক্তার, বারাসত জুড়ে তাঁর পোস্টার, অর্শ, ভগন্দর, সিফিলিস, গনোরিয়া, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি চিকিৎসার ধন্বন্তরি এবং গর্ভপাতও করে। 

আমার কৌতুহল হল, জিজ্ঞেস করলাম, সেই পালোধী কি এই পালোধীর কেউ হন?

হতে পারে, নাও হতে পারে, এরা  শুনেছি  ঝিনাইদহ, যশোরের লোক ছিল, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হল, ১৯৬৫ সালে, আয়ুব খাঁর আমলে, তখন চলে এসেছিল, কিন্তু খুব সেয়ানা, ওর বাবা ওপারে এই কোয়াক ডাক্তারি করত, ও বাবার কাজ ধরেছে, পাসপোর্ট ভিসা করে ওপারে চিকিৎসা করতে যায়, ধরো তিন মাসে একবার।  বাবা কালীপদ পালোধীর সুযোগ্য পুত্র  শিবপদ পালোধীর আগমন  /  শুভেচ্ছায়  স্বাগতম-এই লেখা  পোস্টার পড়ে সেই সময়।  বলল জুড়ান। সেই ডাক্তারখানায় এখন দুই কোয়াক ডাক্তার বসে, আতিকুজ্জামান, সাদিকুজ্জামান, দুই ভাই, কিন্তু চিকিৎসালয়ের নাম তারা একই রেখেছে, ফলে পালোধী গেলে সাড়া পড়ে যায়, যেন কালীপদ পালোধীই ফিরেছে দেশে, ইন্ডিয়ার ডাক্তার,  প্রচুর টাকা নিয়ে শিবপদ পালোধী ফেরে। বারাসত পেরিয়ে কাজিপাড়ায় তার কত বড় বাগানবাড়ি। সেখানেই চেম্বার। শহর থেকে একটু  দূরে, কিন্তু তাতে পসার কমেনি। বর্ডারের ওপারের লোকও আসে। সে এম বি বি এস নয়, বই পড়ে ডাক্তারি করে।  

ওঘরে সুজাতা টিভি দেখছে, এই ঘরে আমি ও জুড়ান রায়।  অদ্ভুত এক  গল্প  জুড়েছে সে। এও পালোধী সেও পালোধী, একজন কোয়াক ডাক্তার, অন্যজন সন্দেহভাজন। এরা জ্ঞাতি হতে পারে, নাও হতে পারে, কিন্তু তার কাছেই গিয়েছিল নীলমাধব ব্যাংকক থেকে ফিরে। তা জুড়ান জানল কী করে?  জুড়ান বলল, সে বারাসতের ডি এম অফিসে এত বছর আছে, সে জানবে না তো কে জানবে?  তার নেটওয়ার্ক আছে। প্রতিদিন দুই জিবির মতো ডেটা পায় সে।  নেটওয়ার্ক  শক্তিশালী।  বারাসতে  কে ঢুকল, কে বেরোল  বারাসত  থেকে,  খবর সে পেয়ে যায়।  পালোধীর সঙ্গে তার খুব জানাশোনা, যশোর জেলার মানুষ তো, পালোধী জানে  জুড়ান কোথায় থাকে।  নীলমাধবের কথা তাই বলেছিল কথা প্রসঙ্গে। কিন্তু এসব কথা শুনে আমার লাভ কী ? এ তো কিসসা হচ্ছে। কলকাতায় এত বড় বড় ডাক্তার থাকতে বারাসত যাবে কেন চিকিৎসা করাতে?  কিন্তু কথাটা বললাম না। আমি খুবই সতর্ক। হয়ত  নীলমাধব গেছে অন্য কোনও কারণে। 

 

জুড়ান বলল, সকলের সব কিছু জানা দরকার।

 

আমি বললাম, না জেনে খারাপ নেই তো।

 

তুমি আসলে নীলমাধবকে ভয় পাও অনুতোষ, কিন্তু সে একজন রাজাকারের ছেলে, তার সব কীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে, পালোধী ডাক্তারও  বলেছে লোকটা  ভাল না।  

 

এতক্ষণে আসল প্রসঙ্গে এসেছে। আমি মাথা নাড়লাম ধীরে ধীরে। কথা অস্বীকার করতেও পারি না, আবার স্বীকার করতেও পারি না। চুপ করে থাকলাম। জুড়ান বলল, ডাক্তার পালোধীর কথা কাকে বলি, তোমাকেই বলতে পারি, তাই বললাম। একটু চুপ করে থেকে জুড়ান আবার জিজ্ঞেস করল, নীলমাধব কি জানতে পেরেছে ?

 

কী জানবে? বিরক্ত হলাম আমি। 

 

মানে রোববার তুমি আমার কাছ থেকে খবর নাও? জুড়ান জিজ্ঞেস করল, নীলমাধব চিন্তায় আছে। 

 

জুড়ান উদ্বিগ্ন গলায় বলল, মনে হয় নীলমাধব  আন্দাজ করেছে কিছু, এতদিনে ভয় পেয়েছে। 

 

তোমাকে বলেছে কিছু? আমি না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।

 

আমাকে বলবে কী, আমি ওর ধারকাছ ঘেঁষি না,  কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, দেখ অনুতোষ, এরা হল বাঘের মতো, ঠিক গন্ধ পায়।

 

আমি বললাম,  বাঘ গন্ধ পায় না, হরিণ পায় ঘাপটি মেরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাঘের গায়ের বোঁটকা গন্ধ।

অদ্ভুত এক  গল্প  জুড়েছে সে। এও পালোধী সেও পালোধী, একজন কোয়াক ডাক্তার, অন্যজন সন্দেহভাজন। এরা জ্ঞাতি হতে পারে, নাও হতে পারে, কিন্তু তার কাছেই গিয়েছিল নীলমাধব ব্যাংকক থেকে ফিরে। তা জুড়ান জানল কী করে?  জুড়ান বলল, সে বারাসতের ডি এম অফিসে এত বছর আছে, সে জানবে না তো কে জানবে?  তার নেটওয়ার্ক আছে। প্রতিদিন দুই জিবির মতো ডেটা পায় সে।  নেটওয়ার্ক  শক্তিশালী।

কথাটা ঠিক পছন্দ হল না জুড়ানের। বলল, তাই বলে নীলমাধব তো হরিণ হবে না। ও আসলে বাঘই। ঝোপে বসে লক্ষ্য করছে  শিকার কোন দিকে যায়। মাপ ঠিক করে নিচ্ছে। এক লাফে  ঘাড়ে গিয়ে থাবা মারবে। কিন্তু নীলমাধবের মাপ ঠিক হবে না। তার আগেই ধরা পড়ে যাবে বসির মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। 

বসির মল্লিক কে? আমি  নতুন একটি  নাম শুনলাম। 

কুখ্যাত রাজাকার, রেপিস্ট আর পাক বাহিনীর চর, কত গণ হত্যার পিছনে ওর হাত ছিল, ভাবতে পারবে না।

বুঝতে পারলাম না।  আমি বললাম। 

তুমি জান না কিছুই অনুতোষ, সেই জন্য তোমাকে ইন্টারনেট শিখতে হবে, ইন্টারনেটে সব আছে, দেখবে ছবি?

কোন ছবি?

বসির মল্লিকের ছবি, কম বয়সের, ওর নামে হুলিয়া আছে, রাজাকারের লিস্টে ওর নাম উপরের দিকে, কুড়ি বছর ইণ্ডিয়ায় আছে।

তুমি যে বলেছিলে মুজিবের হত্যাকারী?  আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

না, ঠিক তা নয়, তবে পার্ক স্ট্রিটে লুকিয়ে থাকা সেই মাস্টার,  হত্যাকারীর সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল এপারে, একই বয়সী তো, দুজনে প্রায় এক সঙ্গেই ভারতে এসেছিল। 

তোমার ভুল হচ্ছে না তো ?  জিজ্ঞেস করলাম। 

একদম না, এই দ্যাখো।  মোবাইল ফোন বের করল জুড়ান রায়, বলল, এই দ্যাখো কুখ্যাত রাজাকার বসির মল্লিকের  কম বয়সের ছবি, এরই দোসর ছিল নীলাম্বর পালোধী, নীলাম মোল্লা হয়েছিল যে মুক্তিযুদ্ধের সময়। বলতে বলতে জুড়ান ফোটো গ্যালারি খুলে এক যুবকের সাদা কালো ছবি দেখাল। গালে চাপ দাড়ি, নিরীহ মুখ। বাম চোখের নিচে ক্ষত চিহ্ন। কিন্তু এই ক্ষতচিহ্ন তো ঢ্যাঙা লোকটির মুখে দেখিনি। ঢ্যাঙা লোকটির ছবিও পাশে রয়েছে। খুলে দেখাল জুড়ান। একবার এইটা, আর একবার ওইটা।  একদম মিল নেই। ক্ষতচিহ্নটিও নেই। সেই প্রশ্ন তুললে  জুড়ান বলল, প্লাস্টিক সার্জারি করে ঐ দাগ মুছে দিয়েছে, কিন্তু ধরা পড়বেই, আর ধরা পড়লে সব ফাঁস হয়ে যাবে।  

আমি বললাম , কিছুই মিলছে না জুড়ান, কার সঙ্গে কার মিল দেখছ? 

মিলবে, মিলবে, মিলবে, যখন মিলবে, হতবাক হয়ে যাবে, মানে বোবা হয়ে যাবে। জুড়ান পা নাচাতে লাগল তার কথা বলতে বলতে, তারপর একটু থেমে বলল, তুমি কি চঞ্চলচন্দ্রের কথা জানো কিছু ?

মাথা নাড়লাম, উঁহু, জানি না, শুনেছি খুব অহঙ্কারি লোক।

কে বলেছে, নীলমাধব তো, দ্যাখো  আসলে নীলমাধবই অহঙ্কারী, আমাকে দয়া করে  যেন  ওর বশংবদ করতে চায়, আমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি জুড়ান রায় সেই লোক নয়, ওর করুণা প্রার্থী নয়, তুমি ফরিদপুর আমি যশোর, ফরিদপুরের  রাজাকারের সঙ্গে আমি কেন গলাগলি করব।

থাক জুড়ান, তুমি চঞ্চলচন্দ্রের কথা বলো বরং। আমি থামাতে চাইলাম। 

জুড়ান বলল, উনি সারা পৃথিবী ঘুরেছেন।

আশ্চর্য! দেখলে তো বোঝা যায় না।

দেখলে কী বোঝা যায় অনুতোষ, কিছুই না, মনে হয় বসির মল্লিক বসন্ত মল্লিক হয়ে বাস করছে ইন্ডিয়ায়, আবার  পার্ক স্ট্রিটের মাস্টারবাবু শেখ মুজিবকে হত্যা করে পাকিস্তান, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, কানাডা–কোথাও আশ্রয় না পেয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে উলুবেড়িয়ায় বিয়ে করে সংসারে মন দিল, এসব কি দেখলে বোঝা যায়?

কথাটা সত্যি, তবু  বিদেশ ঘোরা লোককে দেখলে কি বোঝা যায় না ?

জুড়ান বলল, তুমি কি জানো চঞ্চলচন্দ্র  কটা বিদেশি ভাষা জানেন, হিব্রুও, হিব্রু ভাষা নাকি খুব কঠিন ভাষা, উনি জেরুজালেম গিয়েছিলেন, যিশুর সমাধি  দেখে এসেছেন। 

তোমার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ আছে ?

ইয়েস, আমরা ফেসবুক  ফ্রেন্ড নই  শুধু, দেখাও হয়, কথাও হয়। বুক চিতিয়ে  বলল  জুড়ানচন্দ্র।  জবাব শুনে মনে হল, নীলমাধবকে হারিয়ে দিয়েছে ও। নীলমাধব চঞ্চলচন্দ্রের, প্রত্যাখ্যান পেয়েছে শুধু।  কিছুদিন নাকি ব্লক করে দিয়েছিল চঞ্চল। তার মানে নীলমাধব দেখতেই পেত না চঞ্চলকে। সব বলছে জুড়ান।



Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *