আলপনা আসলে উৎসবের গপ্পো। ফলে যেমন যেমন উৎসব তেমনই সব আলপনা। তবে এর উৎস বোধহয় লোকসংস্কৃতি আর আদিবাসী জনজাতির শিল্প চেতনা ও তার প্রকাশ। বাংলার গ্রাম্য জীবনে লৌকিক দেবদেবীর পুজো এবং নানা রকম ব্রত উদযাপনে যে আলপনা, তা সাধারণত মাটির দাওয়ায় বা মাটির বেদিতেই দেওয়া হয়। রং তুলি লাগে না। আতপচাল বেটে গুলে নিয়ে, ন্যাকড়া পাকিয়ে তুলির মতো ধরে বা সরাসরি ডান আঙুলের মধ্যমাকে কাজে লাগিয়ে লতাপাতার নক্সা আঁকা হয়। মাটির দাওয়াতে সাদা রং শুকিয়ে ফুটে উঠলে তা এক বড় আয়োজন হয়ে দেখা দেয়। আর ঘরের মধ্যে যে পুজোর আসন বা বেদি থাকে, সেখানেও আলপনা এঁকে তার ওপর ঠাকুর সাজানো হয়। আলপনার ওই সাদা আঁকিবুঁকির জন্যই ঘরের অন্যান্য আসবাবের মধ্যেও ছোট্ট পরিসরেও ঠাকুরের আসনটুকু বিশিষ্টতা পায়।
গ্রামেগঞ্জে যেখানে এখনও ধানের গোলা আছে, নতুন ধান গোলায় ভরার সময় সেখানেও শাঁখ বাজিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। এছাড়াও দেবদেবীজ্ঞানে কিছু গাছ ঘিরে একটু উঁচু বেদি করেও আলপনার চল এখনও আছে– যেমন তুলসি, কাঁটা মনসা বা অশ্বত্থ গাছ। কেউ কেউ দাওয়ার নীচে প্রিয়জনদের ভস্মাধার রেখে মাটি লেপে আলপনা দিয়ে রোজ ফুল সাজান। এইসব ব্যক্তিগত যাপনই ক্রমে সামাজিক যাপন হয়ে উঠেছে। লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় সব ঘরেদোরেই শঙ্খলতা, পা–পদ্ম, ধানছড়া, গাছকৌটো আর পেঁচা আঁকা হয়। ধানের গোলাতেও তাই। মনসার আলপনায় সাপ থাকবেই। নারায়ণ বা শিবের পুজোয় অবশ্য এসবের চল দেখিনি। ব্রত পার্বণেই মূলত আলপনার সাগ্রহ বিকাশ।

নকশার ক্ষেত্রেও আঁকাবাঁকা লতার মতোই, আরও একটি হল ছোট বৃত্তকে অর্ধ বৃত্তে ভেঙে ভেঙে বড় করে এঁকে, তার খাঁজে খাঁজে দুর্বার মতো দুটি করে শিখা। একে কেউ বলে পদ্ম, কেউ বলে চক্র, কেউ বলে চিহ্নিত আসন। এসব নক্সার আভাস মেলে গ্রাম্য নকশি কাঁথাতেও। এর কোনও ক্লাস বা কোচিং নেই; পরম্পরায় শেখা ঘরকন্নার অংশ। তারই মধ্যে কারও হাতের টান, মিহি, কারও বা ধ্যাবড়া। তবে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, তাই আলপনাটাই মুখ্য। পিটুলি গোলার এইসব সাদা আলপনায় রঙ বলতে তেল সিঁদুরের ফোঁটা।
গৃহপ্রবেশ বা অন্যান্য শুভ কাজে দেওয়ালে যে আলপনা, তাতে আঙুল দিয়ে আঁকা হয় স্বস্তিক ও বসুধারা, যার সবটাই তেল সিঁদুর ও হলুদ দিয়ে রাঙা। বিয়ে বা উপনয়নের পিঁড়ি আলপনাতেও লাল হলুদ রঙ থাকে। আর কনেচন্দনে কপালে যে আলপনা সে তো বাটা চন্দন রংয়েরই হয়। আদিবাসী মানুষেরা ভালবাসেন দেওয়াল চিত্র। তাঁদের মাটির বাড়িগুলির বাইরের দেওয়ালগুলি নীচে থেকে অর্ধেক রং করা কালো আলকাতরায়, আর বাকিটা লালচে বা গেরুয়া মাটির। দুটি রঙের ওপরেই তাঁরা নকশা আঁকেন সাদা দিয়ে। ফুল, লতা, গাছ, পশুপাখি ছাড়াও মানুষ এবং বাদ্যযন্ত্রের ছবিও থাকে। শুধু যে সামনের দেওয়ালে এমন নয়, চার দেওয়াল জুড়েই মনোরম সব নকশা ও চিত্র।
বাংলা ছাড়িয়ে উড়িষ্যার দিকে যতই যাওয়া যায়, আলপনায় রংয়ের বাহার ততই বাড়ে। ক্রোম ইয়েলো এঁদের পছন্দের রং, হলুদ দেওয়ালে বাদামি নকশা আঁকা। সেটা আবার বাড়ির ভেতর দেওয়ালে। রঙের গোলায় ডোবানো তর্জনী, মধ্যমা এবং অনামিকাকে একসঙ্গে দেওয়ালে ঠেকিয়ে সমানভাবে টানা; অনেকটা ওই ড্র টেবলের মতো। যেখানে রং ফুরলো সেখান থেকে আবার টান। ফলে ওই সামান্য আঁকাবাঁকা রেখাগুলোই আলপনা হয়ে যায়। লম্বা টানা এই রেখাগুলিকে সাজানো হয় মধ্যমার ফোঁটা বা বুঁদি দিয়ে। এসব অঞ্চলের আদিবাসীরা হলুদ মাটির দেওয়ালে সবুজ রঙও ব্যবহার করেন। এঁদের যে বিশেষ উৎসব ‘রজ’ (অম্বুবাচীর মতো) সেদিন মেয়েরা আলপনায় ঘর উঠোন সাজায়; বিশেষত ব্রতের অঙ্গ– উঠোনের দোলনাতলায় সাধ মিটিয়ে গয়নার নকশা এঁকে। এখানকার পোড়ামাটির হাঁড়ি, কলস ও থালাতেও থাকে কালোরঙের আলপনার নকশা, যেগুলি জলে ধোয় না।

বিহার, ঝাড়খণ্ডেও আলপনার চল দেখেছি। নানারকম জ্যামিতিক নকশার সঙ্গে পাখি আঁকতে খুব ভালোবাসেন এঁরা। এঁদের আলপনায় নানা রংবাহার এবং শুকনো চালের তিলক। কার্ত্তিক মাসে ঘরের সামনে যে ছোট্ট মাটির বাড়ি করে পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ জ্বালেন এঁরা, তার গায়েও থাকে সাদা রঙের নানা কারিকুরি। আলপনা দেওয়ার রীতি দক্ষিণ ভারতেও খুব বেশি দেখা যায়। তবে তার নাম রঙ্গোলি। ঝুরো রঙের হররঙ্গি নকশা। নকশা অনুযায়ী ফুটো ফুটো পেতলের বা কাঠের রঙ্গোলী বাক্সের মধ্যে রং ভরে নাড়ালেই নকশা ফুটে ওঠে। অনেকে হাত দিয়েও আঁকেন। এ প্রদেশে ফুলের আলপনা প্রায় তুলনাহীন। নানা রংয়ের বড় ফুল, পাপড়ি ও ঝুরো ফুল দিয়ে মস্ত মস্ত বাহারি নকশা। এমনই হয় নানা ফুলের মালা সাজিয়ে সাজিয়ে চমৎকার সব রঙিন আলপনাও।
আলপনা বলতেই মনে পড়ে আমার চিত্রী বাবার সরাসরি তুলি ধরে আঁকা, ঘরজোড়া সব আলপনা। বিশেষত পঁচিশে বৈশাখের সাজানোয়। সাদা আর গেরি মাটির রঙে সরু আর মোটা তুলিতে মূলত কল্কা আর বুঁদি। সে আঁকা দেখে মনে হত ম্যাজিক। শুরু থেকে শেষ যেন একটা ঘোরের মধ্যে আঁকা। আমাদের ছোট পিসিমাও তুলি ধরে সুন্দর আলপনা দিতেন; যে কোনও অনুষ্ঠান ছাড়াও, দাদা দিদিদের জন্মদিনেও। ঘরের যে সব কোণে পা পড়ে না, সেখানেও আলপনা দেওয়া থাকত। মাসিরাও আলপনা আঁকতেন। তবে তাঁরা আবার অনেক সময় একটা নকশা ছোট কাগজে আগে এঁকে রাখতেন। বড়মামা, সেজমামার আলপনা তো বাঁধিয়ে রাখার মতো সুন্দর হত। এঁরা সবাই সাদা আলপনাই দিতেন।

বাড়ির চারবারের বাৎসরিক লক্ষ্মীপুজোয় ঠাকুমা যে আলপনা দিতেন, তা একেবারে সাবেক ব্রতকথার নকশা। তার সঙ্গে যে কত গপ্পো জুড়ে থাকত। পিটুলিগোলা দিয়ে লক্ষ্মীর জলচৌকিতে আঁকা হত একটা গোলের মধ্যে একজোড়া পা-পদ্ম; তারপর সে গোলটাকে অর্ধবৃত্ত দিয়ে ভেঙে ভেঙে পৌঁছে যাওয়া চৌকির ধারে। ওই আঁজি আঁজিগুলোই নাকি ‘চঞ্চলা ঠাকরুনে’র বেড়া, যাতে তিনি না পালান। এই নকশার ওপর বসানো হত কুনকের ওপর চেলি পরা ধান্যলক্ষ্মী, দু’পাশে দুটি রংকরা পেঁচা, আর চারকোণে চারটি লাল রঙের গাছকৌটো। তার আগে চৌকির নীচে একটা বাক্স এঁকে, নানা নকশায় তাতে ফুটিয়ে তোলা হত হরেক ছাঁদের গয়না। ঠাকরুণের পছন্দ হলে সেটি নাকি তিনি বাড়ির সিন্দুকে রেখে যান।
চৌকি চাপা দিয়ে গয়নাগুলি আড়াল করে, এবারে চৌকির দু’পাশে আঁকা হত দু’টি ধানের গোলা এবং সে দুটির সামনে আবার দুটি পাহারাদার পেঁচা। এই সমস্ত আলপনার ওপর ছড়ানো হত এক মুঠো করে ধান আর কয়েকটা করে কড়ি। লক্ষ্মীর আসন পাতা হয়ে গেলে চৌকির মাঝবরাবর শঙ্খলতার দু’পাশে এমন করে পা-পদ্ম আঁকা হত, যেন তিনি পায়ে পায়ে ঘরে এসে বেদিতে আসীন হয়েছেন। মঙ্গলঘট, নারায়ণের সিংহাসন এবং পুরুতের আসনের নীচেও থাকত আলপনা; এমনকী তা আঁকা হত প্রতিটি নৈবেদ্যর থালার নীচেও।

এছাড়াও সেদিন ঘরের প্রতিটি চৌকাঠ, ঠাকুরঘর ও সিঁড়ির দুপাশেও শঙ্খলতা ও পা-পদ্ম আঁকা হত। ভাদ্রমাসে মনসা–লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় বিশেষভাবে আঁকা হত সাতটি সাপ; আর প্রতিটি সাপের ওপর বসানো হত মাটি দিয়ে গড়া একটি করে ফণাতোলা সাপ; তাদের প্রত্যেকের মুখের সামনে ছোট ছোট দুধকলা দেওয়া পাথরের বাটিগুলিও বসানো হত গোল গোল আলপনা এঁকে। ঠাকুমার দু’পাশে শুয়ে সারারাত ভয়ে মরতাম দু’বোনে। ঠাকুমার সঙ্গে জুটে আমরা দু’বোন এইসব আলপনা আঁকাই আগে শিখেছি; পরে শিখেছি কল্কা ও অন্যান্য শৌখিন নকশা।
বাগবাজার মাল্টিপারপাস ইশকুলের বড় ক্লাসে পেলাম শিবানীদিকে। অপূর্ব শান্তিনিকেতনী আলপনায় ইশকুল সাজিয়ে দিতেন। আমাদের ক্লাসের জয়শ্রী তাঁর তালিম আত্মস্থ করেছে। সে তার দিল্লির কর্মজীবনে নাম করা ইশকুলের বড়দিদিমণি হয়েও সমানে আলপনা এঁকে গেছে যে কোনও উৎসবে। আমাদের বন্ধু গ্রুপে জন্মদিন মানেই তার আঁকা একখানি আলপনার কার্ড। আমাদের ছাত্রজীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজে এসবের চল ছিল না; তবে আমাদের বিভাগে নবীনবরণে নিজে থেকেই আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম, আলপনার ওপর মাটির পিলশুজ, থালায় ফুল রেখে, আয়োজন করে অনুষ্ঠান সাজাবার। রাত্তিরে বাড়ি বসে সবে আঁকব ভাবছি, এমন সময় আর্ট কলেজে পড়া বন্ধু অশোক ভৌমিক বাড়িতে এলো। রং তুলি ছড়িয়ে বসা দেখেই তুলি ধরে নানা রঙে যা এঁকে দিল সে একবারে মডার্ন আর্ট। আমি তো ভেবে আকুল যে এর সঙ্গে কোন মানানসই আলপনা আমি মাটিতে আঁকব! গুম মেরে, রাগ হজম করে, সে সব নিয়ে কলেজে পৌঁছে দেখি, অশোকদা আমার জন্য কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সঙ্গে আমাদের বিভাগে গিয়ে মানানসই একটা আলপনা এঁকে আমার মুখে হাসি ফোটাল।

স্থপতি অরুণেন্দুদার সূত্রে আলাপ হয়েছিল গ্রাম্য লোকশিল্পী রবি ওঝার সঙ্গে। সে তার দিদিমার কাছ থেকে শিখে গ্রামবাংলার ব্রত আলপনা দিয়েই শহরের দেওয়াল সাজায়। এটাই তার রুজি এবং শখও বটে। তবে সব ছাপিয়ে মনে পড়ে, আমার অকালপ্রয়াত সহকর্মী ভাস্কর সুনন্দা দাসের কথা। কলাভবনের ছাত্রী সুনন্দা রঙ তুলিতে যেমন আলপনা আঁকত, তেমনই সাজিয়ে দিত ফুলের আলপনা; সঙ্গে আবার নানারকম পাতা। সে সবও গল্প হয়ে রয়ে গেল, সবার মুখে মুখে।
লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসীদের আলপনা ও দেওয়ালচিত্র আঁকার এই যে ধারা, রবীন্দ্রনাথ এটি গ্রহণ করেছিলেন, দু’হাত বাড়িয়ে। আর তাকে রূপ দিয়েছিলেন নন্দলাল বোস। ফলে শান্তিনিকেতন এমন এক নতুন ঘরানার জন্ম দিল, যেখানে আলপনা হয়ে উঠল মূলধারার শিল্প। আর এর ব্যবহারে যুক্ত হল মন। সেইজন্যেই চৈত্র অবসানে এখানকার উপাসনা মন্দিরের অনুষ্ঠানে আঁকা সাদা আলপনাটাকেই রঙ দিয়ে ভরিয়ে, রঙিন শুভেচ্ছায় আহ্বান করা হয় নতুন বছরকে। এখানেই অনেকের বাড়িতে পাতার মধ্যে আলপনা এঁকে দেওয়াল থেকে ঝুলিয়ে সাজাতেও দেখেছি। প্রতিটি ত্রিপত্রী বেলপাতায় আলপনা এঁকে, তাই দিয়ে গাঁথা এক বিশাল মালাও দেখেছি বেলুড়মঠের পুজোয়, মা দুর্গার গলায়।
ঘরে ঘরে এখন সবাই যেমন একদিকে আলপনার স্টিকার ব্যবহার করে দায় সারছে, অন্যদিকে আর এক দল যোগ দিচ্ছে আলপনা আঁকার প্রতিযোগিতায়। এমনকী বিয়ের পিঁড়ি থেকে কনেচন্দন, সবেতেই স্টিকার। তবু এর মধ্যেই কোথাও নিজস্ব অভিধান মেনে জেগে আছে সাগ্রহ আঙুলের স্পর্শে নানা প্রদেশে, নানা রঙ বাহারে, ভিন্ন ভিন্ন নকশায় আলপনার আঁকিবুঁকি আর রূপকথার আবেশ জড়ানো গপ্পো। আর আমার মেয়ের জীবনযাপন ও অনুষ্ঠানে বড় আদরে বজায় আছে একইসঙ্গে তার হাতের আলপনা ও রঙ্গোলীর আয়োজন।
ছবি সৌজন্য: শ্রী সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী, Pinterest, Holidify
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।