দু’জনে মিলে কথা ছিল আনএক্সপ্লোর্ড গোয়া দেখব, দিদি আর আমি…
দিদি এদিক ওদিক ঘুরে শেষে গোয়ার স্থায়ী বাসিন্দা। সেবার গেলাম গোয়া। পৌঁছনোর পরদিন থেকে ঘুরে বেড়ানোর কথা। দিদির সঙ্গে কিম্বা একা স্কুটিতে। একা ঘোরার প্ল্যানটা গোমড়ামুখে দাদা তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দেয়। পানাজির সমস্ত স্কুটিই নাকি খারাপ, এবং সমস্ত পুলিশ রাস্তায় আমায় ধরতে পারে বলে। মনের দুঃখে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন আমার বডি ক্লক ভোরে উঠিয়ে দেয়। এদিকে ওই পশ্চিম দিকটা প্রায় আলাদাই টাইম জ়োন। সাড়ে ছটা, তাও অন্ধকার, আবার মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুম। সেই যে ঘুমোলাম, ব্যাস, আনএক্সপ্লোরড গোয়ার বারোটা…
যাইহোক ঘুম ভাঙতেই, চা নিয়ে আড্ডা শুরু দিদির সঙ্গে। বিস্কিট-চা-আড্ডা, কাজু-চা-আড্ডা লুপে চলছে। সকাল গড়িয়ে মাঝ দুপুর, ভাত টাত কিছুই হয়নি। আরাম করে গল্প শুনছি। অনেক আগে গোয়া বেড়াতে এসে পর্তুগিজ গ্রামে গিয়েছি। তবে সে তো তাড়াহুড়ো করে। কিন্তু দিদির মুখে গঞ্জালভেজদের বাড়ি গত কাল পরশু কী রান্না হয়েছিল, কিম্বা সিলভাদের বাড়ির বউ ঠিক কটা ব্যবসা শুরু করল আর কী কী ড্রেস কিনল সে গল্প, পর্তুগিজ আর অন্য গোয়ানিজ বাড়ির আর্কিটেকচারের তফাৎ বুঝতে তাদের বাড়ি ঘুরে আসার প্ল্যান.. সে সব করতে করতে বেশ নিজেকে ভাস্কো ডা গামার প্রতিবেশী প্রতিবেশী মনে হচ্ছিল! মনে হচ্ছিল চুলোয় যাক রান্না, এই তো! চোখের সামনে, ভায়া আটলান্টিক, ইউরোপ আর এশিয়ার মিলন ঘটছে দেখছি!

আচমকা “নাহ, এত বেলা হল, কিছু একটা লাঞ্চ না বানালেই নয়” বলেই আড্ডার তাল কেটে দিয়ে দিদি উঠে গেল। আর হাতে ধরিয়ে গেল কেকের মতো কিছু একটা…
“নে ততক্ষণ আর এক টুকরো পর্তুগিজ ভালোবাসা…”
দেখতে ওপর থেকে আহামরি কিছুই না। ধার থেকে দেখলে অনেকগুলো স্তর। জাস্ট চামচ দিয়ে কেটে একটু মুখে দিয়েছি, দিদি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে গেল.. “কী রকম?” গোয়ায় আগে এসে অনেক কিছু খেয়েছি। ভিন্ডালু, কিং ফিশ, বেবি শার্ক, দোদল, নারকেলের মিষ্টি কোকাড় আর অবশ্যই কাজু ফেনি। কিন্তু যেটা মুখে আছে, সেই অতি সাধারণ দেখতে খাবারটির স্বাদের কোনও তুলনাই নেই.. নাম কী এর?
রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দিদি বলল,
“বেবিংকা, কুইন অফ গোয়ান ডেসার্ট। রেসিপি চাই তো? কাল নিয়ে যাব চেনা দোকানে, দেখবি কীকরে বানাচ্ছে..”
পরদিন, দিদির ছানা কে ইস্কুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দিদির মতে, গোয়ার মাছের বাজার না দেখলে কিছুই দেখা হল না! সুতরাং তালিকার প্রথমেই মাছ! সেই যে জেলেদের মাছ ধরার সৈকত দিয়ে ভ্রমণ শুরু, তারপর পানাজির মাছের বাজার। একদম নারীপ্রধান মাছ বাজার, কয়েক হাজার রকমের মাছ তারা প্রবল বিক্রমে বিক্রি করছে! তাক লেগে গেল। আরে বাঙালি আফটার অল! মাছ দেখলেই মনটা চাঙ্গা! তাও মাথায় ঘুরছে, বেবিংকা। সেদিনের শেষ পর্বে এসে, দিদি খানিকটা মন বুঝেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে দাঁড়াল একটা পুরনো দোকানে। মিষ্টি আর বিস্কিটের দোকান, দেওয়াল একটু ময়লা হলুদ রঙের, কিন্তু ভীষণ ভীড়। বোধহয় নতুন রঙ করারও সময় নেই।

দিদি ভিড় পাত্তা না দিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল। তারপর? বাকি দিনগুলো কী কী করলাম, আর যাবতীয় গল্প সব কিছু আর নয়, সোজা বেবিংকাতে যাই বরং… ওটা বলতেই তো আসা! ওই দোকানের পর্তুগিজ লোকটির কাছে শোনা বেবিংকার গল্প আর রেসিপি…
ভদ্রলোকের কথায়, প্রচলিত গল্পটি হল, বেবিংকা প্রথম নাকি, সপ্তদশ শতাব্দীতে ওল্ড গোয়ার কনভেন্ট অফ সান্তা মনিকা নাকি বেবিয়ানা নামে এক নানরুটির উদ্ভাবন করে। সাতটি স্তর দিয়ে প্রথম বানিয়ে সেখানকার যাজকদের খাওয়ান। ওঁদের অনুরোধে আরও স্তর যোগ করা হয়… যদিও কতটা সত্যি সেটা হলফ করে বলা যায় না। আরো মজার ঘটনা জানলাম, আগের দিনে ওল্ড গোয়াতে ডিমের সাদা অংশ দিয়ে কাপড়ে মাড় দেওয়া হত, তাই অনেক কুসুম বেঁচে যেত। সেগুলো ব্যবহার করতেই এই খাবার উদ্ভাবন, কোনও কিছুই ফেলা গেল না, ওদিকে পর্তুগিজরা গিফট করল দারুন এক মিষ্টি..
আসি এবার প্রস্তুত করার গল্পে… বেবিংকা বেক করতে ফেলে দেওয়া নারকেল ছোবড়া ব্যবহার করা হত। এক একটা পাতলা স্তরের ওপর ঢাকা দিয়ে তার ওপর আগুন দেওয়া নারকেল ছোবড়া বসিয়ে দেওয়া হত… ঢিমে আঁচে এক একটা স্তর বহুক্ষণ ধরে রান্না হত। আমরাও রান্না করব এমন ওভেনে যেখানে গ্রিলটা ওপরে দেওয়া..

সব তথ্য সংগ্রহ করে ফেরার পথে দুনিয়া ঘোরা দিদি, যথারীতি হোমওয়ার্ক ধরিয়ে দিল… “বানাবি যখন, দেখিস তো, এর সঙ্গে জার্মান বমকুহেন আর রাশিয়ান মেডোভিক এদের কি মিল..” সে যাকগে। এদিক ওদিক কথা না বাড়িয়ে, আসি মাপজোক আর পদ্ধতিতে…
মাপ:
৪০০ গ্রাম নারকেলের গাঢ় দুধ
৩০০ গ্রাম চিনি
১৮০ গ্রাম ময়দা
৮ টা ডিমের কুসুম
২/৩ কাপ ঘি
১ চা চামচ জায়ফল গুঁড়ো
এক চিমটে নুন
ক্যারামেলের জন্যে
২ টেবিল চামচ চিনি
২ টেবিল চামচ জল
জল চিনি মিশিয়ে কড়ায় নাড়তে হবে, যতক্ষণ না কফির মতো রঙ হবে, তাহলেই ক্যারামেল রেডি! ঠান্ডা হতে দাও।
এর পর, ডিমের কুসুম আলাদা করে, তাতে চিনি মেশাও ভালো করে, ওই হ্যান্ড বিটারে। তারপর একে একে, নারকেলের দুধ, একটু করে ময়দা, পুরো মিশে গেলে এক টেবিল চামচ ঘি, এক চিমটে নুন, আর জায়ফল গুঁড়ো মিশিয়ে ব্যাটার রেডি। ব্যাটারটা দু’ভাগ করে নিয়ে একটা ভাগে ক্যারামেল মিশিয়ে নিতে হবে। তাহলে একটা গাঢ় রঙের আর একটা হালকা রঙের ব্যাটার হবে। ছবি তে ঘনত্বটা বোঝানোর চেষ্টা করা আছে। তার পর প্যানে ঘি বুলিয়ে সাদা ব্যাটার আট চামচ ঢেলে দেওয়া, নীচে পাতলা করে লেয়ার হল। ওদিকে ওভেন ১৮০°C –এ প্রি হিট করা, তাতে প্যান গেল, ১৫ মিনিটের জন্যে…

বেরিয়ে এলে, ওপরে ঘি বুলিয়ে, আবার আট চামচ ক্যারামেল ব্যাটার এর লেয়ার… আবার ১৫ মিনিট বেক! এভাবে, ঘি বুলিয়ে প্রতি লেয়ার ১৫ মিনিট বেক হবে! আমি ১৪ টা লেয়ার করেছি। কিন্তু তাতে প্রায় চার ঘণ্টা লাগল! লাগলেই বা, তার মাঝে রোজকার রান্না, রোজকার বাকি কাজ ও সারা..
জাস্ট একটু ধৈর্য্য আর একটু সামান্য শ্রম, ব্যাস, বেবিংকা রেডি!
পানাজিতে যতদিন ছিলাম, রোজ একটু করে বেবিংকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম হাঁটতে। কখনও জেলেদের পাড়া, কখনও ডোনা পাওলা… সব শেষে বিচে এসে সূর্যাস্ত দেখা, মুখে বেবিংকার টুকরো… দূরে কোনও জাহাজ তখন ভাস্কো-র স্মৃতি নিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে…
সমস্ত ছবি ও রান্না সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।