পশুপাখিদের দেহাংশ ব্যবহার করে অলঙ্কার তৈরির প্রাচীন বহু সভ্যতায় প্রচলিত ছিল। বড় গুবরে জাতীয় পোকার খোলস অলঙ্কার হিসেবে মিশরীয় ও আজটেক রাজ পরিবারের সদস্যরা যেমন ব্যবহার করতেন, তেমনি সবজে-সোনালি স্কারাব বিটলসের (বাংলায় যাকে বলে কাচপোকা) খোলস গুঁড়িয়ে তৈরি আইশ্যাডোও মিশরীয়দের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তবে জীবন্ত গুবরেপোকা ধরে অলঙ্কার হিসেবে পরার ট্রেন্ড শুরু হয় ব্রিটেনের মহারানি ভিক্টেরিয়ার আমলে। মেক্সিকো-র ইউকাতান শহরে এখনও লিভিং ব্রোচ বিক্রি হয় দেখেছি।
১৮৯১ সালের ঘটনা। ব্রিটেনের একটি দৈনিক পত্রিকা ‘এন্টেমোলজিক্যাল নিউজ’-এ একটি অদ্ভুত খবর প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা ছিল যে জনৈকা মিসেস ডিজোন্স তাঁর পোষ্য গুবরে পোকার পিঠে আঠা দিয়ে বড়সড় একটি হীরের টুকরো লাগিয়ে, পোকাটিকে তালিম দিয়েছিলেন তাঁর গলার কাছে নেকলেসের আকারে উড়ে বেড়াতে। এ যুগের মানুষ হিসেবে একইসঙ্গে এহেন উড়ন্ত এবং বিমূর্ত নেকলেস আমাদের চোখে উদ্ভট মনে হতে পারে ঠিকই, কিন্তু ভিক্টোরিয়ান আমলের লন্ডনে এই জীবন্ত জুয়েলারি ছিল হটেস্ট ফ্যাশন ট্রেন্ডগুলির মধ্যে অন্যতম।
তবে বুঝতেই পারছেন, গুবরে পোকাকে পোষ মানানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অত সময় বা ধৈর্য্য ছিল খুব কম মানুষেরই। কাজেই চটজলদি বিকল্প ব্যবস্থাটি ছিল অন্যরকম। রংচঙে কাচপোকা, সোনাপোকা বা চকচকে খোলসের গুবরে জাতীয়দের ঢোকানো হল ছোট্ট সোনা বা রুপোর খাঁচায়, এবং তারপর এই খাঁচাটির সঙ্গে বিভিন্ন ডিজাইনের চেইন জুড়ে মেয়েরা তাদের কাঁধে ব্রোচ হিসেবে পরতে শুরু করলেন। অত্যন্ত ধনী পরিবারের মেয়েরা এই পোকাদের পাখায় লাগিয়ে রাখতেন হীরে-চুনি-পান্নার মতো ঝলমলে রত্ন। মেয়েদের ব্লাউজের ওপর পোকাগুলো তাদের খাঁচাসমেত হেঁটে বা উড়ে বেড়াত। সেটাই ছিল ট্রেন্ড! কেউ কেউ আরও এককাঠি উপরে গিয়ে চুলের খোপায় সূক্ষ্ম নেট দিয়ে ঢেকে ভেতরে জোনাকি ছেড়ে তৈরি করতেন লাইভ হেয়ারডু! ডিনার পার্টিতে সুন্দরীদের খোঁপার ওপর মিটমিটিয়ে জ্বলতে থাকা জোনাকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল অসাধারণ এক স্টাইল স্টেটমেন্ট। এর কিছুদিন পর মেয়েরা খোঁপার ওপর কাঁটা দিয়ে গেঁথে মরা প্রজাপতিও লাগাতে শুরু করেছিলেন।

কথা হচ্ছে, গুবরে, জোনাকী বা প্রজাপতি অবধি ব্যাপারটা আটকে থাকলে তাও একরকম ছিল। কিন্তু এরপরে যা শুরু হল, তা দেখলে হাসবেন না ভিরমি খাবেন বলা মুশকিল। নিজেকে ফ্যাশনদুরস্ত এবং সাহসি প্রমাণ করতে মহিলারা মাথায় পরতে শুরু করলেন আস্ত মোরগ, পাখির বাসা, ইঁদুর মুখে পেঁচা এমনকী ডিম থেকে সদ্য বেরনো ছানা সমেত সম্পূর্ণ ডিমের ক্রেট! বলাই বাহুল্য সেসব তো আর জীবন্ত অবস্থায় পরা সম্ভব নয়। মোরগের বয়েই গেছে মেয়েদের মাথার উপর এক ঠ্যাং তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে। অতএব শুরু হল ফ্যাশনের নামে পক্ষীনিধন। ছোট-বড় সমস্ত পাখির পেট চিরে পাকস্থলি ও অন্যান্য অংশ বের করে নেওয়া হত প্রথমেই। তারপর দেহের ভেতরে আর্সেনিকের মিশ্রণ মাখিয়ে রেখে দেওয়া হত কয়েকদিন। নির্দিষ্ট সময় পরে ভেতরের মাংস ও চর্বি ভালো করে শুকিয়ে গেলে পরার জন্য পাখি তৈরি। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে, পশু বা পাখিদের শবদেহ কাটা-ছেঁড়ার কর্মটি মেয়েরা নিজেদের হাতেই করতেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ভিক্টোরিয়ান ললিতলবঙ্গলতার মতো নারীরা, যাঁরা পান থেকে চুন খসলেই চমৎকার মুচ্ছো যেতেন, তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন মৃত পশুপাখির শরীর সংরক্ষণ অর্থাৎ ট্যাক্সিডার্মির ব্যাপারে রীতিমতো এক্সপার্ট।

ট্যাক্সিডার্মির প্রতি তাঁদের এহেন পক্ষপাতিত্বের পেছনে যুক্তিও ছিল খাসা। তাঁদের মতে, এ ছিল প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন! যে মানুষ যত ভালো মৃত পশুপাখি সংরক্ষণ করতে পারেন, তিনি তত বড় প্রকৃতিপ্রেমিক। মেয়েদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল আরো বেশি, কারণ তাঁরা ভাবতেন যে মৃত জীবজন্তুর শরীর সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীর স্বাভাবিক লালনপালনের ক্ষমতা আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। অতএব নিজেকে ভীষণ সংস্কৃতিমনস্ক ও দয়ালু, হৃদয়বান হিসাবে দেখাতে গিয়ে সেইসময়কার ধনী পরিবারের মেয়েদের জন্য ট্যাক্সিডার্মি হয়ে দাঁড়িয়েছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় শখ। প্রহসন আর কাকে বলে! বুঝতেই পারছেন, এভাবে টুপি, পোশাক, ব্যাগ, অলঙ্কার, হাতপাখা সবকিছুতেই ‘প্রাণের ছোঁয়া’ লাগতে শুরু করায় নির্বিচারে পাখি, পশু ও পতঙ্গহত্যা বাড়ছিল। রঙিন গুবরেদের চকচকে খোলস হয়ে উঠছিল রত্নের মতোই মূল্যবান। যত দুষ্প্রাপ্য গুবরে, তত দাম তার। তা দিয়ে যেমন তৈরি হত অলঙ্কার, তেমনি ধনী পরিবারের মেয়েরা মসলিনের গাউনের ওপরেও সেলাই করে বসাতে শুরু করলেন মৃত পতঙ্গের ডানা ও কঙ্কাল।
এই অদ্ভুত শখের মূল্য চোকাতে গিয়ে বেশকিছু পাখি ও পতঙ্গ জাতি বিলুপ্ত হতে শুরু করে। কিন্তু সমস্যা হল, এই যে মানুষের অন্যায় আবদার মেটাতে গিয়ে যে নিরীহ জীবজন্তুদের প্রজাতির পর প্রজাতি অবলুপ্ত হচ্ছে, এই বিষয়টা তখনকার দিনের লোকজন বিশ্বাসই করতেন না। ততদিনে ডারউইন সাহেবের কল্যাণে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলেছিল ঠিকই, তবে সেই জ্ঞান ছিল অতি সীমিত। বরং তাঁরা মনে করতেন, মৃত পশুর শরীর সংরক্ষণের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে তাঁরা সে প্রজাতিকে নবজীবন দান করছেন। মন্তাগু ব্রাউন-এর লেখা “প্র্যাক্টিক্যাল ট্যাক্সিডার্মি” বইটিতে লেখক পরিস্কার লেখেন যে,
“Society demands that objects of natural history should not be all relegated to the forgotten shelves of dusty museums, but live as “things of beauty and joys forever.” Hence the new alliance between the goldsmith and the taxidermist, resulting in a thousand ingenious combinations of nature and art.”
দীর্ঘ আটান্ন বছর এই ট্রেন্ড চলার পর শেষ পর্যন্ত ১৯২১ সালে মিস এটা লেমনের আন্দোলনের ফলে এই অকারণ প্রাণিহত্যা বন্ধ করতে শেষমেশ ব্রিটেনে ‘প্লুমেজ অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়। নইলে ভালোবাসার নামে এভাবে প্রকৃতিকে গলা টিপে মারার মতো এমন অপরাধ আরো কতদিন চলত কে জানে!
*তথ্যসূত্র: Smithsonian Magazine, Art in Dress, Why Victorian Natural History
*ছবি সূত্র: Pinterest, Vintage Everyday, Wikimedia
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।
তথ্যবহুল লেখা। অত্যন্ত সাবলীল। এরকম ব্যাপার যে ছিল এটা ভাবতেই অবাক লাগছে। লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের পত্রিকাতে ওঁর আরো লেখা চাই।