আমি সেই সুযোগে মুন্নিকে একটু সাইডে টেনে ভোরের ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছিল জানতে চাইলাম। মুন্নি যা রিপোর্ট দিল, তা সংক্ষেপে এইরকম: মুন্নির বাবা সম্প্রতি ফ্রান্স বা ইটালি- কোনও একটা জায়গা থেকে খুব দামি ক্রকারির সেট নিয়ে এসেছিলেন। ঝামেলা এড়ানোর জন্য উনি স্ত্রী এবং বাবার মধ্যে জিনিসগুলোর একটা সন্তোষজনক বাঁটোয়ারাও করে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, তাতে কেউই সন্তুষ্ট হননি। তাও, দিন একরকম চলে যাচ্ছিল। বিপত্তিটা বাধল আজ ভোরে যখন আশা তাক থেকে কাপ-ডিশগুলো বের করে মাজতে লাগল। ওই সময়টা মৃত্যুঞ্জয়বাবু রোজই আশার সঙ্গে কিছু না কিছু খুনসুটি করে থাকেন। কিন্তু আজ তিনি কিছু না বলে-কয়ে একটা ছৌ-নাচের মুখোশ পরে ওকে এন্টারটেইন করতে গেলেন। আশা তাতে আমোদিত হল, না ভয় পেল আশাই জানে। কিন্তু যতবার “টুকি’ বলে থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছিলেন, ততবারই সে ওনার দিকে ওই ইতালীয় বা ফরাসি কাপ একটা করে ছুড়ে দিচ্ছিল। এরকম দু-তিনটে কাপ খান খান হওয়ার পরে মুন্নির মা অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে আশাকে ঠাস করে একটা চড় মারেন। এবং মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে, সোজা বাংলায়, ধুইয়ে দেন। রিটার্ন ভলিতে মৃত্যুঞ্জয়বাবুও রতন এবং অন্যান্য অনেক প্রসঙ্গ টেনে ছেলের বউকে ল্যাজে-গোবরে করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আজ সুজাতা বউদি টপ ফর্মে ছিলেন। সেটা বুঝতে পেরেই হঠাৎ করে রণে ভঙ্গ দিয়ে তিনি ঘরে ঢুকে দরজা দেন। এবং দশ মিনিট পর বেরিয়ে এসে বেগন স্প্রে-র কৌটো এবং ফিনাইল-এর আধখানি বোতল দেখিয়ে ঘোষণা করেন যে, তিনি বেগন, ফিনাইল এবং কেরোসিন খেয়েছেন। ব্যস, একটি ইয়র্কারেই ছেলের বউয়ের মিডল স্টাম্প হাওয়া এবং শ্বশুরমশাই জিন্দাবাদ ।

ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু ওইসব অমৃত সেবন করেছেন সাড়ে ছটা নাগাদ। মানে, আধঘন্টা সময় অলরেডি চলে গেছে। রতন অধৈর্য হয়ে বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছিল, মৃত্যুঞ্জয়বাবু গম্ভীর মুখে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ওঘর থেকে আমার পাঞ্জাবি-পাজামাটা নিয়ে এসো তো।

আমি আনতে যাচ্ছিলাম। রতন আমাকে থামিয়ে মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে বাইরে বেরোতে বেরোতে বলল – “আপনি এই ভাঁজ করা ধুতি পরেই চলুন। ওসব পরে পৌছে দেওয়া যাবে।“ আমার দিকে তাকিয়ে বলল- “বাবলু, তোকে বোকা বললে অর্ধেকটা বলা হয়। যা ট্যাক্সিটা স্টার্ট করা।“ আমি তিনলাফে রাস্তায় নেমে ট্যাক্সির পিছন দরজা খুলে দাঁড়ালাম। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে হোল্ড-অলের মতো ভিতরে ভরে দিয়ে রতন নিজে সামনের সিটে গিয়ে বসল। আমি মৃত্যুঞ্জয়বাবুর পাশে বসতে ট্যাক্সির জানলা দিয়ে দেখলাম, সুজাতা বউদি কাঁদো কাঁদো মুখে আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটো যেন বলছে, তুমিই ভরসা। আমি ওনাকে বলতে গেলাম- পথে এবার নামো সাথী। কিন্তু ট্যাক্সি স্টার্ট নিয়ে নেওয়ার “পথ” আমার গলায় আটকে গেল।

— ভাই, লায়ালকার ভিতর দিয়ে গল্ফগ্রিন ধরে নেবে। আমি কিন্তু দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না।

ট্যাক্সিচালককে প্রায় ধমকের সুরে কথাগুলো শুনিয়ে রতন পিছনে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।

— তুই যে বললি, আসতে পারবি না? ম্যানেজ করলি কীভাবে?

— আজকে ডিপোর বাইরে বেরনোটা সত্যিই খুব টাফ ছিল। কিন্তু ফোনটা ছেড়েই মনে হল, এ তোর একার কম্ম নয়। তুই পারবি না।

আঁতে ঘা লাগল। বললাম- পারব না যদি জানিসই, তাহলে আর ফোন-টোন করে সময় নষ্ট করতে গেলি কেন? ডাইরেক্ট চলে এলেই পারতি।

— আরে ভাই, নিজে বেরতে পারব, তখন কি জানি? শেষটায় মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ইনচার্জকে গিয়ে বললাম, বাবার সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক। এই নিয়ে সেকেন্ড টাইম। ভোরবেলা বাথরুমে গিয়ে পড়ে গিয়েছে। এই মাত্র খবর পেলাম। আমাদের ইনচার্জ আবার খুব পিতৃভক্ত লোক। সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল।

— বাড়িতে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছিস তো?

— বাড়িতে আবার কী বলতে যাব? রতন একটু অবাক হল।

— আরে আকাট, তোর বাবা সকালে গড়িয়ায় বাজার করতে যায় না? হাওয়াই চটি ফটর-ফটর করে এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরবে, ডিপোর কেউ যদি দেখে ফেলে?

— দেখলে দেখবে। বলে দেব, বাবার আসলে কিছু হয়নি, হয়েছিল মার। কিন্তু মা আমার জান-প্রাণ বলে কথাটা সঙ্গে সঙ্গে কেউ আমাকে জানাতে সাহস পায়নি। রতন নির্বিকার মুখে বলল।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবার একটু আড়মোড়া ভেঙে বললেন- “একটা সিগারেট দাও তো রতন।“

–এখন সিগারেট খাওয়া কি ঠিক হবে আপনার? রতন সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল — তুই খাবি একটা? আমি ইতস্তত করে বললাম- না, না মেসোমশায়ের সামনে …

মৃত্যুঞ্জয়বাবু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন — খাও তো। যতসব ন্যাকামি! মুখচোরা গরুই পাল খাওয়ার যম!

— মানে কী কথাটার? সিগারেট ধরাতে ধরাতে জানতে চাইলাম।

— মানে আবার কী? যে গরুগুলো বেশি শান্ত, বাচ্চা-টাচ্চা হওয়ার সময় দেখা যায়, সেগুলোই সবার আগে।

— গরুর ব্যাপারে বাবলুকে ঘাঁটাবেন না। রতন হেসে বলল, ছোটবেলায় ও গরুর লেজ ধরে রাস্তায় ছুটত।

— আসলে তখনও আমার আগের জন্মের স্মৃতি পুরোপুরি লুপ্ত হয়নি। তাই পুরোনো আতীয়-স্বজন দেখলেই ছুটে যেতাম। বড়

একটা ধোঁয়া ছেড়ে বললাম।

গল্ফগ্রিনে ঢোকার মুখে রাস্তায় বড় একটা দোতলা বাড়ি দেখিয়ে রতন বলল — বাড়িটা প্রোমোটারির জন্য নিচ্ছি, বুঝলি।

— তুই? প্রোমোটিং করছিস?

— আমি মানে, আমরা চার-পাঁচজন। শঙ্করদা, মন্টু ওরাই আসল। আমিও আছি। ভদ্রলোক ঢোলাওয়ালা না নোলাওয়ালা কাকে একটা দিতে যাচ্ছিলেন। আমি গিয়ে বললাম বাঙালি ছেলেদের একটা সুযোগ দিন। ইনস্পায়ার্ড হয়ে গেল। অবশ্য ঢোলাওয়ালাকে সরাতে অন্য কলকাঠিও নাড়তে হয়েছিল।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একটু বমি করলেন। আমি নার্ভাস হয়ে ওনার হাতটা চেপে ধরলাম। রতন জিজ্ঞেস করল — অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে? কুছ পরোয়া নহি। আর ম্যাক্সিমাম পাঁচ মিনিট।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু একটু গা ঝাড়া দিয়ে বললেন — না, না ঠিকই আছে। আয়াম ওকে।

— কেন যে বুড়ো বয়সে এসব লাফড়া করতে যান! রতনের গলায় এবার সত্যিই সিমপ্যাথি- “ভারত-পাকিস্তান শান্তিতে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে, আর আপনারা পারেন না?”

— বাদ দাও তো ওসব শান্তি-ফান্তি। দু’দিন বাস চলবে, চারদিন ক্রিকেট ম্যাচ হবে, সাতদিনের দিন আবার বম্ব ব্লাস্ট, জঙ্গি অনুপ্রবেশ, কার্গিল! প্রপার যুদ্ধ ছাড়া জীবনে কখনও শান্তি হয়?

বুড়ো এবার মনে হচ্ছে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। বলে কী! একটু কড়া গলাতেই বললাম — এটা কী বলছেন? দু-দুটো নিউক্লিয়ার পাওয়ার যুদ্ধ করবে?

— ছাড়ো তো তোমার নিউক্লিয়ার পাওয়ার! মৃত্যুঞ্জয়বাবুর গলা সপ্তমে চড়ল। আরে বাবা, অ্যাটম বোমা যদি থাকে তো দেখা! এরাও দেখাক, ওরাও দেখাক, পুজোয় নতুন জামা কিনেছিস তো পর। সপ্তমী গেল, অষ্টমী গেল, নবমি-দশমী গেল, আর কবে পরবি? না, বলে লক্ষ্মীপুজোয় পড়ব। লক্ষ্মীপুজোয় বলছে কালীপুজোয়, কালীপুজোর রাতে বলছে ক্রিসমাসে পড়ব। ও তোমার ক্রিসমাস, ঈদ, বুদ্ধ পূর্ণিমা, রাস পূর্ণিমা সব চলে যাবে, নতুন জামা আর পরা হবে না। আমার সাফ কথা, দিচ্ছি, দিচ্ছি করবি না। যদি থাকে তো ঝেড়ে দে! তোদের পাঁচ কোটি হালকা হোক, আমাদেরও পাঁচ কোটি হালকা হোক… একটু হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচি।

রতন সাবাশ জানানোর ভঙ্গিতে হাসল — এই কথাটা বেড়ে বলেছেন, যুদ্ধ ছাড়া শান্তি হয় না।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু সমর্থন আদায়ের ভঙ্গিতে বললেন- তুমিই বলো রতন, প্রতিটা মুহূর্তে বাঁচার জন্য মারতে হয় না? এই যে তোমরা প্রোমোটারি করছ, ওই ঢোলাওয়ালাকে ল্যাং মেরে সরিয়ে তবেই তো করছ। এখন তুমিই যদি শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রোমোটিং করতে যেতে, পারতে?

–হ্যাঁ। আমি ফোড়ন কাটলাম। হ্যাঁ পারত। তবে সে অন্যরকম প্রোমোটারি।

— কী রকম? রতনের গলায় কৌতৃহল। সাহস বেড়ে গিয়েছিল। আমি মুচকি হেসে বললাম, সুজাতা বউদি যে ব্লাউজগুলো পরে তাতে গোটা পিঠটা একেবারে ময়দানের মতো উন্মুক্ত। ওখানে চাইলে রতন বড় মাল্টিস্টোরেডও তুলতে পারে। কোনও ঝামেলা হবে না। অবশ্য যদি আপনার ছেলে বাধা না দেয়।

— আমার ছেলে? মৃত্যুঞ্জয়বাবু এই প্রথম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সে তো এক নম্বরের ভেডুয়া। মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল বলে তার কোনও গর্ব নেই, এত বড় চাকরি করে বলে তার কোনও দেমাক নেই। তার অহংকার হচ্ছে তার বউ লিবারেটেড। তা “লিবারেটেড’ মানে কী? না, সন্ধেবেলা কন্ডাক্টরের সঙ্গে বেড়াতে বেরবে।

রতন মারমুখী হয়ে বলল — অ্যাই, প্রফেশন তুলে খোঁটা দেবেন না, মাইরি।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু কোনও পাত্তা না দিয়ে বললেন- আর একটা ছেলে বা মেয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যেত, বুঝলে? তা না, ওই সবেধন নীলমনি একটা মেয়ে …

— হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই করেই তো আপনারা যুগে, যুগে মেয়েদের পায়ে শেকল পরিয়েছেন। রতনের গলা উত্তেজিত শোনাল।

— ওরে আমার সমাজ সংস্কারক রামমোহন রায় রে! যাও না ক্ষেতমজুর, বিড়িশ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ছাতাওয়ালার ঘরে ঘরে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করো। তাহলে তো ওই উদয়াস্ত খেটে যাওয়া মেয়েগুলো প্রাণে বাঁচে। সব ক্যাদ্দানি কেবল মাসে তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকা রোজগার করা লোকগুলোর কাছে! আরে, এইসব বাড়িতে একটাই বাচ্চা থাকলে না চাইতেই সব পেতে পেতে সে কীরকম স্বার্থপর হয়ে উঠবে, বোঝ?

— মুন্নি ওরকম হবে না। ও তো এখন থেকেই খেটে খাওয়া আমার কম্পানি পাচ্ছে। রতন একদম বেল্টের নীচে মারল।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু কোনও জবাব না দিয়ে আবার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বমি করতে গেলেন আর ট্যাক্সিটা তখনই ঘ্যাঁচ করে নার্সিংহোমের সামনে এসে দাঁড়াল। রতন নামতে নামতে বলল- “তুই ওনাকে নিয়ে একটু রিসেপশনে বস, আমি এক মিনিটের মধ্যে আসছি।“ রিসেপশনে একটাই খালি চেয়ার ছিল। মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে বসিয়ে আমি পাশে দাঁড়ালাম। তারপর নিজের অজান্তে ওর হাত দুটো চেপে ধরে বললাম- “মেসোমশাই, আপনাকে কিন্তু ফিরে আসতেই হবে।“ গলাটা নিজের কানেই কেমন যেন শোনাল।

মৃত্যুঞ্জয়বাবু আমার দিকে ভাল করে তাকালেন। তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বললেন- ফিরব না কেন? তুমি কি বিশ্বাস করো নাকি আমি ওইসব বেগন স্প্রে, ফিনাইল-টিনাইল খেয়েছি?

হতভম্ব হয়ে বললাম- মানে?

— মানে, দু ঢোক কেরোসিন খেয়েই মনে হল, নকলটাকেই যদি আসল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কেমন হয়? মৃত্যুঞ্জয়বাবু আবার মুচকি হাসলেন। তারপর গলা আরও নামিয়ে বললেন- তবে এসব কথা রতনকে জানিও না যেন, কেমন? ওকে একটু অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া দরকার।

— কিন্তু ডাক্তাররা বুঝে ফেলবে না?

— ফেললেই বা কী? এখানকার আরএমও আমার ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট। নইলে রতনের কথামতো থোড়াই এখানে আসতাম। রতনকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে মৃত্যুঞ্জয়বাবু চুপ করে গেলেন। আমি আর কোনও কথা বলতে পারলাম না। দু’পা এগিয়ে এসে মৃত্যুঞ্জয়বাবু সুজাতা বউদি আর রতনের মাথার ওপর দিয়ে যে বলটা তুলে দিলেন, সেটা মাঠ পেরিয়ে, গ্যালারি পেরিয়ে কোথায় গিয়ে পড়বে, তাই শুধু ভাবতে পারলাম।

আজ সুজাতা বৌদির বাড়িতে আমার আর রতনের নেমন্তন্ন। মৃত্যুঞ্জয়বাবু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন সেই আনন্দে। মাটির প্রদীপ খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। আর মাঝেমধ্যেই আমার হাতটা ধরে বলছে — সত্যি, তোমরা না থাকলে সেদিন যে কী হত! রতনের আজ থেকে ডিউটি। তাই সে আর মৃত্যুঞ্জয়বাবু আগেভাগেই খাবার টেবিলে বসে গিয়েছে। ওদের সঙ্গে সঙ্গত করছে মুন্নি। মৃত্যুঞ্জয়বাবুর যদিও এখন রেসট্রিকশন চলছে, তবু তিনি আজ চিংডিমাছের মালাইকারি থেকে সর্ষে ইলিশ, সবই একটু চেখে-চেখে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন। খুবই স্বাভাবিক, তার সেই ইচ্ছায় বাদ সাধেনি কেউই। পরিবেশন করছেন সুজাতা বৌদি। ঘি রঙের গরদের শাড়ি ও লম্বা হাতাওয়ালা ব্লাউজে ওকে আজ সত্যিই অন্যরকম অপূর্ব দেখাচ্ছে। ডুরে শাড়ি পরা আশা সব এগিয়ে-পিছিয়ে দিচ্ছে। দুশ্চিন্তায় একটু রোগা হয়েছে বলেই বোধহয় ওকেও মন্দ দেখাচ্ছে না।

বেশ বড় একজোড়া ইলিশ মাছের ডিম পাতের ওপর পড়তেই রতন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল — এই সময় এত বড় ইলিশের ডিম? বাবা, ভাল ফাউ তো!

সুজাতা বৌদি কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলে উঠলেন- এই ফাউ জিনিসটা কিন্তু খতরনাক, রতন।

রতন ডিমে একটা কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করল- কেন? এখন তো একটা কিনলে একটা ফ্রিরই যুগ।

— ওইখানেই তো মুশকিল। মৃত্যুঞ্জয়বাবু নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন- এরপর কোনওদিন দেখবে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, “জামাই কিনলে লাঠি ফ্রি। তার মানে কী? না, জামাই খোঁড়া!

রতন হো হো করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে সুজাতা বৌদিও যোগ দিলেন এবং আশাও । “ঘরের মধ্যে ঘর’ গড়ে ওঠার আগেই ধুলিসাৎ। বৃহত্তর বসু পরিবার আবার একই আকাশের নীচে মজবুত ও তন্দুরস্ত। আমি গ্যারেজের সামনে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। হঠাৎ কাঁধের উপর একটা হাতের ছোঁয়ায় ঘুরে দেখি মাটির প্রদীপ। হাসিতে মুখ ভরা।

— কী হল ভাই, বাইরে কেন? ভিতরে চলো।

আমার একটিবারের জন্যও ওর গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে হল না। বললাম — এই তো এক্ষুনি যাচ্ছি। মনে মনে বললাম, বেগন স্প্রে আর ফিনাইল এখনও এ ওর টক্কর নিচ্ছে, যেমন টক্কর নেয় ম্যাটাডোর আর ক্ষ্যাপা ষাঁড়, কিংবা ডুবোপাহাড় আর সাবমেরিন। এসবের মধ্যে সবসময় মাটির প্রদীপ কিংবা কেরোসিন শিখার মতো দুধভাতের থাকা উচিত নয়। সুজাতা বৌদি থাকুন, আশাও থাক। আমরা তো সবাই জানি সেই সিনেমাটার নাম- ‘অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’ যার পোস্টারের নিচে ব্র্যাকেটে লেখা থাকত “কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।“

পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *