আগুন, বই আর গোলাপ

আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০]
[১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১]

গোবরডাঙার শরণার্থী শিবিরে পৌঁছতে চলমান যুদ্ধের এক করুণ ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। রাজাকারদের উপদ্রবে জমি, ঘরদোর ছেড়ে নিরীহ পরিবারগুলো এই ক্যাম্পে এসে বেঁচেবর্তে আছে। তাদের শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করছে এক অজানা জগতে। এক শরণার্থী বউ এসে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল আমাকে,
– স্যার, এই লড়াই কবে শ্যাষ হইব বইল্যা ভাবেন? 
হায় ভগবান, এ প্রশ্নের উত্তর যদি সত্যিই জানতাম! তবু মেয়েটিকে নিরাশ করতে মন চাইল না। বললাম,
– একদম চিন্তা কোরো না। যুদ্ধ শেষ হল বলে, তোমরা ঠিক ঘর ফিরে পাবে।
তখন পাশ থেকে আর এক বউ— কথার ধরন শুনে মনে হল খুলনার— এগিয়ে এসে বলল,
– আমার গাইবাছুরদের ফেলে চলে আসলাম। জানি না ফিরে গিয়ে খোঁজ পাব কিনা। 
তখন আমার পাশ থেকে মিস্টার গোটলা ওঁর অনভ্যস্ত বাংলায় বলা ধরলেন,
– সোব পাইয়া যাইবেন, দিদি। আগে বুলেন ইখানে খানাপিনা ঠিক যাচ্ছে তো?
মেয়েরা হেসে ফেলে মুখে আঁচল চাপা দিল। আর একজন বলল,
– আরে, ডাক্তার সাহেব তো রোজ শুধান খাবার কিমন? আমরা বলি ভালো, ভালো।

গোটলা এবার আমাকে নিয়ে ক্যাম্পের লঙ্গরখানায় গেলেন। অন্তত কুড়িজন রাঁধুনি ক্যাম্পের রান্না সারছে। তাদের দু’জনের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত এক অতি সুপুরুষ, শুভ্রকেশ, প্রৌঢ় ইংরেজ ভদ্রলোক, যাঁকে প্রথম দর্শনেই মনে পড়ে গেল সেই বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তারের চেহারাটা। ডাঃ অ্যালবার্ট শোয়াইটজার। নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত, ইংরেজিতে যাকে বলে পলিম্যাথ, এই ডাঃ শোয়াইটজার তাঁর কীর্তিময় মহৎ জীবনের এক সেরা কাজ করেছিলেন আফ্রিকার এক দেশ গাবন-এর এক নগর লম্বারেনে-তে। সেখানে এক হাসপাতাল তৈরি করে ওই এলাকার রোগীদের চিকিৎসায় কাটিয়ে দেন জীবনের অনেকগুলো বছর। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে থাকতে ওখানকার সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে খুব আনন্দ ও বিস্ময়ের সঙ্গে পড়েছিলাম ওঁকে নিয়ে একটা বই ‘ডক্টর শোয়াইটজার অফ লম্বারেনে’। বিখ্যাত মার্কিন লেখক-সাংবাদিক নর্মান কাজিনসের লেখা। সেটা পড়ে এতই মুগ্ধ ছিলাম যে মা-কে বলে তার এক কপি কিনিয়েওছিলাম। আর সে-বইয়ের একটা উদ্ধৃতি প্রায় মুখস্থও করেছিলাম। লম্বারেনেতে হাসপাতাল ঘুরে দেখতে দেখতে কাজিনসের করা প্রশ্নের উত্তরে হাসপাতালের এক স্বেচ্ছাসেবী ক্লারা আর্কিউহাট ডক্টর শোয়াইটজার সম্পর্কে বলছেন: 

‘Some people come to Lambarene with an image of a sort of sweet saintly St. Francis feeding the birds and they are instead a driving man fighting the jungle and African lethargy and they do not remain for a sufficiently long period to see or sense the goodness and saintliness underneath. They go away feeling hurt and unhappy.’

Camp
রাজাকারদের উপদ্রবে জমি, ঘরদোর ছেড়ে নিরীহ পরিবারগুলো এই ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছে…

যাই হোক, গোবরডাঙার শিবিরে ইংরেজ ডাক্তারকে দেখে ডাঃ শোয়াইটজারকেই মনে এল ক্রমাগত। শিবিরের নানা সমস্যা নিয়ে চর্চা করে যাচ্ছেন আর যে-মেয়েরা ওঁর একটা শব্দও ধরতে পারছে না, তাদের কথা বোঝার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গোটলা আমায় ক্যাম্প ঘুরিয়ে দেখিয়ে সেটির হাল-হকিকত বুঝিয়ে ফেললেন গিয়ে সাহেবের সামনে। সাহেব নিজের পরিচিতিতে একটি কথাও বললেন না, জিজ্ঞেস করলেন না আমি কোন কাগজ থেকে এসেছি। মিনিট কুড়ি কথা বলার পর আমার রুচির একটা পরীক্ষা নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
– আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন তো?
উত্তরে যেই বললাম “হ্যাঁ” অমনি সাহেব বললেন,
– যথেষ্ট। এই যে হ্যাঁ বললেন এতেই খুশি হলাম।

Albert_Schweitzer
ডাঃ আলবার্ট শোয়াইটজার। গোবরডাঙার ডাক্তারকে দেখে মনে এল তাঁর কথা।

তারপর রাঁধুনিদের ডেকে সাহেব নিজের জন্য আমার জন্য আর গোটলার জন্য তিনটে পাত পাড়তে বললেন। খাবার আনা হচ্ছে যতক্ষণে সাহেব ক্যাম্পের অনেক খুঁটিনাটি তথ্য দিলেন, নিজের নামটা বাদে। তাতে সন্ধেবেলা অফিসে ফিরে যে-রিপোর্ট লিখেছিলাম তাতে শিবিরের নানা কাজের বর্ণনা করে সাহেবের উল্লেখ করেছিলাম ডক্টর শোয়াইটজার অফ গোবরডাঙা বলে। এত যুগ পর কিঞ্চিৎ সাহস করেই বলি, লেখাটার খুব প্রশংসা ছড়িয়েছিল পরদিন। গোটলা ধন্যবাদ জানিয়ে ধীরেনবাবুকে বলেছিলেন ওঁদের এক বিয়ার পার্টিতে আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতে। সঙ্গে টোপ রেখেছিলেন সেখানে আমার বর্ণনার ডক্টর শোয়াইটজার অফ গোবরডাঙাও থাকবেন। গিয়েওছিলাম এবং অবাক হয়েছিলাম সাহেবের বিনয়ে। বলেছিলেন,
– আপনি আমাকে ডাঃ শোয়াইটজার নাম দিয়ে বড় বিব্রত করলেন। 
জিজ্ঞেস করেছিলাম,
– কেন বিব্রত হলেন? 
সাহেব উল্টে প্রশ্ন করলেন,
– আপনি ইংলিশ ম্যাথামেটিশিয়ান হার্ডির নাম জানেন?
– খুব জানি। ইন্ডিয়ান ম্যাথামেটিশিয়ান রামানুজমের মাস্টার। উৎফুল্ল সাহেব বললেন,
– রাইট! অ্যাবসলিউটলি! এই হার্ডির একটা থিওরি আছে টু মেজার গ্রেটনেস। যে-মহত্বের মাপটাকে উনি বলেন ব্র্যাডম্যান ক্লাস।
– সেটাও জানি মনে হয়। হার্ডি এতটাই ভক্ত ছিলেন ক্রিকেটার ডন ব্র্যাডম্যানের যে যে-কোনও বিষয়ের সেরার সেরা কীর্তি ও কীর্তিমানকে বর্ণনা করতেন ব্র্যাডম্যান ক্লাস। 

Campbustee
গোবরডাঙার শরণার্থী শিবির ছিল চলমান যুদ্ধের এক করুণ ছবি।

সাহেব একটু অবাকই হলেন মনে হয়।
– ও গড, ইউ নো দিস টু? 
আমাকে বলতেই হল,
– সে যাক গে। কিন্তু আপনি, স্যর, এই ব্র্যাডম্যান ক্লাসের কথাটা আনলেন কেন?
– কারণ আপনি ডাঃ শোয়াইটজারের সঙ্গে তুলনা করে আমাকে ব্র্যাডম্যান ক্লাসে ঠেলে তুলছিলেন বলে। মানবসেবায় ডক্টর অ্যালবার্ট শোয়াইটজার, মাদার টেরিজা এঁরা ব্র্যাডম্যান ক্লাস। আই অ্যাম জাস্ট আ রিজনেবলি গুড ক্যাম্প অ্যাটেনডান্ট।
বলেই সাহেব ওঁর বিয়ার গ্লাসটা বেশ জোরে ঠুকে দিলেন আমারটার সঙ্গে। ঠিক এই সময় বিয়ার হাতে ধীরেনবাবু এসে পৌঁছলেন আমাদের মধ্যে। বড় এক ঢোঁক বিয়ার খেয়ে বললেন গোটলাকে,
– কথা হচ্ছিল যুদ্ধ থামলে যশোহর, খুলনা যাবার ব্যাপারে। আমার ইচ্ছে সেই ট্রিপে এই ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়ার।
বলেই আমাকে দেখালেন। ততক্ষণে আমাদের মধ্যে এসে পড়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কাগজে কাজ করে দেশে ফেরা সাংবাদিক বরুণ রায়। বরুণ তখন অমৃতবাজার পত্রিকার হয়ে যশোহর, খুলনা যাবেন ঠিক হয়ে আছে। ধীরেনবাবু আমার নাম বলাতে টুকটুক করে আমার পাশে এসে বললেন,
– যাক, তাহলে আমরা একসঙ্গে যাচ্ছি।
পাশ থেকে কে একজন বললেন,
– দাঁড়ান, দাঁড়ান, আগে লড়াইটা খতম হোক।

এর দু’দিন পর ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হল ভারত ও বাংলাদেশের জয়ে। আর তার দিন কুড়ি পরে একটা প্রায় নতুন শক্তপোক্ত জিপে করে ধীরেনবাবু, বরুণ রায় ও একজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে পাড়ি দিলাম যশোহরের দিকে। আমরা তিনজন পিছনে, সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে ধীরেনবাবু। গাড়ি স্টার্ট দিতেই সামনে থেকে ধীরেনবাবু বলে উঠলেন
– চলো এবার তোমাকে তোমার পিতৃভূমি খুলনা দেখিয়ে দিই, শঙ্করলাল।
হাড় হিম করা ঠান্ডার মধ্যেও শরীরটা কীরকম উষ্ণ হয়ে উঠল।  (চলবে)

 
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৫ জানুয়ারি ২০২৩
*ছবি সৌজন্য: Old Indian Photos

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *