১
রাজপুত্র কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দিকে পা বাড়ালে তাকে নাকি গোটা রাজ্যটা ঘুরিয়ে দেখানোর রীতি ছিল। যাতে সে বুঝতে পারে, যে ভবিষ্যতে এই রাজ্য সামলাবার ভার তার উপরেই পড়বে। কোনও একটা ঐতিহাসিক উপন্যাসে এমন একটা ঘটনার কথা পড়েছিল প্রমিত। আর নিজের ওই বয়সে, বাবার কাছ থেকে সে উপহার পেয়েছিল একটা লোহার রেজ়র। উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পাবার পর, বাবা প্রমিতের হাতে ওই হলুদ মাথাওয়ালা কালো রেজ়রটা তুলে দিয়ে স্মিত হেসে জানিয়েছিল, যে আজ থেকে ওটা ওর।
ভাল রেজাল্টের পর লোকে ঘড়ি পায়, সাইকেল পায়। প্রমিতের ভাগ্যে জুটেছিল রেজ়র।
– এই সেফটি রেজ়রটার সঙ্গে ইতিহাস জড়িয়ে আছে। বাবা বলেছিল প্রমিতকে।
ইতিহাস নিয়ে প্রমিতের মাথাব্যথা ছিল না। ও একটা ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করেছিল তখন। আর রেজ়রটার মধ্যে ও কোনও ‘সেফটি’ খুঁজে পায়নি, কারণ দাড়ি কামাতে গেলেই কোথাও না কোথাও কেটে গিয়ে রক্ত পড়ত।
– এত যখন ধারাল, তখন ওটা দিয়ে শেভ করতে যাস কেন? সম্পৃক্তা বলেছিল কলেজ ক্যাম্পাসে।
– ধার তো থাকে ভিতরের ব্লেডে। বাইরের অংশটা জাস্ট এমনিই…। প্রমিত দার্শনিক হয়ে উঠতে চেয়েছিল উত্তরে।
তার আগের সপ্তাহেই সম্পৃক্তার ব্রেক-আপ হয়েছে এবং দুঃখ ভোলার জন্য ও একটু বেশিই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে প্রমিতকে। মানে, এমনটাই প্রমিতের মনে হয়েছিল। আর সেই মনে হবার মূল্য নিতে ও নিজেও চেষ্টা করছিল সম্পৃক্তার অস্তিত্বের ভিতর একটা নতুন ব্লেডের মতো শুয়ে থাকতে, যে সমস্ত আগাছাকে মুহূর্তে পরিষ্কার করে দেয়।
তবে সম্পৃক্তা যে ওকেই আগাছা মনে করত, তা টের পেতে অবশ্য ছ’মাস কেটে গেল। তার আগে চরকির মতো ভিকটোরিয়া থেকে প্রিন্সেপ ঘাটে ঘোরাঘুরি করেছে। সম্পৃক্তা একতলার ক্যাশ-কাউন্টারে পার্স ভুলে তিনতলায় চলে এলে, ক্লাসের মাঝপথে বেরিয়ে গিয়ে সেই পার্স খুঁজে এনেছে। আর এইসব করতে গিয়ে ক্লাসেরই অনেকের কাছে অপ্রিয় হয়েছে। সম্পৃক্তার সঙ্গে খেল-খতম হয়ে গেছে খবর পেয়ে তাদেরই কেউ কেউ, বিষাক্ত হয়ে উঠল একদম।
– লেঙ্গি মেরে চলে গেল, কম্পেনসেশনও দিল না?
– এখন যাকে ধরেছে তার গাড়ি আছে। তুই এতদিন সার্ভিস দিলি, তোকে একটা বাইক, নিদেনপক্ষে স্কুটি গিফট করে গেল না?
প্রশ্নগুলো সহজ হলেও উত্তর অজানা ছিল। আর সেই অজানা উত্তরের খোঁজে সাতদিনের বদলে দু’ তিনদিন অন্তর গালে ওই লোহার রেজ়র ঘষত প্রমিত।
তার আগের সপ্তাহেই সম্পৃক্তার ব্রেক-আপ হয়েছে এবং দুঃখ ভোলার জন্য ও একটু বেশিই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে প্রমিতকে। মানে, এমনটাই প্রমিতের মনে হয়েছিল।
কী আশ্চর্য, রক্ত আর অত সহজে পড়ত না। বরং কোথাও একটা জমে থাকত, যেখানে লোডশেডিংয়ের রাতে গাছপালা ঘেরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফেরার সময় সম্পৃক্তা চুমু খেয়েছিল ওর গালে। ঠোঁটে চুমু খাবার জন্য রেস্তোরাঁর কেবিন অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানে দেওয়ালে আরশোলা দেখে সম্পৃক্তার চিৎকার, ক্যানভাসটাই ঘেঁটে দেয় পুরো। সেই ঘাঁটা সময়ের উলটোরথে আর কোনও ভগবান থাকতে পারেন না, কেবল থালায় একটা বাতাসা থেকে যায়। সেই বাতাসাটাই হয়তো লোডশেডিংয়ের রাতের চুমু। কিন্তু টিটকিরি আর একাকিত্ব, লড়াই আর লগ-ইন করার চেষ্টার ভিতর শুধু ওই স্মৃতির জোরে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। গেলে পরে, যারা আওয়াজ দিত তাদেরই একজনকে একদিন ক্যান্টিনে ওর পাশে বসার জন্য ডাকত না প্রমিত। সুস্মিতাও কাছে চলে এসে বাটার-টোস্ট অর্ডার করতে বলত না।
ঘাসের গায়ে যেমন শিশির, যা আগুনে পুড়েছে তার গায়েই মাখন মানায়। সম্পৃক্তার তুলনায় সুস্মিতা হয়তো নেহাৎই মার্জারিন। তবু কল্পনার উপরেই জীবনের সব ওড়াউড়ি নির্ভর করে। নইলে যে দ্রাঘিমা আর অক্ষাংশর উপর ভিত্তি করে প্লেনগুলো পৃথিবীর এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যায়, সেগুলো কি কেউ আকাশের গায়ে এঁকে রেখেছে?
হলুদ মাথাওয়ালা কালো রেজ়র দিয়ে দাড়ি কামাতে কামাতে ভাবত প্রমিত। আর রক্ত ঝরলেও বিশেষ দুশ্চিন্তা করত না, কারণ সুস্মিতা গালের দাগ টাগ অত খেয়াল করত না। তা ছাড়া ভাল মাইনাস পাওয়ার ছিল বলেই হয়তো, চশমা খুলে রাখলে আরশোলাও নজরে পড়ত না ওর। কেবিনে ঢুকলেই সুস্মিতার চশমাটা খুলে নিয়ে একপাশে রেখে দেওয়া তাই অভ্যাস করে নিয়েছিল প্রমিত।
২
রেজ়রটা বাথরুমের একটা বিশেষ জায়গায় রাখাও অভ্যাস প্রমিতের। শরিকি বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হয়ে গিয়ে পুরো হুলিয়াটাই বদলে গিয়েছিল ওদের বাসস্থানের। কিন্তু বাথরুমের ভিতর একটা ছোট্ট দেরাজের বাঁ দিকে রেজ়র রাখার অভ্যাস বদলায়নি ওর।
ফুলশয্যার রাতে, কে জানে কেন, সুস্মিতা ওকে ওই রেজ়র ফেলে দেওয়ার কথা বলে। বহুদিন ধরে রেজ়রের গল্প শুনলেও আগে কখনও ওই কথা বলেনি প্রমিতকে।
ঠোঁটে চুমু খাবার জন্য রেস্তোরাঁর কেবিন অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু সেখানে দেওয়ালে আরশোলা দেখে সম্পৃক্তার চিৎকার, ক্যানভাসটাই ঘেঁটে দেয় পুরো।
– হঠাৎ এ কথা? প্রমিত জানতে চেয়েছিল।
সুস্মিতা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘আমার বোন বলছিল বিয়ের রাতেও নাকি তোমার গালে কাটা দাগ দেখতে পেয়েছে।’
– পাওয়ার কথা নয়। নাপিতের কাছে কাটিয়েছিলাম।
– ইটালিয়ান সেলুনে?
– সে যেখানেই হোক। গালে ক্ষুর ছোঁয়ালেই ভাল লাগে আমার। ওই যে ধার, ওই যে স্বস্তি তা ওই ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ মডেলগুলোয় পাই না। আর তা ছাড়া ওই কথাটাতেই গা গুলিয়ে ওঠে।
সুস্মিতা চুপ করে যায়। ওর মনে পড়ে যায়, যে সম্পৃক্তা ছেড়ে যাওয়ার পর ওরা কয়েকজন ওই নামে ডাকত প্রমিতকে। সেই প্রসঙ্গের অবতারণা করে এই রাতটাকে তিক্ত করতে চায় না ও।
প্রমিত অবশ্য বলে যেতে থাকে। ওর ভিতরের ক্ষোভ দূর আকাশের তারার মতো মিটমিট করে ওর উচ্চারিত শব্দগুলোর ভিতর। এমনকী রাত গভীর হলে যখন ও জড়িয়ে ধরে সুস্মিতাকে, তখন সেই আলিঙ্গনের ভিতরেও অতীত তার দাঁড়া আর নখ নিয়ে জেগে থাকে। যেন কোথাও কোনও সাদা পতাকা উড়তে থাকায় দুই শত্রুদেশের সৈন্য পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু সেই মিলনের ভিতরেও খচখচ করছে একটু আগের একে অপরকে দেওয়া ক্ষত। ভোররাতের দিকে আধোঘুমের মধ্যে প্রমিত একবার বলে ওঠে, ‘রেজ়রটা খুব স্মুদ, তোমার মতোই।’
সুস্মিতা নতুন জায়গায় ঘুমোতে না পেরে জেগেই ছিল। কথাটা কানে যেতেই ওর ইচ্ছে হয়, যেখান থেকে হোক রেজ়রটা বের করে তখনই বাইরে ফেলে দেয়।
পরদিন সকালে অবশ্য রেজরটার কথা মনে পড়েই না আর সুস্মিতার। জীবনের যে ভুলে যাওয়াগুলোকে মানুষ অভ্যাস নাম দেয়, রেজ়রটা তার ভিতরেই ঢুকে পড়ে। প্রমিতকে গালের ফেনায় ওটা চালাতে দেখলেই একমাত্র ওটা বাস্তবে ফিরে আসত। বাকি সময়টা ছায়ার মতো কোথায় মিশে থাকত, কে জানে। কেবল মিষ্টু জন্মানোর পরদিন ওকে যখন নার্সিং-হোমে দেখতে এসেছিল প্রমিত, তখন নিজের বরের গালে কাটা দাগ দেখে হেসে ফেলেছিল সুস্মিতা। ওর মনে পড়ে গিয়েছিল বাসরের সময় বোনের বলা কথা।
কল্পনার উপরেই জীবনের সব ওড়াউড়ি নির্ভর করে। নইলে যে দ্রাঘিমা আর অক্ষাংশর উপর ভিত্তি করে প্লেনগুলো পৃথিবীর এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যায়, সেগুলো কি কেউ আকাশের গায়ে এঁকে রেখেছে?
– হাসছ যে? প্রমিত জিজ্ঞেস করেছিল।
– আজও রক্ত বের করে এসেছ? বাবার কোলে ছেলেকে হাত-পা ছুড়তে দেখে জানতে চাইল সুস্মিতা।
– অল্প একটু রক্ত বেরিয়েছে। এই মক্কেলকে জন্ম দিতে গিয়ে তোমার যা বেরিয়েছে তার থেকে অনেক কম।
কথাটা চুপ করিয়ে দিয়েছিল সুস্মিতাকে। আনন্দে।
৩
রাগে পাগল হয়ে গেলে সাধারণত মানুষ চিৎকার করে। কিন্তু প্রমিত একদম চুপ করে যায়। আর মিষ্টু জন্মানোর পর থেকে ওর এই স্বভাবটা বাড়তে বাড়তে এমন আকার ধারণ করল, যে ওরকম পরিস্থিতি হলে সুস্মিতাই খানিক নার্ভাস হয়ে গিয়ে ওকে যেভাবে পারে কথা বলানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু রেজ়রটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনও চেষ্টাই কোনও কাজে এল না। প্রমিত সাধারণ কাজকর্ম বা খাওয়াদাওয়া চালিয়ে গেলেও ওর মুখ থেকে বাড়তি একটি শব্দও শোনা গেল না।
এবার, সাধারণ সময়ে সেটা চোখে পড়তে তা-ও খানিক সময় লাগে। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে ঘরের চারটে লোকের একজন যদি সম্পূর্ণ চুপ করে যায়, তাহলে একেবারে বিসদৃশ অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রমিতের মা একটা স্ট্রোকের পর থেকে শয্যাশায়ী এবং দিনরাতের অধিকাংশ সময়ই ঘুমন্ত অবস্থায় থাকেন বলে তাঁকে দিয়ে এ ব্যাপারটার কোনও সমাধান হওয়া সম্ভব ছিল না। আর পুরনো কাঠের আলমারির উপরে ফ্রেমবন্দি হয়ে গিয়েছিলেন প্রমিতের বাবা, মিষ্টুর জন্মের পরপরই। স্নানের পর এবং রাতে শোবার আগে, একমাত্র ওই ছবিটার সামনে দাঁড়িয়েই একটু বিড়বিড় করত প্রমিত। কিন্তু তার ভিতর থেকে কোনও শব্দ বা মানে উদ্ধার করা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রাত গভীর হলে, সুস্মিতা এক-একসময় শরীরটাকে সেতু বানিয়ে যোগাযোগহীনতার সমুদ্রটা পেরতে চেয়েছে, নীরবতার দেয়ালটা ভাঙতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষের ভিতরে যা অব্যক্ত, তা তো শরীরে থাকে না! আর যেখানে থাকে তাকে শরীর দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না।
– তুমি তো মিষ্টুকে একটু পড়াতে পার এই সময়টায়। ধূপকাঠির সামনে দেশলাই খুঁজে না পাওয়ার হতাশা গলায় নিয়ে কখনও বলে উঠেছে সুস্মিতা।
– তুমি পড়াচ্ছ তো! তাহলেই হবে। দিঘির জল যেভাবে কোনও বাচ্চার ছোড়া পাথর গিলে নেয়, সেভাবেই প্রশ্নটা গিলে নিয়ে একটা বুদ্বুদ উগরে দিয়েছে প্রমিত।
জীবনের যে ভুলে যাওয়াগুলোকে মানুষ অভ্যাস নাম দেয়, রেজ়রটা তার ভিতরেই ঢুকে পড়ে। প্রমিতকে গালের ফেনায় ওটা চালাতে দেখলেই একমাত্র ওটা বাস্তবে ফিরে আসত।
কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে একটা পুরনো রেজ়র হারানোয়? কোন কোহিনূর লুকিয়ে ছিল ওর ভিতরে, যে প্রমিত একেবারে গুম মেরে গেল? বিয়ের পর পর সিনেমা দেখতে গিয়ে ওরা একবার সম্পৃক্তার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল। সিনেমা শেষে হল থেকে বেরবার সময়ও বোবা হয়ে ছিল প্রমিত। ঠিক হতে হতে রাত পেরিয়ে গিয়েছিল। তার তবু একটা কারণ বোঝা যায়। কিন্তু ওই লোহার রেজ়র বিহনে প্রমিতের এই পাগলামির মানে কী?
ভাবত সুস্মিতা।
ভেবে তল পেত না।
যতদিন না আগুন লাগল।
৪
আগুন লেগেছিল বেশ কয়েকটা বাড়ি পরে। এমন কিছু বিধ্বংসী আগুনও নয়। কিন্তু খবরটা কানে যেতেই প্রমিত যেভাবে মুখে মাস্ক না-লাগিয়েই ছুটে যাচ্ছিল, তাতে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুস্মিতা। ঘামে চপচপে হয়ে ও বাড়ি ফিরে এলে কারণ জানতে চেয়েছিল।
– আমি তো সম্রাট নিরো নই, যে রোম যখন পুড়বে তখন বেহালা বাজাব! প্রমিত গেঞ্জিটা খুলে ফেলতে ফেলতে উত্তর দিয়েছিল।
অবাক হয়েছিল সুস্মিতা। আবার খানিকটা খুশিও হয়েছিল, রাগের ভিতর দিয়ে প্রমিতের স্বাভাবিকতা ফিরে আসার আঁচ পেয়ে। সেই আঁচ গনগনে হয়ে উঠল রাতে।
– বাবাকে জল দিয়ে আগুন নেভাতে দেখে দাদু বুঝতে পারেনি যে বাবাও, দাদুর দোকান লুঠ করতে আসা ভিড়টার অংশ।
– কিসের দোকান ছিল তোমার মায়ের বাবার? সুস্মিতা জিজ্ঞেস করল।
রেজ়রটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনও চেষ্টাই কোনও কাজে এল না। প্রমিত সাধারণ কাজকর্ম বা খাওয়াদাওয়া চালিয়ে গেলেও ওর মুখ থেকে বাড়তি একটি শব্দও শোনা গেল না।
– মুদি কাম স্টেশনারি। আর সে সময়টা, যখন চাল পাওয়া যাচ্ছে না, আটা অমিল, লোকে দিনের পর দিন ছাতু কিংবা মাইলো খেয়ে আছে, তখন মুদি দোকানের মালিকই যেন অত্যাচারী জমিদার। তাকে নিঃস্ব করে দেওয়ার মধ্যেই বিরাট আনন্দ।
– কিন্তু তোমার বাবা…
– আমি, তুমি, মিষ্টু যেমন এই মুখে কাপড় বেঁধে লুকিয়ে থাকা সময়টার অংশ, আমার বাবাও সেই সময়টার অংশ ছিল সুস্মিতা, যখন দোকান লুঠ করাটাও একটা বিপ্লব। কিন্তু বাবা বিপ্লবটা করতে পারেনি, মাকে প্রথমবার দেখেই বাবার হাত কেঁপে গিয়েছিল।
– বাবা তাহলে প্রেমিক ছিলেন বল?
– আমি জানি না। শুধু জানি, মুদি দোকানের সামান্য জিনিস ফুরিয়ে যাওয়ার পর, যখন হাতে কিছু না-পাওয়া লোকেরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল দোকানে, বাবা কাছের টিউকল থেকে জল পাম্প করে এনে দোকানে ঢেলেছিল। আর সর্বস্ব হারানোর মুহূর্তেও দাদুর চোখে ওই দৃশ্যটা লেগে ছিল। বাবা আগ্রহী জানতে পেরেই তাই আমাদের বাড়ি চলে এসেছিল দাদু। আর বিয়ের রাতে ওই লোহার রেজ়রটা তুলে দিয়েছিল বাবার হাতে।
– কেন?
– কারণ ওই পোড়া দোকানটায় একমাত্র ওই রেজ়রটাই অক্ষত ছিল। দাদু তাই…
– তোমার বাবাকে রক্ষাকর্তা ভেবে…
– কিন্তু বাবা সারাজীবন শুধু মা-কে বা আমাদের নয়, আমার ছোট মামা-মাসিদেরও দেখেছে। দাদুর শেষদিকের চিকিৎসার প্রায় সব ব্যবস্থাও বাবাই করেছে। তবু একটা অদৃশ্য ক্ষুর বাবাকে ফালাফালা করত। বাবা নিজে কখনও ওই রেজ়রটা ব্যবহার করতে পারেনি। আমি দাড়ি কামানোর বয়সে পৌঁছতে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটা আমি ছাড়া আর কাউকে বলতে পারেনি।
– তুমি বলে দাওনি মা-কে? বাবা মারা যাওয়ার পরও?
– কেন বলব?
– বলবে না-ই বা কেন? সুস্মিতার গলা একটু উঁচুতে চড়ে গেল।
৫
পরদিন প্রমিতকে কিছু না জানিয়েই ঘর থেকে বেরল সুস্মিতা। দু’ তিনঘণ্টা পর যখন ফিরল, তখন একেবারে রণক্লান্ত চেহারা। প্রমিতের প্রশ্নের উত্তরে, জোড়াতালি দেওয়া কয়েকটা শব্দ বলে স্নানে ঢুকে গেল। আর সন্ধ্যায় দুটো লোহার রেজ়র হাতে করে বাড়িয়ে ধরল প্রমিতের দিকে। তারমধ্যে একটা হারিয়ে যাওয়া রেজ়রটার প্রায় যমজ।
– এখন তো এইরকম রেজ়র পাওয়াই যায় না! তুমি পেলে কী করে? তা-ও আবার লকডাউনের মধ্যে?
– ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। ইচ্ছের তো আর লকডাউন হয়নি। সুস্মিতা হেসে উঠল।
হাসির শব্দটা প্রমিতের মাথার মধ্যে বাজছিল। তবু সেদিন রাতে সুস্মিতাকে কাছে টেনে নিয়ে ও আলতো গলায় বলল, ‘তোমাকে আজ যা-ই বলি, কম পড়ে যাবে।’
খবরটা কানে যেতেই প্রমিত যেভাবে মুখে মাস্ক না-লাগিয়েই ছুটে যাচ্ছিল, তাতে অবাক হয়ে গিয়েছিল সুস্মিতা। ঘামে চপচপে হয়ে ও বাড়ি ফিরে এলে কারণ জানতে চেয়েছিল।
– কিছুই বোলো না। কারণ যা করেছি ভালবেসে করেছি।
– আমিও তোমাকে ভালবাসি সুস্মিতা। কিন্তু তোমাকে ভালবেসেও যদি তোমার আনা রেজ়র আমি ব্যবহার না করি, কিছু মনে করবে তুমি?
– আগে বলো, ব্যবহার করবে না কেন?
– ঠিক যে কারণে বাবা চলে যাওয়ার পরও মা-কে কিছু বলিনি।
– বুঝলাম না।
– আমি মা-কে আসল ঘটনাটা বললে বাবা আর কখনও মায়ের চোখে স্পেশাল থাকত না, ভিড়ের অংশ হয়ে যেত। তেমনি রোদে রোদে ঘুরে তুমি যে লোহার রেজ়র খুঁজে এনেছ আমার জন্য, তা ওরকম অনেক রেজ়রের একটা। ওর মধ্যে আগুন নেই, জল নেই, দাদু নেই, ভালবাসাও নেই। আমি একটা নেশাকে টিঁকিয়ে রাখতে গিয়ে সময়টাকে কীভাবে ফেলে দিই, বলো? প্রমিতের গলা ধরে এল।
– তাহলে কী দিয়ে দাড়ি কামাবে এখন?
– কেন, ওই ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ দিয়ে। ওটা দিয়েই তো সবাই কামাচ্ছে এখন। আমিই বা পারব না কেন?
সুস্মিতা প্রশ্নটার উত্তর দিতে না পেরে তাকিয়ে রইল প্রমিতের দিকে। সিলিং-ফ্যানের হাওয়া ধারাল হয়ে পাক খেতে লাগল ওদের ভিতরে।
পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |
Speechless! Oshadharon! Ar kichhu bolte parchhi na, Still sensing the overwhelming impact! Master craftsmanship!
আজকের প্যানডেমিকের বাস্তব আর চিরকালীন আবেগ কি আশ্চর্য তুলির টানে মিলে গেছে ক্যানভাসে। ভালো লাগলো