দু’পক্ষের বাদানুবাদে উত্তপ্ত মালিহাটি। রাধামোহন ঈষৎ বিচলিত। জীব গোস্বামী-সহ নরহরি সরকার, নরোত্তম ঠাকুরের সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই বজ্রদেবের শিষ্যত্ব স্বীকার করেছেন। ব্রজধামে প্রতিপত্তি ক্ষমতা বিস্তারের উপর নির্ভর করছে যাবতীয় মানসম্মান। তিনি সুবাহুকে সঙ্গে নিয়ে জেনে-বুঝেই একটি ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছেন। বীরভদ্রের উদ্যোগে নেড়ানেড়িরা যখন থেকে সমাজে গৃহীত হয়েছে, ভদ্রলোকেরা বৈষ্ণবধর্ম থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন।

নিম্বার্ক রামানুজ মধ্বাচার্য ভদ্রলোকদের আকৃষ্ট করে। শিক্ষিতজনের স্বভাবতঃই শাস্ত্রের প্রতি সমীহ আছে, তা সে তারা বুঝুক বা না বুঝুক! কিন্তু তাদের কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে, স্বয়ং চৈতন্যদেব যাঁদের আশ্রয় দিতে বলেছেন, সেই পতিত, সমাজচ্যুত বিরাট সংখ্যক নর-নারীদের বৈষ্ণব আখড়া আশ্রয় না দিলে তাঁরা অন্য ধর্মের দ্বারস্থ হবেন। এখনও শাসকের ধর্মই সংখ্যালঘু। তবে শিষ্ট সমাজের যা ব্যবহার, ভবিষ্যতে যে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠলেন পরম বৈষ্ণব!



এই বজ্রদেব উপাধ্যায়ের দল যত জাঁকিয়ে বসবে, তত সাধারণ মানুষ বৈষ্ণবদের
থেকে দূরে সরে যাবে। এই যে রাগলেখা, একে আখড়ায় আশ্রয় দিয়েছেন স্বয়ং তিনি। তা নিয়ে কম অশান্তি তো হয়নি। না, রাধামোহনের ব্যক্তি জীবনে কোনও বিকার নেই। তিনি এই মেয়েটির প্রতি সন্তানস্নেহ অনুভব করেছেন। মেয়েটিকে আশ্রয় দেওয়ার বদলে নরকে ঠেলে দেওয়ার অভিরুচি নেই তাঁর।

তবে মর্ত্য়ের বৃন্দাবনলীলা তার যতই ভাবোল্লাস ঘটাক, গৃহিণী কিন্তু রুষ্ট হয়েছেন। ব্রাহ্মণীর নাকি নজরে এসেছে, তাঁর অনুগামী সুবাহু রাগলেখার প্রতি আসক্ত। হেসেছেন রাধামোহন। প্রেমভক্তি উন্মাদনায় স্বয়ং চৈতন্যদেব পুরী মন্দিরের সেবিকার মুখে “রতিসুখসারে গতমভিসারে” এই সঙ্গীত শ্রবণে গায়িকাকে দর্শন করার জন্য ছুটে গেছেন। কেউ কেউ তারও কদর্থও করেছিল। তারা কোথায়, আর কোথায় মহাপ্রভু!

রাগলেখার সর্বাঙ্গে তিনি শ্রীরাধার অভিসারের প্রস্তুতি ও অপেক্ষা দেখেছেন। অন্যদিকে, তাঁর ব্রাহ্মণী দেখেছেন খিড়কি পুকুরের পিছনে ডালিম গাছের নীচে উভয়ের ঘনিষ্ঠমূর্তি। পূর্ণিমার চাঁদ তখন মাথার উপর। নাকি সুবাহু রাগলেখার আঁচল মুঠোর ভিতর রেখেছিল। সবচেয়ে নির্লজ্জ ব্যাপার, গুরুপত্নীকে দেখেও সংযত হয়নি তারা!



রাধামোহন আপনমনে আবার হাসেন। বাঙালির মনে-প্রাণে যে প্রেমের বিদ্রোহ, তাকে কীভাবে ঠেকাবেন বজ্রদেবরা? নিয়মকানুন, সমাজবন্ধন কোন কালে বাঙালিকে ভীত করেছে? তাহলে শঙ্করাচার্যকে অস্বীকার করে গৌরাঙ্গের রসে প্লাবিত হত না বঙ্গভূমি!

Radha Krishna
রাগলেখার সর্বাঙ্গে তিনি শ্রীরাধার অভিসারের প্রস্তুতি ও অপেক্ষা দেখেছেন

পাঁচ

রাগলেখার দেখা পায়নি গত চারদিন। সুবাহু নিজেই খোঁজ নেয়নি প্রথমে। নেবে কীভাবে? ভোর না হতেই রাধামোহনের বাড়ির সামনে শামিয়ানায় প্রায় যুদ্ধের প্রস্তুতি চলে। আবেগ-উত্তেজনায় প্রথম ক’দিন রাগলেখার কথা মনেও ছিল না তার, কিন্তু তৃতীয় চতুর্থ দিন চঞ্চল হয়ে উঠল সে। আখড়ার রূপমঞ্জরীর কাছে খোঁজ করেছে, কিন্তু খবর পায়নি। পত্নী শিখী, তার দিদির সন্তান সম্ভাবনায় পাশের গ্রামে গেছে। সুবাহু খেয়াল করেছে, দূরত্ব মোটেই বিরহ স্থাপন করে না; ধীরে ধীরে ঔদাসীন্য গ্রাস করে। অন্যদিকে জ্বলে উঠেছে রাগলেখা। আগুনের তাপ পোহানোর চেয়ে আগুনে প্রবেশ করা অনেক বেশি উত্তেজক। ছাই লাগে কীট দমনে। যে বাসনার কীট প্রবেশ করেছে সর্বাঙ্গে, তাকে বিনষ্ট করার মতো ক্ষমতা নেই তার। যেন সজ্ঞানে অগ্নিপ্রবেশ করেছে সুবাহু।



রাগলেখার সর্বাঙ্গে সুখের আলস্য। সুবাহুর উদ্যানবাটীর প্রাঙ্গন নিকনো, বড় পরিচ্ছন্ন। বসন্তে পূর্বের পাতা খসিয়ে নেওয়ার নেশায় যখন বৃক্ষ মশগুল, সেই খসা পাতার খসখসে সরে যাওয়ার শব্দ মন দিয়ে শোনে সে। এখানকার গোছানো নিয়ম যেন শৃংখলের মতো। এতদিনের বনের পাখি সে, হঠাৎই যেন খাঁচার দাঁড় কুহকে টানে তাকে। সুবাহুর শরীর মনে পড়ে। বস্ত্র উন্মোচনের পর সে শরীর কী আশ্চর্য সুন্দর! রাগলেখা দেখে, সামনে সারিবদ্ধ পলাশগাছ পুষ্পের আগমনে রক্ত লাল, শার্দুল লিঙ্গের মতো ভীষণ উদ্যত! সুবাহুর প্রশস্ত বাহুর সংযোগস্থলে তৃণাচ্ছাদিত যে কোমল ভূমি, সেখানে কস্তুরীর গন্ধ পেয়েছে সে। সুবাহুর দৃঢ় অথচ কোমল মুষ্টির ভিতর আঁকড়ে ধরা রাগলেখার স্তনের কাছে তার উদ্য়ত মুখে সে ব্যাকুল এক শিশুকে দেখেছে। এই মায়া যেন প্রেমিকের নয়, গভীর তিরবিদ্ধ মৃগের কাতরতা সুবাহুর সর্বাঙ্গে।



কিন্তু রাগলেখা এই মায়াকে ভয় পায়। ভয় পায় নিজের ছায়াকে। যে ছায়া এক মুহূর্ত পিছু ছাড়ে না তার। এই যেমন এখন প্রলম্বিত ছায়ার সঙ্গে তার প্রতিদিনের নির্জন ঘৃণা ও প্রেমের আদান-প্রদান চলেছে। এর মাঝে কেউ এসে দাঁড়ালে যেন সে নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর স্বাদ পায়। ভালবাসতে তার ভারী ভয়! কারণ একটি সম্পর্কের মৃত্যু শরীরের মৃত্যুর চেয়ে কম নয়। তার জীবনে সুবাহুর ছায়া ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছিল কিন্তু আচম্বিতে তাকে অতিক্রম করে এসে দাঁড়াল সেই দীর্ঘদেহী হন্তারক। যে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বাঁচার জন্য রাগলেখা অর্ধভারত চষে পথের জীবনে আশ্রয় নিয়েছে, সেই দুঃস্বপ্ন যেন আবার হানা দিয়েছে। মানবিক চেষ্টার
যাবতীয় অসারতা অর্থহীনতার মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠল সুবাহুর দুটি কঠিন বাহু, দুটি ঘন স্পৃষ্ট ধনুকের মতো ঠোঁট, শরাহত সেই চাহনি যার জন্য রাগলেখা মৃত্যু অবধি তুচ্ছ করতে পারে।

 

ছাড় বেদয়া পত্র: পর্ব ২

পরবর্তী পর্ব: ২৮ জানুয়ারি

*ছবি সৌজন্য – Pinterest 

সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *