বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের কোনও বৈরিতা নেই, এ কথা বলা বাহুল্য। বিজ্ঞানীর যে চেহারা সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে বা টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল অতি সামান্য। পেশাগত বিজ্ঞানীও সমাজবদ্ধ জীব, অন্য মানুষদের মতোই সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর পছন্দ-অপছন্দ থাকাটাই স্বাভাবিক। সাহিত্যের প্রতি বিজ্ঞানীর মনোভাবও অন্য মানুষদের মতোই বহুবিচিত্র হতে পারে। এই তালিকার একদিকে রাখতে পারি সর্বকালের সেরা জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনকে, যিনি শেষ বয়সে লিখেছিলেন সাহিত্য এমনকি শেক্সপিয়েরের নাটক থেকেও তিনি আর কোনও আনন্দ পান না। অন্যদিকে থাকবে বার্ট্রান্ড রাসেল, যিনি নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর সেরা গণিতজ্ঞ ও দার্শনিকদের মধ্যে একজন এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের বিজেতা। আর এই দুই প্রান্তসীমার মধ্যে কোথায় পড়বেন আমাদের দেশের সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু? 

নিঃসন্দেহে তিনি পড়বেন তাঁর শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের দলে, যিনি শেক্সপিয়ার বিশেষজ্ঞ হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণা এই লেখার বিষয় নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ-নিবন্ধও সাহিত্যেরই অংশ, বাংলা ভাষার সৌভাগ্য যে সাহিত্য ও বিজ্ঞান এই দুই জগতের দুই বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র উভয়েই সেই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে আমরা পরে সংক্ষেপে শুনব, তার আগে সাহিত্যের পরিচিত জগতে তাঁর পদচারণা সম্পর্কে আমরা কিছু কথা জেনে নিই। 

Satyendranath Bose
আমাদের দেশের সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু

সত্যেন্দ্রনাথ বসু কখনও গল্প, কবিতা বা উপন্যাস লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই, কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ নিয়ে সন্দেহমাত্র নেই। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’, সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনা সংকলন। সেখানে পাওয়া যাবে তাঁর অনূদিত কয়েকটি লেখা। তার মধ্যে যেমন আছে কিছু বিজ্ঞান বা অন্য বিষয়ে লেখা, তেমনই আছে কয়েকটি বিদেশি গল্পের অনুবাদ। ১৯৬৬ সালে হিব্রু ভাষায় নোবেলজয়ী লেখক শ্যুয়েল জোসেফ অ্যাননের তিনটি ছোট গল্প ফরাসি ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করেছিলেন। অপর এক নোবেলজয়ী লেখক হাইনরিখ বোয়েলের একটি ছোটগল্প তিনি মূল জার্মান থেকে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়াও তার অনুবাদের তালিকায় আছে ইতালিয়ান লেখক এডমন্ডো ডে অ্যাামিচির একটি ছোট গল্প। এই অনুবাদ গল্পগুলির প্রায় সবকটিই দেশ, অমৃত ও কম্পাস পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। মাত্র পাঁচটি লেখার মধ্যে বৈচিত্র খুঁজতে যাওয়া হয়তো অর্থহীন, তবু বলি অ্যাামিচির গল্পটি বিশুদ্ধ বিয়োগান্তক সাহিত্য, এক জাহাজে দুই কিশোর-কিশোরী মারিও ও জুলিয়েটার সাক্ষাৎ ও জাহাজডুবির সময় জুলিয়েটার জন্য মারিওর আত্মত্যাগের গল্প। বোয়েলের গল্পটিতে অর্থহীন যুদ্ধ কেমনভাবে সাধারণ মানুষকে নৈরাশ্যে ডুবিয়ে দেয় সেই কথা খুঁজে পাওয়া যাবে। অ্যাননের গল্পগুলি মূলত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার উপর ব্যঙ্গের কশাঘাত। নানা রকম বিষয় নিয়ে লেখা হলেও একদিক দিয়ে গল্পগুলোর মিল আছে, তাদের কোনওভাবেই বিজ্ঞান সাহিত্যের অন্তর্গত বলা যাবে না। 

শুধু বিদেশি নয়, সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যেরও অনুরাগী পাঠক। একবার এক রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে এসেছেন, তারপরে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে কদিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাবেন। গাড়ির পিছনের সিটে বসার জায়গা নেই, কারণ তা বাংলা গল্প, উপন্যাস, কবিতার বইতে ঠাসা; তাঁর ওই কদিনের রসদ। এ অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরিণত বয়সের কাহিনি, তবে শৈশব থেকেই তাঁর  সাহিত্য অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। বন্ধু পশুপতি ও গিরিজাপতি ভট্টাচার্যদের বাড়িতে হাতে লেখা পত্রিকা ‘মনীষা’-তে লিখেছিলেন ছোটবেলায় আসামে কাটানোর বিবরণ। ভাষার বিষয়ে তাঁর ছিল স্বাভাবিক দক্ষতা। স্কুলের শিক্ষকেরাও জানতেন সে কথা। ‘মেঘদূত’ ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ, টেনিসন ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন থেকেই ছিল তাঁর সঙ্গী। একই সঙ্গে তিনি ফরাসি ভাষাটাও শিখে নিয়েছিলেন। গবেষণা জীবনের সূচনাতে রপ্ত করেছিলেন জার্মান। ইতালিয়ান ভাষাতেও ব্যুৎপত্তি ছিল। সে যুগে বিজ্ঞানের ছাত্রদের বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনও ছিল, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যার অধিকাংশ যুগান্তকারী আবিষ্কার জার্মান ভাষাতেই প্রকাশিত হচ্ছিল। 

একবার এক রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে এসেছেন, তারপরে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে কদিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাবেন। গাড়ির পিছনের সিটে বসার জায়গা নেই, কারণ তা বাংলা গল্প, উপন্যাস, কবিতার বইতে ঠাসা; তাঁর ওই কদিনের রসদ। এ অবশ্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরিণত বয়সের কাহিনি, তবে শৈশব থেকেই তাঁর  সাহিত্য অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রের নিতান্ত কেজো ভাষা আর সাহিত্যের রসাস্বাদনের মধ্যে কিন্তু একটা পার্থক্য আছে। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষাচর্চাকে অবশ্যই দ্বিতীয় দলে ফেলতে হবে। বিশ্বভারতীতে তিনি যখন উপাচার্য, তখন অন্নদাশঙ্কর রায় দেখেছিলেন, বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদের সম্পর্কে তিনি পড়ছেন মূল ফরাসি ভাষাতে। তাঁর সাহিত্যানুরাগের সঙ্গে মিলেছিল বিজ্ঞানীর কৌতূহল, তাই ভাসের নাটক ‘চারুদত্ত’ ও শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ শুধুমাত্র পড়েই সন্তুষ্ট হননি, তাদের মধ্যে কোনটি প্রাচীনতর তা শব্দের বিবর্তন তত্ত্ব থেকে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছিলেন অন্নদাশংকরকে। ভাষাতত্ত্বে তাঁর এমনই দখল ছিল যে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অরিজিন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর ভূমিকাতে তাঁর অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। 

Rabindranath Tagore
  রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে ধ্রুবতারা

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে ধ্রুবতারা। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সমর্থনে বক্তৃতাতে তিনি বলছেন, “রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষা যে কোনো কাজে অপটু এ আমি স্বীকার করতে নারাজ।” অন্যত্র তিনি বলেছেন, “মানুষটা কতদিকে কতকিছু যে করে গেলেন! থই মেলা ভার!”  রবীন্দ্রনাথকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন জোড়াসাঁকোতে; বন্ধু মাণিকলাল দে’র সঙ্গে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়িতে বিচিত্রা ক্লাবের বৈঠকে। আমন্ত্রণ আসত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের থেকে। রবীন্দ্রনাথ থাকতেন অনেক সভাতে। অনেক বছর পরে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তিনি লিখেছিলেন, সৌমেন্দ্রনাথের কথা শুনে “বিচিত্রায় রবীন্দ্রনাথের কথার রেশ যেন বাজতে থাকে মনের মণিকোঠায়।”

কবির ভাইঝি ইন্দিরা দেবীর স্বামী বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে সেখানেও তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। দেখা হয়েছিল ঢাকাতেও, কিন্তু স্বভাবগতভাবেই এগিয়ে গিয়ে কখনও পরিচয় করেননি। পরে আইনস্টাইন যখন রবীন্দ্রনাথের কাছে বোসের খবর জানতে চান, তখন রবীন্দ্রনাথ নিজের তাগিদেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সত্যেন্দ্রনাথ বারবার গেছেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বপরিচয়’ তাঁকেই উৎসর্গ করা, প্রকাশের পূর্বে তা সংশোধন করে দেওয়ার জন্য কবির অনুরোধ তিনি সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সত্যেন্দ্রনাথের মূল্যায়ন, “… তাঁর সমস্ত বাক্যজালের ভেতর দিয়েও চিরন্তন সত্য, যে সত্য রূপায়িত হয়নি, যে সত্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে, সেই সত্যের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন।” বিজ্ঞানী যে চিরন্তন সত্যের অন্বেষণ করে চলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও তিনি তার ইঙ্গিত পেয়েছেন।

আরও পড়ুন: ক্যালকাটা ফ্যান: এক অক্লান্ত সংগ্রামীর স্বপ্ন

বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা নিয়ে এসেছিল ‘সবুজপত্র’ পত্রিকা। সত্যেন্দ্রনাথ তার ভগীরথকূলের মধ্যে থেকেও বেছে নিয়েছিলেন অন্তরাল। তিনের এক বিডন স্ট্রিটে দোতলার ঘরে এক বৈঠকে পত্রিকার নাম ঠিক হয়। সেখানেই প্রচ্ছদ আঁকা হল, সম্মতি দিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯১৮ সালে হারীতকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে তাঁর বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করেছিলেন সবুজপত্র গোষ্ঠী। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে সবুজপত্রের দলে নিয়ে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তবে প্রমথ চৌধুরী সত্যেনকে দিয়ে কলম ধরাতে পারেননি। হাল ছেড়ে দিয়ে লিখেছিলেন, “সত্যেন্দ্র সাদা কাগজের উপর কালো আঁচড় কাটেন না, বোধহয় তার কারণ তিনি কালো বোর্ডের উপর সাদা খড়ির আঁচড় কাটাটাই তাঁর স্বধর্ম বলে স্থির করে নিয়েছেন।” হারীতকৃষ্ণের সূত্রেই সত্যেন্দ্রনাথের সবুজপত্রের আসরে প্রবেশ। তিনি লিখেছেন, “সম্ভবত মুখের কথায় বন্ধুবরের অতিশয় ভক্তি থাকায় কলমের কালিমায় সে-ভক্তিকে কলঙ্কিত করতে চাননি।” 

Parichayসুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। সেবার গরমের ছুটিতে কলকাতায় এসেছেন, প্রথম সংখ্যায় তাঁর লেখা চাই। বন্ধুরা সত্যেনকে একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখলেন, লেখা না দিলে মুক্তি নেই। পাওয়া গেল প্রবন্ধ, ‘বিজ্ঞানের সংকট’। সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছাড়াও পরিচয়ের প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুশোভন সরকার, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যয়ের মতো মানুষেরা। এঁদের অনেকেই ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পত্রিকার সম্পাদনাতেও সাহায্য করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। একবার এক বিখ্যাত লেখকের লেখা ছোট করার জন্য নির্মমভাবে কাটাছেঁড়া করে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থটি তাঁকেই উৎসর্গ করেছিলেন। 

Bangiya Bijnan Parishad
বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সামনে

‘বিজ্ঞানের সংকট’ দিয়ে হাতেখড়ির পরে বিজ্ঞান সাহিত্যে আরও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, যদিও তার সংখ্যা অল্পই। তাঁর লেখা প্রবন্ধের সংখ্যা দিয়ে বিজ্ঞান সাহিত্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানকে বিচার করা যাবে না। বাংলাতে বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন অনেককে। ঢাকাতে থাকাকালীন তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামক দ্বিমাসিক পত্রিকা, সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতাতে আসার পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ জন্মলগ্ন থেকেই প্রকাশ করেছিল ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা, তা আজও নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে। সেখানে লেখেননি পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও পরিচিত বিজ্ঞান সাহিত্যককে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অধ্যাপক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিখ্যাত বই ‘বঙ্গসাহিত্যে বিজ্ঞান’ সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যোগেই পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা এবং বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের অবদান অতুলনীয়। 

বিজ্ঞান সাহিত্য কেমন হতে হবে সে সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট মতামত ছিল। একদিকে যেমন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো বিজ্ঞান লেখক শেষ পর্যন্ত পুরাতনী মনোভাব গ্রহণ করার ফলে কোনও স্থায়ী সাহিত্যকীর্তি রেখে যেতে পারেননি, সেকথা লিখতে তিনি সঙ্কোচ বোধ করেননি, তেমনই বিজ্ঞান বিষয়ে রামেন্দ্রসুন্দরের ভাষার প্রশংসায় তিনি ছিলেন পঞ্চমুখ। ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকাতে প্রথম বছর লেখকদের জন্য যে নিবেদন রাখা হয়েছিল, তা থেকে এখনও আমরা বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ পেতে পারি। সংক্ষেপে বলা যায়, (১) লেখা এমন বিষয়ে হওয়া উচিত যা মানুষকে আকৃষ্ট করে; (২) ভাষা হতে হবে সহজ-সরল; (৩) লেখা অনাবশ্যক দীর্ঘ না করে পত্রিকার চার-পাঁচ পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই ভালো; (৪) উপযুক্ত পরিভাষা না থাকলে বিদেশি শব্দকে বাংলা হরফে লেখাই বাঞ্ছনীয়। 

সাহিত্যানুরাগী সত্যেন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করতে বসে শেষ পর্যন্ত একটা কথা মনে হয়— তিনি এমন একজন মানুষ যাকে খণ্ডিত করে চেনার চেষ্টা কিছুদূর পর্যন্তই সফল হওয়া সম্ভব। কবি বিষ্ণু দে বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিনে উপলক্ষ্যে যা লিখেছিলেন, তাই হয়তো তাঁর শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন—

“যাঁকে চেনা মনের একটি জয়,
মানবিক বড় অভিজ্ঞতা।
আশ্চর্য সে মন, ব্যাপ্তি যার সর্বদিকে,
শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, সঙ্গীতে, অথচ
প্রত্যহের জীবনসম্ভোগে–” 

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Picryl, Wikisource,

Gautam Gangopadhyay Author

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব। বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আছে সত্যেন্দ্রনাথের একটি ছোট জীবনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *