প্রায় তেত্রিশ বছর আগে সামান্য পুঁজি সম্বল করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া আজকের মত ডাল ভাত ছিল না। তাই যখন একটা স্যুটকেস হাতে ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের এক পড়ন্ত বিকেলে অভিবাসী হয়ে সিডনিতে হাজির হলাম মনে নানা রকম আশঙ্কা জাগছিল। ‘নৌকা পুড়িয়ে‘ অবশ্য আসিনি— বেশ আরামের আধা সরকারী চাকরি থেকে এক মাস ছুটি নিয়ে এসেছি স্ত্রী এবং শিশুকন্যাকে দেশে রেখে। পরিকল্পনা ছিল এই সময়ের মধ্যে নতুন দেশে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পাকাপাকিভাবে থাকার বা ফিরে যাবার সিদ্ধান্তে আসার।
প্রথম কয়েকমাসে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার অনেকটাই আমার অঙ্কের হিসাবে ছিল না। বিস্তারিত বিবরণ দেব না— তবে সংক্ষেপে কিছু বলতে হবে পাঠককে সেই সময়ের পরিস্থিতির বিষয়ে কিছুটা বোঝানোর জন্য।
এবারের লেখা মূলত অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক নিরাপত্তা (social security) ব্যবস্থা নিয়ে। এই সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়টি সারা অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আশাকরি পাঠকদের, এবং ভবিষ্যতের অভিবাসীদেরও কিছু অজানা তথ্য দিতে পারব।

বলাই বাহুল্য, এই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অস্ট্রেলিয়ার একচেটিয়া নয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত এবং প্রগতিশীল দেশের অধিবাসীরা সরকার-প্রদত্ত এই ধরণের সুবিধা কমবেশি উপভোগ করেন। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক ইত্যাদি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলির ব্যবস্থা শুনেছি মোটামুটিভাবে সেরা। সে দেশের সরকার নাগরিকদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন।
দেশে থাকতে মোটামুটি কম মাইনের চাকরিতেও কিছুটা কর দিতে হত। বিনিময়ে (সত্তর বা আশির দশকের কথা বলছি) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সুবিধাই নজরে আসত না। প্রচলিত ধারণা ছিল আয়কর শুধু অলস সরকারী কর্মচারীদের বেতন এবং নিম্নমানের সরকারী পরিষেবার খাতে ব্যয় হয়। ধারণাটা বোধহয় পুরোপুরি ভ্রান্ত ছিল না। তাই সিডনিতে পা দেবার পরেরটি দিনই একটা বেশ সুখকর অভিজ্ঞতা হল। আমন্ত্রণপত্রে অভিবাসন দফতর বেশ কয়েকটি সরকারী দফতরে নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রত্যাশা ছিল লাল ফিতেয় মোড়া কোনও অপরিচ্ছন্ন সরকারী অফিসে কিছু অভদ্র সরকারী কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাতের। সেই কথা ভেবে ঘুম থেকে উঠে খুব একটা উজ্জীবিত বোধ করছিলাম না।
নির্দেশিত দফতরগুলির মধ্যে একটি ছিল সামাজিক নিরাপত্তার ভারপ্রাপ্ত। ঝকঝকে পরিবেশে একটি মধ্য তিরিশের সুশ্রী শ্বেতাঙ্গিনী মহিলার প্রশ্ন তালিকার একটি ছিল আমার কাছে কত অর্থ আছে। সেই অপ্রতুল বৈদেশিক মুদ্রার আমলে কুড়িয়ে বাড়িয়ে শ’পাঁচেক ডলার নিয়ে এসেছিলাম সপ্তাহ তিনেক কোনওরকমে চলার মতো। আশা ছিল ঐ সময়ের মধ্যে কোনও কাজ পেয়ে যাব। ভদ্রমহিলা আমার পুঁজির বহর শুনে প্রায় আঁতকে উঠলেন। এরপর আমার তাজ্জব হওয়ার পালা শুরু। বুঝলাম সেই মুহূর্তে আমি সরকারীভাবে বেকার। সেই জন্য আমার নথিভুক্ত হবার দিন থেকেই দু সপ্তাহ অন্তর কিছু অর্থ প্রাপ্য। সেই ‘বেকার ভাতা‘ নাকি সরাসরি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়।
ভদ্রমহিলার চিন্তার কারণ পরবর্তী বেকারভাতা প্রদানের নির্দিষ্ট তারিখ দিন দশেক পরে। এই কদিন আমার চলবে কী করে? তড়িঘড়ি আমায় কিছু নগদ অগ্রিমের ব্যবস্থা করে দিলেন। পুরো ব্যাপারটাতে ধাতস্ত হতে কিছু সময় লেগেছিল।

আই.আই.টির স্নাতক দিসাবে বেকারত্ব ব্যাপারটা আমার ভাবনার মধ্যে কোনওদিনও ছিল না। পাশ করার বেশ কয়েকমাস আগেই একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুভব করলাম, সেই মুহূর্তে একটা নতুন দেশে সদ্য এসে আমার পরিচিতি একজন বেকার ছাড়া আর কিছুই নয়। বুঝলাম যতদিন না কাজ পাচ্ছি সরকারের দায়িত্ব আমার মোটা ভাত–কাপড়ের জোগান দেওয়া।
অস্ট্রেলিয়া সেই সময়ে একটা বড় রকমের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে চলছে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী দেশের ১১ শতাংশ কর্মপ্রার্থী মানুষ বেকার। এর ওপর অনতিদূর খ্রিষ্টমাসের ছুটির জন্য বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই সেই সময়ে নতুন কর্মী নিয়োগে অনুৎসাহী। তাই যত সহজে কাজ পাব ভেবেছিলাম আদতে তা হয়নি— নিস্ফল দরখাস্ত করে গেছি নতুন বছর অবধি। এই কয়েক মাস স্ত্রী কন্যা (সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ওরা এসে গিয়েছিল) নিয়ে কাজ খুঁজে যেতে পেরেছি এই সরকারী সাহায্যের জন্যই। না হলে হয়ত হাল ছেড়ে দেশে ফিরে আসতে হত।
আরও পড়ুন: জীবন থেকে জীবনে: অন্তিম পর্ব
আয়ের পুনর্বন্টন সংক্রান্ত তত্ত্ব কিছুটা অর্থনীতি পাঠের সুবাদে অজানা ছিল না। তবে কিছু না করে ঘরে বসে অর্থপ্রাপ্তির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাটা কেমন যেন আরব্য রজনীর গল্পের মত লেগেছিল।

পরবর্তীকালে কাজ পাওয়ার পর আবার কর দিতে শুরু করেছি। এদেশের সামাজিক নিরাপত্তা প্রক্রিয়া এবং উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি। ব্যক্তিগত এবং ব্যবসা কর এবং অন্যান্য শুল্ক সরকার নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসাবে বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেন, যার একটি বৃহৎ অংশ নির্দিষ্ট থাকে জনকল্যাণের জন্য। ধনতান্ত্রিক দেশে চাকরির স্থিরতা কম। ব্যবসায় মন্দা এলে রাতারাতি কিছু মানুষ ছাঁটাই হয়ে যেতেই পারেন। নানা পারিবারিক পরিস্থিতি বা অসুস্থতাজনিত কারণেও সব সময়ে কাজ করা সম্ভব হয় না। অবস্থাটা অধিকাংশ মানুষের কাছেই কাম্য নয়। চাকরি খোওয়ালে বা কাজ করার অবস্থায় না থাকলে জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তনই করতে হয়। এই ধরণের কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার সাময়িক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়— মানুষ আত্মমর্যাদা বজায় রেখে বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে।
এই ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ কী করত ? বাবার কাছে শুনেছি বাংলায় ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বর্ণনা, অসহায় মানুষের “একটু ফ্যান দাও গো” বলে কাতর আর্তির কথা। তবে সাহেবরা ঐ ভাবে অনাহারে অর্ধাহারে মরার জাত নয়— বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন হলে চুরি ডাকাতি খুন জখম রাহাজানি করবে ওরা। এই সহজ সত্যটি সাধারণ মানুষ জানে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তাই বেকার ভাতা, পেনশন এবং অন্যান্য খাতে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রায় সর্বজনীন সমর্থন আছে। ২০১৪ সালের বাজেটে তৎকালীন রক্ষণশীল সরকার কিছু বড় রকমের পরিবর্তনের চেষ্টা করে প্রায় গদি হারাতে বসেছিলেন।

তবে পাঠক ভেবে বসবেন না বেকার ভাতায় রাজার হালে থাকা যায়। একেবারেই নয়। কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার গড় ব্যক্তিগত আয় ৯০ হাজার ডলার। কর বাদ দিলে হাতে থাকে ৬৫ হাজার মতো। ১৯ বছরের কম দুটি সন্তান সমেত একটি পরিবার বেকার ভাতা এবং অন্যান্য কয়েকটি খাতে মিলিয়ে ৫৫ হাজার ডলারের মতো সরকারি অনুদান পান। বড় বা মাঝারি শহরে বাড়িভাড়া কম করে ২০ হাজার, চারজনের ভদ্রগোছের খাওয়ার খরচ অন্তত ১৫ হাজার। এই হিসাব অনুযায়ী থাকা খাওয়ার পর একটি চাকুরিরত পরিবারের উদ্বৃত্ত অর্থ ৪৫ হাজার। তুলনায় বেকারভাতা-নির্ভর পরিবারের হাতে থাকে মাত্র ২০ হাজার— যা দিয়ে পরিবহন, ক্রমবর্ধমান গ্যাস–বিদ্যুতের খরচ, জামাকাপড়, মনোরঞ্জন, ইত্যাদি নানা খরচ মেটাতে হয়। সুতরাং মানুষের কাজ খোঁজার তাগিদ রয়েই যায়। (প্রসঙ্গত বলে রাখি, আপাতত অস্ট্রেলিয়ান ডলারের বাজারমূল্য কমবেশি ৫০ টাকা হলেও তুলনামূলক ক্রয়ক্ষমতা অনেক কম— বড়জোর ২০ টাকার সমান। সুতরাং উপরোক্ত বেকার ভাতার ক্রয়ক্ষমতা ১০ লক্ষ টাকার মতো। নেহাত কম নয়)।
অবশ্য এই ব্যবস্থা সর্বদা ছিল না। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর মন্দার সময়ে মানুষের নানারকম দুর্দশার কথা শোনা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরোত্তর উন্নতি হতে থাকে। ঐ সময় থেকেই বেকারভাতা, পেনশন ইত্যাদি কল্যাণ ব্যবস্থার উন্নতির শুরু। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে অবশ্য ব্যবস্থাগুলির প্রয়োজনীয় সংশোধনও হয় থেকে থেকে।
অভিবাসীদের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বড় পরিবর্তন এসেছিল ৯০ দশকের মাঝামাঝি রক্ষণশীল দল (লিবারেল ও ন্যাশনাল পার্টির সমঝোতায় গঠিত, পরিচিতি ‘কোয়ালিশন‘ নামে) ক্ষমতায় আসার পর। সেই সময় থেকে নতুন অভিবাসীদের বেকারভাতা প্রাপ্তির জন্য দুই বছরের অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সে জন্য মনে হয় না ভারতীয় অভিবাসীদের কিছু এসে গেছে। ২০০১ সালের জনগণনায় ভারতজাত মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ, এই মুহূর্তে তা ৮ লক্ষ ছুঁই ছুঁই, জনসংখ্যার ৩ শতাংশ। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি এবং অন্যান্য পেশার শিক্ষিত মানুষ এদেশে দাপটের সঙ্গে মাথা উঁচু করে আছেন। এক সহকর্মিনী ভদ্রমহিলা একদিন আমায় প্রশ্ন করেছিলেন “আপনাদের এত বুদ্ধি হয় কী করে বলুন তো? কী খান আপনারা?”
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১০ মার্চ , ২০২৩
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।