ধরা যাক, একটা ওয়ার্ড ফাইল খোলা রয়েছে এক ঘণ্টা ধরে। অনেক দূর থেকে দেখা, লাইটহাউসের আলোর মতো একটা একা, নিঃসঙ্গ কার্সার শূন্য স্ক্রিনটায় যাচ্ছে, আসছে, যাচ্ছে। লেখক মানুষটি তাকিয়ে রয়েছেন পর্দার দিকে। একটা শব্দও লিখতে পারেননি আজ। এই নিয়ে পরপর পাঁচ দিন। সপ্তাহের শুরুতে প্রথম যেদিন ওয়ার্ড ফাইলটা খুলেছিলেন, একটা তরতাজা স্ক্রিন দু’দিকে দু’হাত বাড়িয়ে যেন ডেকেছিল তাঁকে। সর্বস্ব নিয়ে ছুট্টে চলে গিয়েছিলেন লেখক, সেই সাদা পর্দার দিকে। ভেবেছিলেন, অক্ষরে অক্ষরে অক্ষৌহিনী সেনার জন্ম দেবেন ওই স্ক্রিনে, পাতার পর পাতায়। কিন্তু হঠাৎ করে যে কী হল! লিখতে বসার প্রবল উৎসাহই সার, তার পরে লেখা এগলো না এক অক্ষরও। রোজ দু’ঘণ্টা শূন্য পাতার সামনে ঠায় বসে থাকেন, অক্ষর প্রসবের অপেক্ষায়। ‘ধুত্তেরিকা’ বলে রোজ দুম করে, ঘেন্না মিশিয়ে, সজোরে বন্ধ করে দেন ল্যাপটপের স্ক্রিন। মনে আশা থাকে, আজ হল না। কাল হবে ঠিক। কালের পর কাল যায়। লেখা এগোয় না।
স্ক্রিনের বদলে এবারে ধরি একটা সাদা পাতা। নতুন খাতার মলাটটা উল্টনোর পর প্রথম সাদা পাতার উপরে রাখা আছে একটা কলম। সোনালি নিব ঝকমক করছে। আগের উপন্যাসটা তো এই ঝরনা কলমেই লিখেছেন তিনি। বেস্টসেলারের তালিকা থেকে বইটা যখন আর নামতেই চায় না সপ্তাহের পর সপ্তাহ, ঠিক করেছিলেন পরের উপন্যাসটার চলনেও ওই কলমই সঙ্গী হবে। কাপড় দিয়ে বাঁধানো দামি খাতা দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। লেখার টেবিলে রোজ নিয়ম করে বসেও একটা শব্দ লিখে উঠতে পারছেন না। নিজের উপর এবার ক্রমশ বিরক্তি ধরতে শুরু করেছে। তাহলে কি স্টক ফুরোল? লেখালিখি করা ছেড়ে দেবেন এবার? সেটা ভাবলেও তো সারা শরীর জুড়ে হিম স্রোত বয়ে যায়। জীবনজোড়া একঘেয়েমির মধ্যে এটুকুই তো অক্সিজেন! এই লেখালেখি ছাড়া বাঁচবেন কী করে? কী নিয়ে? না না তা হয় না। কিছুতেই হয় না। কিন্তু কলমটাই যদি দিনের পর পর দিন এ ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তা-ই বা কী করে মেনে নেওয়া যায়!
এ গোলমালের বাহারি নাম ‘রাইটার্স ব্লক’। তবে আমাদের ডালহৌসি স্ক্যোয়ারের রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সঙ্গে কিন্তু এর কোনও সম্পর্ক নেই! সোজা কথায় বলতে গেলে, রাইটার্স ব্লক হল এমন এক সমস্যা যার ফলে লেখকরা সাময়িকভাবে আর লিখতে পারেন না। এ যেন এক প্রসারিত হাইওয়েতে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা এক আপাত অলঙ্ঘনীয় পাহাড়। গাড়িতে ফুল ট্যাঙ্ক তেল ভরে দুগ্গা দুগ্গা বলে যাত্রা শুরু করার আগে যে বাধার কথা আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি। এক পরিচিত সাহিত্যিকের কথা মনে পড়ছে। উনি কথাপ্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, লিখতে বসার আসলে দু’টো উপায় আছে। এক, ভালো করে আগে ভেবে নেওয়া। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার ডায়লগের মতো, ভাবা প্র্যাকটিস করা। লেখাটা আগেই লেখা হয়ে যাবে মাথায়। এবার খাতা খোলা। হাত তখন কাজ করবে প্রিন্টারের মতো। আর অন্য পদ্ধতিটা হল, রোজ নিয়ম করে আগে খাতা খুলে তারপর ভাবতে বসা। প্রতিদিনের বাজার যাওয়ার মতো একটা অভ্যেস। ওই সাহিত্যিক মজা করে বলেছিলেন, রাইটার্স ব্লকের খপ্পরে একবার পড়ে গেলে, ভেবে নিয়ে খাতা খোলা কিংবা খাতা খুলে ভাবতে বসা— এই দু’টো রাস্তার একটাও কাজ করে না। সত্যি কথা বলতে কী, মাথার মধ্যে ভাবনার যে গুপ্ত কুঠুরিটা আছে, রাইটার্স ব্লক তার দরজাটাই তো দড়াম করে বন্ধ করে দেয় সবার আগে।
কাপড় দিয়ে বাঁধানো দামি খাতা দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। লেখার টেবিলে রোজ নিয়ম করে বসেও একটা শব্দ লিখে উঠতে পারছেন না। নিজের উপর এবার ক্রমশ বিরক্তি ধরতে শুরু করেছে।
পৃথিবীর তাবড় তাবড় লেখকেরা এই রাইটার্স ব্লকের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়েছেন, কষ্টের বিবরণ সাক্ষাৎকারে বলেছেন। অধিকাংশই লেখেননি। বিদেশে তাও যদি বা কেউ কেউ লিখেছেন, এই উপমহাদেশের লেখকদের এমন অভিজ্ঞতার কথা সচরাচর নথিবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। ইংরেজ ঔপন্যাসিক ফিলিপ পুলম্যান বলেছিলেন, “যে কোনও লেখাই শক্ত কাজ। যে দিনটায় অন্য দিনের থেকে অপেক্ষাকৃতভাবে সহজে লেখার কাজটা করা যেতে পারে, সেই দিনটাই আশার। প্লাম্বারদের প্লাম্বার্স ব্লক হয় না, চিকিৎসকদেরও ডক্টর্স ব্লক হয় না। লেখকদের ক্ষেত্রেই কেন এমন একটা নাম দিয়ে সমব্যথিতা প্রত্যাশা করা হবে?” আসলে প্রশ্নটা সমব্যথিতার নয়, প্রশ্ন সৃষ্টিশীলতার এবং তা থমকে যাওয়ার।
মায়া এঞ্জেলোর কথায় আসি। তিনি বলেছিলেন, “আমি শুধু লিখে যাওয়ার চেষ্টা করি। দরকার পড়লে দু’সপ্তাহ ধরে আমি এটাই লিখব— একটা বিড়াল মাদুরের উপর বসল। এর মতো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর অন্য কিছু হয় না। কিন্তু আমি চেষ্টা করি। যখন আমি লিখতে বসি, আমি শুধুই লিখি।” স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, লিও তলস্তয়, ভার্জিনিয়া উলফ থেকে শুরু করে এ যুগের হার্পার লি, জোসেফ মিশেলের মতো লেখকেরাও রাইটার্স ব্লকের শিকার হয়েছেন। শোনা যায়, সৃষ্টিশীলতার এই স্তব্ধতা থেকে বেরতে না পেরে আফিমে ভয়ংকর আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন কোলরিজ। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ত এই আসক্তিকে গাঢ় করেছিল আরও। এমন উদাহরণ বহু দেওয়া যায়।
কেন হয় রাইটার্স ব্লক? কেন হঠাৎ করে থমকে যায় সৃষ্টিশীলতা? কারণটা শারীরিক না মানসিক? লেখকরা বলেন, অবসাদ এর অন্যতম কারণ। জীবনের ঘটনাগুলো তো কোনও অনুষ্ঠানবাড়ির মেনু কার্ড মেনে পরপর আসে না। সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরে বহু ক্ষেত্রে ওই লালন করা সম্পর্ক ভেঙে যায়। এর প্রভাব পড়ে লেখায়। আর্থিক কষ্ট অনেক সময়ই নতুন লেখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’-য় প্রকাশিত ওয়াসি আহমেদের একটি লেখা থেকে জানতে পারি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানিয়েছিলেন, আগের মতো লিখতে ‘বল না পাওয়া’-র কথা। ওপার বাংলার প্রবাদপ্রতিম লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লেখালিখি শুরু করেছিলেন ষাটের দশকে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর লেখার পরেই কলম থামিয়ে দেন। ফিরে আসেন প্রায় বছর দশেক পরে। গত দশ বছর কি রাইটার্স ব্লকের শিকার হয়েছিলেন তিনি? জানা যায় না। ইচ্ছে করে কেউ তো নিজের লেখা থামান না। তবে অন্য দিকে অনেক সাহিত্যিক এটাও বলেছেন যে, এই রাইটার্স ব্লক বলে হয়তো আসলে কিছু হয় না। পুরো ব্যাপারটাই মানসিক এক স্তব্ধতা। কিন্তু এর বদ্ধ দেওয়াল থেকে তাঁরাও জীবনের একটা সময় বেরিয়ে আসতে পারেননি।
কেন হয় রাইটার্স ব্লক? কেন হঠাৎ করে থমকে যায় সৃষ্টিশীলতা? কারণটা শারীরিক না মানসিক? লেখকেরা বলেন, অবসাদ এর অন্যতম এক কারণ। জীবনের ঘটনাগুলো তো কোনও অনুষ্ঠানবাড়ির মেনু কার্ড মেনে পরপর আসে না। সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরে বহু ক্ষেত্রে ওই লালন করা সম্পর্ক ভেঙে যায়। এর প্রভাব পড়ে লেখায়। আর্থিক কষ্ট অনেক সময়ই নতুন লেখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নতুন লেখাটা যদি ভালো না হয়, পাঠক যদি আগের লেখাগুলোর মত সাদরে এই লেখাটাকে গ্রহণ না করে ছুঁড়ে ফেলে দেন ডাস্টবিনে— এই ভয়ও অনেক সময় লেখকদের নতুন লেখার জন্ম দেওয়ার আগে, লেখা এগনোর আগে মাঝেমধ্যেই ভাবায়।
চিকিৎসকেরাও উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন সৃষ্টিশীলতার এই নৈঃশব্দের। তাঁরা বলেছেন, এর উৎস লুকিয়ে রয়েছে আমাদের মস্তিষ্কে। আমাদের মাথার সেরিব্রাল কর্টেক্স অংশটাই আসলে লেখায়। আর এই অংশ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সৃষ্টিশীলতাও মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে কিন্তু শুধু শারীরিক আঘাত নয়। মানসিক আঘাতও একই রকম ভাবে পীড়া দেয়। আবেগপ্রবণ মানুষ হলে মানসিক কষ্ট হয়তো শরীরের যন্ত্রণাকেও ছাপিয়ে যায় অনেক সময়।
গ্লোবালাইজেশনের যুগে লেখালিখিও ক্রমশ ডিজিটাল মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বহু মানুষ লেখার জন্য ফেসবুককে বেছে নেন। কোনও লেখা সম্পাদকের মনোনয়নের জন্য অপেক্ষা করার ঝামেলা নেই, সম্পাদকের টেবিলে মাসের পর মাস বন্দি হয়ে থাকা লেখার প্রাসঙ্গিকতা হারানোর ভয় নেই, নিজের লেখায় তৃতীয় ব্যক্তির ছুরি-কাঁচি চলারও কোনও আশঙ্কা নেই। মাথায় লেখা এল, লিখে ফেলা হল, চোখের পলকে পোস্ট হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর পরে শুধুই লাইক, শেয়ার আর কমেন্টস। ভাবলে অবাক হতে হয়, এমন মাধ্যমে লেখেন যাঁরা, তাঁদেরও রাইটার্স ব্লক হয়। কারণটা বড় অদ্ভুত। লাইক না পাওয়ার ভয়।
এটা পড়েই তার্কিকরা তর্ক জুড়বেন। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথ একটার পর একটা লিখে গেলেন কোন ম্যাজিকে? তাঁর মানসিক আঘাত কম ছিল? একের পর এক স্বজন হারিয়েছেন জীবনে। তিন সন্তান ঝরে গিয়েছেন অকালে। তা হলে লিখলেন কী করে? কী করে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও পর পর ক্লাসিকের জন্ম দিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়? তাঁরা বলবেন, বিপন্নতা ছাড়া লেখা হয় নাকি? রবীন্দ্রনাথ, মানিকের মতো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে শ’য়ে শ’য়ে। কিন্তু আমরা এটাও তো বুঝি, সৃষ্টিশীলতা আর বিপন্নতা— কোনওটাই অঙ্কের মতো সমীকরণ মেনে চলে না। নাটকের স্টেজের মতো এক এক মানুষের কাছে জীবনের পর্দা এক এক রকম ভাবে খোলে। এ নিয়ে তর্ক অন্তহীন।
একটু এ যুগের দিকে তাকাই এবারে। গ্লোবালাইজেশনের যুগে লেখালিখিও ক্রমশ ডিজিটাল মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বহু মানুষ লেখার জন্য ফেসবুককে বেছে নেন। কোনও লেখা সম্পাদকের মনোনয়নের জন্য অপেক্ষা করার ঝামেলা নেই, সম্পাদকের টেবিলে মাসের পর মাস বন্দি হয়ে থাকা লেখার প্রাসঙ্গিকতা হারানোর ভয় নেই, নিজের লেখায় তৃতীয় ব্যক্তির ছুরি-কাঁচি চলারও কোনও আশঙ্কা নেই। মাথায় লেখা এল, লিখে ফেলা হল, চোখের পলকে পোস্ট হয়ে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর পরে শুধুই লাইক, শেয়ার আর কমেন্টস। ভাবলে অবাক হতে হয়, এমন মাধ্যমে লেখেন যাঁরা, তাঁদেরও রাইটার্স ব্লক হয়। কারণটা বড় অদ্ভুত। লাইক না পাওয়ার ভয়।
ধরা যাক, প্রথম লেখাটা দু’শো লাইক পেয়েছিল। দ্বিতীয়টা মাত্র পঁয়ত্রিশ। এটা দেখে মরমে মরে গিয়ে, গুমরে গিয়ে তৃতীয় লেখাটাতে আর হাত দিতে পারেন না লেখক। মনের মধ্যে দোলাচল। কে পড়বে? এত কষ্ট করে লিখে যদি একটাও লাইক না পাই এ লেখায়? এ যেন দুনিয়াজোড়া এক ক্লাসরুমের সামনে প্রকাশ্যে অ্যানুয়াল পরীক্ষার মার্কশিট বিতরণ। কম লাইক অথবা না-লাইক মানে এ পরীক্ষায় তুমি ডাহা ফেল। আর এই ভয়েই নতুন লেখার দিকে হাত দিতে পারেন না নব্য লেখক। লাইকের সংখ্যা লেখার মানের সঙ্গে সমানুপাতিক— এমন এক ভ্রান্ত ধারণা তাঁদের মাথার মধ্যে স্ক্রু দিয়ে এঁটে দিয়েছে আজকের এই ভার্চুয়াল দুনিয়া। আমার এক কবি বন্ধুকে দেখেছিলাম, প্রতিটি লেখা ফেসবুকে পোস্ট করার পর একটা ডায়রিতে লিখে রাখতে, পোস্ট করার প্রথম দিনে তাতে লাইক পড়ল কত। আর সেই ডায়রিটা ছিল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ঠিক যেমনভাবে প্রতিটা কবিতার শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখে রাখতেন তারিখ ও রচনা-স্থান।
রাইটার্স ব্লক না হয় হল, এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী? অনেকে ভুরু কুঁচকে বলতেই পারেন, এটা কোনও অসুখ হলে তবে তো তার পথের সন্ধান। এ তো কোনও অসুখই নয়। অসুখী ভাবটা আবার অসুখ হল কোন কালে? তবে যাঁরা এর খপ্পরে পড়েছেন, তাঁরা মুক্তির নানা উপায় খুঁজে গিয়েছেন। কেউ কেউ আজীবন। কেউ এই না লেখার শিকল কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, অনেকে পারেননি। মুক্তির উপায় নিয়ে প্রশ্ন করলে এ ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন, লেখালিখি থেকে মনটা একদম সরিয়ে নিলেই কাজের কাজ হবে। দুনিয়ার সব কিছু নিয়ে ভাবা শুরু করা যেতে পারে, শুধু লেখালিখিটা ছাড়া। আমার এক পরিচিত সাহিত্যিক রাইটার্স ব্লক থেকে নিষ্কৃতির উপায় জানতে শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের। বয়স্ক ডাক্তারবাবু সব শুনে বলেছিলেন, “আরে আঁতলামিটা ছাড়ুন তো মশাই। প্র্যাক্টিকাল হোন। কী হবে লিখে?” সাহিত্যিক পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এই ‘কী হবে লিখে’-র উত্তর কিংবা উপলব্ধি তো তাঁর একান্ত নিজের। বলেছিলেন, জড় দুনিয়াকে এর মানে বোঝানোর চেষ্টা বৃথা।
কেউ বলেন, লেখা না এলেই ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুমনোর চেষ্টা করুন অন্তত। বাস্তবটাকে ভুলে থাকুন। এভাবেই দুম করে মাথার মধ্যে চলে আসবে নতুন কোনও প্লট, অথবা কোনও থমকে যাওয়া লেখার পরের কয়েকটা লাইন। অনেকে পরামর্শ দেন, বেশি করে চা-কফি খান। পছন্দের সিনেমা দেখুন। ভাল লাগা গান শুনুন সারা দিন। নদীর ধারে বসুন। জলের ছলাৎছল শুনুন। এমন মতের উল্টো মতও বাজারে আছে ভালই। তাঁরা পরামর্শ দেন, লেখা না এলে ওই লেখাকেই আরও জাপ্টে ধরে থাকার চেষ্টা করুন, অন্তর দিয়ে। প্রাণভোমরার মতো লেখার চিন্তাকে আদর করুন আরও। কোন অবস্থায় চিন্তার সেই মাছরাঙা পাখিটা ছোঁ মেরে তুলে আনবে সেই আকাঙ্খা মাছ, সেটা তো আমরা আগে থেকে আঁচ করতে পারি না কেউই।
রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে ওঠার জন্য আবার কারও পরামর্শ, সম্পাদকের কথা না ভেবে, লেখা মনোনীত হবে কিনা সেই চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে লিখতে বসুন। পছন্দের শব্দ কিংবা লাইনটা মাথায় না এলে লেখা শুরু করবেন না— এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। দরকার হলে না ভালো লাগা শব্দটা দিয়েই লেখা শুরু করুন। অন্তত কলমটা তো চলে তা হলে। আর শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই লেখেন যাঁরা, তাঁরা সেই লেখা রচনার সময়টাতে অন্তত ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করে দিতে পারেন। মানে, ফেসবুক খুলে সাদা বাক্সটার মধ্যে লেখালিখির চেষ্টা না করাই ভাল। এতে স্বাভাবিকভাবে লেখার প্রক্রিয়া থমকে যায়।
‘খোয়াবনামা’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এক কালজয়ী উপন্যাস। রাইটার্স ব্লকে ভুগতে হয়েছিল ইলিয়াস সাহেবকেও। উপন্যাসের কিছুটা অংশ লেখার পরে তাঁর কলম থমকে যায় হঠাৎ। ওয়াসি আহমেদ লিখছেন, “এমন অবস্থায় তাঁর মনে হয়েছে উপন্যাসের অকুস্থল অর্থাৎ করতোয়ার পাড়ে ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়!” বগুড়া জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলেই তো এই উপন্যাসের বিস্তৃতিলাভ। স্তব্ধতার মাঝে সেখান থেকে ঘুরে এলেন ইলিয়াস সাহেব। শোনা যায়, এর পরেই লেখা আবার এগোতে থাকে তরতর করে। তার্কিকরা এটা শোনার পরে বলতে পারেন, ভাগ্যিস ‘চাঁদের পাহাড়’ লেখার সময় বিভূতিভূষণবাবুর রাইটার্স ব্লক হয়নি। তাঁর কাছে তো আফ্রিকা যাওয়ার উপায় ছিল না!
এ তর্কের শেষ নেই। অনেকে পরামর্শ দেন, দিনের শেষে সৃষ্টিশীলতাও একটা অভ্যাসের মতো। আর সৃষ্টি বজায় রাখার একমাত্র পথই তো হল অভ্যাসের দাসত্ব করা। মানে লেখা না এলেও নিয়ম করে লিখতে বসা। বসেই থাকা। এতে আদতে কাজ হয় কিনা তা কবি-সাহিত্যিকরাই সব চেয়ে ভাল বলতে পারবেন। তবে তাঁরা বলেন, ঘুম পাওয়া, ক্ষিদে পাওয়ার মতো লেখা তো আর ‘পায়’ না। শুধু বসে কী লাভ? ফলে ফের তর্ক। রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে ওঠার জন্য আবার কারও পরামর্শ, সম্পাদকের কথা না ভেবে, লেখা মনোনীত হবে কিনা সেই চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে লিখতে বসুন। পছন্দের শব্দ কিংবা লাইনটা মাথায় না এলে লেখা শুরু করবেন না— এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। দরকার হলে না ভালো লাগা শব্দটা দিয়েই লেখা শুরু করুন। অন্তত কলমটা তো চলে তা হলে। আর শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই লেখেন যাঁরা, তাঁরা সেই লেখা রচনার সময়টাতে অন্তত ইন্টারনেট সংযোগ ছিন্ন করে দিতে পারেন। মানে, ফেসবুক খুলে সাদা বাক্সটার মধ্যে লেখালিখির চেষ্টা না করাই ভাল। এতে স্বাভাবিকভাবে লেখার প্রক্রিয়া থমকে যায়।
ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হলে, রাইটার্স ব্লকে বিদ্ধ হয়েছেন এমন লেখকদের অভিজ্ঞতার কথা পড়লে, এই প্রাচীর লঙ্ঘন না করতে পারার যন্ত্রণা আর পাঁচিল টপকানোর চটজলদি টোটকা— দু’টোই পাওয়া যায়। তবে অক্ষরকে ভালবাসা আর সাদা পাতায় নতুন অক্ষরের জন্ম দেওয়া এতটাই ব্যক্তিগত এক অনুভূতি যে এক এক মানুষের কাছে এই অভিজ্ঞতা এক এক রকম ভাবে ধরা দেয়। ওপার বাংলার আরও এক বিখ্যাত সাহিত্যিক আহমাদ মোস্তাফা কামালের একটি লেখায় চোখ আটকে গেল হঠাৎ। তিনি লিখেছেন, “…দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছর জুড়ে। বসেই থাকি লেখার টেবিলে। শূন্য মন, শূন্য চোখ, শূন্য হাত। দীনহীন। তবু বসে থাকি। রক্তাক্ত হই, তবু অপেক্ষা করি।”
রাইটার্স ব্লকের নিউক্লিয়াস হয়তো লুকিয়ে আছে মাত্র এ ক’টি লাইনেই।
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
সুন্দর লিখেছেন। প্রায়শই এই ব্যাপারটা হয় কিন্তু বলে বোঝানো যায় না। আজ এটা পড়ে অনেক মিল পেলাম। হ্যাঁ সত্যিই, মনের সাথে লেখার ডায়রেক্ট কানেকশন। They are proportional to each other.
হ্যাটস অফ লেখককে।
খুব সুন্দর করে পুরো ব্যাপার টা লিখেছিস। রাইটার্স ব্লক কি সেটা জানতাম , কিন্তু তার পেছনে এই বিশ্লেষণ টা জানা ছিল না। তুই আগেরকার কথা যেমন দিয়েছিস , তেমন Social Media তে লেখা এটাও ভালো explain দিয়েছিস। এত বিস্তৃত জানাও ছিল না। তোর কলম এর বল বাড়ুক। আমরাও খুশি হব। ভালো থাকিস ভাই।
গভীর, মনস্ক লেখা।