আমি কলকাতায় এলেই প্রতি শনিবার আমার ছোটোমামার ছেলে ঋভু দুপুর দুপুর হাজির হয়ে যায়। ও আমার থেকে বেশ খানিকটা ছোটই। সবে ক্লাস এইট পাশ করে নাইনে উঠেছে। তবে পড়াশোনা ছাড়াও আরো অনেক দিকে আগ্রহ থাকায় জমে ভালো। ওরও প্রশ্নের শেষ নেই, আর একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা পেয়ে আমিও আহ্লাদে আটখানা।

এবারে বাড়ি এসেছি ডিসেম্বরে। মাসখানেক সময় নিয়ে এলেও ঋভুর সঙ্গে কয়েকটা দিন যে আড্ডা মেরে আর ঘুরে বেড়িয়ে কাটাব, সেই সুযোগই পাচ্ছি না। হাতে গুচ্ছের কাজ। কাজেই ছেলের মান হয়েছে। শনিবার সক্কাল সক্কাল এসে গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। পিসির লুচিতেও মন ভরেনি। আমি একটু খোঁচাব ঠিকই করে রেখেছিলাম।

আমি: এর মানেটা কী। এক বছর পর বাড়ি এসেছি আর তুই গাল ফুলিয়ে বসে থাকবি? কেমন চলছে স্কুল, খেলাধুলো, নতুন কী দেখলি, কী করলি, কিছুই তো বললি না!

ঋভু: ইয়ার্কি মারছ? (এইরে বেশ খেপে আছে!) এক বছর বাদে এসে কয়েকটা চকলেট ধরিয়ে তুমি নিজে একা একা ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছ! আর আমি গাল ফোলালেই দোষ? সেই কবে থেকে বসে আছি দু’জনে মিলে ‘মানি হাইস্ট’টা শেষ করব। দু’টো এপিসোড দেখেই দিব্যি কেটে পড়লে!

আমি: কী করি বল্, এই এত্ত কাজ। তোর পিসির ব্যাংকের কাজ, বাড়ির কাজ, আমার পুরনো স্যারদের সঙ্গে দেখা করা, এক বছরের বই একেবারে স্টক করে নিয়ে যাওয়া, এই সব করতে করতে সময়ই তো আর পাচ্ছি না। যাই হোক আর রাগ করিসনে ভাই। শনি-রবিটা চুটিয়ে ‘লা কাসা দে পাপেল’ দেখব দুজনে আর আড্ডা দেব। তোর পিসি আর বৌদি আমাদের জন্য রান্না করবে! আমিও না হয় খানিক করব, কর্ডন ব্লিউ!

নিউমিজম্যাটিক্স হল অর্থ (মানি) এবং তার ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা। এর মধ্যে যেমন মুদ্রা বা কয়েন পড়ে, তার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ব্যাংক নোট, টোকেন, মেডেল ইত্যাদি আরও অনেক কিছুই পড়ে। এমন কি স্টক আর বন্ডও পড়ে। তুই যদি একটু খোঁজ করিস দেখবি নিউমিজম্যাটিক্স কথাটা গ্রিক থেকে এসেছে, যার বাংলা মানে ‘আর্থিক’। আর নোটাফিলি হল শুধুমাত্র কাগজ বা পলিমারের তৈরি ব্যাংক নোটের পড়াশোনা।

খিল খিল করে হেসে ফেলে ঋভু। যাক! থমথমে ভাবটা গেছে অবশেষে!

ঋভু: চটপট চালাও! টাকা ছাপা শুরু করেছে কিন্তু।

আমি: সে আর বলতে! একেবারে ইউএনসি নোট বুঝলি! ওহ!

ঋভু: সে আবার কি?

আমি: কেন? আনসার্কুলেটেড নোট! জানিস না?

ঋভু: এই দাঁড়াও দাঁড়াও! এ রকম দুম করে একটা কিছু বলে দিলে চলে না। একটু খুলে বল।

আমি: বেশ। শোন তবে! ‘নোটাফিলি’র নাম শুনেছিস?

ঋভু: নো-টা-ফি-লি? কই নাতো?

আমি: নোটাফিলি হল বিভিন্ন ধরণের ব্যাংক নোট জমানোর বৈজ্ঞানিক নাম। যেমন স্ট্যাম্প জমায়?

ঋভু: (বেশ উত্তেজিত) ফিলাটেলি! সে তো জানি। কিন্তু তুমি যা বললে সে তো নিউমিজম্যাটিক্স, তাই না? নোটাফিলি কবে হল?

আমি: ঠিকই বলছিস। নিউমিজম্যাটিক্স হল অর্থ (মানি) এবং তার ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক পড়াশোনা। এর মধ্যে যেমন মুদ্রা বা কয়েন পড়ে, তার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ব্যাংক নোট, টোকেন, মেডেল ইত্যাদি আরও অনেক কিছুই পড়ে। এমন কি স্টক আর বন্ডও পড়ে। তুই যদি একটু খোঁজ করিস দেখবি নিউমিজম্যাটিক্স কথাটা গ্রিক থেকে এসেছে, যার বাংলা মানে ‘আর্থিক’। আর নোটাফিলি হল শুধুমাত্র কাগজ বা পলিমারের তৈরি ব্যাংক নোটের পড়াশোনা।

মোটামুটি ভাবে ১৯৪০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ সিরিয়াসলি ব্যাংক নোট জমানো এবং সেই সংক্রান্ত নানা গবেষণার কাজ করে আসছেন। ১৯৬১-তে তৈরি হয় ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক নোট সোসাইটি (IBNS)। তারপর ১৯৭০ সালে আলাদা ভাবে এই ফিল্ডের নামকরণ করা হয়। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট! এখন নিউমিজম্যাটিক্স বলতে মানুষ প্রধাণত ‘কয়েন কালেকশান’ বোঝেন।

ঋভু: সে তো বুঝলাম। কিন্তু ওই যে বললে ইউএনসি, তার সঙ্গে নোটাফিলির কী সম্পর্ক?

আমি: ধীরে বৎস ধীরে!

৩৭টা দেশ আছে। তাছাড়াও আরও কিছু অ্যান্টিক, মানে এখন বাজারে পেতে হলে বেশ কসরত করতে হবে তোকে। তবে এত লাফানোর কিছু নেই। হংকং -এর সঞ্জয় রেলানের কাছে ২২১টা দেশের ২২১টা ব্যাংক নোট আছে। ওটা ২০০৭ থেকে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা নিয়ে রেখেছে।

দ্যাখ্, একজন নোট কালেক্টারের কাছে নোটের কতগুলো জিনিস ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই দেখে নিতে হয় নোটটা কী অবস্থায় আছে। মানে এক্কেবারে কড়কড়ে, নাকি একটু ঝরঝরে, নাকি একেবারেই প্যাতপ্যাতে? (খিল খিল করে হাসে ঋভু)। তার উপর নির্ভর করেই একটা একটা নাম। মানে ইউএনসি অর্থাৎ আনসার্কুলেটেড, মানে যা একেবারেই কোনও হাত ঘোরেনি। খুব দুষ্কর এমন নোট পাওয়া। এরপর আছে অ্যাবাউট সার্কুলেটেড (এএস) আর এক্সট্রিমলি ফাইন (ইএফ)। ভাবতে পারবি না ইএফ এর থেকে ইউএনসির মূল্য প্রায় দশগুণ বেশি। একটা নোট ছেঁড়া কিনা, বা তাতে কোনও দাগ আছে কিনা, কিম্বা নেহাতই নোটটা পাঁচ হাত ঘুরে নোটাফিলের কাছে এসেছে কিনা, তার উপর নির্ভর করে আরও বেশ কিছু ধাপের নিচে রয়েছে ফেয়ার বা পুয়োর ক্যাটাগোরি।

ঋভু: বাব্বা! বুঝেছি। কিন্তু স্ট্যাম্প থাকতে খামোখা টাকা জমাতে যাবে কেন একটা লোক?

আমি: কারণ স্ট্যাম্পের মতোই পেপার কারেন্সি একটা দেশ বা জাতির ইতিহাসের বাহক। কখনও কখনও এক একটা ব্যাংক নোট তোকে একটা জায়গা সম্বন্ধে হাজার একটা খবরও দিয়ে দিতে পারে। দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাই।

(ব্যাগ থেকে আমি আমার নোটাফিলির কালেকশানের গোছাটা বের করতেই ঋভু একেবারে লাফিয়ে উঠল!)

ঋভু: উরিব্বাস! এটা কবে থেকে করছ? এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলে? এর মানেটা কী?

আমি: আরে শুরু করেছি অনেকদিন। ২০১৩। প্রত্যেকবার আনা হয় না। এবার তোকে দেখাব বলে নিয়ে এসেছি।

ঋভু: দেখি দেখি! ক’টা আছে?

আমি: সে দ্যাখ, সে কারণেই তো আনা। ৩৭টা দেশ আছে। তাছাড়াও আরও কিছু অ্যান্টিক, মানে এখন বাজারে পেতে হলে বেশ কসরত করতে হবে তোকে। তবে এত লাফানোর কিছু নেই। হংকং-এর সঞ্জয় রেলানের কাছে ২২১টা দেশের ২২১টা ব্যাংক নোট আছে। ওটা ২০০৭ থেকে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা নিয়ে রেখেছে। যাই হোক, আয় তোকে কয়েকটা মজার জিনিস দেখাই।

তোকে বললাম না, এক একটা নোট এমন বানানো হয় যে, তুই সেটা দেখে দিব্যি একটা জায়গা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবি? তার একটা উদাহরণ এই জাপানি ইয়েন। এটা ১০০০ ইয়েন। ২০০৪ সালে প্রথম ছাপা হয়। আমার এই নোটটা ইএফ ক্যাটাগোরির। এবারে ভাল করে সামনে পেছনটা দ্যাখ।


সামনে যার ছবি দেখছিস উনি হলেন হিদেয়ো নোগুচি। হিদেয়ো একজন বিশ্ববিখ্যাত জাপানি ব্যাক্টেরিয়া বিজ্ঞানী। ১৯১১ সালে, প্যারালাইসিসের জন্য যে সিফিলিসের ব্যাক্টেরিয়াই দায়ী, সেটা আবিষ্কার করেন। আর পেছনে দেখ- একটা পাহাড়, একটা লেক আর কিছু ফুলগাছ।

ঋভু: ওটা মাউন্ট ফুজি না? ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি?

আমি: সাবাস তোপসে, ফাটিয়ে দিয়েছিস! লেকটা হল লেক মোতোসু। গাছগুলো চেরি ব্লসম। কাজেই এই নোটটা থেকে তুই যেমন একজন জাপানি বিজ্ঞানীর নাম জানলি, আবার তার সঙ্গে দেশটার প্রকৃতির সঙ্গেও খানিকটা পরিচয় হল, তাই না? একই ভাবে চিন, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রোর নোটে তুই নানা নাম করা ডাক্তার, বায়োলজিস্ট, কবিদের ছবি পাবি।

ঋভু: ফ্যাসিনেটিং!

আমি: পিকচার আভি বাকি হ্যায় দোস্ত!
(ঋভুর চোখ জ্বলজ্বল করছে!)
এবার তোকে কয়েকটা “হিস্টোরিকাল আর্টিফ্যাক্ট” দেখাই। এই দ্যাখ ইউএসএসআর-এর রুবেল।

ঋভুঃ আরিব্বাস! মানে সোভিয়েত?

আমি: আজ্ঞে! ভাল করে দ্যাখ। মাঝামাঝি নিচের দিকে লেখা ১৯৬১। তবে একটা একটু ময়লা। অন্যটা অনেক বেশি পরিষ্কার আর কড়কড়ে। বুঝতেই পারছিস নোটের ক্যাটাগরি আলাদা।

সোভিয়েত রুবেল, বাঁ দিক আর ডান দিকে- নোটদু’টির দুই দিক দেখান হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে দু’টোই ১৯৬১ -এর। তবে উপরের টা “এসি” ক্যাটাগোরি আর নিচেরটা “ফেয়ার”।

সোভিয়েত রুবেল, বাঁ দিক আর ডান দিকে- নোটদু’টির দুই দিক দেখানো হয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে দু’টোই ১৯৬১-এর। তবে উপরেরটা ‘এসি’ ক্যাটাগোরি, নিচেরটা ‘ফেয়ার’। তোকে আলাদা করে এটা দেখানোর আর একটা কারণ আছে। এই নোট দু’টো দ্যাখ এর পরেই। দু’টোই “উজবেকিস্তানের সোম” ।

ঋভু: এই ছোটটা নিশ্চয়ই পুরনো?

আমি: ঠিক ধরেছিস।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর উপরের রুবেলগুলো অকেজো করে দেওয়া হয় ১৯৯৩ সালে। অন্য অনেক সোভিয়েত টুকরোর মতোই উজবেকিস্থান তখন সদ্যজাত। তাই ১৯৯৩ -এর ১৫ নভেম্বর ১, ২, ৩, ৫, ১০, …, ১০০, …, ১০০০০ অবধি প্রথম সোম নোট ছাপা হয়। তাড়াহুড়ো করে ছাপা ‘ট্রানজিশনাল কারেন্সি’ বলে এত সাধারণ দেখতে। নোটের সামনে উজবেক ‘কোট অফ আর্মস’, পেছনে ‘সমরকন্দ মরুভুমির শের-দোর মাদ্রাসা’।

সেখানেই ২০১৭ -য় ছাপা নতুন ১০০০০ সোমের কাজ খেয়াল কর। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ান একটা দেশের কারেন্সি কত পরিণত। নোটের পেছনে তাশকেন্তের সেনেট বিল্ডিংয়ের ছবি।

ঋভু: তুমি এগুলো জোগাড় করলে কী ভাবে?

আমি: সে অনেক তপস্যার ফল। ও গল্প অন্যদিন হবে। এখন শেষ আরেকটা গল্প বলে আমরা ‘মানি হাইস্ট’ দেখব।

ঋভু: হ্যাঁ হ্যাঁ! বল বল প্লিজ।

আমি: বেশ। আফ্রিকার জাম্বিয়া দেশের নাম শুনেছিস নিশ্চয়?

ঋভু: হ্যাঁ।

আমি: তো এই জাম্বিয়া ১৯৬৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বেশ কয়েক ধাপে ওদের প্রথম ‘কোয়াচা’ প্রকাশ করে। প্রথম নোটটার সামনে যাঁর ছবি দেখছিস, উনি ওদের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কেনেথ কাউন্ডা। নোটের পেছনে দ্যাখ চাষিরা ক্ষেতে কাজ করছে। ১৯৯২-তে এই ৫০০ কোয়াচার নোটটা প্রকাশ পায়। সামনে যে পাখিটা দেখছিস ওটা আফ্রিকার ফিশ ঈগল। পেছনে দ্যাখ জাম্বিয়ার বিখ্যাত হাতি। তার সাথে যে স্ট্যাচুটা দেখছিস ওটা ওদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সিম্বল। লুসাকা শহরে আছে।


২০১২ সালে আর্থিক মন্দার হাত থেকে রেহাই পেতে জাম্বিয়া একটা বিরাট আকারের ‘রি-ডিনমিনেশন’ করে। সমস্থ বড় নোটের মান ১০০০ দিয়ে ভাগ করা হয় এবং ৫০০ কোয়াচার মত নোটকে বাতিল করে ৫০ Ngwee মুদ্রায় রূপান্তরিত করা হয়। নতুন নোটগুলিতে অবশ্য আর রাষ্ট্রপতির ছবি দেওয়া হয়নি। সামনে ফিশ ঈগল, কোট অফ আর্মস ইত্যাদি। পেছনে কোনও এক প্রজাতির প্র লুসাকার ফ্রীডম স্ট্যাচু এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কোনও একটা ছবি।
কাজেই বুঝতে পারছিস দু’টো নোটই অত্যন্ত অ্যান্টিক। আর তোকে চুপি চুপি বলি, দু’টোই ইউএনসি!

ঋভুর চোখ প্রায় কপালে ওঠার জোগাড়! বলছ কী?

আমি: হুম! বেশি পাঁচ কান করিস না খবরটা। চুরি গেলে আমাদেরই গোয়েন্দাগিরি করতে হবে।

ঋভু: (হাসতে হাসতে) বেশ! সবই তো বুঝলাম। তোমার কাছে এত দেশ বিদেশের টাকা। কিন্তু আমাদের দেশের টাকা এতে নেই কেন?

আমি: দূর পাগল! থাকবে না কেন? ওটাই তো ট্রাম্প কার্ড! এই দ্যাখ।

Rupak bardhan Roy

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *