পঞ্চাশের দশকের শেষে আর ষাটের দশকের শুরুতে অনেক বঙ্গ-সন্তান জীবিকার খাতিরে বর্তমানের ছত্তিসগড়ে উপস্থিত হন। তারপর রেলের চাকরি বা ভিলাই স্টিল প্লান্টে চাকরি নিয়ে ওখানেই থেকে যান। তাঁদের মধ্যে বাঙালিয়ানা ছিল পুরোদস্তুর। প্রাণপণ চেষ্টা করে গিয়েছেন আজীবন বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখতে। পরের প্রজন্ম সেখানে হিন্দি মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও বাড়ির পরিবেশের জন্যে বাংলাটা ভালোই রপ্ত হয়েছিল। যদিও স্কুলে বা বাড়ির বাইরে কাজের প্রয়োজনে হিন্দি হয়ে উঠেছিল তাঁদের মুখ্য ভাষা। তাঁদের পরের প্রজন্ম যাঁরা এখন কর্মজগতে ঢুকেছেন, তাঁরা বাড়িতে চাপের চোটে আর পালা-পার্বণের বাইরে পারতপক্ষে বাংলা বলেন না। তাঁরা হিন্দিতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের বাঙালিয়ানা নেই বললেই চলে।

রঙ্গনদার ক্যাটারিং কোম্পানি ছত্তিসগড়ের প্রবাসী বাঙালিদের কাছে এক সুপরিচিত নাম। রায়পুর আর বিলাসপুরে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাওয়ানোর বরাত পেয়ে থাকে। আমি কর্মসূত্রে দীর্ঘকাল ওই রাজ্যে কাটিয়েছি। তাই আমাদের আড্ডাতে ছত্তিসগড় ঘুরে-ফিরে আসে। পাঁড় বাঙাল রঙ্গনদাকে বাঙাল রান্না নিয়ে জিজ্ঞেস করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছত্তিসগড়ের বাঙালিদের বর্তমান প্রজন্ম যতটা বাঙালি, কলকাতার বাঙালরা ততটাই বাঙাল।” কথাটা বুলেটের মতো বিদ্ধ করল আমায়। সত্যিই তো, আজ থেকে বছর পঁচিশ আগেও শুঁটকি মাছের দর্শন পাওয়া যেত, গন্ধ আসত নাকে। খুবই বিরক্তিকর গন্ধ, কিন্তু খেতে দারুণ! মনে পড়ে না গত পঁচিশ বছরে একবারও যে পাড়ায় থাকি, সেখানে শুঁটকির গন্ধ পেয়েছি বলে।

লটে মাছ এখন ঘটিদের হেঁসেলে সুনির্দিষ্ট জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের বাড়িতে রান্না হওয়া লটে দিদিভাইদের বাঙাল শ্বশুরবাড়িতে রপ্তানি হয়। মনে পড়ল জয়ন্ত চুইঝাল আনিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। তার স্বাদ হোটেলে বা বাড়িতে কম লোকই নিতে পেরেছেন বলে জয়ন্ত দুঃখ করেছিল। সেটা রঙ্গনদাকে বলতে রঙ্গনদা লুফে নিল কথাটা। বলল, “মাছ বলতেই এখন ঝাল-ঝোল-কালিয়া। এমনকি ইলিশ মানেই সর্ষে আর তেল-ঝোল। শেষ কবে বেগুন দিয়ে ইলিশের ঝোল খেয়েছিস ভেবে দেখ!”

ফরাসি স্টার্টার- এঞ্জেল অন হর্সব্যাক। ছবি সৌজন্যে: Simplyrecipes.com

বাঙালি কী খেতে চায় জিজ্ঞেস করাতে রঙ্গনদা তার ক্যাটারিং-এর অভিজ্ঞতা থেকে দু’টো ঘটনা বলল। এক জায়গায় মেনুতে রাবড়ি ছিল। রাবড়ি কম পড়ায় রঙ্গনদা অন্য মিষ্টি দিতে চাইছে, কিন্তু কর্তা নাচার। তাঁর বক্তব্য তিনি অনেক শখ করে মেনুতে রাবড়ি রেখেছেন। সব্বার ভালো লেগেছে বলেই বেশি খেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাকি লোকেদের রাবড়ি না খাওয়াতে পারলে তাঁর মাথাকাটা যাবে। অগত্যা রঙ্গনদা সেই কর্তার চোখের আড়ালে বেশ কয়েকটা মিল্কমেডের টিন আনিয়ে, সেটা পাতলা করে, তাতে টুকরো করে কাটা রুমালি রুটি ডুবিয়ে দিয়ে পরিবেশন করেছিল। অনুষ্ঠানের কর্তা আপ্লুত হয়ে জানিয়েছিলেন, পরের রাবড়িটা আগেরটার চেয়ে বেশি ভালো। আর একবার বজবজের কাছে এক সরকারী সংস্থার অনুষ্ঠানে সেই সংস্থার সর্বোচ্চ কর্তা আসবেন বলে খাবারের এলাহি ব্যবস্থা করা হয়েছে। নন-ভেজের রকমারি দেখলে তাক লেগে যায়। বড় কর্তা যখন খেতে গেলেন, জানা গেল তিনি নিরামিষাশী। নিমেষে সেই সংস্থার বাকি সব্বাই নিরামিষাশী হয়ে গিয়েছিল।

তারপর খানিক ভেবে রঙ্গনদা বলেছিল, “আসলে কী জানিস, বাঙালির মেনু প্ল্যানিং-এ দু’টো জিনিস খুব কাজ করে- নস্টালজিয়া আর রেকগনিশন। প্রবাসীদের দেখি অনুষ্ঠানের মেনুর আলোচনায় বসলে কলাপাতায় পরিবেশন, মাটির ভাঁড়ে জল থেকে শুরু করে রাধাবল্লভি, নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, লম্বা ফালি বেগুনভাজা, সব এক রাখতে চান। যেমন তাঁরা দেখেছেন চল্লিশ বছর আগে দেশ ছাড়ার আগে। দেখবি, আমরা বাজারে গিয়ে বিক্রেতার হাঁড়ির খবর নিই। আর তাঁর কাছেই ফিরে ফিরে যাই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে। স্ট্যান্ডার্ড বা প্রাইসিং আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

অবশ্যই আমরা কনভেনশনাল। তবে নতুন প্রজন্ম এক্কেবারেই তা নয়। বিরিয়ানি খেতে হলে আমরা বাসমতী চালের বিরিয়ানির বাইরে ভাবতেই পারব না। কিন্তু একটা পঁচিশ বছরের ছেলে স্বচ্ছন্দে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে রান্না বাংলাদেশী বিরিয়ানি খেয়ে নেবে। ভালো লাগলে আওধি বিরিয়ানি ছেড়ে বাংলাদেশী বিরিয়ানিই খাবে। এই নতুন প্রজন্ম স্মৃতির ব্যাগেজ নিয়ে ঘোরে না রেস্তোরাঁ বা খাবার বাছার সময়। উল্টে তারা মুঠোফোনের সাহায্য নেয় রেস্তোরাঁর রেটিং জানতে, মেনু জানতে। নতুন কিসিমের খাবার দেখলে নেট খুঁজে সেই খাবারের হাল-হকিকৎ জেনে নেয়।

মনে পড়ে গেল জয়মাল্য এক্কেবারে এক কথা বলেছিল। ওর রেস্তোরাঁতে মেনুর জন্যে যত লোক ফিরে আসে, তার চেয়ে বেশি লোক ফেরত আসে সম্পর্কের খাতিরে। ফিউশন রান্না নিয়ে রঙ্গনদা এক ধাপ চড়া- “এটা সব্বার কাজ নয়। জয় পারে বলে যে সব্বাই পারবে, তা হতে পারে না। কষা মাংসে সোয়া-সস দিয়ে দিলে ফিউশন হয় না, বকচ্ছপ হয়। এটাই বেশির ভাগ লোক বোঝে না!” আমি বলি, “কিন্তু জয়ও তো চাপে আছে। অন্যরকম খাবার বানাতে শুরু করেছে!” রঙ্গনদা বলল, “জয়কে বল‌ চাপ না নিতে। শেফ জয়ের একটা ব্র্যান্ড ইকুইটি তৈরি হয়ে গিয়েছে।”

অবশেষে অভিজিৎ বোস আমার মনের মধ্যে জমা সমস্ত সংশয়ের মেঘ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন, যেমন চিরকাল দিয়ে এসেছেন। অভিজিৎদার অধীনে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। পোড় খাওয়া হোটেলিয়ার অভিজিৎদা আক্ষরিক অর্থে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ভারতের নামী বেশ কিছু হোটেলের সর্বোচ্চ পদ সামলে কয়েকদিন হল তার সাদার্ণ অ্যাভিন্যুর ফ্ল্যাটে বসে ল্যাদ খাচ্ছেন। লেকের, আকাশের, পাখির ছবি তুলছেন আর পোষ্টাচ্ছেন। আমাদের নিজস্ব স্যাটা বোসের কাছে গিয়ে বডি ফেলতে ব্যাটের মাঝখান দিয়ে সপাটে ছয় হাঁকালেন-  “আগের সাথে তুলনার কোনও মানেই হয় না। খেয়াল করে দেখ কুড়ি-পঁচিশ বছরে লোকের হাতে কত অপশন এসেছে!


কলকাতার সাম প্লেস এলস -এর এই প্রাণপুরুষ কলকাতার আইএইচএম থেকে পাশ করে তাজ গ্রুপে কেরিয়ার শুরু করেন। ভারতের চার প্রান্তেই পার্ক গ্রুপের হোটেলের দায়িত্ব আর বৈদিক ভিলেজের সর্বোচ্চ পদ সামলে এখন পুরনো দুর্বলতা পর্ক, পাশ্চাত্য সঙ্গীত, ওয়াইন আর নতুন দুর্বলতা ছবি তোলাতে সময় দিচ্ছেন।


 

“আগে কলকাতায় কত রকমের খাবার পাওয়া যেত, আর এখন কত রকমের খাবার পাওয়া যায় ভেবে দেখেছিস? কত লোক বাইরে খেতে বেরচ্ছে ভেবে দেখেছিস! এমনকি ডি-মনিটাইজেশনের পরেও পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁতে লাইন পড়ত। তাহলে ভাব কী সংখ্যক লোকে বাইরে খেতে বেরোচ্ছে আজকাল! কলকাতা জুড়ে এখন রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে। বারাসাত থেকে বিধাননগর, কোথায় রেস্তোরাঁ নেই আজকাল? তবে বাঙালি রেস্তোরাঁয় বসে বাঙালি খাবার আর খেতে চায় না কলকাতায়। বিশেষ দিনগুলো বাদে। আর কলকাতার বাইরে আগে বাঙালি খাবারের সুবিধে ছিল না। এখন প্রায় সব বড় শহরেই বাঙালি রেস্তোরাঁ হয়েছে। বিশাল সংখ্যক অবাঙালি এখন এই বাঙালি রেস্তোরাঁগুলোতে খেতে যাচ্ছে।”

বাঙালি খাবারের ব্যাপারে কনভেনশনাল কিনা প্রসঙ্গে অভিজিৎদার মত- “অবশ্যই আমরা কনভেনশনাল। তবে নতুন প্রজন্ম এক্কেবারেই তা নয়। বিরিয়ানি খেতে হলে আমরা বাসমতী চালের বিরিয়ানির বাইরে ভাবতেই পারব না। কিন্তু একটা পঁচিশ বছরের ছেলে স্বচ্ছন্দে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে রান্না বাংলাদেশী বিরিয়ানি খেয়ে নেবে। ভালো লাগলে আওধি বিরিয়ানি ছেড়ে বাংলাদেশী বিরিয়ানিই খাবে। এই নতুন প্রজন্ম স্মৃতির ব্যাগেজ নিয়ে ঘোরে না রেস্তোরাঁ বা খাবার বাছার সময়। উল্টে তারা মুঠোফোনের সাহায্য নেয় রেস্তোরাঁর রেটিং জানতে, মেনু জানতে। নতুন কিসিমের খাবার দেখলে নেট খুঁজে সেই খাবারের হাল-হকিকৎ জেনে নেয়। কোনও অচেনা খাবার পছন্দ না হলে মনে সেটা আমাদের মতো পুষে রাখে না। বা তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্যে নতুন স্বাদ খুঁজতে হোঁচট খায় না। আবার নতুন স্বাদের সন্ধান করে।

বেগুন দিয়ে ইলিশ।  ছবি সৌজন্যে: Cookpad.com

“আমরা পরিবারের সঙ্গে রেস্তোরাঁতে গিয়ে ফ্রেশ লাইম সোডা অর্ডার দিয়ে এসেছি। হয়তো সেখানে আর পাঁচ জনের মতো ‘সুইট’ না বলে ‘সল্ট অ্যান্ড সুইট’ চেয়ে তারিফ পেয়েছি। কিন্তু এই প্রজন্ম রেস্তোরাঁতে সোজা ভার্জিন মোহিতো অর্ডার দেয়। আমাদের সময় কি ভার্জিন মোহিতো ছিল না? ছিল! ক’জন জানতেন? যাঁরা জানতেন, তাঁরা বই পড়ে জানতেন। বানান অনুযায়ী মোহিতোকে মোজিতো বলেই জানতেন। সেটা যে অর্ডার দেওয়া যায় সেটা জানতেন না। তাই এই নন-অ্যালকোহলিক পানীয় শুধু পানশালাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। রেস্তোরাঁর মেনুতে থাকত না!”

অভিজিৎদা এই প্রসঙ্গে একটা অদ্ভুত উদাহরণ দিলন। “ফরাসি মেনুতে স্টার্টার হিসেবে জনপ্রিয় পদ ‘এঞ্জেল অন হর্সব্যাক’ হচ্ছে বেকন দিয়ে অয়েস্টার র‍্যাপ করা একটা পদ। এই দেশে অয়েস্টার পাওয়া যেত না বলে কলেজে আমরা অয়েস্টারের পরিবর্ত হিসেবে লিভার ব্যবহার করতাম। সেই সূত্র ধরে দেশের নামী হোটেলগুলোতে লিভার বেকন দিয়ে র‍্যাপ করে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। আমাদের প্রজন্মের স্বাদবদলের প্রতি এতটাই অনীহা যে, লিভারের বদলে চিকেনের টুকরো দিলেও আমরা হোঁচট খাই। যেটা অনেক বেশি সহজ সমাধান আর আসল স্বাদের অনেক কাছাকাছি, আমরা আজ পর্যন্ত তাকে মেনে নিতে পারলাম না।”

জয় বলেছিল, ওর রেস্তোরাঁর এতো সুনাম সত্ত্বেও বারবার ফিরে আসা কাস্টমারের সংখ্যা বেশ কম। তাই তাকে অন্য রকম খাবারও পরিবেশন করতে হচ্ছে। অভিজিৎদা আমার কথা লুফে নিলেন। মনে করিয়ে দিলেন, কলকাতার নতুন প্রজন্মের রেস্তোরাঁগুলো চিকেন আ লা কিভ, টারটার সসের সঙ্গে ফিশ ফ্রাই বা ফ্রায়েড ফিশ, প্রন ককটেল, প্রন কাটলেটের মতন পুরনো কিছু ডিশ রেখেছে তাদের সাফল্য সুনিশ্চিত করতে।

ফিউশন রান্নাপ্রণালীকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন অভিজিৎদা। কলকাতার সাম প্লেস এল‌স-এর অন্যতম রূপকার অভিজিৎদা পাশ্চাত্য সঙ্গীতটা অনেকের চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন। ওঁর মতে ফিউশন সঙ্গীতের মতো ফিউশন কুইজিনেরও কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এটা একটা হুজুগ মাত্র। অভিজিৎদা বার্সিলোনার অদূরে বিশ্ববিখ্যাত শেফ ফেরান আদ্রিয়ার মলিকিউলার রন্ধনপ্রণালীর ‘এল বুলি’ রেস্তোরাঁর উদাহরণ টানলেন। আমি প্রতিবাদ করলাম- “কেন? শুনেছিলাম সেখানে টেবিল পেতে কয়েকমাস আগে বুকিং করতে হয়!” অভিজিৎদা হাসতে হাসতে ইন্টারনেট থেকে বিবিসি-র একটা লেখা দেখালেন। বিশ্বের সেরা পঞ্চাশ রেস্তোরাঁর তালিকায় রেকর্ড পাঁচ বার থাকা ‘এল বুলি’ ২০১১ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, জন্ম ইস্তক কোনওদিন লাভের মুখ না দেখে।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল বন্ধু জয়মাল্য আর তার সমস্যার কথা। জয় বলেছিল, ওর রেস্তোরাঁর এতো সুনাম সত্ত্বেও বারবার ফিরে আসা কাস্টমারের সংখ্যা বেশ কম। তাই তাকে অন্য রকম খাবারও পরিবেশন করতে হচ্ছে। অভিজিৎদা আমার কথা লুফে নিলেন। মনে করিয়ে দিলেন, কলকাতার নতুন প্রজন্মের রেস্তোরাঁগুলো চিকেন আ লা কিভ, টারটার সসের সঙ্গে ফিশ ফ্রাই বা ফ্রায়েড ফিশ, প্রন ককটেল, প্রন কাটলেটের মতন পুরনো কিছু ডিশ রেখেছে তাদের সাফল্য সুনিশ্চিত করতে। ব্যাক টু ব্যাসিকস আর কি!

জয়ন্তর হোটেলের ‘গ্লোবাল-দিসি’ বুফেতে পরিবেশিত ফিউশন রান্নার চেয়ে সেখানকার ‘খাও গলি’ ব্রেকফাস্ট বুফে বেশি জনপ্রিয়। কারণ লোকে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে সেখানে। একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন তাঁরা পরিবেশন করা খাবারের সঙ্গে। কলকাতাতে এখন বিভিন্ন রকমের খাবার পাওয়া যায়। ঈশানীর ‘সার‌ফিরে’-তে চমৎকার কোস্টাল কুইজিন পাওয়া যাচ্ছে মনে করাতে অভিজিৎদা বললেন- “এক্কেবারে সত্যি। কিন্তু তুই বল,‌ তুই কি মুম্বইয়ের মহেশ লাঞ্চ হোমের সোল ফিশ কারিকে ভুলতে পেরেছিস? সেটা কলকাতায় পাওয়া গেলে কি দৌড়বি না সেখানে? মুশকিলটা হচ্ছে এই চাহিদাটা সবাই বোঝে না! যারা বোঝে, তারা এই শহরে ভাল ব্যবসা করছে! তাই তুই দেখবি মুম্বইয়ের ‘খাও গলি’, দিল্লির ‘পরোটা গলি’, করিম‌স-এর খাবার নিয়ে কলকাতায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ফেস্টিভাল করছে আর মুনাফা লুটছে। এখন এই মুড সুইং-এর যুগে মানুষ নতুন স্বাদ আর পরিচিত স্বাদ, দু’টোই চায়।  আর যারা নিজেদের নীতিতে আটকে থাকছে, তারা হয় হোঁচট খাচ্ছে, তা না হলে খাবারের দাম এমন আকাশ ছোঁয়া রাখছে যাতে কম সংখ্যক মানুষ এলেও তাদের লোকসান হচ্ছে না।

মোহিতো ককটেল।  ছবি সৌজন্যে: Gimmesomeoven.com

“এই দ্বিতীয় পথটা তারাই নিতে পারে, যারা কলকাতার জেন রেস্তোরাঁ বা শেফ জয়ের মতো একটা ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছে। ‘এল বুলি’র বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে ঠিক শিক্ষাটা নিয়ে সফলভাবে differentiation strategy ব্যবহার করছে। কোন রাস্তাটা নিতে হবে, সেটা নির্বাচন করাটা খুব দরকারি। সেখানে পাকামি করলে চলবে না। পাকামি করেছিস বা একগুঁয়ের মতো থেকেছিস কি মরেছিস। এই শহরে মুড়ি-মুড়কির মতো রেস্তোরাঁ খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে তাই! আমি যে বছর কলকাতায় ফেরত আসি, তার আগের বছর, ২০১৪-তে অন্তত হাজারখানেক রেস্তোরাঁ কলকাতা শহরে খুলেছিল। তার ৪০% সেই বছর খুলে সেই বছরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ব্যাক টু ব্যাসিকস ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনও কন্টিনেন্টাল রেস্তোরাঁ খুললে আমি গিয়ে ফিশ অ্যান্ড চিপস অর্ডার দেব, দেখব ফিশ অ্যান্ড চিপ্‌সের সঙ্গে ম্যাশড পিজ‌ আর মল্টেড ভিনিগার দেওয়া হচ্ছে কিনা। যদি না দেওয়া হয়, আমি আর সেখানে ফেরত যাব না। সেখানে নতুন প্রজন্মও ফেরত যাবে না, কারণ তাঁরা যতই খাবারের ব্যপারে উদার আর সাহসী হোক, ঐতিহ্য নিয়ে ওরাও আপস করবে না, বা এক্সপেরিমেন্ট সহ্য করবে না।”

অভিজিৎদার সঙ্গে কথা বলে চার মহারথীর বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একসময় বেদুইনের সামনে পৌঁছে গিয়েছি। একটা রোল কিনে পা বাড়াতেই ভুরুটা কুঁচকে গেল। লেবুর টুকরো আর লংকাটা কোথায়? থমকে দাঁড়িয়ে ঠোঙাটা উপুড় করতেই লংকা আর লেবু উঁকি মারল। আমি হেসে ফেললাম। আমার প্রশ্নের উত্তরটা বোধহয় পেয়ে গিয়েছি। অভিজিৎদা আবার একটা ছয় মেরেছে। বাঙালি পোশাক নিয়ে আপস করে ধুতি ফেলে দিতে পারে, খাবার নিয়ে আপস করবে না। নতুন প্রজন্মও যতই সাহসী হোক না কেন, খাবারের ব্যাপারে, বেদুইনের রোলে ওরাও আলাদা করে লেবু-লংকা খুঁজবে।

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

5 Responses

  1. ধুতি আর বাংলা শার্টের মতো আরো বহু ঐতিহ্য বাঙ্গালি এক অজানা কারণে ছেড়ে অন্যের নকল করতে শিখেছে। এটা শুধু এ প্রজন্মেরই কথা নয়, আমাদের সময়েও একই জিনিস দেখেছি। শুঁটকি মাছের কথা ছেড়েই দিলাম, কটা বাড়িতে এখন কচি পটল দিয়ে শিঙিমাছের পাতলা জিড়ে বাটার ঝোল হয়? মাছে ভাতে বাঙ্গালি আমরা মাছ খেতেই ভুলে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। একটা সময় শুনতাম বাঙ্গালি প্রাদেশিক নয় বরং আন্তর্জাতিক। আজ সেটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়। তাই এখন বহু রেস্তোরাঁয় বহুবিধ পদ সহজলভ্য হলেও আমরা হয়ত স্ট্যাটাস আপডেট করার জন্যই খেতে যাচ্ছি,খাওয়ার ভালবেসে বা নতুন স্বাদ নেবার জন্য নয়। সেটা টেরিটি বাজারে চাইনিজ ব্রেকফাস্ট খেতে গেলেই বোঝা যায়। হয়ত এ কারণেই বহু রেস্তোরাঁ উঠে যায়। তবু্ও এখনো এই বাঙ্গালিই হুলিওর সাথে এনরিকের গান শোনে, ট্রাডিশন আর ফিউশনের আলাদা স্বাদ খুঁজে তার তারিফ করে।পিনাকীর লেখার শেষ ছত্রেই তাঁরই সুর খুঁজে পেলাম। খুব ভাল লাগলো লেখার বিশ্লেষন আর শীতের দুপুরে ছাদে বসে আঁচার খাবার মত পুরোনো ঘটনার প্রয়োগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *