মস্করা আর মালপো – এ দু’ইয়ের প্রেমে মজেই তিনি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ক’জন জানেন তাঁর মিলিটারি মেজাজের বিপ্লবী চরিত্রের কথা! সত্যেন বোসের প্রিয় ছাত্র সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়ই যে কমেডি-সম্রাট ভানু হয়ে উঠবেন এবং তামাম বাংলা তাঁকেই মানবে ‘বাঙাল’-ইয়ানার অবিসংবাদী আইকন হিসেবে, সে কথা কে-ই বা ভেবেছিল ১৯২০ সালে তাঁর জন্মকালে! আজ তাঁর জন্মশতবর্ষে তাঁর সঙ্গে কল্প-সাক্ষাতে আর এক মনেপ্রাণে বাঙাল কবি-লেখক অনিমেষ বৈশ্য। 


 

কইসে কতা আমার লগে… আমার লগে কতা কইসে…।
সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে উদ্বাহু হয়ে নাচছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

রোগা ডিগডিগে।
বুকের ছাতি ২৮ ইঞ্চি।
নায়িকা সুচিত্রা সেন তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলেছেন।
আর তাতে আত্মহারা হয়ে তিনি লাফাচ্ছেন।
কতা কইসে, কতা কইসে, আমার লগে কতা কইসে।

Bhanu Bandyopadhyay
কইসে কতা আমার লগে… সঙ্গে সেই বিখ্যাত নাচ! সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে। সৌজন্য – youtube.com

পঞ্চাশের দশকে কোনও মেয়ে যদি কোনও ছেলের সঙ্গে কথা বলত, তা হলে এমনই হত। এমনকি আশির দশকেও এই ঝম্পের ইতরবিশেষ হত না। কিন্তু তার পর থেকে আর কেউ লাফায় না।
দুনিয়া বদলেছে। ভানুও তাঁর সমাজের যাবতীয় অনুষঙ্গ নিয়ে বিদায় নিয়েছেন।
আজ ভানুর জন্মশতবর্ষ।
কিন্তু ভানুর সেই অসম্ভব জনপ্রিয় কৌতুক নকশা আর কি কেউ শোনে?
ভানু যেন ‘শহর থেকে দূরে’ ছবির সেই হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, যিনি রোজ একটু একটু করে পিছিয়ে পড়েন শহরের ডাক্তারের কাছে।

Bhanu Bandyopadhyay
সেই চিরস্মরণীয় জুটি যা প্রায় উত্তম-সুচিত্রার মতোই বাঙালি মানসে প্রোথিত। ছবি সৌজন্য – facebook.com

সেই সমাজটাই আর নেই, যে-সমাজে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ভানু।
তখন বাঙালি ট্রেনে-বাসে ধুতি পরত।
রেডিও, সিনেমা ছাড়া কোনও বিনোদনও ছিল না।
সেই অবিভক্ত বাংলায় এক ভদ্রলোক নদীর ধারে এক টাঙাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই নদীর নাম কী?
টাঙাওয়ালা বললেন, ‘বুড়িগঙ্গা।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘বুড়িগঙ্গা ক্যান?’
টাঙাওয়ালার উত্তর, ‘গোমুখ থিইক্যা আইতে আইতে বুড়াইয়া গেসে। হের লিগ্যা বুড়িগঙ্গা।’
ভানুর এই হাস্যরসে আজ যেন ভাটা।

Bhanu Bandyopadhyay
সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু পদার্থবিদ্যার কৃতী ছাত্র এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। ছবি সৌজন্য – facebook.com

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর প্রিয় ছাত্র ঢাকার পোলা সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় আজ একা। তাঁর বুকে কিলবিল করছে অখণ্ড বাংলা। তিনি খুঁজে চলেছেন অমল কৈশোরকে। একদিন রাতে কল্পনায় তাঁর সঙ্গে দেখা হল একাকী। বাতাসে সেদিন একটা কথাই তিরতির করে উড়ছে-আশিতে আসিও না।
–আফনারে কই য্যান দেখসি? কই দেখসি কন দেহি! হ হ চিনছি চিনছি। আমাগো সাম্যময়দা। ঢাকার পোলা।
—কী যে কন। কারে দ্যাখতে কারে দ্যাখছেন। আমি হালায় সাম্যময় হইলাম কবে? আমি তো…
—উঁহু, হেই কতা কইলে হইব না। আফনে সাম্যময়ই। ঢাকার পাঁচগাঁওয়ের পোলা। আফনার বাবায় আসিল নবাবি এস্টেটের কর্মচারি।
—-কিন্তু আফনে আমারে চিনলেন ক্যামনে? আফনের বাসাও কি…
—-হে হে। আফনারে চিনে না এমন মাইনষে আছে নাকি? তায় আবার ঘুড়ার গাড়িতে উঠসেন। ঢাকাইয়া কুট্টির লগে তো আফনের খুব ভাব-ভালোবাসা। তা ছাড়া আমিও তো ঢাকার পোলা। কতা হুইন্যা বুঝেন না?
—হ বুঝছি। হালায় আমার নাম যে সাম্যময় আমি নিজেই ভুইলা গেসি। ব্যাবাকে আমারে কয় ভানু। ছোট্ট নাম। কইতে কষ্ট নাই।
—তা দাদা, রাইত-বিরাইতে ময়দানে ঘুরেন ক্যান? দিনকাল তো সুবিধার না।
—ক্যামন চাঁদ উঠসে দ্যাখসেননি? দ্যাশের কতা খুব মনে হয়। বাত্তি জ়াম্বুরার মতো চাঁদ। হলুদ। ফটফট করতাসে। আমাগো ক্লাবের তো শতবর্ষ। তাই ঘুরতে আইসি। ঘোড়ার গাড়ি চইড়া ময়দানে পাক মারমু। কত মাইনষের কতা যে মনে হয়। সালে, ভেঙ্কটেশ, ধনরাজ, আপ্পারাও। এই হালার সালে আমারে একদিন কী কয় জানেননি?

—সালে মানে ফুটবলার সালে? কী কয়?
—-আমারে একদিন আইয়া কয়, ভানু তুমহারা নাম বহুত ছোটা হ্যায়। দেখো হামারা নাম কিতনা বড়া হ্যায়, পুথম পরমাভিল বাবাখান আব্দুল রদ্দার সালে।
—এইডা তো নাম না, নামাবলি।
—তয় আর কই কী! আমিও কম যাই না। আফটার অল ঢাকার পোলা। আমি কইলাম, আমার পুরা নাম হুনবেন? তাইলে হুনেন, অ- এ অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে, ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে ভানু ব্যানার্জি। নাম হুইন্যা ভিরমি খায় আর কী!
—হা হা হা। দাদা, আফনের গাড়িতে আমারে নিবেননি? আমরা তো দুইজনেই ইস্টবেঙ্গল। আইজ বরং একটু প্যাচাল পাড়ি।
—আইসেন যহন উইডা পড়েন। বাঙালরা অতিথিরে ফিরায় না। আমারে ঘুড়ার গাড়ির ন্যাশা কেডা ধরাইসে জানেননি? বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত। দীনেশদার যেইদিন ফাঁসি হইল, কাইন্দা বুক ভাসাইছিলাম।
—কন কী! আফনের লগে দীনেশ গুপ্তের যোগাযোগ আছিল?
—আমি ছিলাম দীনেশদার খোচর। কুন পুলিশ কই যায়, সব খবর আমি দীনেশদারে দিতাম। পুলিশ সদরঘাটে নাইমা ঘুড়ার গাড়িতে উঠলেই আমি গিয়া গাড়োয়ানের গা ঘেইস্যা বইয়া পড়তাম।

—দাদা আফনেও তো তাইলে বিপ্লবী।
—আমি বিপ্লবী না। আমি বিপ্লবীরে খবর সাপ্লাই দিতাম। তা ছাড়া, দীনেশদা আমারে কত সিনেমার কত কতা শিহাইসে তার ইয়ত্তা নাই। চার্লি চ্যাপলিন, লরেল হার্ডির নাম তো আমি দীনেশদার কাছেই হুনি। আইজ ব্যাবাক মনে পড়তাসে আমার।

Bhanu Bandyopadhyay
বিয়ের দুদিন পর সস্ত্রীক ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য – alchetron.com

—দাদা, আফনের লগে তো বিজ্ঞানী সত্যেন বসুরও খুব দারুণ সম্পর্ক আছিল কইয়া হুনসি।
—সত্যেনদা তো আমার মাস্টারমশাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ফিজিক্স পড়তাম। আমারে খুব ভালোবাসতেন সত্যেনদা। আমিই একমাত্র পোলা, উনারে দাদা কইয়া ডাকতাম। বিয়ার পর আমার বৌ নীলিমারে লইয়া সত্যেনদার বাসায় গেসি। সত্যেনদা তো নীলিমার কীর্তন হুইন্যা এক্কেরে চিৎপাত। আমারে কয় কী জানেন?
—কী কয়?
—কয় যে, আমি ভাবতাসি কেডা কারে বিয়া কইরা উপকৃত হইসে। নীলিমা তুমারে নাকি তুমি নীলিমারে? আমাগো সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসিল চাঁন্দের হাট। রমেশচন্দ্র মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার, মহম্মদ শহিদুল্লাহ, জসিমউদ্দিন, নির্মল গুপ্ত। কারে ছাইড়া কার নাম কমু?
—সব দিকপাল।
—হ, দিকপাল। আমি তো ঢাকা রেডিওতে কবিতা পড়তাম। জসিমউদ্দিনের, মোহিতলালের। ক্যারিক্যাচারও করতাম। তা আমি আসিলাম মহা ফাঁকিবাজ। একদিন জসিমউদ্দিন আমারে ডাইক্যা কন, তুমি কলেজে আস না ক্যান? আমি কিন্তু তুমারে পাশ করাইতে পারুম না।
—ফেল করসিলেন?
—আরে ধুর, ফেল করুম ক্যান। আমিও জসিমউদ্দিনরে কইয়া দিলাম, আফনে যদি স্যর আমারে ফেল করান, তাইলে আমিও আর আফনের কবিতা রেডিওতে কমু না। এই কতা হুইন্যা স্যরের কী হাসি! এক্কেরে গড়াইয়া পড়েন আর কী!

—এই দ্যাহেন দাদা। আমাগো মাঠের কাছে আইয়া পড়সি। অহন তো রাইত। কেউ নাই। একবার মাঠে যাইবেননি?
—কত কতা যে মনে আইতাসে কী কমু! হেই বিয়াল্লিশ সাল থিক্যা আমি ইস্টব্যাঙ্গল ক্লাবের মেম্বার। কার্ড নম্বর ২১৩। হেই বছরই ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হইল। দ্যাশ উত্তাল। আমার রক্ত তহন টগবগাইয়া ফুটতাছে। আমি দীনেশদার চ্যালা। জাম্বুরায় লাথ্থি মাইরা ফুটবল খেলসি। ইস্টব্যাঙ্গল আমার রক্তে। চলেন… যাইব্যাননি? সবুজ ঘাসে একটু গড়াগড়ি খাইয়া লই আইজ।
—চলেন যাই।

Bhanu Bandyopadhyay
পর্দা কাঁপানো নায়কদের পাশেও তিনি ছিলেন স্বমহিমায় ভাস্বর! কখনও কখনও তাঁদের ছাপিয়ে যেতেন অভিনয়ে। ছবি সৌজন্য – milleniumpost.in

— আমার ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ দ্যাখসেন তো? আইজ দ্যাহেন উলডা ছবি। আমি স্বর্গের থিক্যা মর্ত্যে নাইমা আইসি। শচীনকত্তার কতা খুব মনে পড়তাসে। সুরসাগর হিমাংশু দত্তও আইতেন খেলা দ্যাখতে। ইস্টব্যাঙ্গল ভালো খেললেই শচীনকত্তা কইয়া উঠতেন, খেলা তো না, যেন ফৈয়াজ খাঁয়ের ঠুংরি। উফফ। আর হালার মহনবাগানের খেলায় রস নাই। এক্কেরে শুকনা। ধ্রুপদ-ধামারের মতো।
—ও দাদা, আফনেরে যেন কেমন কেমন দেহায়। জাইগ্যা স্বপ্ন দ্যাহেন নাকি? কেমন ঘোর ঘোর ভাব।
—আরে মশয় কন কী! ওই তো দ্যাহেন, শচীনকত্তা। সবুজ ঘাসে পরির মতো নাচতাসে। ও কত্তা, ভেঙ্কটেশ গোল দিসে নাকি? খাড়ান দাদা, আমিও আইতাসি। আমিও আইজ জাম্বুরা লইয়া নাচুম। মাসিমা, আইজ আর মালপো খামু না। আইজ বল খেলুম। আরে চলেন, চলেন।
—হ্যাঁ চলেন।
—টাগডুম টাগডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল, আহা টাগডুম টাগডুম…
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না, সব ভুলে যাই তাও ভুলি না…

আকাশে ফটফটে জ্যোৎস্না। সবুজ মাঠে ধুতি পরে নেচে চলেছেন ভানু। একটা আস্ত বাংলাদেশ যেন নাচছে সেই সাড়ে চুয়াত্তরের মতো। কতা কইসে, কতা কইসে, আমার লগে কতা কইসে।

কৃতজ্ঞতা: ভানু সমগ্র, পত্রভারতী

পেশায় সাংবাদিক হলেও হৃদয়ে চিরনবীন কবি। এখনও বসন্ত এলে পলাশ ফুলের দিকে তাকাতে, কচি ঘাসের গন্ধ শুঁকতে আর সুপর্ণার বিরহে পাশ ফিরতে ভালোবাসেন। ছবি লেখেন গদ্যে। আনন্দবাজার পত্রিকার “অন্য পুজো” কলাম লিখে সুপরিচিত। পরে সেটি গাংচিল থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ফেসবুক কলাম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই নুনমরিচের জীবন।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *